ক্যাপ্টেন বুক ভরে দম নেন। সামনে থাকা লোকগুলোর দিকে তাকান। তারাও যেন দম আটকে অপেক্ষা করছে। সবাই নির্দেশের জন্য উন্মুখ। যা করার ঝটপট করতে হবে। কিন্তু অতি কম সময়ের ভেতরই পুরোটা গুছিয়ে চিন্তা করতে হবে। চিন্তা করাটাও লড়াই। কোনো রকম ভুল করা যাবে না। এতটুকু ছোট্ট ভুল মানেও বিরাট মাশুল। ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফির বিরুদ্ধে লড়তে হবে; সোজা কথা তো নয়ই। ক্যাপ্টেন নিজের পক্ষে যতটা সম্ভব এদিক-ওদিকের সব খবরাখবর জোগাড় করেছেন।
ক্যাপ্টেন ফৌজের আসার পর থেকেই চৈনিক সমরবিদ সান জুর শিষ্য। তার মতো লাইব্রেরি থেকে এত এত বই তোলে আর জমা দেয়—খুব একটা নেই। এক কোর্সমেট বলেছিল, ‘বন্ধু, এত কী পড়ো?’
ক্যাপ্টেন বলেছিলেন, ‘তোমরা দেখো, আমি খুব বই পড়ি! ভুল। আসলে তো পড়ি মানুষ। মানুষ পড়া, মানুষ বোঝা, মানুষ চেনা ছাড়া মানুষের আর কাজ কী!’
ক্যাপ্টেন ভালো করেই জানেন যে নিজের শক্তি ও শত্রুর শক্তি—দুটো সম্পর্কে শতভাগ জানা থাকলে বিজয় কেউ ঠেকাতে পারবে না। নিজেকে জানো আর শত্রুকে জানো—যেকোনো লড়াইয়ে এটাই এক নম্বর কাজ। সেই সঙ্গে ক্যাপ্টেন এ–ও জেনেছেন যে জনগণ, ইতিহাস ও ভূগোলের সায় ছাড়া কোনো যুদ্ধ জেতা যায় না। ইতিহাসের পাতা উল্টে উল্টে যত দলিল আছে, সবই কমবেশি এ কথাই তাঁকে জানিয়ে গেছে। এই যে তে মু জিন মানে সবার চেনা চেঙ্গিস খান; যে যুদ্ধ করে মোঙ্গলদের মন জিতে নিয়েছিলেন, সেটা তো নিজের ছোট একটা দল নিয়ে বিশাল এক সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই ছিল। তিনি তাঁর প্রতিপক্ষ জ মু খাঁর বিশাল সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কীভাবে জিতেছিলেন, সেসব ইতিহাসের পাতা থেকে ক্যাপ্টেন ভালো করে জেনে নিয়েছিলেন। নিজের ভেতরে ছোটবেলা থেকে ফৌজি ভাবটা তাঁর অটুট। নিজেকে তিনি জাতযোদ্ধা ছাড়া অন্য কিছু কোনো দিন ভাবতে পারেননি।
সবাই টান টান উত্তেজনায় তাকিয়ে আছে। ক্যাপ্টেন ভুল আর মাশুলের যোগ–বিয়োগ করে চলেছেন। তিনি নিজেকেই নিজে বলছেন, ‘এখন হামলা ছাড়া আর কোনো মামলা নেই। মারো, নয়তো মরো। একদম যোগ–বিয়োগের মরণখেলা।’
জড়ো করা লোকজনের ভেতর মকবুলও ছিল। অল্প সময়ের ভেতর সে বাড়বকুণ্ড থেকে এখানে চলে এসেছে। ছুটি শেষ করে কেবল ব্যারাকে ফিরবে ফিরবে, এর ভেতরে খবর এসে গেছে যে গতকাল ঢাকায় রাতের বেলায় অতর্কিত হামলায় হাজার হাজার মানুষ খতম। রাজারবাগে একটা পুলিশও নাকি আর বেঁচে নেই। সব পুড়িয়ে খাক করে দেওয়া হয়েছে।
মাশরেকি পাকিস্তানের বাঙালিদের কলিজা ঢাকাতে আচ্ছামতো সবক দিয়ে এবার কিনারার দিকে এগোচ্ছে পাকিস্তানি বাহিনী। কুমিল্লা থেকে এক শর মতো গাড়ি ভরা সেনা আর গোলাবারুদ নিয়ে একটা কনভয় রওনা দিয়েছে চট্টগ্রামের দিকে।
ক্যাপ্টেন অল্প কথায় ঘটনাগুলো বলে হঠাৎ চুপ করেন। চুপই শুধু না, দুই ঠোঁট ভেতর দিকে চেপে, তার ওপরে ডান হাতের তর্জনী সেঁটে দিয়েছেন; যেন নিজের মুখ থেকেও হুট করে কোনো বেফাঁস কথা না বের হয়। অন্যরাও যেন এখন কোনো কথা না বলে, এমন কোনো ভঙ্গি না দেখালেও একদম পিনপতন নিস্তব্ধতা। সবাই থম মেরে আছে: ঠিক এরপর কী কথা আসতে যাচ্ছে?
গত কয়েক দিনে এ দেশে কী কী হয়েছে, তিনি বললেন। বললেন, ‘যা হয়ে গেছে, সেসব আর ফিরিয়ে আনা যাবে না। সামনে যা যা করতে হবে, সেটাই আসল। এখানে ঝোপ বুঝে কোপ দেওয়ার মতো কিছু করা যাবে না। প্রতিশোধ আর সাহস ছাড়া আমাদের হাতে কিন্তু আর তেমন কোনো হাতিয়ারই নেই। তারা কিন্তু পোড়ামাটি ছাড়া আর কিছু চায় না। মানুষের এতটুকু মূল্য ওদের কাছে নেই। আমাদের কাছে দেশ ও মানুষের মূল্য আছে। এটাও আমাদের শক্তি।’
চট্টগ্রামে ততক্ষণে গেরিলা কায়দায় কীভাবে হানাদারকে ঠেকানো যাবে, সে ব্যাপারে ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম তৎপরতা শুরু করেছেন। এর ভেতর কয়েকটা দলকে সীতাকুণ্ডে পাঠানো হয়েছে। সুবেদার মুসা এক কোম্পানি সেনা নিয়ে কুমিরায় আছেন। আরও একটা দল আসবে কালুরঘাট থেকে।
কুমিরা শত্রুকে গাড্ডায় ফেলার জন্য একটা মোক্ষম জায়গা। এখানে পশ্চিমে সমুদ্র, পুবে পাহাড়। তাহলে কনভয়টাকে মাঝখানে দুয়েক মাইলজুড়ে এলাকার ভেতর দিয়েই আসতে হবে।
এর ভেতর আবার কয়েকটা জায়গায় রাস্তা খুব চিপা। ঢাকা–চট্টগ্রাম আসা-যাওয়ার বড় রাস্তা ছাড়া এদিকে অন্য পথে আসার উপায়ও নেই। কোথাও কোথাও হিজিবিজি গাছপালা দিয়ে ঘন জঙ্গল।
ক্যাপ্টেন বলেন, বিষয়টা ভালো করে বুঝে নিতে হবে। রাস্তার দুই ধারে দুটো পুকুর। যাদু পুকুর আর ফকিরা পুকুর। পুকুরের ঢালে এলএমজি রাখতে হবে। সেগুলোও রাস্তার দিকে তাক করা থাকবে। রাস্তায় সত্তর–আশি গজ দূরে দূরে বড় বড় গাছ ফেলে ব্যারিকেড দেওয়া হবে।
ক্যাপ্টেন পুরো ছকটা সবাইকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। সেইমতো সব পজিশন নেওয়া হলো। রাস্তা দুপাশে আর পাহাড়ের ঢালে। সেখানে ভারী মেশিনগান হাইওয়ের দিকে তাক করে বসানো। সীতাকুণ্ড থেকে খবর এসেছে। কনভয় কিছুক্ষণের মধ্যে কুমিরায় চলে আসবে। দম বন্ধ করা অপেক্ষায় সবাই।
বাড়বকুণ্ডের বাদশা মিয়ার ঘটনাটা মকবুলের কাছে পরে শুনেছিলেন ক্যাপ্টেন।
বাদশা মিয়ার রামদা নিয়ে তাড়া করার দৃশ্যটা মকবুল কিছুতেই ভুলতে পারছিল না। তার নিজের হাতেও একটা লাঠি ছাড়া কিছু ছিল না তখন। আসলে এত এত লোক জড়ো হওয়ার পর কারও ভেতর আর ভয়ডর বলে কিছু থাকে না। বাদশা মিয়াকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে শেষ করে দিল শয়তানরা।
ঢাকার ম্যাসাকার শোনার পর কুমিল্লা থেকে বিরাট কনভয় রওনা দিয়েছে। এ খবর রটে যাওয়ার পর মানুষজনও খেপে অস্থির। রুখতে না পারলে ওরা একটা লোককেও জানে বাঁচতে দেবে না।
বাড়বকুণ্ড কেমিক্যালস ফ্যাক্টরির এলাকায় একটু একটু করে অনেক মানুষ জড়ো হয়েছিল। যার যা আছে, তা-ই নিয়ে সবাই হাজির। মিলের পাহারার কাজে লাগানো বন্দুক যে কটা পাওয়া গেছে, সেগুলো যেমন আছে, তেমনি রামদা আর লাঠি হাতে শ খানেক লোক। কেবল তা–ই নয়, অনেকের হাতে অ্যাসিডভরা ঘটি, বাটি, বোতল। কোনোমতেই রেহাই দেওয়া যাবে না। কিছু করতে এলেই গায়ে অ্যাসিড মরা হবে। কোনো ছাড় নেই। এ সময়ের বোকার হদ্দও বোঝে,Ñশয়তানের বিরুদ্ধে কোনো ভালোমানুষি চলে না।
বাড়বকুণ্ডে যতটুকু পারল, সবাই মিলে রাস্তায় ব্যারিকেড দিল। ব্যারিকেডে কনভয় থামতেই লোকজন হামলা করে বসল। এদের ভেতর বাদশা মিয়া রামদা নিয়ে এক পাকিস্তানি সেনাকে তাড়া করে। তারপর পাল্টা পাকিস্তানি সেনার দল তাকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মারল।
ক্যাপ্টেনের কথা একটাই, জনগণ আমাদের সঙ্গে আছে। এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র। নইলে.
কথামতো এখানেও গ্রামের লোকজন দিয়ে ব্যারিকেড তৈরি করা হলো। তারা ব্যারিকেড দিয়েই সটকে পড়েছে।
এদিকে সন্ধ্যা ছটার ভেতর আরেকজন বাঙালি ক্যাপ্টেন জায়গামতো চলে এসেছেন। তিনি দ্রুতই বুঝতে পারলেন যে শত্রুর ডানে পাহাড়, বাঁয়ে সমুদ্র। রাস্তা ছাড়া শত্রুর সামনে এগোনোর আর কোনো পথ তাদের নেই। তিনি তিনজন প্লাটুন কমান্ডারকে অল্প সময়ের ভেতর পুরো ছকটা বুঝিয়ে দেন। তাঁর কথামতোই ভারী মেশিনগান পাহাড়ের ঢালে। এটাই বলতে গেলে তাদের সবচেয়ে বড় সম্বল। বাঁ দিকে এলএমজি নিয়ে পজিশানটা ‘ইউ’য়ের মতো হলো। তিনি বলেছিলেন, এতে করে ডানে-বাঁয়ে ও পেছনে তিন দিকে আমরা থাকব। যেদিক থেকে শত্রু আসবে, সেটা সাঁড়াশির হা-এর মতো খোলা থাকবে।
পাহাড়ের ঢাল থেকে পুরোটাই দেখা যায়। ক্যাপ্টেনের ছকমতো যা ওরা চিন্তাও করতে পারবে না, সেদিক থেকে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওদের সবকিছু তছনছ করে দিতে হবে। অ্যান্ড উই উইল ডু ইট। কোনো ভুল করা যাবে না।
কনভয় এল সাতটার দিকে। এটা পাকিস্তানি বাহিনীর চব্বিশতম ফ্রন্টিয়ার ফোর্স। ব্যারিকেড দেখে কনভয় থামল। একে একে গাড়ি থেকে সেনারা নেমে এল। ব্যারিকেড সরাতে শুরু করল। তারা যখন ব্যারিকেড সরাতে ব্যস্ত, ঠিক সেই সময় ডান দিক থেকে প্রথমে ভারী মেশিনগানের গুলি শুরু হলো। ক্ষণবিলম্ব না করে তিন দিক থেকে শুরু হলো গুলি। ভারী মেশিনগান থেকে মাঝেমধ্যেই ট্রেসার রাউন্ড বের হচ্ছে।
আচমকা এমন দশার ভেতরে আর দিশা না পেয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর লোকেরা যে যেদিকে পারল, ছুটল। তাদের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার শফি গাড়ি থেকে বেরিয়ে পাহাড়ের দিকে দৌড়াতে লাগলেন। যদিও পুরো এলাকায় কোথাও যাওয়ার অবস্থা তাদের ছিল না। গ্রামের লোকজনও ওত পেতে ছিল। জায়গামতো যে কটাকে পাওয়া গেল, সঙ্গে সঙ্গে সাবাড় করা হলো।
বেগতিক দশাটা তারপরও শত্রুরা একটু সামলে উঠতে চেষ্টা করল। হাজার হলেও পেশাদার প্রশিক্ষিত বাহিনী। ওপর থেকে, পাশ থেকে আর পেছন থেকে লাগাতার গুলির বৃষ্টিতে তারাও হাল ছেড়ে দিতে চাচ্ছিল না। কনভয়ের গাড়িতে গাড়িতে মেশিগান, মর্টার, আর্টিলারি থেকে সাধ্যমতো জবাব দেওয়ার চেষ্টা করল। ওপর থেকে মুক্তিবাহিনীর গুলিতে ধাই ধাই করে মাটিতে পড়ে যাচ্ছিল একের পর এক পাকিস্তানি সেনা। আক্রমণের সামনে কোনোভাবেই টিকতে পারছিল না। এদিকে কনভয়ের তিনটি ট্রাকে আগুন ধরে গেছে। কিছুক্ষণ পরপর পাকিস্তানি জওয়ানদের লাশ পড়ছে তো পড়ছেই। রাত নয়টার দিকে হাল ছেড়ে দিল পাকিস্তানি বাহিনী। দুই ঘণ্টা টানা গোলাগুলি চলেছে।
দুই ট্রাকভর্তি অস্ত্র আর গোলাবারুদ ফেলে পাহাড়ি এলাকা ধরে রীতিমতো উবে গেল পুরো এফএফ বাহিনী। পেছনে পড়ে রইল তাদের এক শ বাহান্নটা লাশ। চব্বিশ ফ্রন্টিয়ার্স ফোর্সের লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাহনূর খান জিন্দা ফিরতে পারলেন না।
নিজেদের চৌদ্দজন শহীদ হলেন।
মুক্তিফৌজের শোক করার সময় ছিল না। ক্যাপ্টেন জানেন, দু-এক দিনের ভেতরই বিপুল শক্তি নিয়ে শত্রুরা পাল্টা আক্রমণে আসবে। সেই লড়াই হবে আরও কঠিন, আরও রক্তক্ষয়ী। সেখানে কতটা জয় হবে কে জানে! এবার তো তাদের গাড্ডায় ফেলা গেল। এরপর নিজেদের জন্য কী অপেক্ষা করছে, কিছুটা হলেও তিনি আন্দাজ করতে পারেন। জয়-পরাজয় একটা কিছু তো হবেই। তারপরও লড়াইয়ের নেশাটা ক্যাপ্টেনের রক্ত থেকে মাথায় চড়তে থাকে।
ক্যাপ্টেন আবারও দুই ঠোঁট ভেতর দিকে চেপে ধরেন। জিভের ডগাটা ঠোঁটের ওপর বোলাতে থাকেন। এদিকে তর্জনীটা আপনাআপনি ঠোঁটের ওপর এসে ঠাঁই নেয়।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আম দ র শত র র সময় র ল কজন
এছাড়াও পড়ুন:
গাড্ডা
ক্যাপ্টেন বুক ভরে দম নেন। সামনে থাকা লোকগুলোর দিকে তাকান। তারাও যেন দম আটকে অপেক্ষা করছে। সবাই নির্দেশের জন্য উন্মুখ। যা করার ঝটপট করতে হবে। কিন্তু অতি কম সময়ের ভেতরই পুরোটা গুছিয়ে চিন্তা করতে হবে। চিন্তা করাটাও লড়াই। কোনো রকম ভুল করা যাবে না। এতটুকু ছোট্ট ভুল মানেও বিরাট মাশুল। ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফির বিরুদ্ধে লড়তে হবে; সোজা কথা তো নয়ই। ক্যাপ্টেন নিজের পক্ষে যতটা সম্ভব এদিক-ওদিকের সব খবরাখবর জোগাড় করেছেন।
ক্যাপ্টেন ফৌজের আসার পর থেকেই চৈনিক সমরবিদ সান জুর শিষ্য। তার মতো লাইব্রেরি থেকে এত এত বই তোলে আর জমা দেয়—খুব একটা নেই। এক কোর্সমেট বলেছিল, ‘বন্ধু, এত কী পড়ো?’
ক্যাপ্টেন বলেছিলেন, ‘তোমরা দেখো, আমি খুব বই পড়ি! ভুল। আসলে তো পড়ি মানুষ। মানুষ পড়া, মানুষ বোঝা, মানুষ চেনা ছাড়া মানুষের আর কাজ কী!’
ক্যাপ্টেন ভালো করেই জানেন যে নিজের শক্তি ও শত্রুর শক্তি—দুটো সম্পর্কে শতভাগ জানা থাকলে বিজয় কেউ ঠেকাতে পারবে না। নিজেকে জানো আর শত্রুকে জানো—যেকোনো লড়াইয়ে এটাই এক নম্বর কাজ। সেই সঙ্গে ক্যাপ্টেন এ–ও জেনেছেন যে জনগণ, ইতিহাস ও ভূগোলের সায় ছাড়া কোনো যুদ্ধ জেতা যায় না। ইতিহাসের পাতা উল্টে উল্টে যত দলিল আছে, সবই কমবেশি এ কথাই তাঁকে জানিয়ে গেছে। এই যে তে মু জিন মানে সবার চেনা চেঙ্গিস খান; যে যুদ্ধ করে মোঙ্গলদের মন জিতে নিয়েছিলেন, সেটা তো নিজের ছোট একটা দল নিয়ে বিশাল এক সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই ছিল। তিনি তাঁর প্রতিপক্ষ জ মু খাঁর বিশাল সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কীভাবে জিতেছিলেন, সেসব ইতিহাসের পাতা থেকে ক্যাপ্টেন ভালো করে জেনে নিয়েছিলেন। নিজের ভেতরে ছোটবেলা থেকে ফৌজি ভাবটা তাঁর অটুট। নিজেকে তিনি জাতযোদ্ধা ছাড়া অন্য কিছু কোনো দিন ভাবতে পারেননি।
সবাই টান টান উত্তেজনায় তাকিয়ে আছে। ক্যাপ্টেন ভুল আর মাশুলের যোগ–বিয়োগ করে চলেছেন। তিনি নিজেকেই নিজে বলছেন, ‘এখন হামলা ছাড়া আর কোনো মামলা নেই। মারো, নয়তো মরো। একদম যোগ–বিয়োগের মরণখেলা।’
জড়ো করা লোকজনের ভেতর মকবুলও ছিল। অল্প সময়ের ভেতর সে বাড়বকুণ্ড থেকে এখানে চলে এসেছে। ছুটি শেষ করে কেবল ব্যারাকে ফিরবে ফিরবে, এর ভেতরে খবর এসে গেছে যে গতকাল ঢাকায় রাতের বেলায় অতর্কিত হামলায় হাজার হাজার মানুষ খতম। রাজারবাগে একটা পুলিশও নাকি আর বেঁচে নেই। সব পুড়িয়ে খাক করে দেওয়া হয়েছে।
মাশরেকি পাকিস্তানের বাঙালিদের কলিজা ঢাকাতে আচ্ছামতো সবক দিয়ে এবার কিনারার দিকে এগোচ্ছে পাকিস্তানি বাহিনী। কুমিল্লা থেকে এক শর মতো গাড়ি ভরা সেনা আর গোলাবারুদ নিয়ে একটা কনভয় রওনা দিয়েছে চট্টগ্রামের দিকে।
ক্যাপ্টেন অল্প কথায় ঘটনাগুলো বলে হঠাৎ চুপ করেন। চুপই শুধু না, দুই ঠোঁট ভেতর দিকে চেপে, তার ওপরে ডান হাতের তর্জনী সেঁটে দিয়েছেন; যেন নিজের মুখ থেকেও হুট করে কোনো বেফাঁস কথা না বের হয়। অন্যরাও যেন এখন কোনো কথা না বলে, এমন কোনো ভঙ্গি না দেখালেও একদম পিনপতন নিস্তব্ধতা। সবাই থম মেরে আছে: ঠিক এরপর কী কথা আসতে যাচ্ছে?
গত কয়েক দিনে এ দেশে কী কী হয়েছে, তিনি বললেন। বললেন, ‘যা হয়ে গেছে, সেসব আর ফিরিয়ে আনা যাবে না। সামনে যা যা করতে হবে, সেটাই আসল। এখানে ঝোপ বুঝে কোপ দেওয়ার মতো কিছু করা যাবে না। প্রতিশোধ আর সাহস ছাড়া আমাদের হাতে কিন্তু আর তেমন কোনো হাতিয়ারই নেই। তারা কিন্তু পোড়ামাটি ছাড়া আর কিছু চায় না। মানুষের এতটুকু মূল্য ওদের কাছে নেই। আমাদের কাছে দেশ ও মানুষের মূল্য আছে। এটাও আমাদের শক্তি।’
চট্টগ্রামে ততক্ষণে গেরিলা কায়দায় কীভাবে হানাদারকে ঠেকানো যাবে, সে ব্যাপারে ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম তৎপরতা শুরু করেছেন। এর ভেতর কয়েকটা দলকে সীতাকুণ্ডে পাঠানো হয়েছে। সুবেদার মুসা এক কোম্পানি সেনা নিয়ে কুমিরায় আছেন। আরও একটা দল আসবে কালুরঘাট থেকে।
কুমিরা শত্রুকে গাড্ডায় ফেলার জন্য একটা মোক্ষম জায়গা। এখানে পশ্চিমে সমুদ্র, পুবে পাহাড়। তাহলে কনভয়টাকে মাঝখানে দুয়েক মাইলজুড়ে এলাকার ভেতর দিয়েই আসতে হবে।
এর ভেতর আবার কয়েকটা জায়গায় রাস্তা খুব চিপা। ঢাকা–চট্টগ্রাম আসা-যাওয়ার বড় রাস্তা ছাড়া এদিকে অন্য পথে আসার উপায়ও নেই। কোথাও কোথাও হিজিবিজি গাছপালা দিয়ে ঘন জঙ্গল।
ক্যাপ্টেন বলেন, বিষয়টা ভালো করে বুঝে নিতে হবে। রাস্তার দুই ধারে দুটো পুকুর। যাদু পুকুর আর ফকিরা পুকুর। পুকুরের ঢালে এলএমজি রাখতে হবে। সেগুলোও রাস্তার দিকে তাক করা থাকবে। রাস্তায় সত্তর–আশি গজ দূরে দূরে বড় বড় গাছ ফেলে ব্যারিকেড দেওয়া হবে।
ক্যাপ্টেন পুরো ছকটা সবাইকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। সেইমতো সব পজিশন নেওয়া হলো। রাস্তা দুপাশে আর পাহাড়ের ঢালে। সেখানে ভারী মেশিনগান হাইওয়ের দিকে তাক করে বসানো। সীতাকুণ্ড থেকে খবর এসেছে। কনভয় কিছুক্ষণের মধ্যে কুমিরায় চলে আসবে। দম বন্ধ করা অপেক্ষায় সবাই।
বাড়বকুণ্ডের বাদশা মিয়ার ঘটনাটা মকবুলের কাছে পরে শুনেছিলেন ক্যাপ্টেন।
বাদশা মিয়ার রামদা নিয়ে তাড়া করার দৃশ্যটা মকবুল কিছুতেই ভুলতে পারছিল না। তার নিজের হাতেও একটা লাঠি ছাড়া কিছু ছিল না তখন। আসলে এত এত লোক জড়ো হওয়ার পর কারও ভেতর আর ভয়ডর বলে কিছু থাকে না। বাদশা মিয়াকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে শেষ করে দিল শয়তানরা।
ঢাকার ম্যাসাকার শোনার পর কুমিল্লা থেকে বিরাট কনভয় রওনা দিয়েছে। এ খবর রটে যাওয়ার পর মানুষজনও খেপে অস্থির। রুখতে না পারলে ওরা একটা লোককেও জানে বাঁচতে দেবে না।
বাড়বকুণ্ড কেমিক্যালস ফ্যাক্টরির এলাকায় একটু একটু করে অনেক মানুষ জড়ো হয়েছিল। যার যা আছে, তা-ই নিয়ে সবাই হাজির। মিলের পাহারার কাজে লাগানো বন্দুক যে কটা পাওয়া গেছে, সেগুলো যেমন আছে, তেমনি রামদা আর লাঠি হাতে শ খানেক লোক। কেবল তা–ই নয়, অনেকের হাতে অ্যাসিডভরা ঘটি, বাটি, বোতল। কোনোমতেই রেহাই দেওয়া যাবে না। কিছু করতে এলেই গায়ে অ্যাসিড মরা হবে। কোনো ছাড় নেই। এ সময়ের বোকার হদ্দও বোঝে,Ñশয়তানের বিরুদ্ধে কোনো ভালোমানুষি চলে না।
বাড়বকুণ্ডে যতটুকু পারল, সবাই মিলে রাস্তায় ব্যারিকেড দিল। ব্যারিকেডে কনভয় থামতেই লোকজন হামলা করে বসল। এদের ভেতর বাদশা মিয়া রামদা নিয়ে এক পাকিস্তানি সেনাকে তাড়া করে। তারপর পাল্টা পাকিস্তানি সেনার দল তাকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মারল।
ক্যাপ্টেনের কথা একটাই, জনগণ আমাদের সঙ্গে আছে। এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র। নইলে... তিনি চিন্তাই করতে পারেন না প্রায় এক ব্যাটালিয়ান পাকিস্তানি সেনার সঙ্গে কোনোভাবেই কয়েক শ লোক নিয়ে যুদ্ধ কীভাবে সম্ভব!
কথামতো এখানেও গ্রামের লোকজন দিয়ে ব্যারিকেড তৈরি করা হলো। তারা ব্যারিকেড দিয়েই সটকে পড়েছে।
এদিকে সন্ধ্যা ছটার ভেতর আরেকজন বাঙালি ক্যাপ্টেন জায়গামতো চলে এসেছেন। তিনি দ্রুতই বুঝতে পারলেন যে শত্রুর ডানে পাহাড়, বাঁয়ে সমুদ্র। রাস্তা ছাড়া শত্রুর সামনে এগোনোর আর কোনো পথ তাদের নেই। তিনি তিনজন প্লাটুন কমান্ডারকে অল্প সময়ের ভেতর পুরো ছকটা বুঝিয়ে দেন। তাঁর কথামতোই ভারী মেশিনগান পাহাড়ের ঢালে। এটাই বলতে গেলে তাদের সবচেয়ে বড় সম্বল। বাঁ দিকে এলএমজি নিয়ে পজিশানটা ‘ইউ’য়ের মতো হলো। তিনি বলেছিলেন, এতে করে ডানে-বাঁয়ে ও পেছনে তিন দিকে আমরা থাকব। যেদিক থেকে শত্রু আসবে, সেটা সাঁড়াশির হা-এর মতো খোলা থাকবে।
পাহাড়ের ঢাল থেকে পুরোটাই দেখা যায়। ক্যাপ্টেনের ছকমতো যা ওরা চিন্তাও করতে পারবে না, সেদিক থেকে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওদের সবকিছু তছনছ করে দিতে হবে। অ্যান্ড উই উইল ডু ইট। কোনো ভুল করা যাবে না।
কনভয় এল সাতটার দিকে। এটা পাকিস্তানি বাহিনীর চব্বিশতম ফ্রন্টিয়ার ফোর্স। ব্যারিকেড দেখে কনভয় থামল। একে একে গাড়ি থেকে সেনারা নেমে এল। ব্যারিকেড সরাতে শুরু করল। তারা যখন ব্যারিকেড সরাতে ব্যস্ত, ঠিক সেই সময় ডান দিক থেকে প্রথমে ভারী মেশিনগানের গুলি শুরু হলো। ক্ষণবিলম্ব না করে তিন দিক থেকে শুরু হলো গুলি। ভারী মেশিনগান থেকে মাঝেমধ্যেই ট্রেসার রাউন্ড বের হচ্ছে।
আচমকা এমন দশার ভেতরে আর দিশা না পেয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর লোকেরা যে যেদিকে পারল, ছুটল। তাদের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার শফি গাড়ি থেকে বেরিয়ে পাহাড়ের দিকে দৌড়াতে লাগলেন। যদিও পুরো এলাকায় কোথাও যাওয়ার অবস্থা তাদের ছিল না। গ্রামের লোকজনও ওত পেতে ছিল। জায়গামতো যে কটাকে পাওয়া গেল, সঙ্গে সঙ্গে সাবাড় করা হলো।
বেগতিক দশাটা তারপরও শত্রুরা একটু সামলে উঠতে চেষ্টা করল। হাজার হলেও পেশাদার প্রশিক্ষিত বাহিনী। ওপর থেকে, পাশ থেকে আর পেছন থেকে লাগাতার গুলির বৃষ্টিতে তারাও হাল ছেড়ে দিতে চাচ্ছিল না। কনভয়ের গাড়িতে গাড়িতে মেশিগান, মর্টার, আর্টিলারি থেকে সাধ্যমতো জবাব দেওয়ার চেষ্টা করল। ওপর থেকে মুক্তিবাহিনীর গুলিতে ধাই ধাই করে মাটিতে পড়ে যাচ্ছিল একের পর এক পাকিস্তানি সেনা। আক্রমণের সামনে কোনোভাবেই টিকতে পারছিল না। এদিকে কনভয়ের তিনটি ট্রাকে আগুন ধরে গেছে। কিছুক্ষণ পরপর পাকিস্তানি জওয়ানদের লাশ পড়ছে তো পড়ছেই। রাত নয়টার দিকে হাল ছেড়ে দিল পাকিস্তানি বাহিনী। দুই ঘণ্টা টানা গোলাগুলি চলেছে।
দুই ট্রাকভর্তি অস্ত্র আর গোলাবারুদ ফেলে পাহাড়ি এলাকা ধরে রীতিমতো উবে গেল পুরো এফএফ বাহিনী। পেছনে পড়ে রইল তাদের এক শ বাহান্নটা লাশ। চব্বিশ ফ্রন্টিয়ার্স ফোর্সের লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাহনূর খান জিন্দা ফিরতে পারলেন না।
নিজেদের চৌদ্দজন শহীদ হলেন।
মুক্তিফৌজের শোক করার সময় ছিল না। ক্যাপ্টেন জানেন, দু-এক দিনের ভেতরই বিপুল শক্তি নিয়ে শত্রুরা পাল্টা আক্রমণে আসবে। সেই লড়াই হবে আরও কঠিন, আরও রক্তক্ষয়ী। সেখানে কতটা জয় হবে কে জানে! এবার তো তাদের গাড্ডায় ফেলা গেল। এরপর নিজেদের জন্য কী অপেক্ষা করছে, কিছুটা হলেও তিনি আন্দাজ করতে পারেন। জয়-পরাজয় একটা কিছু তো হবেই। তারপরও লড়াইয়ের নেশাটা ক্যাপ্টেনের রক্ত থেকে মাথায় চড়তে থাকে।
ক্যাপ্টেন আবারও দুই ঠোঁট ভেতর দিকে চেপে ধরেন। জিভের ডগাটা ঠোঁটের ওপর বোলাতে থাকেন। এদিকে তর্জনীটা আপনাআপনি ঠোঁটের ওপর এসে ঠাঁই নেয়।