ইসরায়েলি ‘জায়নবাদী বর্বরতার’ বিরুদ্ধে বিশ্ববাসীকে সোচ্চার হওয়ার
Published: 21st, March 2025 GMT
যুদ্ধ বিরতি চুক্তি লঙ্ঘন করে গাজায় ইসরায়েলের নতুন করে হামলা বন্ধ ও গণহত্যার বিরুদ্ধে বিশ্ববাসীকে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)।
শুক্রবার (২১ মার্চ) জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে আয়োজিত প্রতিবাদ সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল থেকে এ আহ্বান জানানো হয়।
বাসদের সাধারণ সম্পাদক কমরেড বজলুর রশীদ ফিরোজের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সমাবেশে বক্তব্য রাখেন কমিটির সহকারী সাধারণ সম্পাদক কমরেড রাজেকুজ্জান রতন, সদস্য জুলফিকার আলী ও নগর কমিটি সদস্য খালেকুজ্জামান লিপন।
বিশ্বজনমত উপেক্ষা করে মার্কিন মদদে ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের বর্বর নৃশংস হামলায় তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করে নেতৃবৃন্দ।
তারা বলেন, ইসরায়েল ৪২ দিনের মাথায় যুদ্ধ বিরতির চুক্তি ভঙ্গ করে ১৭ মার্চ মধ্যরাত থেকে আবারো ফিলিস্তিনের গাজায় নতুন করে হামলা শুরু করেছে। তিন দিনের হামলায় মৃত্যুর সংখ্যা ১ হাজার ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে ২০০ এর অধিক শিশু, অধিকাংশ নারী ও বয়স্ক মানুষ।
ইসরায়েলি হামলায় গত ১৭ মাসে গাজায় ৫০ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। এর মধ্যে ২০ হাজারের বেশি ছিল শিশু। শুধু তাই নয়, বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গাজা থেকে মানুষজনকে সরে যেতে বলেছে এবং বলছে ‘গাজায় নৃশংসতা কেবল মাত্র শুরু’।
হাজার হাজার টন বোমা ফেলে ফিলিস্তিনকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে। এই হামলার বিরুদ্ধে খোদ ইসরায়েল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে কিন্তু ইসরায়েল তাতে তোয়াক্কা করছে না। কারণ তার প্রতি সমর্থন রয়েছে যুদ্ধবাজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের।
তারা বলেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গাজা থেকে সেখানকার বাসিন্দাদের সরে গিয়ে খালি করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতে দিতে বলেছে। নেতানিয়াহুর সাথে বৈঠক করে ট্রাম্প নতুন করে হামলার নীল নকশা করেছে। তারই ধারাবাহিকতায় গাজায় নতুন করে হামলা শুরু হয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যের তেল ও খনিজসম্পদের দখল ও ঐ অঞ্চলে সামরিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য ইসরায়েলকে ব্যবহার করছে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা। সেজন্য অস্ত্র-অর্থসহ সব ধরনের সহযোগিতা করে যাচ্ছে। আর মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সহযোগিতায় ও মদদে জায়নবাদী ইসরাইল গণহত্যায় মেতে উঠেছে। এই ধ্বংসযজ্ঞে গাজার ঘরবাড়ি, হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ ও গির্জা ধ্বংস হয়েছে। পানি ও পয়ঃনিষ্কাশনের ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ সরবরাহ ধ্বংস করেছে এমনকি জাতিসংঘ ভবনও ধ্বংস করা হয়েছে। পুরো গাজার ৮৩ শতাংশ গাছপালা, ৮০ শতাংশের বেশি কৃষিজমি ও ৯৫ শতাংশ গবাদিপশু নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়েছে।
নেতৃবৃন্দ বলেন, যুদ্ধবিরতির সময়েও গাজায় ১৫০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। গাজায় যে হামলা চালানো হচ্ছে, তা অতীতের যে কোনো যুদ্ধের ভয়াবহতাকে হার মানিয়েছে। এখন সেখানে কোন ত্রাণ পৌঁছাতে পারছে না যে কারণে সেখানকার মানুষ ক্ষুধা, দুর্ভিক্ষ ও চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুবরণ করছে। ইসরায়েলি গণহত্যা বন্ধ, দেশে দেশে পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ সৃষ্ট সকল যুদ্ধ এবং যুদ্ধ উন্মাদনার বিরুদ্ধে বিশ্ববাসীকে প্রতিবাদ প্রতিরোধে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানান। একই সাথে গাজায় মানবিক সংকট মোকাবিলায় জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক সাম্প্রদায়িকে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ারও জোর দাবি জানান বাসদ নেতৃবৃন্দ।
নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশ সরকারকে গাজায় ইসরাইলি বোমা হামলা ও গণহত্যা বন্ধের দাবি আন্তর্জাতিক সকল ফোরামে তুলে ধরা এবং গণহত্যাকারী নেতানিয়াহুর বিচারের দাবি উত্থাপনের দাবি জানান।
ঢাকা/মামুন/এনএইচ
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ইসর য় ল গণহত য
এছাড়াও পড়ুন:
আমরা গাজাবাসী নিজেদের আর কত মিথ্যা বলব
আমরা গাজার মানুষ বারবার হুমকির মুখে পড়েছি। আমরা আমাদের ‘সাফ’ করে দেওয়ার হুমকি শুনেছি; গণহত্যার হুমকি শুনেছি। আমাদের ওপর ‘জাহান্নাম’ নামিয়ে আনার হুমকি শুনেছি। আসলে আমরা তো ইতিমধ্যেই জাহান্নাম পার করেছি। ৭ অক্টোবর ২০২৩ থেকে ১৯ মার্চ ২০২৫—গণহত্যার এই দহনকালে গাজার ২০ লাখ ফিলিস্তিনির মতো আমিও বেঁচে আছি।
সত্যি বলতে, আমি বেঁচে আছি জীবনকে আঁকড়ে ধরে নয়, বরং ‘লাইফ’ (জীবন) শব্দ থেকে ‘এফ’ ফেলে দিয়ে ‘লাই’ (মিথ্যা) ধরে রেখে বেঁচে আছি। যত বেশি নিজেকে মিথ্যা বলেছি, ততই আমার নাজুক অস্তিত্ব টিকেছে। প্রথম মিথ্যাটার কথা এখনো মনে পড়ে। সেটা গণহত্যারও অনেক আগের কথা।
২০০৮-০৯ সালে ইসরায়েলের গাজা আক্রমণের পর নিজেকে বলেছিলাম, ‘আর কখনো এমন যুদ্ধ দেখব না।’ সেটি একেবারেই শিশুসুলভ মিথ্যা ছিল। এরপর ২০১২ সালেও যুদ্ধ দেখলাম। ২০১৪ সালে দেখলাম। ২০২১ সালে দেখলাম। এমনকি ২০২৩ সালের মে মাসেও।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর সন্ধ্যায় যখন ইসরায়েলি যুদ্ধবিমানগুলো গাজার ওপর নির্বিচার বোমাবর্ষণ শুরু করল; তখন আমার মা ভয়ে কাঁপতে লাগলেন। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। আমি মাকে জড়িয়ে ধরলাম। সেই মুহূর্তে সত্য বলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। সেদিন মাকে আর নিজেকে বললাম, ‘এটাই আমাদের করুণ জীবনের শেষ অধ্যায়।’ মনে হচ্ছিল, সামনে যা আসছে, তাতে কোনো না কোনোভাবে মরবই। বাঁচার কোনো পথ নেই। মা-ও তা–ই ভেবেছিলেন; তাই কাঁদছিলেন।
কিন্তু নিশ্চিত মৃত্যুকে পুরোপুরি মেনে নিয়ে কীভাবে বাঁচা সম্ভব? মানুষ স্বভাবতই বাঁচতে চায়। তাই আবার নিজেকে মিথ্যা বলা শুরু করলাম...
আমি যুদ্ধের মধ্যে বড় হয়েছি এবং ১৫ মাসের গণহত্যার মধ্যেও বেঁচে থেকেছি। তবু আমি আশ্চর্য হচ্ছি, এত বড় যন্ত্রণার পরও আমি ভয় থেকে বাঁচার কোনো প্রতিরোধব্যবস্থা তৈরি করতে পারিনি। আমি এখনো সামনের দিন নিয়ে ভয় পাচ্ছি।শিগগিরই যখন ১৭ অক্টোবর ইসরায়েল ব্যাপ্টিস্ট হাসপাতালে হামলা করে শত শত মানুষকে হত্যা করে, তখন আমি নিজেকে মিথ্যা বলেছিলাম। আমি
নিজেকে বলেছিলাম, গাজার জন্য পৃথিবী উঠে দাঁড়াবে এবং আর কখনো ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান গাজাকে বোমা মারবে না। এটা ছিল একটি স্বল্পস্থায়ী মিথ্যা। এরপর ইসরায়েলের বোমাবর্ষণ তীব্রতর হয়ে উঠেছিল এবং গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছিল।
যখন ইসরায়েল আমাকে ওই বছর ডিসেম্বর মাসে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত করেছিল, আমি নিজেকে বলেছিলাম, কয়েক দিনের মধ্যে আমি ফিরে আসব। ২০২৪ সালের মে মাসে ফিরে আসার পর, আমি নিজেকে বলেছিলাম, এবার আর আমাকে বাস্তুচ্যুত করা হবে না।
যখন ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আমার সপ্তম বাস্তুচ্যুতি থেকে ফিরে এলাম, তখন ইসরায়েল গাজায় ত্রাণপ্রবাহ কঠোরভাবে সীমিত করে দিয়েছিল। তখন আমি নিজেকে বলেছিলাম, পৃথিবী আমাদের ক্ষুধার্ত হতে দেবে না। কিন্তু তা-ই হলো। কয়েক সপ্তাহ, আমি এবং আমার পরিবার প্রায় না খেয়ে বেঁচে ছিলাম। আল-মাওয়াসিতে বাস্তুচ্যুত অবস্থায় কিছু রুটি, জাআতার এবং টুনা মাছের কিছু ক্যান সঞ্চয় করেছিলাম, তা একটু একটু করে খেয়ে কোনোমতে বেঁচে ছিলাম।
আরও পড়ুনইসরায়েলের নৃশংসতা নিয়ে যদি সবাই মুখ খুলত১৮ ঘণ্টা আগেকিন্তু ইসরায়েলের সঙ্গে অস্ত্রবিরতির প্রথম পর্ব কার্যকর হওয়ার পর আমি নিজেকে সবচেয়ে নিকৃষ্ট মিথ্যা বলেছিলাম। বলেছিলাম, ‘এটাই শেষ, যুদ্ধের গণহত্যার অংশ শেষ হয়েছে। কারণ, ইসরায়েল আর কী করতে পারে, যা তারা আগে করেনি? আমরা তো সব ধরনের যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে গেছি!’ কিন্তু ভেতরে-ভেতরে জানতাম, আমি নিজের কাছে মিথ্যা বলছিলাম।
আমি জানতাম, গাজার অনেক মানুষের মতো, এটা শুধু সময় এবং উপায়ের ব্যাপার ছিল যে ইসরায়েল আবার কখন ও কীভাবে গণহত্যা শুরু করবে।
এতটুকু সময়ের মধ্যে একটি সংকেত মিলেছিল যে আবার হামলা আসছে। পবিত্র রমজানের শুরু হওয়ার পরপরই ইসরায়েল সব সাহায্যপ্রবাহ বন্ধ করে দেয়। এটি আরেকটি খাদ্যসংকট সৃষ্টি করে। দুই সপ্তাহ পর, সাহ্রির ডাকের বদলে আমরা প্রচণ্ড বোমাবর্ষণের শব্দে জেগে উঠলাম। ওই বোমায় ৪০০ জনের বেশি মানুষ মরেছে। এর মধ্যে অন্তত ১০০টি শিশু ছিল।
ইসরায়েল তাদের ‘সম্পূর্ণ’ বিজয় অর্জন করতে আর কত শিশুকে হত্যা করবে? এ দফায় তাদের ‘কাজ শেষ করতে’ কত সময় লাগবে? আমাদের আর কতটা ভীতি ও দুর্দশা সহ্য করতে হবে? আর এবার এই হামলা কীভাবে শেষ হবে?
ইসরায়েলের গণহত্যামূলক যুদ্ধের ১৫ মাস পার হওয়ার পরও আমি এ প্রশ্নগুলোর কোনো উত্তর জানি না। কারণ, একের পর এক তাদের পাশবিকতা দিয়ে ইসরায়েল আমাকে চমকে দিতে থাকে।
এখনো আমি বলে যাচ্ছি, এগুলো কী? এটি কি গণহত্যার চূড়ান্ত পর্যায়? আক্রমণ চালিয়ে যাওয়া, সব সাহায্য বন্ধ করে দেওয়া এবং পানি ও বিদ্যুতের লাইন কেটে দেওয়া কি চলতেই থাকবে? আমার ভয়, ইসরায়েল নৃশংসতার পথে আরও বহুদূর যাবে।
ইসরায়েলি সরকার বলছে, যতক্ষণ না তারা তাদের বন্দীদের ফিরে পায়, ততক্ষণ এই আক্রমণগুলো চলবে। যদি এটা সত্যি হয়, তবে যুদ্ধবিরতির কী দরকার ছিল? এটা কি হত্যাকারীদের কিছু সময়ের ‘বিশ্রাম’ ছিল?
এদিকে পৃথিবী আবারও শুধু নিন্দা জানাচ্ছে, কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। এটি আমাদের বহুবার ব্যর্থ করেছে। আমরা এতবার ব্যর্থ হয়েছি যে আমি গণনা করা ছেড়ে দিয়েছি।
আমি যুদ্ধের মধ্যে বড় হয়েছি এবং ১৫ মাসের গণহত্যার মধ্যেও বেঁচে থেকেছি। তবু আমি আশ্চর্য হচ্ছি, এত বড় যন্ত্রণার পরও আমি ভয় থেকে বাঁচার কোনো প্রতিরোধব্যবস্থা তৈরি করতে পারিনি। আমি এখনো সামনের দিন নিয়ে ভয় পাচ্ছি।
আমি আবার মৃত্যুর মুখোমুখি হচ্ছি। কিন্তু এবার আমি নিজেকে সত্য বলতে চাই। আমি বলতে চাই, ইসরায়েল আমার ওপর যে জীবন চাপিয়ে দিয়েছে, আমি তার চেয়ে ভালো জীবন পাওয়ার যোগ্য। আমি আর নিজেকে মিথ্যা বলতে চাই না, আমি বাঁচতে চাই।
কাসেম ওয়ালিদ গাজাভিত্তিক ফিলিস্তিনি পদার্থবিদ ও লেখক
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ