আমরা গাজার মানুষ বারবার হুমকির মুখে পড়েছি। আমরা আমাদের ‘সাফ’ করে দেওয়ার হুমকি শুনেছি; গণহত্যার হুমকি শুনেছি। আমাদের ওপর ‘জাহান্নাম’ নামিয়ে আনার হুমকি শুনেছি। আসলে আমরা তো ইতিমধ্যেই জাহান্নাম পার করেছি। ৭ অক্টোবর ২০২৩ থেকে ১৯ মার্চ ২০২৫—গণহত্যার এই দহনকালে গাজার ২০ লাখ ফিলিস্তিনির মতো আমিও বেঁচে আছি।

সত্যি বলতে, আমি বেঁচে আছি জীবনকে আঁকড়ে ধরে নয়, বরং ‘লাইফ’ (জীবন) শব্দ থেকে ‘এফ’ ফেলে দিয়ে ‘লাই’ (মিথ্যা) ধরে রেখে বেঁচে আছি। যত বেশি নিজেকে মিথ্যা বলেছি, ততই আমার নাজুক অস্তিত্ব টিকেছে। প্রথম মিথ্যাটার কথা এখনো মনে পড়ে। সেটা গণহত্যারও অনেক আগের কথা।

২০০৮-০৯ সালে ইসরায়েলের গাজা আক্রমণের পর নিজেকে বলেছিলাম, ‘আর কখনো এমন যুদ্ধ দেখব না।’ সেটি একেবারেই শিশুসুলভ মিথ্যা ছিল। এরপর ২০১২ সালেও যুদ্ধ দেখলাম। ২০১৪ সালে দেখলাম। ২০২১ সালে দেখলাম। এমনকি ২০২৩ সালের মে মাসেও।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর সন্ধ্যায় যখন ইসরায়েলি যুদ্ধবিমানগুলো গাজার ওপর নির্বিচার বোমাবর্ষণ শুরু করল; তখন আমার মা ভয়ে কাঁপতে লাগলেন। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। আমি মাকে জড়িয়ে ধরলাম। সেই মুহূর্তে সত্য বলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। সেদিন মাকে আর নিজেকে বললাম, ‘এটাই আমাদের করুণ জীবনের শেষ অধ্যায়।’ মনে হচ্ছিল, সামনে যা আসছে, তাতে কোনো না কোনোভাবে মরবই। বাঁচার কোনো পথ নেই। মা-ও তা–ই ভেবেছিলেন; তাই কাঁদছিলেন।

কিন্তু নিশ্চিত মৃত্যুকে পুরোপুরি মেনে নিয়ে কীভাবে বাঁচা সম্ভব? মানুষ স্বভাবতই বাঁচতে চায়। তাই আবার নিজেকে মিথ্যা বলা শুরু করলাম.

..

আমি যুদ্ধের মধ্যে বড় হয়েছি এবং ১৫ মাসের গণহত্যার মধ্যেও বেঁচে থেকেছি। তবু আমি আশ্চর্য হচ্ছি, এত বড় যন্ত্রণার পরও আমি ভয় থেকে বাঁচার কোনো প্রতিরোধব্যবস্থা তৈরি করতে পারিনি। আমি এখনো সামনের দিন নিয়ে ভয় পাচ্ছি।

শিগগিরই যখন ১৭ অক্টোবর ইসরায়েল ব্যাপ্টিস্ট হাসপাতালে হামলা করে শত শত মানুষকে হত্যা করে, তখন আমি নিজেকে মিথ্যা বলেছিলাম। আমি
নিজেকে বলেছিলাম, গাজার জন্য পৃথিবী উঠে দাঁড়াবে এবং আর কখনো ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান গাজাকে বোমা মারবে না। এটা ছিল একটি স্বল্পস্থায়ী মিথ্যা। এরপর ইসরায়েলের বোমাবর্ষণ তীব্রতর হয়ে উঠেছিল এবং গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছিল।

যখন ইসরায়েল আমাকে ওই বছর ডিসেম্বর মাসে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত করেছিল, আমি নিজেকে বলেছিলাম, কয়েক দিনের মধ্যে আমি ফিরে আসব। ২০২৪ সালের মে মাসে ফিরে আসার পর, আমি নিজেকে বলেছিলাম, এবার আর আমাকে বাস্তুচ্যুত করা হবে না।

যখন ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আমার সপ্তম বাস্তুচ্যুতি থেকে ফিরে এলাম, তখন ইসরায়েল গাজায় ত্রাণপ্রবাহ কঠোরভাবে সীমিত করে দিয়েছিল। তখন আমি নিজেকে বলেছিলাম, পৃথিবী আমাদের ক্ষুধার্ত হতে দেবে না। কিন্তু তা-ই হলো। কয়েক সপ্তাহ, আমি এবং আমার পরিবার প্রায় না খেয়ে বেঁচে ছিলাম। আল-মাওয়াসিতে বাস্তুচ্যুত অবস্থায় কিছু রুটি, জাআতার এবং টুনা মাছের কিছু ক্যান সঞ্চয় করেছিলাম, তা একটু একটু করে খেয়ে কোনোমতে বেঁচে ছিলাম।

আরও পড়ুনইসরায়েলের নৃশংসতা নিয়ে যদি সবাই মুখ খুলত১৮ ঘণ্টা আগে

কিন্তু ইসরায়েলের সঙ্গে অস্ত্রবিরতির প্রথম পর্ব কার্যকর হওয়ার পর আমি নিজেকে সবচেয়ে নিকৃষ্ট মিথ্যা বলেছিলাম। বলেছিলাম, ‘এটাই শেষ, যুদ্ধের গণহত্যার অংশ শেষ হয়েছে। কারণ, ইসরায়েল আর কী করতে পারে, যা তারা আগে করেনি? আমরা তো সব ধরনের যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে গেছি!’ কিন্তু ভেতরে-ভেতরে জানতাম, আমি নিজের কাছে মিথ্যা বলছিলাম।

আমি জানতাম, গাজার অনেক মানুষের মতো, এটা শুধু সময় এবং উপায়ের ব্যাপার ছিল যে ইসরায়েল আবার কখন ও কীভাবে গণহত্যা শুরু করবে।

এতটুকু সময়ের মধ্যে একটি সংকেত মিলেছিল যে আবার হামলা আসছে। পবিত্র রমজানের শুরু হওয়ার পরপরই ইসরায়েল সব সাহায্যপ্রবাহ বন্ধ করে দেয়। এটি আরেকটি খাদ্যসংকট সৃষ্টি করে। দুই সপ্তাহ পর, সাহ্‌রির ডাকের বদলে আমরা প্রচণ্ড বোমাবর্ষণের শব্দে জেগে উঠলাম। ওই বোমায় ৪০০ জনের বেশি মানুষ মরেছে। এর মধ্যে অন্তত ১০০টি শিশু ছিল।

ইসরায়েল তাদের ‘সম্পূর্ণ’ বিজয় অর্জন করতে আর কত শিশুকে হত্যা করবে? এ দফায় তাদের ‘কাজ শেষ করতে’ কত সময় লাগবে? আমাদের আর কতটা ভীতি ও দুর্দশা সহ্য করতে হবে? আর এবার এই হামলা কীভাবে শেষ হবে?

ইসরায়েলের গণহত্যামূলক যুদ্ধের ১৫ মাস পার হওয়ার পরও আমি এ প্রশ্নগুলোর কোনো উত্তর জানি না। কারণ, একের পর এক তাদের পাশবিকতা দিয়ে ইসরায়েল আমাকে চমকে দিতে থাকে।

এখনো আমি বলে যাচ্ছি, এগুলো কী? এটি কি গণহত্যার চূড়ান্ত পর্যায়? আক্রমণ চালিয়ে যাওয়া, সব সাহায্য বন্ধ করে দেওয়া এবং পানি ও বিদ্যুতের লাইন কেটে দেওয়া কি চলতেই থাকবে? আমার ভয়, ইসরায়েল নৃশংসতার পথে আরও বহুদূর যাবে।

ইসরায়েলি সরকার বলছে, যতক্ষণ না তারা তাদের বন্দীদের ফিরে পায়, ততক্ষণ এই আক্রমণগুলো চলবে। যদি এটা সত্যি হয়, তবে যুদ্ধবিরতির কী দরকার ছিল? এটা কি হত্যাকারীদের কিছু সময়ের ‘বিশ্রাম’ ছিল?

এদিকে পৃথিবী আবারও শুধু নিন্দা জানাচ্ছে, কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। এটি আমাদের বহুবার ব্যর্থ করেছে। আমরা এতবার ব্যর্থ হয়েছি যে আমি গণনা করা ছেড়ে দিয়েছি।

আমি যুদ্ধের মধ্যে বড় হয়েছি এবং ১৫ মাসের গণহত্যার মধ্যেও বেঁচে থেকেছি। তবু আমি আশ্চর্য হচ্ছি, এত বড় যন্ত্রণার পরও আমি ভয় থেকে বাঁচার কোনো প্রতিরোধব্যবস্থা তৈরি করতে পারিনি। আমি এখনো সামনের দিন নিয়ে ভয় পাচ্ছি।

আমি আবার মৃত্যুর মুখোমুখি হচ্ছি। কিন্তু এবার আমি নিজেকে সত্য বলতে চাই। আমি বলতে চাই, ইসরায়েল আমার ওপর যে জীবন চাপিয়ে দিয়েছে, আমি তার চেয়ে ভালো জীবন পাওয়ার যোগ্য। আমি আর নিজেকে মিথ্যা বলতে চাই না, আমি বাঁচতে চাই।

কাসেম ওয়ালিদ গাজাভিত্তিক ফিলিস্তিনি পদার্থবিদ ও লেখক

 আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ইসর য় ল র গণহত য র র গণহত য বল ছ ল ম আম দ র

এছাড়াও পড়ুন:

জুলাই হত্যাযজ্ঞকে ‘জেনোসাইড’ বলা কেন বিভ্রান্তিকর

২ এপ্রিল প্রথম আলো অনলাইনে ‘জুলাই হত্যাকাণ্ড কি জেনোসাইডের সংজ্ঞার মধ্যে পড়ে’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। লেখক আরিফ রহমান প্রবন্ধটিতে দাবি করছেন, ‘বাংলাদেশে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট সময়ে সংঘটিত সহিংস নিধনযজ্ঞকে রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত গণহত্যা বলাই অধিক যুক্তিযুক্ত’...বা ‘একাডেমিক ও নৈতিক যুক্তিতে এ ঘটনা যে গণহত্যা, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।’

লেখক জেনোসাইড কনভেনশনের সংজ্ঞার কথা উল্লেখ করলেও নামজাদা কয়েকজন গবেষকের সংজ্ঞা ও মডেল ব্যবহার করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন। আরিফের লেখার মূল যে স্পিরিট—‘রাষ্ট্র পরিচালিত নিষ্ঠুর বলপ্রয়োগ যে কতটা ভয়ংকর রূপ নিতে পারে, বাংলাদেশে ২০২৪ সালের ঘটনাই তার এক গভীর শিক্ষা’-এর সঙ্গে পরিপূর্ণ একমত হয়েও তাঁর অবস্থানের আইনি/যৌক্তিক দুর্বলতা ও এর সম্ভাব্য পরিণতির আশঙ্কা থেকে এই লেখার অবতারণা।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসরে ‘গণহত্যা’ শব্দের দুই ধরনের ব্যবহার রয়েছে। প্রথমত, রাজনৈতিক রেটরিক অর্থে ‘গণহত্যা’ দিয়ে আসলে বোঝানো হয়ে থাকে একসঙ্গে একের অধিক মানুষকে হত্যা করা; সেখানে ইংরেজি ‘ম্যাসাকার’ বা ‘মাসকিলিং’ অর্থে এটা ব্যবহৃত হয়।

ষাটের দশক থেকে আজতক এ ভূখণ্ডে যেকোনো ধরনের রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন, যেখানে একের অধিক লোক মারা গেছেন, সব কটাকেই রাজনৈতিক পরিসরের জনপ্রিয় বুলিতে ‘গণহত্যা’ বলা হয়ে থাকে। মুক্তিযুদ্ধকালীন গণহত্যা সংঘটনের বহু আগেও যেমন রাষ্ট্রীয় সহিংসতা/হত্যাযজ্ঞ বোঝাতে ‘গণহত্যা’ শব্দের ব্যবহার পাওয়া যায়, তেমনি বর্তমানে পিলখানা বা শাপলার রাষ্ট্রীয় হত্যাযজ্ঞের ক্ষেত্রে ‘গণহত্যা’ সম্বোধনও বহুল প্রচলিত। এখানে গণহত্যা ও মাসকিলিং আসলে সমার্থক।

 এর বাইরে দ্বিতীয় আরেক ধরনের ব্যবহার রয়েছে: ‘জেনোসাইড’ অর্থে। ‘জেনোসাইড’–এর অর্থ ও সংজ্ঞা আন্তর্জাতিক আইন বা জেনোসাইড কনভেনশনে খুবই নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের অভিধান থেকে শুরু করে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় ‘জেনোসাইড’–এর পরিভাষা হিসেবেও ‘গণহত্যা’ ব্যবহারের চল রয়েছে।

কিন্তু আইনে জেনোসাইডের সংজ্ঞায় যে কয়েকটা অপরাধমূলক কাজ বা অ্যাক্টকে জেনোসাইড হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছে, তাতে হত্যা বা মাসকিলিং আরও অনেকগুলো অপরাধের একটি। সেখানে দেখা যায়, কাউকে ‘হত্যা’ না করেও আসলে ‘জেনোসাইড’ চালানো সম্ভব, কেননা সেখানে হত্যার বাইরে আরও কিছু অপরাধমূলক কাজের উল্লেখ রয়েছে, যেমন, শারীরিক ও মানসিক ক্ষতিসাধন বা জোরপূর্বক জন্মদানে বাধা প্রদান বা এক গোষ্ঠীর শিশুদের অন্য গোষ্ঠীতে স্থানান্তর।

কিন্তু ‘গণহত্যা’ ব্যবহার করলে কেবল ‘হত্যা’কেই প্রাধান্য দেওয়া হয়, ফলে বাংলাদেশের অনেকেই জেনোসাইডের পরিভাষা হিসেবে গণহত্যা ব্যবহার না করে সরাসরি জেনোসাইড বা গোষ্ঠীনিধন/বা জাতিনিধন বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।

আরিফ রহমান তাঁর কলামে চব্বিশের হত্যাকাণ্ডকে যে ‘গণহত্যা’ বলতে চান, সেটা আসলে ‘জেনোসাইড’ অর্থে। রাজনৈতিক রেটরিক অর্থে ইতিমধ্যে এটা ‘গণহত্যা’ হিসেবে বহুল প্রচলিত হয়ে গেছে। কিন্তু ‘জেনোসাইড’ অর্থে একে ‘গণহত্যা’ বলাটা বিভ্রান্তিকর। কেন, সেটা সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করা যাক।

প্রথমত, ‘জেনোসাইড’ হচ্ছে গোষ্ঠীকেন্দ্রিক অপরাধ। আরিফ রহমানও বলছেন, ‘একটি গোষ্ঠীর অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পিত অভিযান’। ‘জেনোসাইড’ শব্দের প্রবর্তক রাফায়েল লেমকিন থেকে শুরু করে জেনোসাইড কনভেনশন হয়ে প্রায় প্রত্যেক গবেষক পর্যন্ত এ বিষয়ে একমত।

১৯৪৮ সালে জেনোসাইড কনভেনশনে যখন এই আইন চূড়ান্ত হচ্ছে, তখন বহু বাহাসের পর গোষ্ঠীর চারটি বর্গকে ‘সুরক্ষিত গোষ্ঠী’ হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে: জাতীয়, নৃগোষ্ঠী, জাতিগত ও ধর্মীয় গোষ্ঠী; অর্থাৎ, এই চার বর্গের কোনো গোষ্ঠীকে আংশিক বা পূর্ণ ধ্বংস করার নিয়তে (ইনটেনশন) যদি কিছু নির্দিষ্ট অপরাধমূলক কাজ করা হয়, তাহলে সেটা জেনোসাইড হবে।

এই ‘গোষ্ঠী পরিচয়’–এর নির্দিষ্টতাই অপরাপর অপরাধ থেকে একে পৃথক করে। আন্তর্জাতিক আইনে কেন ‘রাজনৈতিক’ বর্গ নেই, সেটা নিয়ে পরবর্তীকালে বহু গবেষক প্রশ্ন তুলেছেন, সমালোচনা করেছেন। কিন্তু, লিও কুপারসহ সবাই বাস্তবিক কারণেই এই আইনকে আলাপের রেফারেন্স পয়েন্ট হিসেবে নিয়ে থাকেন।

এখন চব্বিশের ঘটনায় ভিকটিমরা (ভুক্তভোগী) আন্তর্জাতিক আইনের সংজ্ঞার আওতায় পড়েন না। অর্থাৎ, কেবল জাতীয়, নৃগোষ্ঠী, জাতিগত বা ধর্মীয় গোষ্ঠীর সদস্য হওয়ার কারণে কেউ হত্যাযজ্ঞ বা ধ্বংসযজ্ঞের শিকার হননি। আরিফ রহমান সে কারণে আন্তর্জাতিক আইন ধরে আলাপ না করে বিভিন্ন গবেষকের মারফতে আলোচনা করেছেন, যাঁরা ‘রাজনৈতিক’ বর্গের অনুপস্থিতির কারণে জেনোসাইডের সংজ্ঞার সমালোচনাও করেছেন বা তাদের আলোচনার সুবিধার্থে সংজ্ঞাকে খুবই শিথিল আকারে ব্যবহার করেছেন।

আরিফ যে গ্রেগরি স্ট্যান্টনের ৮টি (পরে স্ট্যান্টন আরও দুটো ধাপ বাড়িয়েছিলেন) ধাপের মডেল ব্যবহার করেছেন, সেই গ্রেগরি স্ট্যান্টনও কিন্তু কনভেনশনের সংজ্ঞা ও পরিচয়ের ওই চারটি বর্গকে কবুল করেই আলোচনা করেছেন। তিনি কেবল জেনোসাইডকে একটা প্রক্রিয়া হিসেবে কিছু ধাপে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন, যেন এটা আগে থেকে মোকাবিলা করা যায়।

অন্যদিকে, আরিফ যদি গবেষকদের বরাত দিয়ে ‘রাজনৈতিক’ বর্গকে অন্তর্ভুক্ত করতেও চান, তাহলেও চব্বিশের সহিংসতাকে এটাতে আটানো সম্ভব হবে না। কারণ, কোনো নির্দিষ্ট ‘রাজনৈতিক’ দল বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় সহিংসতা ছিল না।

চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্যই ছিল, কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল বা ব্যানারের বাইরে গিয়ে এটা সংঘটিত হয়েছে। তাদের নানা ধরনের রাজনৈতিক মতামত থাকলেও, বা একটা বিশেষ মুহূর্তে একটা নির্দিষ্ট রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে সমাবেশ তৈরি হলেও, এটাকে নির্দিষ্ট ‘রাজনৈতিক’ গোষ্ঠী বলা সম্ভব হবে না।

প্রথমত, এখানে যেকোনো সুরক্ষিত গ্রুপ বা গোষ্ঠী হওয়ার জন্য সেটাকে স্থায়ী (পারমানেন্ট) ও স্থিতিশীল (স্টেবল) হতে হবে; রুয়ান্ডা ও যুগোস্লাভিয়ার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মামলাগুলোয় গোষ্ঠী প্রসঙ্গে এ কথা বলা হয়েছিল। অর্থাৎ, এই গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিরা সাধারণত জন্মসূত্রে নির্ধারিত হবেন যা সহজে পরিবর্তনযোগ্য নয়।

দ্বিতীয়ত, আরিফ যেভাবে শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে জনতাকে ‘রাজনৈতিক’ গোষ্ঠী হিসেবে তুলে ধরতে চান, সেটা করতে গেলে ‘রাজনৈতিক’ বর্গ এতই শিথিল হয়ে পড়ে যে আইনের দিক থেকে এটা আর অর্থবহ থাকে না। যেকোনো দলবদ্ধ গোষ্ঠীকে আসলে সে অর্থে ‘রাজনৈতিক’ বলা সম্ভব, এমনকি অনেক জাতীয় বা নৃগোষ্ঠীকেও কেউ কেউ রাজনৈতিক নির্মাণ বলেও সাব্যস্ত করতে পারবেন।

এটাও উল্লেখ করা জরুরি যে ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সংজ্ঞায় পূর্বে ‘রাজনৈতিক’ বর্গ অন্তর্ভুক্ত ছিল, সেটা অভ্যুত্থানের পর আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সংশোধনীর মাধ্যমে বাদ দেওয়া হয়।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই বলার চেষ্টা করেছেন, এটা বাদ না দিলে আমাদের আইন অনুযায়ী চব্বিশের সহিংসতাকে ‘জেনোসাইড’ বলা যেতে পারত! কিন্তু, ওপরে এটাই বলার চেষ্টা করা হলো যে ‘রাজনৈতিক’ বর্গ থাকলেও চব্বিশের সহিংসতাকে ‘জেনোসাইড’ বা জেনোসাইড অর্থে গণহত্যা বলা সম্ভব নয়।

তৃতীয়ত, চব্বিশের সহিংসতাকে ‘জেনোসাইড’ না বললে কি অপরাধকে লঘু করা হয়? আমাদের উত্তর হচ্ছে, না। জেনোসাইডকে ‘ক্রাইম অব অল ক্রাইমস’ বলে সাব্যস্ত করার যে বহুল রেওয়াজ রয়েছে, তাতে মনে হয়, আইনে বুঝি একধরনের অপরাধের ক্রমবিন্যাস বা হায়ার্কি রয়েছে!

এটা ঠিক যে আন্তর্জাতিক আইনে জেনোসাইড প্রমাণের মানদণ্ড খুব উঁচু, কোনো ঘটনাকে জেনোসাইড প্রমাণ করতে খুব কসরত করতে
হয়। এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যেকোনো হত্যাযজ্ঞকে ‘জেনোসাইড’–এর খোপে ঢোকানোর প্রয়াস খুব লক্ষণীয়।

সম্প্রতি গবেষকেরা (যেমন ডার্ক মোজেস) বলছেন, এই মনোভাব মানে এটাই সবচেয়ে বড় অপরাধ এবং সবকিছু এটাতে অন্তর্ভুক্ত করার যে প্রবণতা, তা আদতে ক্ষতিকর। এটা বিভিন্ন সহিংসতা ও অপরাধের বিবিধ মাত্রাকে কাটছাঁট করে, তার ধরন ও প্রকৃতিকে ঠিকঠাকমতো বুঝতে দেয় না।

ফলে হত্যাযজ্ঞমাত্রই ‘জেনোসাইড’ বা সে অর্থে গণহত্যা বলে দাবি করলে, একদিকে যেমন গণহত্যা/জেনোসাইড বর্গ হিসেবে অর্থহীন হয়ে উঠে, তেমনি যেসব ঘটনা আসলেই জেনোসাইড, সেগুলো লঘু হয়ে পড়ে। এ কারণে অনেকেই হরেদরে ঘটনাকে জেনোসাইড ব্যবহার করতে সতর্ক করেন।

চব্বিশের ঘটনাকে যদি জেনোসাইড অর্থে গণহত্যা না বলি, তাহলে অপরাধের কোন ব্যানারে আলোচনা করা যেতে পারে? আরিফ নিজেও তাঁর লেখায় যেসব প্রতিবেদনের কথা বলছেন, সেখানেও এর স্পষ্ট ইঙ্গিত দেওয়া আছে। যেমন জাতিসংঘের ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, এই ঘটনাকে মানবতাবিরোধী অপরাধ বলার যথেষ্ট যৌক্তিক কারণ রয়েছে এবং পুরো প্রতিবেদনে নানা কায়দায় সেটাকেই প্রমাণ করা হয়েছে। চব্বিশের সহিংসতাকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করাই যৌক্তিক ও সঠিক। এটাকে জেনোসাইড অর্থে গণহত্যা বললে মারাত্মক আইনি বিভ্রান্তি তৈরি হবে।

তাই আমরা মনে করি যে আন্তর্জাতিক আইনে কোনোভাবেই চব্বিশের সহিংসতাকে ‘জেনোসাইড’ বলে প্রমাণ করা যাবে না। এটাকে জোর করে যদি ‘জেনোসাইড’ অর্থে গণহত্যা বলা হয়ে থাকে, তাহলে কিছুদিন পর মূল অপরাধীরাই বলতে শুরু করবেন যে এটাকে গণহত্যা হিসেবে প্রমাণ করা যাবে না; ফলে নৈতিকভাবে দায়মুক্তি ঘটেছে বলে প্রচারণার সুযোগ পাবেন।

এ রকম তৎপরতা থেকে এ ধরনের ‘ভুল’ চিহ্নায়ন দুই তরিকার বিপদ ঘটাবে। এক. খোদ চব্বিশের সহিংসতাকে পুরোপুরি বুঝতে সহায়ক হবে না এবং অপরাধীদের প্রচারণার সুযোগ করে দেবে; দুই. যেগুলো আসলেই ‘জেনোসাইড’মূলক ঘটনা, সেগুলোকে লঘু করে তুলবে।

সহুল আহমদ লেখক ও গবেষক

উম্মে ওয়ারা সহযোগী অধ্যাপক, ক্রিমিনোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ‘মার্চ ফর গাজা’ বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ঐক্য: সারজিস
  • গণহত্যার প্রতিবাদ জানাতে রাজধানীতে জনতার ঢল
  • গণহত্যার প্রতিবাদে সরব বাংলাদেশ
  • গণহত্যা বন্ধ ও স্বাধীন ফিলিস্তিন দাবি
  • ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি আগ্রাসনের প্রতিবাদে বরিশালে বিক্ষোভ 
  • গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যার প্রতিবাদে বাংলাদেশ জাসদের বিক্ষোভ
  • ইসলামী আন্দোলনকে বাইপাস করে সংসদে যাওয়ার সুযোগ নেই: চরমোনাই পীর
  • গাজায় গণহত‌্যা: জিএম কা‌দে‌রের নেতৃ‌ত্বে রাজধানী‌তে বি‌ক্ষোভ
  • ‘ইসরায়েলের পণ্য বর্জনের জিহাদ শুরু করতে হবে’
  • জুলাই হত্যাযজ্ঞকে ‘জেনোসাইড’ বলা কেন বিভ্রান্তিকর