কর্ণফুলীর তীরের শহর চট্টগ্রাম। লুসাই পাহাড় থেকে নেমে আসা স্রোতোধারাকে সাক্ষী রেখে গড়ে ওঠা হাজার বছরের জনপদ। তবে শহরের মর্যাদা মিলেছে ১৮৬৩ সালে। মিউনিসিপ্যালিটি হলেই কি আর রাতারাতি নগরসভ্যতা দাঁড়ায়! শহরের বাড়বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিদ্যাপীঠ, চিকিৎসাকেন্দ্র, সড়ক, যানবাহন, বাজারসদাইয়ের বিপণিকেন্দ্র—কত কিছুই যে দরকার হয়। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ধীরলয়ে শহরের যাবতীয় অনুষঙ্গ গড়ে ওঠে। এই যেমন মর্যাদাপ্রাপ্তির শত বছর পর চট্টগ্রামে প্রথম বহুতল আধুনিক বিপণিকেন্দ্র গড়ে ওঠে। নাম ‘বিপণী বিতান’। ডাকনাম নিউমার্কেট। এ শহরের প্রথম আইকনিক স্থাপনা। চলন্ত সিঁড়িসহ চারতলা ভবনটি চট্টগ্রামের প্রথম আধুনিক বাণিজ্যালয়। নতুন মার্কেট থেকে ‘নিউমার্কেট’ নামের উৎপত্তি। সে কারণে আসল নাম ঢাকা পড়েছে নিউমার্কেটের ভেতর।

দেশে দেশে এ রকমই হয়ে আসছে। এই যেমন কলকাতায় রয়েছে নিউমার্কেট। ধর্মতলা এলাকায় ১৮৭৪ সালে নির্মিত হগ সাহেবের বিপণিকেন্দ্রটি নিউমার্কেট নামে পরিচিত। এটা মূলত ইংরেজদের জন্য নির্মাণ করা হয়েছিল। উদ্বোধনের পর কলকাতার প্রথম পৌর বাজারের খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। সারা ভারত থেকে বিত্তশালী ঔপনিবেশিকরা র‍্যাঙ্কেন অ্যান্ড কোম্পানি, কাথবার্টসন ও হার্পার এবং বিখ্যাত স্টেশনারি ও বই বিক্রেতা আরডব্লিউ নিউম্যান বা থ্যাকার স্পিঙ্কের মতো একচেটিয়া খুচরা বিক্রেতাদের কাছ থেকে কেনাকাটা শুরু করেন। কলকাতা করপোরেশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান স্টুয়ার্ট হগের এ মার্কেটের পেছনে অবদান রয়েছে। তখন মুখে মুখে এ বাজারকে বলা হতো ‘হগ সাহেবের বাজার’। ২৮ বছর পর ১৯০৩ সালে সরকারিভাবে এর নাম হলো ‘স্টুয়ার্ট হগ মার্কেট’। তবে কলকাতাবাসীর কাছে এর আদি অকৃত্রিম পরিচয় ‘নিউমার্কেট’।

ফেরা যাক চট্টলায়। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর চট্টগ্রামের মনিহারি, বস্ত্রসহ নানা পণ্যের জন্য বিখ্যাত ছিল কয়েকটি বড় দোকান। এর মধ্যে অন্যতম ছিল ওয়াদুদ মালাবার স্টোরস, লাকি স্টোরস, সিটি স্টোরস, মজুমদার ব্রাদার্স, চন্দ স্টোরস ইত্যাদি। এ ছাড়া টেরি বাজার ও রেয়াজুদ্দিন বাজারকেন্দ্রিক কিছু দোকান ছিল। এক ছাতার নিচে রকমারি পণ্যের কেনাকাটার সুবিধা নিয়ে ১৯৬৪ সালে গড়ে তোলা হয় ‘বিপণী বিতান’। ৪৮০টি দোকান নিয়ে এ মার্কেটের যাত্রা।

আমান উল্লাহ চৌধুরীর ‘আধুনিক চট্টগ্রাম ও সিডিএ’ বইয়ে বিপণী বিতান নির্মাণের আদ্যোপান্ত উল্লেখ রয়েছে। এ মার্কেটের নামকরণ করেন চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) তখনকার জনসংযোগ কর্মকর্তা এ বি চৌধুরী। ১৯৬১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল আজম খান। খ্যাতিমান স্থপতি ফিদা হোসেন ওরফে জি ইব্রাহিম ২ লাখ ৬০ হাজার বর্গফুট আয়তনের এই বিপণিকেন্দ্রের নকশা করেন। নির্মাতা ছিল এম এ কায়েম ও সিরাজের হক ব্রাদার্স।

বর্তমানকালের ঘিঞ্জি কিংবা অগ্নিঝুঁকিময় ভবন করার চিন্তা নিউমার্কেট নির্মাতাদের ছিল না। চলাচল, আলো বাতাসের জন্য ১ লাখ ৩৭ হাজার ৮৯ বর্গফুট জায়গা খালি রাখা হয়। মাঝখানে রয়েছে সবুজের সমারোহ, নার্সারি। সবুজের পাশ ঘেঁষে ফুলের সৌরভ গায়ে মেখে ঘোরানো–প্যাঁচানো ওয়াকওয়ে উঠে গেছে চতুর্থ তলায়। সিডিএ এ মার্কেট নির্মাণ করে। তাদের একটা সমিতি রয়েছে ‘বিপণী বিতান মার্চেন্ট ওয়েলফেয়ার কমিটি’।

ফিরে দেখা

শুরু থেকেই জমজমাট ছিল আধুনিক এই বিপণিবিতান। এক ছাদের নিচে পোশাক, রূপলাবণ্যচর্চার উপকরণ, রান্নাঘরের সামগ্রী, গৃহসজ্জা, ইলেকট্রনিক পণ্য, মনিহারি, কার্ড, খাবার, বিনোদনের সামগ্রী—সবই যে মেলে এখানে। চট্টগ্রামের তখনকার জনপ্রিয় ও আদি যত ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান—সব কটিই তখন নিউমার্কেটে দোকান কেনে। সেই স্মৃতিচারণা করছিলেন ওয়েলফেয়ার কমিটির বর্তমান সভাপতি মোহাম্মদ সাগির।

‘আমাদের ব্যবসা ছিল স্টেশন রোডে তখন। ওয়াদুদ ব্রাদার্স ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। যখন মার্কেট হয়, তখন বাবা আবদুল মান্নান এখানে দোকান নেন। শাড়ির দোকান। এভাবে লাকি কর্নার, দানু মিয়া অ্যান্ড সন্স, কনক বাহার, কানুনগো ওয়াচ, ভিক্টর ইলেকট্রনিক, রেডিও ভিশন—সব কটি প্রথম দিকের দোকান। জমজমাট ছিল শুরু থেকেই। এখনো কমবেশি আছে। তবে অনেকে ব্যবসা পরিবর্তন করেছেন। এখন তো অনেক মার্কেট,’ বলছিলেন সাগির।

নিচতলায় শাড়ি, জামাকাপড়, রান্নার সামগ্রী ও দু-একটি খাবারের দোকান ছিল। দোতলায় মূলত স্বর্ণালংকার, ঘড়ি, স্টেশনারি ও টেইলার্সের দোকান রয়েছে। তৃতীয় তলায় জুতা, জামাকাপড়, ব্যাগ ইত্যাদির ব্যবসা। এ ছাড়া চতুর্থ তলার পুরোটা ইলেকট্রনিকস মার্কেট হিসেবে পরিচিত। ওই মেঝেতে একটি মসজিদও রয়েছে।

এখন শুরুর দোকানের সংখ্যায় কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। অনেকে এক দোকান ভাগ করে দুটি করেছেন। আবার অনেকে ব্যবসাও পরিবর্তন করেছেন। এই যেমন মার্কেটের আইকনিক ঘড়ির দোকান ‘কানুনগো অ্যান্ড সন্স’। শুরু থেকেই এ দোকান ছিল এখানে। পরে দুই ভাগ হয়ে আরেকটি কানুনগো ওয়াচ কোং হয়।

‘কানুনগো ১৯৬২’ দোকানের কর্ণধার সুবীর কানুনগো বলছিলেন দোকানের ইতিহাস, ‘১৯৬২ সালে সদরঘাট শাহজাহান হোটেল মার্কেটে আমার বাবা অমৃত লাল কানুনগো ও জেঠা অমূল্য রতন কানুনগো প্রথম ঘড়ির দোকান শুরু করেন কানুনগো অ্যান্ড সন্স নামে। এরপর নিউমার্কেট হওয়ার পর এখানে “কানুনগো অ্যান্ড সন্স” নামে দোকানের যাত্রা শুরু হয়। ১৯৮৩ সালে দুই ভাইয়ের মধ্যে ব্যবসা ভাগ হয়ে যায়। এখন মোট তিনটি কানুনগো ওয়াচের দোকান রয়েছে এই মার্কেটে।’

নিচতলায় থাকা আগের লাকি কর্নার এখন নাম পরিবর্তন করে ‘হ্যান্ডি বাজার’ নাম ধারণ করেছে। হারিয়ে গেছে ডায়মন্ড ও ঐকতান। নিউমার্কেটে দোতলায় শুরু থেকেই ছিল একমাত্র রেস্তোরাঁ ডায়মন্ড। এ অঞ্চলের অনেক লোকের জিবে ডায়মন্ডের চা, কাটলেট, চপ ইত্যাদির স্বাদ লেগে রয়েছে। বিশেষ করে মার্কেটে যাতায়াত ছিল এমন ক্রেতা কিংবা তরুণ যুবকদের মুখে মুখে ফিরত ডায়মন্ড–স্তুতি। মার্কেটের খুব কাছেই সরকারি সিটি কলেজ। এ কলেজের শিক্ষার্থীদের অনেকের দুপুরের আড্ডা ছিল ডায়মন্ডে।

মার্কেটে ঘোরাঘুরি, স্থানে স্থানে আড্ডা দিতেন বিভিন্ন বয়সের তরুণ কিংবা যুবকেরা। বিশেষ করে ঈদের সময়গুলোতে এ ধরনের আড্ডা ও ঘোরাঘুরি অনেক বেড়ে যেত। তখন দল বেঁধে বিভিন্ন পাড়া–মহল্লা, বিশেষ করে আলকরণ সদরঘাট কিংবা কোনো স্কুল–কলেজের ছাত্রদেরও দেখা যেত। আর ঘোরাঘুরি শেষে ডায়মন্ডে চায়ের কাপে ঝড় উঠত।

প্রজন্মের পর প্রজন্ম এভাবে ডায়মন্ডে আড্ডা দিয়ে চা কাটলেট খেয়ে বেড়ে উঠেছে। কিন্তু কয়েক বছর আগে এই আড্ডাস্থলের ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে ডায়মন্ডের পাশে থাকা মিষ্টি পান ও দেশি-বিদেশি সিগারেটের দোকানটিও বন্ধ হয়ে গেছে।

তরুণ–যুবক বয়সের নারী-পুরুষের আরেকটি আকর্ষণ ছিল চতুর্থ তলার গানের ক্যাসেটের দোকানে। শুরুর দিকে কলের গানের রেকর্ড বিক্রি হতো। পরবর্তী সময়ে স্টিরিও ক্যাসেটের প্রচলন শুরু হয়। ঐকতান নামের একটি দোকানে তরুণ-তরুণীরা ভিড় করতেন ঈদ কিংবা অন্যান্য উৎসবে বের হওয়া বিভিন্ন শিল্পী বা ব্যান্ডের অ্যালবামের জন্য। সভাপতি মোহাম্মদ সাগিরের কণ্ঠেও আক্ষেপ এ নিয়ে, ‘এখন তো আর ক্যাসেটে গান শোনার চল নেই। তাই হারিয়ে গেছে এই ঐতিহ্যবাহী দোকান। ডায়মন্ড দোকানটিও শুরুর দিকের। সেটাও বন্ধ হয়ে গেছে।’

স্মৃতি হয়ে গেছে নিচতলা ও দোতলায় থাকা জন্মদিন, নতুন বছর কিংবা ভালোবাসা জানানোর কার্ডের দোকানগুলোও। অর্চিস গ্যালারি, আজাদ প্রোডাক্টের এই কার্ডগুলো এখন স্মৃতির পাতায়। হারিয়ে গেছে নিচতলায় থাকা শার্টিং-শুটিংয়ের দোকানও।

শুরুর দিকে ‘কানুনগো অ্যান্ড সন্স’ নামে একটি দোকান ছিল। এখন মার্কেটে ‘কানুনগো ওয়াচ’ নামের দোকান রয়েছে তিনটি.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ড য়মন ড র জন য ব যবস প রথম শহর র ন চতল কলক ত

এছাড়াও পড়ুন:

টেলিযোগাযোগ খাত সংস্কারে গ্রাহকের স্বার্থ প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে, বিটিআরসি চেয়ারম্যান

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) মো. এমদাদ উল বারী বলেছেন, ইন্টারনেটকে সহজলভ্য এবং গুণগত মান বাড়াতে বিটিআরসি কাজ করছে। টেলিযোগাযোগ খাতের সংস্কারে গ্রাহকের স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। বৃহস্পতিবার নগরীর একটি হোটেলে খুলনা বিভাগের ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার (আইএসপি) ও অন্যান্য টেলিকম অপাটেরদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় তিনি এ কথা বলেন। 

সভায় ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (আইএসপিএবি) খুলনা বিভাগের আহ্বায়ক মওদুদ আহমেদ সভাপতিত্ব করেন। এতে বক্তব্য রাখেন খুলনার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট দীপংকার দাশ ও বিটিআরসির উপ-পরিচালক রাইসুল ইসলাম।

বিটিআরসি চেয়ারম্যান বলেন, ইন্টারনেট ও টেলিকম সেক্টর সবার মাঝে সহজবোধ্যভাবে তুলে ধরতে বিভিন্ন পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। খুব শিগগিরই টেলিকম বিটের সাংবাদিকদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। তৃণমূল পর্যায়ে কাজ করা আইএসপিদের প্রশিক্ষণেও সহযোগিতা করা হবে। নতুন লাইসেন্সে নীতিমালাটি টেকসই করতে গ্রাহকদের স্বার্থকে প্রধান্য দেওয়া হচ্ছে।

মতবিনিময় সভায় আইএসপিদের পক্ষ থেকে বেশ কিছু দাবি তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে রয়েছে আইএসপির এক্সিস্টিং ক্যাটাগরি বজায় রাখা, জাতীয় সম্পদের অপচয় রোধে এবং কিউওএস বৃদ্ধিতে একটিভ শেয়ারিংয়ের অনুমতি, ভালো মানের রাউটার অল্প দামে পাওয়ার ব্যবস্থা, তৃণমূল আইএসপিদের পর্যাপ্ত ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা, ফাইবার সংযোগে আইএসপিদের একচেটিয়া অধিকার রাখা এবং বিটিআরসির সেবাকে আরও বেশি ডিজিটালাইজড করা। 

 

 

সম্পর্কিত নিবন্ধ