কক্সবাজারের উখিয়ার সংরক্ষিত বন থেকে পাহাড় কাটার খবর পান বিট কর্মকর্তা সাজ্জাদুজ্জামান। তখন রাত তিনটা। পাহাড় কাটা থামাতে এক সহকর্মীকে সঙ্গে নিয়ে মোটরসাইকেলে রওনা দেন। ঘটনাস্থলে পৌঁছামাত্র তাঁকে ট্রাকচাপা দিয়ে সটকে পড়ে অভিযুক্তরা। ঘটনাস্থলেই মারা যান সাজ্জাদ। এটি গত বছরের ৩১ মার্চের ঘটনা।
প্রায় একই রকম ঘটনা আছে মহেশখালীতেও। ২০২০ সালের এপ্রিলে বনের জায়গায় পানের বরজ নির্মাণে বাধা দিতে গেলে হামলায় মারা যান মো.
বনের সম্পদ রক্ষায় বন কর্মকর্তা ও রক্ষীরা প্রায়ই দখলদারদের হামলার শিকার হচ্ছেন। বন বিভাগ বলছে, তাদের লোকবল-সংকট প্রকট। তা ছাড়া তাদের অস্ত্রও সেকেলে। বনদস্যুদের হাতে এর চেয়ে উন্নত অস্ত্র থাকে। অবৈধ দখল ঠেকাতে কিংবা উচ্ছেদ করতে গেলেই তাঁদের ওপর হামলা চালানো হয়।
বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৭ সালে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির হাজারিখীল এলাকায় প্রথম বন কর্মকর্তাকে হত্যর ঘটনা ঘটে। এরপর ১৯৮৫ সালে দুজন, ২০১৮ সালে একজন, ২০২০ সালে একজন, ২০২৪ সালে একজনসহ ছয়জন হামলায় নিহত হন। গত চার বছরে বন বিভাগের সাত জেলায় ১৩৭টি হামলার ঘটনায় ২৯২ জন বন কর্মকর্তা ও রক্ষী আহত হয়েছেন।মূলত রাজনৈতিক নেতাদের উসকানিতে ক্ষমতাসীনদের মদদে বনের জমি দখল, কাঠ কাটা ও পাচারের ঘটনা ঘটে, বলছে বন বিভাগ। আর রাজনৈতিক নেতা ও ক্ষমতাসীনদের অভিযোগ, বন বিভাগের লোকজন ঘুষ নিয়ে উচ্ছেদ–বাণিজ্য করে।
ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা)–এর সদস্যসচিব শরীফ জামিল প্রথম আলোকে বলেন, বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীর চাপে থাকা বাংলাদেশের বনাঞ্চল সংরক্ষণে দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষের সক্ষমতা ও জবাবদিহির অভাব দীর্ঘদিনের। তবে তার উত্তরণে আন্তরিক প্রচেষ্টা সুশাসনের অভাব থাকায় রাজনৈতিক সরকারের আমলে দেখা যায়নি। উল্টো বন ধ্বংসের মাধ্যমে গোষ্ঠীস্বার্থ চরিতার্থ করা হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে এখন পর্যন্ত বন ব্যবস্থাপনায় তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসেনি।
হামলায় হতাহতবন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৭ সালে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির হাজারিখীল এলাকায় প্রথম বন কর্মকর্তাকে হত্যর ঘটনা ঘটে। এরপর ১৯৮৫ সালে দুজন, ২০১৮ সালে একজন, ২০২০ সালে একজন, ২০২৪ সালে একজনসহ ছয়জন হামলায় নিহত হন। গত চার বছরে বন বিভাগের সাত জেলায় ১৩৭টি হামলার ঘটনায় ২৯২ জন বন কর্মকর্তা ও রক্ষী আহত হয়েছেন।
বন বিভাগের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, সবচেয়ে বেশি হামলার ঘটনা ঘটেছে কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগে। এ বিভাগে ৩৪টি হামলায় আহত হয়েছেন ৪৮ জন। নিহত সাজ্জাদুজ্জামান কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের অধীন কর্মরত ছিলেন। হামলার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ঘটনা কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগে। এ বিভাগে ২৮টি হামলায় আহত হয়েছেন ৮৫ জন।
হামলার ঘটনায় সমপরিমাণ মামলাও করেছে বন বিভাগ। তবে কোন মামলার অগ্রগতি কতটুকু, সে তথ্য অধিদপ্তরের কাছে নেই।
বন কর্মকর্তা সাজ্জাদুজ্জামান হত্যার ঘটনায় ১০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ। সম্প্রতি কথা হয় তাঁর বড় ভাই কামরুজ্জামান কাজলের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘মামলার ধীরগতিতে আমরা একটু হতাশ। বন বিভাগকে অনুরোধ করেছিলাম, একজন উকিলের ব্যবস্থা করে দিতে। কারণ, বন বিভাগে যাঁরা আছেন, তাঁরা ব্যস্ত থাকেন।’
কামরুজ্জামান জানান, সাজ্জাদ বিয়ে করেছিলেন মারা যাওয়ার দুই বছর আগে। তাঁর একটি কন্যাসন্তান আছে। বন অধিদপ্তর সাজ্জাদের স্ত্রীকে আউটসোর্সিংয়ে চাকরি দিয়েছে। তাঁরা কোনো রকমে বেঁচে গেছে।
বন বিভাগের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, সবচেয়ে বেশি হামলার ঘটনা ঘটেছে কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগে। এ বিভাগে ৩৪টি হামলায় আহত হয়েছেন ৪৮ জন।উসকানিতে হামলাগত ২৯ ডিসেম্বর বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আজম খান জামালপুরের সখীপুর উপজেলার ডাকবাংলো এলাকায় এক সমাবেশ থেকে বনের জায়গায় থাকা একটি ঘরেও হাত না দিতে বন বিভাগকে হুঁশিয়ার করে দেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে টাঙ্গাইল বন বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আজম খানের হুঁশিয়ারির পর নিরাপত্তাহীনতায় উচ্ছেদের কাজ আপাতত বন্ধ রেখেছেন তাঁরা। গত ৫ আগস্টের পর টাঙ্গাইলের মধুপুর, অরণখোলা, ধলাপাড়া ও করটিয়া এলাকায় জবরদখল বেড়েছে।
জানতে চাইলে আজম খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি বন বিভাগের বাণিজ্যের কথা বলেছি। বন দখলের কথা বলিনি। যারা ব্রিটিশ আমল থেকে জমিদারদের কাছ থেকে জমি পত্তন নিয়ে খাজনা দিয়ে শত বছর ধরে বসবাস করে আসছে, তাদের বন বিভাগ উচ্ছেদ করার নামে বাণিজ্য করে। আমি তাদের বাণিজ্যের বিরুদ্ধে বলেছি।’
এর আগে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে গাজীপুর–৩ আসনের সংসদ সদস্য মুহাম্মদ ইকবাল হোসেন গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মাসিক আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় সবুজ জবরদখল উচ্ছেদে গেলে বন কর্মকর্তাদের বেঁধে রাখতে স্থানীয় লোকজনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। ২০২৩ সালের ১১ অক্টোবর গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুর এলাকায় তিনি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বনের ভেতর দিয়ে একটি রিসোর্টের জন্য সড়ক নির্মাণে সহযোগিতা করেছেন বলে অভিযোগ করেছিল বন বিভাগ।
গত ৫ আগস্টের পর ঢাকা বন বিভাগের অধীন থাকা গাজীপুরে কমপক্ষে ৯০ একর জায়গা জবরদখল হয়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা বশির আল মামুন। তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন হুমকি সত্ত্বেও আমরা ৩৫ একর জায়গা উদ্ধার করেছি।’
আমি বন বিভাগের বাণিজ্যের কথা বলেছি। বন দখলের কথা বলিনি। যারা ব্রিটিশ আমল থেকে জমিদারদের কাছ থেকে জমি পত্তন নিয়ে খাজনা দিয়ে শত বছর ধরে বসবাস করে আসছে, তাদের বন বিভাগ উচ্ছেদ করার নামে বাণিজ্য করে। আমি তাদের বাণিজ্যের বিরুদ্ধে বলেছি।বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আজম খান২০২০ সালের জানুয়ারিতে কক্সবাজারের চকরিয়ার তৎকালীন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য জাফর আলম ভূমি মন্ত্রণালয়কে এক সরকারি পত্রে বনের ভেতর অবৈধ দখলদারদের সংরক্ষিত বনের জমি ইজারা দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তার মাস দুয়েক পর চকরিয়ার হারবাং এলাকায় বনের জায়গা দখলমুক্ত করতে গেলে হামলার শিকার হন বন বিভাগের লোকজন।
আওয়ামী লীগের সাবেক এ দুই সংসদ সদস্য বর্তমানে পলাতক থাকায় তাঁদের বক্তব্য জানা যায়নি।
বন অধিদপ্তরের প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, রাতের দিকে বনভূমি জবরদখল হয় বেশি। সে জন্য দিনের চেয়ে রাতে বন কর্মীদের ওপর হামলার ঘটনা বেশি ঘটে।
এত হামলা কেনবন অধিদপ্তরের সাবেক প্রধান বন সংরক্ষক ইশতিয়াক উদ্দিন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, প্রথম কথা হচ্ছে বনের অবৈধ দখলকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। ফলে হামলার ঘটনা বাড়ছে। বিচারটা আগে ওখানে করা দরকার।
বন বিভাগের জমি চলে যাচ্ছে। এটার কোনো বিচার হয় না। এ বিচার না হওয়াতে দিন দিন বনের জায়গা দখলে বন অপরাধীরা উৎসাহিত হচ্ছে আর হামলার ঘটনা ঘটছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বন বিভাগ থেকে নিরাপত্তারক্ষীদের যে বন্দুক, এসএলআর রাইফেল, থ্রি-নট-থ্রি কিংবা কাটা রাইফেল দেওয়া হয়, সেগুলো সেকেলে এবং অনেক ক্ষেত্রে অকার্যকর। বনদস্যুদের হাতে এর চেয়ে উন্নত অস্ত্র থাকে।
জনবল–সংকটবন অধিদপ্তরের অধীনে মোট বনভূমি আছে ৬৩ লাখ ৬৩ হাজার ৩০৯ একর। এর বিপরীতে তাদের জনবল আছে মাত্র ১০ হাজার ৫০৭ জন। অর্থাৎ প্রতি একজন দিয়ে ৬০৫ একর (৩০০ ফুটবল মাঠের সমান) বনভূমি রক্ষা করা হচ্ছে।
বন অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০২৩ সালে বনের লোকবল ১৭ হাজার ৩০৫ জনে উন্নীত করতে একটা প্রস্তাব দেওয়া হলেও জনপ্রশাসন মাত্র ৫০৮ জনের পদ মঞ্জুর করে। অর্থ মন্ত্রণালয় সেটাকে আবার ৩৩০–এ নিয়ে আসে।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প রথম আল ক র বন ব ভ গ ২০২০ স ল আজম খ ন র ঘটন য় এল ক য় সদস য
এছাড়াও পড়ুন:
জীবনে বহু কিছু করার পর ‘ধৈর্য-সহ্যে’ কপাল খুলছে গোলাম রসুলের
সবে সন্ধ্যা নেমেছে শহরের বুকে। খুলনা নগরের সেন্ট যোসেফ উচ্চবিদ্যালয়ের সামনের ফুটপাতে ছোট একটা দোকানের সামনে বেশ ভিড়। অর্ডার দিয়ে কেউ টুলে বসে আছেন, কেউ আবার প্রিয়জনকে সঙ্গে নিয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করছেন। বিক্রেতা দুজনের চার হাত যেন চলছে সমানতালে। একজন ছোট ছোট ফুচকা বানাচ্ছেন, তো আরেকজন ভেলপুরির প্লেট সাজাচ্ছেন। আবার কখনো একজন পেঁয়াজ–শসা কুচি করে নিচ্ছেন আর আরেকজন বিল রাখা বা টিস্যু এগিয়ে দেওয়ায় ব্যস্ত।
নগরের আহসান আহমেদ রোডের সেন্ট যোসেফ উচ্চবিদ্যালয়ের সামনের একটি ছোট ফুচকা ও ভেলপুরির ভ্রাম্যমাণ দোকানের চিত্র এটি। দোকানের নামটাও বেশ অন্য রকম। ‘ধৈর্য-সহ্য ছোট ফুচকা ও ভেলপুরি স্টোর’। দোকানটি চালান গোলাম রসুল নামের একজন। বিকেল ৪টা থেকে রাত ৯টা-১০টা পর্যন্ত চলে এই ভ্রাম্যমাণ দোকান। এই দোকানের ছোট ফুচকা বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
গোলাম রসুলের বাড়ি বাগেরহাটের মোল্লাহাট উপজেলার কুলিয়া ইউনিয়নের পুরাতন ঘোষগাতী গ্রামে। সাত ভাই–বোনের সংসারে রসুলের বড় ভাই ভাজাপোড়া খাবারের ব্যবসা করতেন। বুঝতে শেখার পর থেকেই তাই এতেই হাতেখড়ি হয় রসুলের। তবে তাতে ঠিক পোষাচ্ছিল না। তাই বছর ৩০ আগে কিছু করার আশায় খুলনা শহরে আসেন গোলাম রসুল। তবে এই শহরে পুরোপুরি থিতু হতে পারেননি। নানা টানাপোড়েনে কখনো খুলনা, কখনো মোল্লাহাট, আবার কখনো ঢাকায় কেটেছে তাঁর সময়। ৪৮ বছরের এই জীবনে নানা রকম কাজ করেছেন। ব্যবসাও করেছেন অনেক কিছুর। তবে সেসব ব্যবসায় কেবল লোকসানই হয়েছে তাঁর। অবশেষে ‘ছোট ফুচকায়’ তাঁর কপাল খুলেছে।
কাজের ব্যস্ততার মধ্যেই কথা হয় গোলাম রসুলের সঙ্গে। রসুল বলেন, ‘আগে রিকশা চালাইছি। নানা রকম ব্যবসাও করছি। গ্রাম থেকে কিনে মাওয়া ফেরিঘাট আর ঢাকায় ডাব বেচছি। ওই ব্যবসায় অনেক মার খাইছি। মানুষ টাকা দেয় নাই। এখনো ৬০-৭০ হাজার টাকা পাব। ডাব ব্যবসায় মার খেয়ে দুই বছর আগে আবারও খুলনা শহরে আসি কিছু করা যায় কী না সেই জন্যি।’ খুলনা এসে আবারও রিকশার প্যাডেল ঘোরাতে থাকেন রসুল একই সঙ্গে মাথায় ঘুরতে থাকে চিন্তা। এরপর শীতের পিঠা বিক্রি শুরু করেন। শীত শেষ হতে আবারও অনিশ্চয়তা। এখন কী হবে!
গোলাম রসুল বলেন, ‘গরম চলে আসল, কী করব বুঝে পাচ্ছিলাম না। পরে খুলনার ৭ নম্বর ঘাট থেকে কিনে ভেলপুরি বেচছি। কিন্তু এতে হচ্ছিল না। এরপর চিন্তা করলাম আনকমন কিছু করা যায় কি না। গত বছরের কোরবানির ঈদের পর থেকে শুরু করি ছোট ফুচকা বিক্রি।’
দোকানটি চালান গোলাম রসুল নামের একজন। বিকেল ৪টা থেকে রাত ৯টা-১০টা পর্যন্ত চলে এই ভ্রাম্যমাণ দোকান