সিলেটের কোম্পানীগঞ্জে ক্ষুদ্রঋণ দেওয়ার কথা বলে প্রায় ৩০০ মানুষের কাছ থেকে কোটি টাকার মতো হাতিয়ে নিয়েছে প্রতারক চক্র। ঋণের বিপরীতে সঞ্চয় হিসেবে ওই অর্থ নেওয়া হয়। তবে ঋণ দেওয়ার আগের রাতে গা-ঢাকা দিয়েছে প্রতারক চক্রটি। 

ভুক্তভোগীদের তথ্যমতে, গত মাসের শেষে দিলওয়ার হোসেন তার এক সহযোগী নিয়ে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় যায়। তারা প্রচার চালায়, পিপলস ট্রাস্ট নামে একটি নতুন সংস্থা প্রতিটি গ্রাম থেকে ৫ জনকে ক্ষুদ্রঋণ দেবে। ঋণের পরিমাণ ৫০ হাজার থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত। দুই সপ্তাহ আগে তেলিখাল ইউনিয়নের দক্ষিণ বুরদেও এলাকায় একটি বাসা ভাড়া নিয়ে অফিসও চালু করে প্রতারকরা। পরে লাখ টাকা ঋণের বিপরীতে সঞ্চয় হিসেবে ১০ হাজার টাকা জামানত আদায় করে তারা। প্রথমে ৫ জনের কথা বললেও পরে এক গ্রামে ১০ জনের কাছ থেকেও জামানত নেওয়া হয়। এভাবে উপজেলার রাজারখাল, বাগারপাড়, ঘোড়ামারা, কাঁঠালবাড়ী, মেঘারগাঁও, ইসলামপুর, খাগাইল, বর্নী, কলাবাড়ীসহ কয়েকটি গ্রামের ৩০০ মানুষের কাছ থেকে প্রায় কোটি টাকা সংগ্রহ করে তারা। তবে গত রোববার টাকা দেওয়ার আগে শনিবার রাতেই অফিস ফেলে প্রতারকরা লাপাত্তা। 

ইসলামপুরের পিয়ারা বেগম বলেন, এনজিওর দু’জন ঋণ দিচ্ছে শুনে প্রথমে সন্দেহ হয়েছিল। তবে অন্যরা বলেছিল, ব্যাংক তো; পালিয়ে যাবে না। পরে এক লাখ টাকা পেতে ১০ হাজার টাকা সঞ্চয় দেন। গত রোববার ঋণের টাকা দেওয়ার কথা ছিল। আগের রাতেই অফিসে তালা দিয়ে পালিয়েছে। বাড়ির মালিকও ওই লোকদের বিষয়ে সঠিক তথ্য দিতে পারেননি। তিনি জানান, আগামী রোববার উপজেলা নির্বাহী কমকর্তার কাছে এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ দেবেন। 
প্রবাসফেরত নবী হোসেন সমকালকে জানান, ব্যবসা ও অটোরিকশা কিনতে ২ বছর মেয়াদি ঋণের জন্য তিনিও জামানত দিয়েছিলেন। তবে এভাবে প্রতারিত হবেন, ভাবেননি। স্থানীয় কেউ এর সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে বলে সন্দেহ তাঁর।

নভাগী গ্রামের আতাউর রহমান ও তাঁর ভাই-ভাতিজা ৫ লাখ করে ঋণের জন্য দেড় লাখ টাকা জমা দেন। এক পরিবার থেকে দেড় লাখ টাকা পেয়ে ওই বাড়ির এক মেয়েকে ১৩ হাজার টাকা বেতনে চাকরিও দেয় কথিত এনজিও সংস্থার ব্রাঞ্চ ম্যানেজার দিলওয়ার হোসেন। 
এদিকে ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে পাওয়া কাগজপত্রে দিলওয়ার হোসেনকে সংস্থাটির কোম্পানীগঞ্জের ব্রাঞ্চ ম্যানেজার হিসেবে দেখানো হয়। কাগজপত্র অনুযায়ী দি পিপলস ট্রাস্টের রেজিস্ট্রেশন নম্বর ভি-৪৫৬১/ই ৩১৪২টি ৯৬৩১/৬৫। প্রধান কার্যালয় দেখানো হয়েছে ঢাকার সাভার এলাকার রোড ২৬, ব্লক-সি,  ট্রাস্ট ভবন, দ্বিতীয় তলা। এ ছাড়া সংস্থাটি জয়েন্ট স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে ২০০৫ সালের ৫ মে গ্রহণ করা রেজিস্ট্রেশন নম্বর-২০০৭ দেখানো হয়েছে। 
কোম্পানীঞ্জ থানার ওসি উজায়ের আল মাহমুদ আদনান সমকালকে জানান, ভুক্তভোগীরা থানায় গিয়েছিলেন। তিনি লিখিত অভিযোগ দিতে বলেছেন। অভিযোগ পেলে গুরুত্ব দিয়ে দেখা হবে।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ঋণ

এছাড়াও পড়ুন:

সাহিত্যে রন্ধনশিল্পের প্রভাব

মুসলিম সভ্যতায় খাওয়ার সংস্কৃতি কথা তখনকার সাহিত্যকে প্রভাবিত করেছে। সাহিত্যিকদের অনেকে রান্নার স্বাদ, রস ও প্রকার বিভিন্ন উপমায় বর্ণনা করেছেন। অনেকে ভোজনশালার পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেছেন চটুল ও রহস্যময় বর্ণনায়। কেউ কেউ বুদ্ধিবৃত্তিক সমালোচনাও করেছেন। তাঁদের বইয়ে রান্নার সঠিক নিয়ম কী হওয়া উচিত এবং সুস্বাদু খাবারের পূর্বশর্ত কী, তা অনুসন্ধান করেছেন। আবু বাকার আল-রাযির (৩১১ হিজরি, ৯২৩ খ্রিষ্টাব্দ) মুনাফি আল-গিজা ওয়াদাফিউল আযমারাহ এ বিষয়ে একটি অনন্য গ্রন্থ।

বাগদাদি লেখক ‘মিসাল বাগদাদ’ বাগদাদের রন্ধনশিল্পের বিশালতা কাব্যিক ঢঙে বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘যেখানে কালো সিসা রুটির ওপর ছড়িয়ে দেওয়া ছিল, সেটি দেখলে মনে হতো যেন পূর্ণ চাঁদ, এবং তার স্বাদ এত মিষ্টি ছিল যেন এক গ্রাসে খেয়ে ফেলা যেত।’

ইবন তাইফুর মারভেজি (২৮০ হিজরি, ৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দ) তাঁর কিতাব বাগদাদ গ্রন্থে মাওমুন নামে এক বাগদাদি বিশেষজ্ঞের বাড়িতে খাবারের সময়ে উপস্থিত ছিলেন। তিনি সেখানে কী কী দেখেছেন, তার সরস বর্ণনা দিয়েছেন। সে সময় মাওমুনের অতিথিশালায় প্রায় তিন শ ধরনের খাবার পরিবেশন করা হয় এবং মাওমুন প্রতিটি খাবারের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে বোঝান।

আরও পড়ুনমন্দ প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণের উপায়০৬ এপ্রিল ২০২৫

বাদশাদের মতো অনেক মন্ত্রীদেরও খাবারের প্রতি আগ্রহ ছিল গভীর। জাহাজি (২১৬ হিজরি, ৮৩১ খ্রিষ্টাব্দ) একটি উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেন, পারস্যের গভর্নর আমর ইবন লাইস তার ব্যক্তিগত রন্ধনশালায় সাড়ে ছয় শ উট ব্যবহার করতেন। এগুলো ছিল মন্ত্রীর প্রাসাদে খাবার প্রস্তুত করার জন্য প্রয়োজনীয় উপাদানের বিশাল নির্দেশ।

এ ছাড়া বিশেষজ্ঞদের উপস্থিতিতে খাবার প্রতিযোগিতার কথাও শোনা যায়। এই ধরনের প্রতিযোগিতা কেবল যে খাবার প্রস্তুতির জন্য ছিল তা নয়, এটি ছিল একটি আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক ধারণা ছিল, যেখানে রান্নার শৈলী ও খাবারের বৈচিত্র্য চিহ্নিত করার উদ্যোগ নেওয়া হতো।

কঠোর নজরদারি ও মান নিয়ন্ত্রণ

ইসলামি সভ্যতায় রেস্তোরাঁয় ও খাদ্য উৎপাদনে কঠোর নজরদারি চালানো হতো। খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধ, তৈরির পাত্রের পরিচ্ছন্নতা, রাঁধুনির ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য, উপকরণের বিশুদ্ধতা—এসব ছিল বাধ্যতামূলক।

আলাদা চুলা: আলাদা খাবারের জন্য আলাদা চুলা বরাদ্দ থাকত। যেমন যেখানে মাছ ভাজা হয়, সেখানে রুটি বানানো নিষেধ ছিল। তেল বারবার ব্যবহার করাও নিষিদ্ধ ছিল।

অপ্রাপ্তবয়স্ক সরবরাহকারী: একটি মজার তথ্য হলো—যেসব রুটি বিক্রেতা ‘সরবরাহকারী’ রাখত, তাদের বলা হতো অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেদেরই নিয়োগ দিতে, যাতে তারা গৃহস্থালির নারীদের সামনে যাওয়া হলেও কোনো সামাজিক অস্বস্তি না হয়।

আরও পড়ুনসুরা সাফে মন্দ আচরণ নিয়ে আল্লাহর বক্তব্য৩১ জুলাই ২০২৩

ওজনে কারচুপি: তখন বেশির ভাগ খাবার বিক্রি হতো ওজনে। তাই ওজনে কারচুপি ঠেকাতে ‘মুহতাসিব’ বা বাজার তদারকি কর্মকর্তারা নজরদারি করতেন। যেমন, মাংস রান্নার আগে-পরে ওজন করে দেখা হতো, যেন অতিরিক্ত শুকিয়ে না যায় বা ভেতরে লোহা জাতীয় কিছু ঢুকিয়ে ওজন না বাড়ানো হয়।

ভেজাল-নিরোধ: বিভিন্ন ভেজালের কৌশলও ধরা পড়েছে। কেউ কেউ কিমার ভেতরে ভুঁড়ি, পেঁয়াজ ও বুটলতাও ঢুকিয়ে দিত। কেউবা সমুচার ভেতরে মাছ ও মসলা দিয়ে মাংসের বিকল্প বানাত। এগুলো ধরা হতো ভাজনের আগেই কেটে দেখে।

রসায়ন ব্যবহার: এক ধরনের খাদ্যভিত্তিক ‘রাসায়নিক ভেজাল’ও ছিল। রঙিন মাংস বানানো হতো আসল মাংস ছাড়াই। কলিজা, ডিম, এমনকি মধু বা চিনি ছাড়া মিষ্টিও তৈরি হতো। একজন প্রাচীন চিকিৎসক—ইবন আল-কিন্দি—এমন প্রযুক্তির উল্লেখ করেন তাঁর কেমিস্ট্রি অব কুকিং বইতে। তবে এসব গোপন রাখা হতো, যাতে কেউ শিখে অনৈতিকভাবে না ব্যবহার করে।

ফাতেমি যুগে নারী রাঁধুনিরাও (দাসী) ছিলেন বিশিষ্ট। কেউ কেউ ৮০ রকম ভাজাভুজি বানাতে পারতেন। এমন দক্ষতা দেখে এক তুর্কি রাজা তাঁর রাঁধুনিদের কায়রোতে পাঠিয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন।

আরও পড়ুনশয়তানের মন্দ প্ররোচনা থেকে বাঁচার দোয়া২৭ এপ্রিল ২০২৩

আধুনিক রান্নার আগমনী

বিখ্যাত ‘বিফ বোর্গুইনিয়ন’ ফরাসি রান্না, যা ধীরে ধীরে রান্না করা হয়, সেটি ৭০০ বছর আগেই আরব অঞ্চলে প্রচলিত ছিল ‘স্কবাজ’ নামে। এতে মাংস, মসলা, খেজুরের রস ও জাফরান দিয়ে ট্যানুরে সারা রাত রান্না হতো।

রমজান উপলক্ষে নানা খাবার, যেমন: কাতায়েফ, হরিরা, কুসকুস, সামোসা, লুকাইমাত (লালমোহন জাতীয় মিষ্টি) ও সোবিয়া (একধরনের মিষ্টি পানীয়)—এই সব খাবার বহু শতাব্দী ধরে প্রচলিত।

আন্দালুসীয়রা খাবার একসঙ্গে পরিবেশন করতেন না। একে একে পরিবেশন করতেন—প্রথমে ডাল, তারপর মিষ্টি, মাঝে মাঝে আচার, সবশেষে পুনরায় মিষ্টি। এ রেওয়াজ এখনো মরক্কোসহ কিছু অঞ্চলে প্রচলিত।

ইরাকের সংগীতজ্ঞ জেরিয়াব শুধু সুর নয়, খাবারের রুচিতেও বিপ্লব এনেছিলেন আন্দালুসিয়ায়। তিনি খাবারের পরিবেশনা, থালার সাজসজ্জা, গ্লাসের ব্যবহার (সোনা-রুপার বদলে কাচের), ও চামচ-কাঁটা ছুরি ব্যবহারে সৌন্দর্যবোধের পরিচয় দেন। তাঁর কৌশল পরবর্তীতে ইউরোপেও ছড়িয়ে পড়ে।

খাদ্য শুধু পেট ভরানোর বিষয় নয়, বরং তা সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য, সৌন্দর্য ও নৈতিকতারও বহিঃপ্রকাশ। ইসলামি সভ্যতার রন্ধনশৈলী আমাদের শিখিয়ে দেয়—ভালো খাবার মানে বিশুদ্ধতা, রুচিশীলতা এবং সামাজিক সচেতনতার এক অনন্য মিশেল।

আলজাজিরা ডট নেট অবলম্বনে

আরও পড়ুনঅহংকারের পরিণতি মন্দ২৬ মার্চ ২০২৪

সম্পর্কিত নিবন্ধ