এক-এগারোর সময়কার মতো বিএনপির বিরুদ্ধে ‘মিডিয়া ট্রায়াল’-এর প্রেক্ষাপট তৈরির চেষ্টা হচ্ছে বলে সম্প্রতি অভিযোগ করেছেন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি বলেছেন, নির্বাচনে জেতার জন্য বিএনপির যত বেশি সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে, তত বেশি বিএনপিকে মিডিয়া ট্রায়ালের মুখোমুখি করা হচ্ছে (সমকাল অনলাইন, ১৭ মার্চ ২০২৫)।

কথা হচ্ছে, মিডিয়া ট্রায়াল আসলে কী? এটি কীভাবে কাজ করে? সহজ ভাষায় বলতে গেলে, প্রচলিত আদালতের বাইরে সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে কোনো ব্যক্তিকে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করাকে মিডিয়া ট্রায়াল বলা যেতে পারে। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩১ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুসারে, এমন কোনো বেআইনি পদক্ষেপ নেওয়া যাবে না, যা কোনো ব্যক্তির জীবন, সুনাম এবং সম্পত্তির ক্ষতির কারণ হয়। এ ছাড়াও দোষী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত একজন ব্যক্তিকে অপরাধী বলা যাবে না। 

দুনিয়াজুড়েই প্রচলিত আদালতের রীতি হচ্ছে, বাদী ও বিবাদী উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনে সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে রায় তৈরি করা। একজন বিচারক এই রায় ঘোষণা করেন। কিন্তু বর্তমানে সামাজিক মাধ্যম ও কোনো কোনো সংবাদমাধ্যম সঠিক কারণ প্রকাশ না করে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে একতরফা দোষারোপ করতে পারে। কোনো প্রকার যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া বা রীতি অনেক ক্ষেত্রেই অনুসরণ করা হয় না, যা সম্পূর্ণরূপে ন্যায়বিচারের নীতি লঙ্ঘন করে। প্রচলিত বিচার ব্যবস্থায় অভিযুক্ত ব্যক্তির আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ থাকে। আইনজীবীর মাধ্যমে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ থাকে। বিপরীত পক্ষের বানোয়াট যুক্তি দিয়ে কোনো ব্যক্তির বিচার করা যায় না। কিন্তু মিডিয়া ট্রায়ালে এই সুযোগ থাকে না। ফলে একজন ব্যক্তি শুধু তাঁর মর্যাদাই হারান না; মানসিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হন। যদি সেটি দলগত অবস্থান হয়, তাহলে তারাও প্রতিপক্ষের তুলনায় পিছিয়ে পড়েন। 

বিএনপির শীর্ষ নেতার আশঙ্কা, বিএনপিকে মিডিয়া ট্রায়ালের মুখোমুখি করার প্রেক্ষাপট তৈরি করা হচ্ছে। বিএনপির এই অভিযোগ খতিয়ে দেখতে চাইলে আমরা ২০০৭ সালের দিকে ফিরে তাকাতে পারি। সেই সময়ে মিডিয়া ট্রায়ালের শিকার হয়ে দলটি ভয়াবহ ইমেজ সংকটে পড়েছিল। ২০০৭ সালের ৭ মার্চ কোনো ধরনের মামলা ছাড়াই তৎকালীন সেনা সমর্থিত মইন উদ্দিন ও ফখরুদ্দীনের ওয়ান-ইলেভেনের সরকার জরুরি বিধিমালায় তারেক রমহানকে গ্রেপ্তার করেছিল। তার পর থেকেই তারেক রহমানের চরিত্র হননে প্রচারণা চালানো হয়েছিল। লক্ষণীয়, সেই আমলে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছর ও বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের টানা প্রায় ১৬ বছরে টাস্কফোর্স, এনবিআর, দুদকসহ সরকারের সব সংস্থা অনুসন্ধান করেও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতি অথবা অবৈধ সম্পদ অর্জনের কোনো অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। কিন্তু তারেক রহমানকে ‘টেন পার্সেন্ট’ বা ‘খাম্বা তারেক’ প্রভৃতি নেতিবাচক বিশেষণে হাজির করা হয়েছিল। ২০ মার্চ ২০২৫, বৃহস্পতিবার সব মামলা থেকে বিচারিক খালাস পেয়েছেন তিনি।  

আমরা যদি অতীত থেকে শিক্ষা নিতে না পারি, মিডিয়া ট্রায়ালের অপরাধীদের জবাবদিহির আওতায় না আনা যায়, তাহলে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করা সহজ হবে না। এটি কেবল একটি দলের প্রতি ঘটানো অবিচার নয়; পুরো দেশের বিচার ব্যবস্থার একটি চিত্র। 

এখন প্রশ্ন দেখা দিতে পারে, মিডিয়া ট্রায়াল কেন হয়? উত্তর হচ্ছে, বিচারিক কার্যক্রমে দীর্ঘসূত্রতা ও ক্ষেত্রেবিশেষে আস্থাহীনতার জন্যই এমনটা হয়। মিডিয়া ট্রায়ালের ক্ষতিকর দিক হচ্ছে, এই প্রক্রিয়ায় একজন মানুষের আজীবনের অর্জিত সুনাম ভূলুণ্ঠিত হতে পারে। এর মাধ্যমে একজন মানুষের স্বাভাবিক জীবনেও ছন্দপতন ঘটে। বিঘ্নিত হয় ব্যক্তি বা তাঁর পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা।
৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের দর্প চূর্ণ হয়েছে। রাজনৈতিক পরিস্থিতি আমূল বদলেছে। দেশের সার্বিক পরিস্থিতির যে বদল ঘটেছে, তা কিন্তু নয়। এখন এটা নিশ্চিত করা দরকার, বিচারিক প্রক্রিয়া প্রভাবমুক্ত থাকবে। সারা দুনিয়াতেই সংবাদমাধ্যমকে নানাভাবে প্রভাবিত করার সুযোগ থাকে। সংবাদমাধ্যমের একটি বড় লক্ষ্য হচ্ছে জনমত তৈরি। অর্থাৎ সম্মতি উৎপাদন। অন্যদিকে বিচারিক আদালতের লক্ষ্য হচ্ছে, অপরাধের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা। পাশাপাশি অভিযুক্তকে সর্বোচ্চ সুরক্ষাও দেওয়া। অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত হওয়ার আগেই অভিযুক্তকে কোনো প্রকার সামাজিক বা মিডিয়ার বিচারের মুখোমুখি করা যাবে না। 

একটি ব্রিটিশ প্রবাদ রয়েছে। যার বাংলা অনেকটা এমন– তুমি যদি কোনো কুকুরকে হত্যা করতে চাও তাহলে তার একটা খারাপ নাম দাও। অর্থাৎ কাউকে হত্যা বা ধ্বংস করতে চাইলে তাকে একটা ঘৃণিত নাম দিতে হবে। তারপর তুমি তাকে ধ্বংস করতে পারো। 
‘মিডিয়া ট্রায়াল’ হচ্ছে প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার প্রতিও এক ধরনের হুমকি। অর্থাৎ বিচার প্রক্রিয়ার আগেই বিচারকাজকে প্রভাবিত কিংবা বিচারিক প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করা। সুস্থ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় এটি কোনোমতেই কাম্য নয়। ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশে বহুল উচ্চারিত শব্দ হচ্ছে সংস্কার। যদি আমরা সত্যিকারের সংস্কার চাই, তাহলে প্রত্যাশার পাশাপাশি প্রতিজ্ঞাও থাকতে হবে– রাজনৈতিক মত যা-ই থাকুক না কেন, প্রতিপক্ষকে মিডিয়া ট্রায়ালের দিকে ঠেলে দেব না। যেহেতু মিডিয়া সর্বগ্রাসী; এটি কখন কার দিকে তাক হবে– এমন ঝুঁকি থেকেই যাবে। রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য সবচেয়ে ভালো হচ্ছে, যে কোনো মিডিয়া ট্রায়ালকে না বলা। 

বিএনপি কেন মিডিয়া ট্রায়ালের ভয়ে ভীত হচ্ছে, তার কারণ সহজেই অনুমান করা যায়। দলটির সামনে এখন রাজনৈতিক বড় ধরনের কোনো প্রতিপক্ষ নেই। এমন বাস্তবতায় নিজেদের সাংগঠনিক দুর্বলতা কাটিয়ে এগিয়ে যাওয়ার বদলে নিজেদের অসংগতি যদি সংবাদমাধ্যমের বরাতে ছড়িয়ে পড়ে, সেটি দলটির জন্য সুখকর হবে না। এমন আশঙ্কা থেকেই বিএনপি অতীতের ঘটনা সামনে টেনে আনার মধ্য দিয়ে দলটির নেতাকর্মীকে সাবধান করতে চাইতে পারে। তবে শেষ কথা হচ্ছে, রাজনৈতিক দল এবং সংবাদমাধ্যম যদি নিজেদের প্রতিপক্ষ ভাবতে শুরু করে, সেটা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার পথ বাধাগ্রস্ত করবে। সেটা গণতন্ত্রকামী কারও কাম্য হতে পারে না। 

এহ্‌সান মাহমুদ: সহকারী সম্পাদক, 
সমকাল; কথাসাহিত্যিক 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ব এনপ ত র ক রহম ন র জন ত ক প রচল ত ব এনপ র র জন য সরক র অপর ধ দলট র ধরন র

এছাড়াও পড়ুন:

পাইকারি বাজারেও ক্রেতা কম

নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে বান্টি এলাকার বাটিক কাপড়ের মার্কেটের সুনাম রয়েছে দেশজুড়ে। দেশের প্রায় সব জেলা থেকেই ব্যবসায়ীরা এখানে আসেন। রমজান মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত এ মার্কেটে বিক্রি বেশ ভালো ছিল। কিন্তু এখন মার্কেটটির সামনের সারির দোকানগুলোকে খুচরা ক্রেতাদের আনাগোনা থাকলেও ভেতরের সারির দোকানগুলোতে ক্রেতার আনাগোনা একেবারেই কমে গেছে।

বাটিক মার্কেটের ব্যবসায়ীদের ধারণা, ঈদ যতই ঘনিয়ে আসবে, ক্রেতার সংখ্যা আরও কমে যাবে। গতকাল বুধবার দুপুরে এমনটাই জানান হাজী বারেক মোল্লা সুপারমার্কেটের ঝুমু বস্ত্রালয়ের স্বত্বাধিকারী জাহাঙ্গীর আলম। তিনি জানান, ঢাকার বাইরে থেকে ক্রেতা আসছেন। বিক্রি কম। ব্যবসায়ীরা অনেকে অলস সময় কাটাচ্ছেন। এর কারণ শীতের পর পরই এবারের ঈদ এসেছে। এ জন্য পাইকারি ক্রেতা অন্যান্য বছরের তুলনায় অনেক কম। গত বছর রমজান মাসে ২৫ লাখ টাকার কাপড় বিক্রি করতে পারলেও এ বছর তিনি এখন পর্যন্ত ১০ লাখ টাকার কাপড় বিক্রি করতে পেরেছেন।

বুধবার বিকেলে দেখা যায়, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশে বান্টি বাজারের বাটিক মার্কেটগুলোতে ক্রেতার আনাগোনা তেমন নেই। দোকান মালিকরা অলস সময় কাটাচ্ছেন। কেউ আবার দোকান গোছাতে ব্যস্ত। কেউ দোকান পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করছেন। বান্টি এলাকার প্রায় এক কিলোমিটারজুড়ে এ দৃশ্য চোখে পড়ে। মাঝেমধ্যে দু-একজন খুচরা ক্রেতার দেখা মিললেও অনেকে থ্রিপিসের দাম কিছুটা বেশি বলে জানান। এমনই একজন ক্রেতা আব্দুস সালাম জানান, অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার বাটিক মার্কেটে থ্রিপিসের দাম কিছুটা বেশি। বাজারের ব্যবসায়ীরা সুতার মূল্য বেশি হওয়ায় কাপড়ের দামও বেড়েছে বলে জানান।

থ্রিপিস কিনতে আসা ছনপাড়া গ্রামের ক্রেতা লিপি আক্তার জানান, তিনি ১ হাজার ২০০ টাকা দিয়ে দুটি থ্রিপিস কিনেছেন। দাম কিছুটা বেশি। দোকানে তেমন ভিড় নেই বলে নিজেই দেখে পছন্দমতো থ্রিপিস কিনতে পেরেছেন।

বান্টি বাজারের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাটিক, থ্রিপিসসহ বাটিক কাপড়ের রাজধানী বান্টি বাজার। প্রায় ৪৫ বছর আগে এ এলাকায় বাটিকশিল্পের কাজ শুরু হয়। আবহাওয়াজনিত কারণে এবারের ঈদে সুতি কাপড়ের প্রতিই মানুষের আগ্রহ বেশি। তাই সুতি কাপড়ে বাটিকের কাজ করছেন এখানকার কারিগররা। বাটিকশিল্প ঘিরে বান্টি এলাকায় গড়ে উঠেছে বিশাল মোকাম।

দোকান মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রমজানের ১৬ তারিখ পর্যন্ত বাটিকের মোকামে বেশ ভালোই বিক্রি হয়েছিল। বান্টি এলাকায় মহাসড়কের দুই পাশে ২০টি মার্কেটে প্রায় দুই হাজার দোকানের প্রতিটিতে একদিনে গড়ে চার-পাঁচ লাখ টাকার কাপড় বিক্রি হয়ে থাকে। বছরে এখানে গড়ে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হয়। এবারের ঈদে প্রায় আড়াইশ কোটি টাকার কাপড় বিক্রির লক্ষ্য ছিল ব্যবসায়ীদের।

মালিয়া এক্সক্লুসিভ কালেকশনের মালিক জুয়েল মিয়া জানান, এ এলাকার বাটিকের কাপড় ঢাকাসহ দেশের বহু এলাকায় যায়। বান্টির বাটিক দেশ ছাপিয়ে মধ্যপ্রাচ্যেও যাচ্ছে। সৌদি আরব, দুবাই, মালয়েশিয়া, ভারত, নেপালসহ বিভিন্ন দেশে বাটিকের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এ বছর তিনি তাঁর পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে রমজানের ১৬ দিনে ৩০ লাখ টাকার থ্রিপিস বিক্রি করতে পেরেছেন। এখন ক্রেতা কম। প্রতিদিন কিছু খুচরা ক্রেতা দোকানে আসেন।

শামীম ফ্যাশন কর্নারের মালিক তরিকুল ইসলাম জানান, ঈদ ঘনিয়ে এলে পাইকাররা এখানে কম এলেও খুচরা ক্রেতার পদচারণায় মুখর থাকত। কিন্তু এবারের চিত্র ভিন্ন। পুরো মার্কেটে তেমন কোনো ক্রেতা নেই।

একই কথা জানালেন সামির থ্রিপিসের মালিক সামির আলী, শামীম ফ্যাশন কর্নারের মালিক তরিকুল ইসলাম, আনাস বাটিক ঘরের মালিক রমজান মিয়া, প্রভা থ্রিপিস অ্যান্ড জিহাদ বুটিকসের স্বত্বাধিকারী মঞ্জুর হোসেন, মেসার্স আয়েশা থ্রিপিসের মালিক বাচ্চু মিয়া, সানাউল্লাহ শপিংমলের মালিকসহ অন্য ব্যবসায়ীরা।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • নরসিংদীতে আ. লীগ-বিএনপির সংঘর্ষ, গুলিবিদ্ধসহ নিহত ২
  • ঘর বেচে কেনা হয়েছিল কম্পিউটার, এখন কোটি টাকার মালিক ফ্রিল্যান্সার রায়হান
  • যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণে নতুন সতর্কতা জারি করেছে যুক্তরাজ্য
  • যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণের জন্য নতুন সতর্কতা জারি করেছে যুক্তরাজ্য
  • যখন আমি নবীন চিত্রশিল্পী
  • নোবিপ্রবি ছাত্রদল নেতার বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীকে হয়রানির অভিযোগ
  • বৃদ্ধরা জানালেন, তরুণ বয়সে যেসব কাজ না করার জন্য তাঁরা এখন আক্ষেপ করেন
  • পেয়ার বিক্রেতার সঙ্গে অদ্ভুত অভিজ্ঞতা প্রিয়াঙ্কার
  • পাইকারি বাজারেও ক্রেতা কম