শিশুর লাল-সাদা রঙের একটা বল ঠিক জাম্বুরা গাছের নিচটায়। উঠানের অদূরে খাটিয়ায় সাদা কাপড়ে মোড়ানো হাবিবুর রহমানের লাশ। মহিষের শিঙের মতো তীক্ষ্ণ শীতের সাদা সকাল আর ভোররাতে আজানের ঠিক আগে ওনার হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হওয়া। ভদ্রাবতীর পাড় থেকে ভেসে আসা খেজুর-রসের ঘ্রাণের বাতাস, আর মৃত্যুর সময় পাশে পড়ে থাকা কিছু চিঠি। বাড়ির সীমানায় রাস্তায় হলদে লাল পাকা বরই ঝরে পড়ে টুপটাপ। কিসের চিঠি? জানতে হলে যেতে হবে অনেক বছর পেছনে।
ভদ্রাবতী নদীর পাড়ের যেখানে জমাট মাটি বড় বড় টুকরো ফাটলের মতো হয়ে ভেঙে পড়তে যেয়েও পড়ে না, যেখানে বুড়ো বটের ঝুড়ি ধরে বহু বছরের পুরোনো কানি ডাইনি, রাক্ষস-খোক্ষস গভীর রাতে, বসন্ত বাতাসে দোল খায় বলে জানা যায়, সমতলের কিছু ছায়াযুক্ত অংশে শিশুদের বিচিত্র সব খেলা খেলতে দেখা যায়, এমনই এক জায়গায় কোত্থেকে এনে ফেলা রাখা কিছু সিমেন্টের কালভার্টের ভাঙা অংশে দূর থেকে একজনকে বসে থাকতে দেখা যায় .
হ্যাঁ, রেবু ... পুরো নাম রেবা আনসারী। যাকে দেখা যেত এই ভদ্রাবতী নদীর পাড়েই। লম্বা, ফর্সা সুন্দর গড়নের রেবুর কোঁকড়ানো, কালো একগোছা কোমরের নিচ পর্যন্ত চুল, যা নিয়ে হাঁটত ঘণ্টার পর ঘণ্টা, কখনও চুপচাপ ভাবত আর ছিল খামখেয়ালি স্বভাব। সে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে আর হাবিবুর রহমান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান বিভাগে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলো, ঠিক সেদিন এ জায়গায়ই দেখা হলো। রেবুকে একটা হলুদ কামিজ, বেগুনি সালোয়ার, ওড়না আর কোঁকড়ানো চুলে দুই বেণি করে পা দোলাতে দেখা গেল আর গুনগুন করে নজরুলের গান গাইতে শোনা গেল–
“তুমি শুনিতে চেয়ো না আমার মনের কথা,
দখিনা বাতাস ইঙ্গিতে বোঝে
কহে যাহা বনলতা।”
হুট করে গান থামিয়ে চুপ করে বসে থাকা হাবিবকে বলল– “ওমা, সে কি তুমি তো দেখি ভাদ্র মাসের তালের মতো মুখটা করে আছো? তুমি তো নিজেই ঢাকায় যেতে চাওনি, পরীক্ষার ফর্মই কিনলে না। এখন বিরহে এ রকম করে কী হবে বলো? তার চেয়ে এই-ই ভালো হয়েছে। পুরুষ মানুষ সারাদিন গা ঘেঁষে বসে থাকা আমার পছন্দ না, ও রকম হলে একসময় প্রেম ম্যাড়মেড়ে হয়ে যায়। এর চেয়ে দূরে দূরে থাকব, বিরহে কাতর হবো, দুজন ছুটিছাটায় বাড়ি এলে অল্পস্বল্প দেখা হবে, দুজন দুই জায়গায় কী দেখলাম, প্রেমের গভীরতা মাপব, রোজ নয়তো সপ্তাহে চিঠি লিখব ... এমন প্রেমই আমার পছন্দ। রেবু আবার মনের আনন্দে গান ধরল– “তুমি শুনিতে চেয়ো না আমার মনের কথা ...।” ক’দিন পর ঢাকায় চলে গেল। যাওয়ার দিন বাসে উঠেই খুব গম্ভীর হয়ে গেল যেন জানালার ওপাশে বাইরে দাঁড়ানো হাবিবকে সে চেনেই না। হাবিব অস্বস্তিতে ভোগে। রেবু এত খামখেয়ালি কেন? কিছুই কি বলার নেই অন্য সব প্রেমিকার মতো– “ঠিকমতো খেয়ো। শরীরের যত্ন নিও। ঠান্ডা লাগিয়ো না।” বা এত বছরে সরাসরি একদিনের জন্যও বলল না– “আমি তোমাকে ভালোবাসি।”
বাস ছেড়ে দেয় ধীরগতিতে। হাবিবের এবার চোখে পানি চলে আসে। ঠিক এ সময় রেবু জানালার কাচ সরিয়ে বলে ওঠে– “হাবিবুর রহমান সাহেব, চোখ মোছেন, এই যে নেন রুমাল।” হাবিব হাত বাড়িয়ে নিতে যেয়ে দেখে একটা হলদে খামে চিঠি। চিঠিটা হাতে নিয়ে তার বিস্ফোরিত চোখের মণি শুধু রেবু একা না, পুরো বাসভর্তি মানুষ দেখছিল। রেবুর পেছনের সিটের এক ভদ্রলোক উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়েই পড়ল যে চিঠিটা বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটার হাতেই পড়েছে নাকি অন্য কোথাও আবার উড়ে চলে গেল। হাবিবের হাতে খাম দেখে সে হাততালি দিয়ে ফেলল আনন্দে। ওদিকে খামখেয়ালি রেবু মুখ টিপে হেসে সেদিন বিদায় নিয়েছিল। বাড়ি ফিরে হাবিব সেদিন সারারাত চিঠিটা কতবার পড়েছিল হিসাব নেই। টেবিল ল্যাম্পের মৃদু আলোয় হাবিবের চোখ আবার টলমল করে। চিঠিতে লেখা ছিল–
প্রিয়তমেষু,
ডিসেম্বর জানুয়ারির তীব্র শীতে মফস্বল শহরের সবাই হাসনুহেনার তীব্র ঘ্রাণ আর বোগেনভিলিয়ার নানা রং বুকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে খুব তাড়াতাড়ি। একমাত্র আমিই কিছু ঘ্রাণ আর রং নিয়ে তোমাকে ভাবি, তোমাকে কিছু লিখতে চাই। সারাটা সকাল যায় আমার বড় বড় কর্তাদের বাংলোর যে নির্জন রাস্তা, সেই পথে হেঁটে হেঁটে। বাংলোর মূল ফটকের সামনে দাঁড়ানো প্রহরীর স্থির চোখ, উঁকিঝুঁকি দিয়ে বাংলোর ভিতরের গোছানো বাগান, গত রাতে কর্তাদের খেলা ব্যাডমিন্টনের ঝুলে থাকা নেট, কোথাও না আমি ভালোবাসা খুঁজে পাই না। ডিসির বাংলোর সামনের চিঠি লেখার লালরঙা ডাকবাক্সটাও আজকাল শূন্য পড়ে থাকে, ওটার মাথার ওপর বসে একটা কাঠশালিক তার সঙ্গীকে খোঁজে। মফস্বলের মানুষেরাও কি আজকাল চিঠি লিখতে, ভালোবাসতে ভুলে গেল? হারমোনিয়ামের ওপর হুট করে উড়ে এসে বসা প্রজাপতি, ফুটফাট গায়ের রংবেরঙের বেলুন, বিদ্যাপতি স্কুলের দপ্তরির ঢং ঢং আওয়াজের ঘণ্টা, মেহগনি শিরীষের লালচে হওয়া পাতা, বায়ু বুদ্বুদশূন্য জল, ভিড়ের মধ্যেও শুনতে না পাওয়া কোলাহল, সদ্যভোরে নতুন বউয়ের ফুলেফেঁপে থাকা চওড়া পাড় লালশাড়ি, সহজ শিশুর কুসুমে লেপ্টানো ঠোঁট, বেণির গোলাপিরঙা কাঞ্চন ফুল ... সবকিছুর কসম ... সবকিছুর ... মফস্বল শহরের সব ভালোবাসা আমি একাই বুকে নিয়ে ঘুরছি, আমার কারুকাজ করা সরিষারঙা শালটায় যত্ন করে মুড়ে ... শুধু তোমার জন্য।
ইতি,
আমি
পরদিন রাতে হাবিব চিঠি লিখতে বসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের খামখেয়ালি সুন্দরী ছাত্রী রেবুর জন্য। রেবুর শালের ভাঁজে ভাঁজে যত্ন করে যে ভালোবাসা রাখা তা এবার ভাঁজ খুলে দেখা হয়, রোদে ওম পায়, শেষ বিকেলের নরম আলোয় ভাঁজ করে রাখা হয় যত্নে, আবার পরদিন খোলা হয় নতুন করে। ভালোবাসার এই রূপ কেউই কখনও আগে দেখেনি ভদ্রাবতীর পাড়ে, একসাথে হাঁটার সময়।
মাঝখানে হাবিব বাড়িতে আসে কিন্তু সে সময় রেবু আসতে পারেনি পরীক্ষার ব্যস্ততায়। কিন্তু সেবার হলে ফেরার ক’দিন পরেই পায় রেবুর চিঠি। রেবুরা ডিপার্টমেন্টের সবাই মিলে গিয়েছে সমুদ্র দেখতে। সেখান থেকেই রেবু তাকে চিঠি লিখেছে।
প্রিয়তমেষু,
জানো তো, আমাদের বহু বছর ধরে আগলে রাখা লালচে হওয়া দলিল দস্তাবেজ, মূল্যবান কাঞ্চিভরম শাড়ি, সোনার অনন্তবালা, শোকেসে সাজানো সুদৃশ্য টিপট সব ছেড়েছুড়ে চলে এসেছি। আমি জীবন নিয়ে খুব ভাবছি ইদানীং, ভাবতে ভালো লাগছে।
সমুদ্রের পাড়ে জোড়াতালি দেওয়া নৌকোতে জংলি ছাপার শাড়ি, সস্তা মালা পরে বসে আছি। নরম আঙুলের ডগায় বালুতে বারবার নিজের নামটা লিখছি, সকাল বিকেল।
সরযূবালার মিহি সুতোর কারুকাজ করা দেয়ালচিত্র কিংবা শিশুর রং পেন্সিলে আকা সূর্যাস্তের ছবির মতো, তুমিও একদিন গ্রহ নক্ষত্রের হিসেব ছাড়াই চলে এসো।
আমি তো তোমার অপেক্ষায় আছি। শুরু হোক সমুদ্র উপাখ্যান। নোনাজল, তুমি আমি আর আমাদের, শুধু আমাদের মায়াগল্প।
ইতি,
আমি
হাবিব বরাবরের মতোই সারারাত সেই চিঠি পড়ল। দাড়ি, কমা, সেমিকোলন সব মুখস্থ করে ফেলল। ছয় মাস পরে যখন তাদের দেখা হলো, হাবিবের মনে হলো ঢাকার জল হাওয়া লেগে, হলের খাবার খেয়ে রেবু কিছুটা রোগা হয়েছে কিন্তু তাকে আরও সুন্দর লাগছে। হাবিব খুব অস্বস্তিতে ভোগে এই রূপ, এই রেবুকে দেখে। সেবার ভদ্রাবতী নদীর পাড়ের জল আগের মতোই রয়ে গেল ঠিকই কিন্তু তাদের প্রেম আরও গভীর, আরও পরিণত হলো। বুড়ি বটগাছের এক ডাইনিও উষ্ণ নিঃশ্বাসের দুটি মানুষের কাছে আসার ছায়ার দিকে তাকিয়ে খিলখিলিয়ে হেসে বলল– “তা বেশ বেশ।”
কয়েক বছর পরের কথা। সেবার ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে শীত এত বেশি যে কেউ খুব প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের হয় না, এত কুয়াশা যে এক হাত দূরের মানুষকে চিনতেও কষ্ট হয়। হাবিব আর রেবুকেও এ সময় দেখা যায় ভদ্রাবতীর পাড়ে। হাবিবের মাথায়, গলায় খয়েরিরঙা মাফলার, পুরো শরীর একগাদা শীতের কাপড় দিয়ে মোড়া তবুও সে হাঁচি দিচ্ছে একটু পরপর। পাশে বসা রেবু নীরবতা ভেঙে বলে উঠল– “আমি এখানকার পড়া শেষ করে আমি লন্ডনে পড়তে যাওয়ার কথা ভাবছি। সামনেই তো ফাইনাল পরীক্ষা। এখনই বিয়ের কথা কিছু ভাবছি না। আর তুমিও সরকারি চাকরির কথা ভাবো। এখন থেকেই প্রস্তুতি নাও। মিথ্যে আশা বা সান্ত্বনা দিয়ে তো কিছু হয় না। আমি আমার ঢাকার বন্ধুদের দেখেছি ওরা কত সামনে চিন্তা করে। তুমিও ঢাকায় চলে এসো। মফস্বলে পড়ে থেকো না, শুধু পিছিয়েই পড়বে।” হাবিবের হাঁচি দেওয়া নিজের অজান্তেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সে সেদিনও অবাক হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের এক সুন্দরী ছাত্রীকে দেখছিল। তবে এবার সেই ছাত্রীর নাম “রেবু” নয়, নাম– “রেবা আনসারী”
এরপরে ভদ্রাবতী নদীর পাড়ে আর কখনও তাদের একসাথে দেখা যায়নি। হাবিবের কখনও মনে হয়েছে নদীর পাড়টাকে খোলা ময়দান যেখানে ঘোড়ার খুরের আঘাতে শুধু ধূলিকণাই নয়, মানুষের ভিতরও ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। এ শহরে সেই মত্ত ঘোড়াকে কশে লাগাম দেওয়ার কেউ নেই। যে শহরে হাবিবের মতো কারও পকেটে যে মুঠোভরা ভালোবাসা, তা দেখার কেউ থাকে না। আবার সেই একই মফস্বল শহরের আদুরে রেবু, ঢাকায় যেয়ে হয়ে যায় পুরোদস্তুর রেবা আনসারী, এরপর লন্ডনে যেয়ে হয় ব্যারিস্টার রেবা আনসারী ... যে ভালোবাসাকে খান খান করে ভেঙে দেখে শুধুই ভালো একটা বাসা, দালান হিসেবে। কাকে কী বলবে সে?
ভদ্রাবতীর জল কিছু হয়তো, মিথ্যে নয়তো হাবিবকে বোঝে। সে আগের মতোই পড়া শেষ করে এসে একা হাঁটে। শীতের অবেলায় কারও শালের ভাঁজে, কারুকাজে ভালোবাসা মনে করে। শুধু এই নদীর পাড়টার আকাশ কখন গোলাপি কাঞ্চন ফুলরঙা মনে হয়। একসময় হাবিবের সরকারি ব্যাংকে চাকরি হয়। এখানকারই একটা শাখায়। পরিবার থেকে বিয়ে দেয় জোর করে। মেয়ে শ্যামলা, মাঝারি উচ্চতা, রোজা নামাজ করা মেয়ে। ও তো উচ্চশিক্ষিত না, এসএসসি পাস। ফ্যামিলি প্ল্যানিংয়ে তৃতীয় শ্রেণির চাকরি হওয়ার কথা প্রায় ঠিক। সবকিছুর ওপর হাবিবের বাবার মেয়েটাকে খুব সংসারি মনে হয়েছে। বিয়ের ব্যাপারে হাবিব একটা কথাও বলেনি, সে স্মৃতি নিয়ে বাঁচতে চায় বাকিটা জীবন। সংসার করা দরকার, তাই করবে। কে পাশে এলো না এলো, এটা ব্যাপার না। তার বারবারই মনে হয়, রেবুর কোনো দোষ ছিল না, ভালোবাসায় কোনো ভেজাল ছিল না। সব দোষ, ভেজাল তারই। একজন পুরুষ হয়ে সে কেন রেবুর সাথে সাহস করে এগিয়ে যেতে পারল না। রেবুর মতো সুন্দরী, স্মার্ট, উচ্চশিক্ষিত মেয়ের জন্য ছেলেরা কত কি করে! আর সে কী করেছে? কিছুই না। রেবু তো তাকে টেনেই তুলতে চেয়েছে বারবার। দীর্ঘ দাম্পত্য জীবনে হাবিব তার স্ত্রী দিলরুবা খানমকে কখনও ভালোবাসতে পারেনি, কোথায় যেন বেহুলা-লখিন্দরের বাসরঘরের মতো একটা সূক্ষ্ম ছিদ্র থেকেই গেল। তিনটে ছেলেমেয়ে হলো। স্ত্রীকে উনি বিয়ের প্রথমরাতেই রেবুর কথা বলেছিলেন। এরপর তিন ছেলেমেয়েও একসময় অদেখা রেবু আন্টিকে চিনতে শুরু করল। মেজো মেয়ে শম্পা বড় হবার পর, তার বাবা আর রেবু আন্টির প্রেমের চিঠিগুলো দেখত এক সুন্দর সাহিত্যকর্ম হিসেবে। আর হাবিবের স্ত্রী এসব পাত্তা না দিয়ে ছেলেমেয়েকে বড় করা, বাড়িঘর, চাকরিতে ব্যস্ত ছিল পুরোটা সময়।
ক্যাটকেটে নীলরঙা বার্মিজ শাল গায়ে দিলরুবা খানম চিঠিগুলো নিয়ে উঠোনের সিমেন্ট বাঁধানো অংশে কাঠের জলচৌকি নিয়ে বসা। একটু দূরেই এ বাড়ির ঝি আজিজুলের মা দুই চুলোয় ভাত আর মাছের ঝোল বসিয়েছে। দিলরুবার দৃষ্টি ভাত তরকারির দিকে না, লালরঙা উত্তপ্ত আগুনের দিকে। হাতে ধরে থাকা চিঠিগুলো এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় বোঝা মনে হতে থাকে। যত বোঝা তার দীর্ঘ একত্রিশ বছরের সংসার জীবন, তিনটা বাচ্চা সামাল দেওয়াও মনে হয়নি। এই বোঝা ঝেড়ে ফেলবার সময় এসেছে, এত বছর যা চেষ্টা করেও পারেননি। উনি উঠতে যাওয়ার প্রস্তুতি নেন, একটু অদূরে চুলোর লাল আগুন পর্যন্ত, ব্যস। কিন্তু হায়, গতিজড়তার চেয়ে স্থিতিজড়তা এই মুহূর্তে এগিয়ে থাকে। ওনার চোখ এই প্রথম ভেজা দেখা যায় স্বামী হাবিবুর রহমানের প্রাণপ্রিয় চিঠিগুলোর জন্য, যা বছরের পর বছর ওনার সংসারে নীরবে সহাবস্থান করছিল, কখনও রেবা আনসারী যার সংক্ষিপ্ত আদুরে নাম “রেবু” ওনাকে, বাচ্চাদের ছাড়িয়ে বিশেষ একটা গুরুত্বপূর্ণ সম্মানের জায়গা দখল করে নিয়েছে এই সংসারে, তাকেই-বা উনি অস্বীকার করবেন কীভাবে? উনি উঠতে যেয়েও উঠতে পারেন না চৌকি থেকে কিন্তু ওনাকে তো পারতেই হবে। ভারী শরীরটা নিয়ে আর্থ্রাইটিসের ব্যাথায় না, ওনার বুকে তীব্র ব্যথা হয়, উনিও কি ওনার স্বামীর মতো মারা যাচ্ছেন? ওনার মুখ কুঁচকে যায় ব্যথায়, স্বামী মারা যাওয়ার পর ওনার রক্তচোখের কোণ দিয়ে এই প্রথম পানি বেয়ে পড়তে দেখা যায়, ঠিক যেমন কচি সবুজরঙা পেঁপের গায়ে ধারালো কিছু দিয়ে চিড়ে দিলে দুধসাদা কষ বেরোয়। অদূরের আগুন ঝাপসা লালরঙা এক ঘোর তৈরি করে। এই মুহূর্তে তাকে আর আগুন মনে হচ্ছে না, মনে হচ্ছে লালরঙা ঘুড়ি, যে কোনো মুহূর্তেই আকাশে উড়বে, দিলরুবারও ঘুড়ির সাথে উড়ে চলে যেতে মন চাচ্ছে। যে আকাশে রেবা আনসারীর চিঠি নেই, শুধুই দিলরুবার নিজস্ব ভালোবাসার অক্ষর ভেসে বেড়ায় ... উনি জীবনে এই প্রথমবার স্বামী হাবিবুর রহমানকে চিঠি লেখেন ... বিড়বিড় করে একই বাক্য প্রতিবার– “প্রিয় টুম্পা, শম্পা, রুবাইয়ের আব্বা-আমি, আমরা সবাই তোমারে অনেক ভালো পাই।”
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: হ ব ব র রহম ন এই ম হ র ত নদ র প ড় র জন য স ন দর পর ক ষ আনস র
এছাড়াও পড়ুন:
ভিসা জটিলতা নিরসনে ব্যবস্থা নিতে ইতালির প্রতি আহ্বান
বাংলাদেশি কর্মীদের ভিসা আবেদন নিষ্পত্তির যথাযথ ব্যবস্থা নিতে এবং বিদ্যমান ভিসা জটিলতা দ্রুত সমাধানে ইতালির দূতাবাসকে অনুরোধ করেছে ঢাকা।
বুধবার (১৯ মার্চ) পররাষ্ট্র সচিব মো. জসিম উদ্দিনের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ইতালির রাষ্ট্রদূত আন্তোনিও আলেসান্দ্রো। ওই সময় এ বিষয়ে উদ্বেগ পুনর্ব্যক্ত করে সচিব এ আহ্বান জানান।
পরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা বলা হয়েছে।
আলোচনাকালে পররাষ্ট্র সচিব ভিসা আবেদনের বিশেষ করে অভিবাসী কর্মীদের আটকে থাকা ভিসার বিষয়টি উত্থাপন করেন।
তিনি আরো বলেন, “ভিসা প্রদানে এই ধরনের বিলম্বের ফলে ওয়ার্ক পারমিট (নুলা ওস্তাস) মেয়াদোত্তীর্ণ বা বাতিল হতে পারে। এতে ভিসা প্রার্থী ও তাদের পরিবারের উপর বিশাল আর্থিক, সামাজিক ও মানসিক চাপ সৃষ্টি হতে পারে।”
রাষ্ট্রদূত আলেসান্দ্রো এই বিষয়টি সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করছেন বলে প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।
তিনি আরও জানান, গত বছরের ২২ অক্টোবর পর্যন্ত বাংলাদেশি নাগরিকদের দেওয়া সকল লুল্লা ওস্তাস বর্তমানে ইতালিয় সরকারের নতুন আইনের অধীনে স্থগিত রয়েছে।
রাষ্ট্রদূত বলেন, “আইনটি গৃহীত হওয়ার আগে যারা ইতিমধ্যেই ভিসা আবেদন জমা দিয়েছেন তাদের ভ্রমণ নথি ফেরত দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।”
রাষ্ট্রদূত আরও জানান যে, লুল্লা ওস্তার পুনঃপরীক্ষা প্রক্রিয়া কেবল ইতালির প্রাদেশিক অভিবাসন কর্তৃপক্ষ দ্বারা পরিচালিত হয়, যারা লুল্লা ওস্তা নিশ্চিত বা বাতিল করতে পারে।
তিনি আরো বলেন, “মুলতুবি থাকা লুল্লা ওস্তার যাচাই-বাছাইয়ে হস্তক্ষেপ করার কোনও ক্ষমতা দূতাবাসের নেই।”
প্রক্রিয়াকরণের সময় সম্পর্কে একটি প্রশ্নের বিষয়ে, ইতালিয় রাষ্ট্রদূত ব্যাখ্যা দিয়েছেন যে, দূতাবাস ৯০ দিনের মধ্যে প্রতিটি ভিসা প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার অবস্থানে নেই।
বাংলাদেশে গৃহীত কাজের ভিসা আবেদন এবং ইতালিতে ‘ফ্লো ডিক্রি’ বাস্তবায়নের বাধ্যতামূলক নিয়ন্ত্রণের জন্য কখনও কখনও ৯০ দিনেরও বেশি সময় লাগে।
“লুল্লা ওস্তা”-এর মেয়াদ সম্পর্কে রাষ্ট্রদূত আলেসান্দ্রো বলেছেন, “আইনত স্থগিতাদেশের ফলে মেয়াদ শেষ হওয়ার তারিখ হিমায়িত অবস্থায় রয়েছে।”
রাষ্ট্রদূত আলেসান্দ্রো পররাষ্ট্র সচিবকে আশ্বস্ত করেছেন, তিনি ইতালির উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের কাছে মুলতবি থাকা লুল্লা ওস্তাসের পুনঃপরীক্ষা দ্রুত করার এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সমস্যাটির সমাধানের অনুরোধ পৌঁছে দেবেন।
ঢাকা/হাসান/ইভা