‘পৃথিবীটা অপরূপ। তবু তার মুগ্ধ তরুতলে।
দোতারা বাজায় বসে কেউ কেউ—উদাসী বাউল।
রাখে সে চরণচিহ্ন দীপ্তিময় তারকার ফুল
দিতে এসে কান্নাভেজা শরতের নিশি শেষ হলে—
ক্লান্ত হাতে উষাকালে রাধিকার ছড়ানো আঁচলে,
স্মৃতির অরণ্যে কিছু রেখে যায় শেফালি বকুল,
ভাদরের ভরানদী ভাঙে যার হৃদয়ের কূল;
অশ্রু তার টলমল তৃণে তৃণে শিশিরের জলে।’
[একটি জিজ্ঞাসা]
‘বিবাগী বসন্ত বাউল যৌবন’ সনেটগ্রন্থের উপর্যুক্ত সনেটটি যখন লেখা হয়, সে সময়টি ছিল ৩ অক্টোবর ১৯৬৮। বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকের শেষাংশে আত্মপ্রকাশ করা কবি আতাউল হক সিদ্দিকী। গ্রন্থভুক্ত হওয়ার আগে সনেটটির শিরোনাম ছিল, ‘একটি জিজ্ঞাসা : তোমার সমীপে’। সনেটটি রচিত হয়েছিল নওগাঁ ডিগ্রি কলেজ বার্ষিকী শাহাদৎ হোসায়েন স্মৃতি সংখ্যায়, মরহুম শাহাদাৎ হোসায়েন স্মরণে। সনেটের দুটি অংশ, অষ্টক এবং ষষ্ঠক। অষ্টক অংশে যেমন কবি পৃথিবীর রূপ-রস-সৌন্দর্যের বর্ণনার মধ্য দিয়ে সূচনা করেছেন, তেমনি ষষ্ঠক অংশে নিয়ম মেনেই সেই রূপ-রস-গন্ধ ও সৌন্দর্য ছেড়ে যাবার বেদনাকে প্রতিভাত করেছেন। ষষ্ঠক অংশে তিনি বলেন, ‘পৃথিবীতে ডানা মেলে দগ্ধ ওরা শ্বেত পারাবত,/ নাগিনী সোহাগীরাত তাহাদের-ফাগুনে আগুন/ ব্যাপ্ত হলে কাছে টানে মরণের চিরচেনা পথ।/ মধুমাসে তারা তাই বুকে নিয়ে তৃষ্ণা নিদারুণ/ করুণার তীর ছুঁয়ে বিস্তৃতির সমুদ্রে মিলায়—/ তুমি কি তেমনিভাবে অসময়ে নিয়েছ বিদায়?’ এই পাঠককে সম্মোহিত করে অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তৈরি উপাখ্যান, তাতে যদিও জীবনানন্দীয় আবহ বিদ্যমান, তবুও তার নিজস্বতা, একরাশ ভাবের মুখোমুখি হতে হয় পাঠককে। উন্মোচিত হতে থাকে উপলব্ধির জগৎকে প্রসারিত করে লুকানো বিরহগাথা।
সনেটের স্মরণীয় এবং পূজনীয় ইতালিয়ান কবি পেত্রার্ক এবং ইংরেজ কবি উইলিয়াম শেক্সপিয়র। পেত্রার্ককে বলা হয় সনেটের জনক। অন্যদিকে শেক্সপিয়র সনেট লিখেছেন, তাতে তিনি পেত্রার্কের ফর্ম অনুসরণ করেননি। ফলে অন্যান্য ভাষার কবিরা যখন সনেট রচনায় মনোযোগ দেন, তখন সচেতন দুটো ধারা দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। বাংলা ভাষার সঙ্গে পেত্রার্কের রীতি অনুসরণ করেই সনেটের প্রথম পরিচয় করিয়েছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। পরবর্তী সময়ে বাংলা ভাষার প্রথিতযথা কবিরা তো বটেই, অন্য কবিরাও সনেট রচনায় মনোযোগ দিয়েছেন। বাংলা ভাষাতেও লেখা হয়েছে অনবদ্য সনেট। সনেটের বিষয়ের ক্ষেত্রে দেশপ্রেমকে যেমন প্রাধান্য দেওয়া হয়, তেমনি ব্যক্তি বন্দনাও। কবি আতাউল হক সিদ্দিকী, বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকের শেষার্ধে শুরু যখন কাব্য সাধনায় নিজের অস্তিত্ব মিশিয়ে দিতে থাকেন, তখন অন্যদের সঙ্গে তাঁর বড় পার্থক্য হয়ে দাঁড়ায় সনেট রচনার ধারা। সবাই নানা ছন্দের কবিতা লেখার পর সনেট রচনায় হাত দেন, তখন আতাউল হক সিদ্দিকী কাব্যচর্চার সূচনাই সনেটের হাত ধরে।
১৯৬৮ সালে কলেজ বার্ষিকীতে প্রথম লেখা প্রকাশের পর তাঁর সনেটগুলো প্রথম গ্রন্থভুক্ত হয় ১৯৯৮ সালে। ‘বিবাগী বসন্ত বাউল যৌবন’ শিরোনামের সনেটগ্রন্থের পর একে একে প্রকাশ পেয়েছে, ‘আমি সেই লোক’, ‘উড়ে যায় মরমি পাখি’, ‘বেপথু কীর্তনীয়া’, ‘বরেন্দ্র বাউল’। পরে এই পাঁচটি সনেটগ্রন্থ নিয়ে সনেট সমগ্র। এরপর প্রকাশিত ‘সেই ডাকে’ সনেটগ্রন্থটিসহ আগের পাঁচটি গ্রন্থকে ‘সনেট সমগ্র’ নামে দুই মলাটের মধ্যে এনেছে কথাপ্রকাশ।
গত ছয় দশকে আতাউল হক সিদ্দিকী নেট রচনা থেকে নিজেকে সরিয়ে নেননি। বরং সনেটকেই নিজেকে প্রকাশের বড় মাধ্যম করেছেন। সনেট রচনায় আতাউল হক সিদ্দিকীর পারঙ্গমতা ঈর্ষণীয়। এ ক্ষেত্রে তিনি শুধু পেত্রার্ককেই অনুসরণ করেননি, তিনি শেক্সপিয়রের রীতিতেও সনেট লিখেছেন। শুরু থেকেই দুটো ধারা তিনি সচেতনভাবে লালন করেছেন, প্রকাশ করেছেন। ৮ ও ৬ পঙ্ক্তির যে বিন্যাস, ভাবের যে বিস্তার প্রথম ৮ পঙ্ক্তিতে এবং শেষের ৬ পঙ্ক্তিতে সিদ্ধান্ত জানানোর যে পেত্রার্কীয় রীতি তা যেমন তিনি অনুসরণ করেছেন। তেমনি ৪, ৪, ৪, ২ পঙ্ক্তির বিন্যাসের শেক্সপিয়রীয় রীতিকেও অনুসরণ করেছেন। কোথাও তাঁর সপ্রতিভতার ঘাটতি নেই। সনেটের বিষয় নির্বাচনের ক্ষেত্রেও তাঁর দক্ষতা। সনেটের যে গতি, তা তিনি অনুসরণ করেন। আতাউল হক সিদ্দিকী সনেট রচনার ধারায় আধুনিক। তিনি শব্দ বাছাইয়ে যেমন, তেমনি বিষয়ের ক্ষেত্রেও নিপুণতার ছাপ রেখেছেন। সতত সঞ্চরণশীল কবি আতাউল হক সিদ্দিকী, তাঁর গাঢ় উপলব্ধির যে সহজাত প্রকাশ সনেটের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন, তা বাংলা সনেটের ধারাকেই শুধু সমৃদ্ধ করেনি, পাঠককেও তৃপ্তি দিতে সক্ষম।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: বই উৎসব কর ছ ন প রথম
এছাড়াও পড়ুন:
মঙ্গল গ্রহকে বসবাসের উপযোগী করতে অভিনব প্রস্তাব
লাল গ্রহ মঙ্গল নিয়ে মানুষের মাতামাতি থেমে নেই। মঙ্গল গ্রহের মাটিতে পারক্লোরেট রয়েছে, যা সাধারণভাবে মানুষ বা অন্য সব প্রাণের জন্য ক্ষতিকর। কীভাবে মানুষ মঙ্গল গ্রহকে প্রাণ ধারণের উপযোগী করা যায়, তা নিয়ে নানা পরীক্ষা করছেন বিজ্ঞানীরা। মঙ্গল গ্রহকে বসবাসের উপযোগী করার নানা উপায় নিয়ে অসংখ্য তত্ত্ব রয়েছে। অনেক বিজ্ঞানী অ্যান্টার্কটিক মরুভূমির মস বা লাইকেনের মতো উদ্ভিদ ব্যবহারের প্রস্তাব করেছেন। এসব উদ্ভিদ মঙ্গলের কঠিন পরিস্থিতি সহ্য করতে পারে বলে ধারণা করা হয়।
আরও পড়ুনমঙ্গল গ্রহে থাকা অদ্ভুত কাঠামো কি প্রাচীন সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ০৮ এপ্রিল ২০২৫সম্প্রতি পোলিশ একাডেমি অব সায়েন্সেসের বিজ্ঞানী লেজেক চেকভস্কি মঙ্গল গ্রহকে প্রাণের উপযোগী করতে অভিনব এক প্রস্তাব দিয়েছেন। মঙ্গল গ্রহকে বসবাসের উপযোগী করতে বিভিন্ন গ্রহাণু দিয়ে আঘাত করার কথা বলেছেন তিনি। তাঁর মতে, মঙ্গল গ্রহের মাটি পারক্লোরেট পূর্ণ বলে প্রাণের জন্য ক্ষতিকর। গ্রহের নিম্ন বায়ুমণ্ডলীয় চাপ মানুষের শরীরের জলীয় অংশকে দ্রুত শুকিয়ে ফেলবে। তাই মঙ্গল গ্রহে গ্রহাণু বিধ্বস্ত করার মাধ্যমে প্রাণের উপযোগী করে তোলার একটি পরিকল্পনা করেছেন তিনি।
লেজেক চেকভস্কির তথ্যমতে, মঙ্গল গ্রহের বায়ুমণ্ডল কার্বন ডাই-অক্সাইড দিয়ে গঠিত বলে স্বাভাবিক জীবনধারণের জন্য উপযুক্ত নয়। তবে হিমায়িত কোনো গ্রহাণুর আঘাতে গ্রহটির পরিবেশ বদলে যেতে পারে। গ্রহাণুর আঘাতে বায়ুমণ্ডল তৈরি হলে সেখানে সহায়ক গ্যাস নির্গত হতে পারে।
সূত্র: এনডিটিভি
আরও পড়ুনমঙ্গল গ্রহে স্পেসএক্সের রকেট পাঠানোর সম্ভাব্য সময় জানালেন ইলন মাস্ক১০ এপ্রিল ২০২৫