রবার্ট ক্লিটগার্ড (১৯৮৮) দুর্নীতির সর্বাধিক স্বীকৃত সংজ্ঞাটি প্রদান করেছেন। তাঁর মতে, ‘দুর্নীতি হলো ব্যক্তিগত লাভের জন্য রাষ্ট্রীয় পদের অপব্যবহার।’ দুর্নীতির বিভিন্ন রূপের মধ্যে ঘুষ, চাঁদাবাজি, কমিশন, রেন্ট-সিকিং, তহবিল আত্মসাৎ, পৃষ্ঠপোষকতা, স্বজনপ্রীতি, গোষ্ঠীপ্রীতি, পক্ষপাতিত্ব ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত। বিশেষভাবে রাজনৈতিক অনুদানকেও রেন্ট-সিকিং তথা অন্যায়ভাবে রাষ্ট্রীয় সুবিধা লাভের জন্য ঘুষ প্রদানের চেষ্টা বৈ আর কিছুই নয়।

ঠিক একই সুরে খ্যাতনামা বাংলাদেশি অর্থনীতিবিদ প্রফেসর মুশতাক খান তাঁর বিখ্যাত ‘ডিটারমিন্যান্টস অব করাপশন.

..’ বইয়ে যুক্তি দেন, লবিং ও রাজনৈতিক অনুদানও রেন্ট-সিকিং আচরণের অংশ।

এই প্রবণতা বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেখা যায়। এর মধ্যে নোবেল পুরস্কারের মতো মর্যাদাপূর্ণ সম্মান অর্জনের প্রচেষ্টাও অন্তর্ভুক্ত। এটি সর্বজনবিদিত যে কিছু ব্যক্তি এ ধরনের সম্মান লাভের সম্ভাবনা বাড়ানোর জন্য লবিস্ট নিয়োগ করেন, যাতে তাঁরা বিশাল অর্থ ব্যয় করেন। যখন কোনো ব্যক্তি এ ধরনের পন্থা গ্রহণ করেন, তাঁরা শুধু ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করেন না, বরং সামগ্রিকভাবে সমাজে দুর্নীতির বিস্তারেও ভূমিকা রাখেন।

বাংলাদেশে রাজনীতির, ব্যবসার এবং প্রভাব খাটানোর সংস্কৃতি একটি উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। এটা এখন সবারই জানা, যাঁরা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও বিপুল আর্থিক সম্পদের অধিকারী, তাঁরা বাইরের শক্তির সাহায্যে প্রচলিত আখ্যান পরিবর্তন করতে, রাজনৈতিক আন্দোলন গঠন করতে এবং এমনকি রাষ্ট্রের উচ্চ পদ কুক্ষিগত করতেও সক্ষম। শক্তিশালী দেশের শক্তিশালী ব্যক্তি বা এজেন্সির সঙ্গে লবিংই এখন মনে হচ্ছে ‘সকল ক্ষমতা উৎস’।

আন্তর্জাতিক খ্যাতি গড়া এবং সম্মান অর্জনের জন্য লবিস্ট নিয়োগের এ প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন ধরেই অভিজাতদের একটি অস্ত্র, যেখানে পর্দার আড়ালে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষেত্রেও একই চর্চা আমরা দেখে আসছি। নবগঠিত দল নিয়েও একই আলোচনা তৈরি হয়েছে। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো সবাই নিজেদের গণতন্ত্রের রক্ষক হিসেবে উপস্থাপন করে, অথচ দুর্নীতিকে টিকিয়ে রাখার জন্য ব্যবহৃত একই পন্থার ওপর নির্ভর করে, তখন তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলা জরুরি।

উন্নত দেশগুলো ও তাদের সমন্বয়ে গঠিত সংস্থা উন্নয়নশীল দেশকে দুর্নীতি বিষয়ে জ্ঞান দিয়ে থাকে, কিন্তু তাদের দেশেই দুর্নীতির প্রধান প্রধান উপসর্গ বিদ্যমান। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক প্রচারণার অর্থায়ন করপোরেট অনুদানের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। ফলে এমন একটি ব্যবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো নির্বাচিত কর্মকর্তাদের ওপর বিশাল প্রভাব বিস্তার করে। প্রেসিডেন্ট বা অন্য যেকোনো সরকারি পদপ্রার্থী মূলত বড় করপোরেশন, বিলিয়নিয়ার এবং বিশেষ স্বার্থগোষ্ঠীগুলোর আর্থিক অনুদানের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল।

এসব অনুদান কেবল উদারতার বহিঃপ্রকাশ নয়, বরং এগুলো একটি কৌশলগত বিনিয়োগ, যা রাজনৈতিক সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য প্রদান করা হয়। এমনকি নির্বাচনী সময়সীমার বাইরেও করপোরেশনগুলো রাজনৈতিক দলগুলোতে অর্থ ঢালতে থাকে, যাতে ক্ষমতায় গেলে রাজনীতিবিদেরা জনকল্যাণের চেয়ে করপোরেট স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়।

করপোরেট অনুদানের প্রভাব অনেক মার্কিন প্রেসিডেন্টের নীতিতে স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, বারাক ওবামা, যিনি তাঁর প্রচারণায় ওয়াল স্ট্রিটের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তিনি গোল্ডম্যান স্যাক্স ও জেপি মরগান চেজের মতো বৃহৎ ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে উল্লেখযোগ্য আর্থিক সহায়তা পেয়েছিলেন। আর্থিক সংস্কারের বিষয়ে তাঁর বক্তব্য সত্ত্বেও তাঁর প্রশাসন ২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের সময় ওয়াল স্ট্রিটকে বেইলআউট দিয়েছিল, যখন লাখ লাখ আমেরিকান তাঁদের বাড়িঘর হারিয়েছিলেন।

বড় বড় ব্যবসায়ী বা করপোরেট কোম্পানিগুলোর চাঁদা বা অনুদান নিয়ে যদি রাজনৈতিক দলগুলোকে চলতে হয় তাহলে বুঝতে হবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির মৌলিক কাঠামো অপরিবর্তিত রয়ে গেছে। পৃষ্ঠপোষকতার যে চক্রটি করপোরেট অভিজাতদের কৌশলগত অনুদানের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণের সুযোগ দেয়, তা কোনো বাধা ছাড়াই অব্যাহত রয়েছে। রাজনৈতিক অনুদান এখন আর সদিচ্ছা বা গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণের মাধ্যম নয়, বরং এটি প্রভাব কেনাবেচার হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে, যা ক্ষমতাকে কিছু নির্দিষ্ট প্রভাবশালী গোষ্ঠীর হাতেই সীমাবদ্ধ রাখে।

ডোনাল্ড ট্রাম্প, যিনি নিজেকে একজন জনগণের নেতা ও বহিরাগত রাজনীতিক হিসেবে উপস্থাপন করেছিলেন, তিনি জীবাশ্ম জ্বালানি কোম্পানি, বৃহৎ ওষুধ নির্মাতা সংস্থাগুলোসহ করপোরেট দাতাদের কাছ থেকে কোটি কোটি ডলার সংগ্রহ করেছিলেন। এর প্রতিদানে তার প্রশাসন পরিবেশগত বিধিনিষেধ শিথিল করে এবং এমন কর হ্রাস কার্যকর করে, যা মূলত বড় করপোরেশনগুলোরই সবচেয়ে বেশি লাভবান করেছে।

জো বাইডেনের প্রচারণার বড় অংশ অর্থায়ন করেছিল গুগল ও মাইক্রোসফটের মতো প্রযুক্তি জায়ান্টরা, পাশাপাশি ওষুধ ও স্বাস্থ্যসেবা খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো। মোটেই আশ্চর্যের কিছু নয় যে তাঁর প্রশাসন বিগ টেকের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ ও ওষুধের মূল্য সংস্কারের বিষয়ে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপে ধীরগতিতে অগ্রসর হয়েছে।

এই প্রবণতা সাম্প্রতিক প্রেসিডেন্টদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, জর্জ ডব্লিউ বুশের প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় হলিবার্টনের মতো প্রতিরক্ষা ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অনুদান এসেছিল, যা পরবর্তীকালে ইরাক যুদ্ধে লাভজনক সরকারি চুক্তি অর্জন করেছিল।

আরও পড়ুনকোন দল কোথা থেকে টাকা পাচ্ছে, কেন পাচ্ছে?১২ মার্চ ২০২৫

বিল ক্লিনটনের প্রশাসন আর্থিক খাতের দাতাদের কাছ থেকে সুবিধা পেয়েছিল। ফলে গ্লাস-স্টিগল অ্যাক্ট বাতিলের পথ প্রশস্ত হয়েছিল। এটি ব্যাংকিং খাতের নিয়ন্ত্রণ শিথিল করেছিল এবং ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। এমনকি রোনাল্ড রিগ্যান, যিনি মুক্তবাজার নীতির জন্য প্রশংসিত হন, তিনিও বড় করপোরেট স্বার্থের দ্বারা সমর্থিত ছিলেন, যা তাঁর বৈষম্যমূলক কর হ্রাস ও শ্রমিক ইউনিয়ন দমন নীতির মাধ্যমে ব্যাপকভাবে লাভবান হয়েছিল।

এই করপোরেট প্রভাবের চক্র গণতন্ত্রকে বিকৃত করে, যেখানে নির্বাচিত কর্মকর্তারা জনগণের প্রতিনিধির পরিবর্তে কার্যত করপোরেট আমেরিকার স্বার্থরক্ষকের ভূমিকায় পরিণত হন। যখন করপোরেশনগুলো রাজনৈতিক প্রচারণার জন্য অর্থায়ন করে, তারা এর বিনিময়ে প্রতিদান আশা করে—হোক তা অনুকূল আইন প্রণয়ন, কর ছাড় কিংবা নিয়ন্ত্রণ শিথিলকরণের মাধ্যমে। এটি মূলত আইনি দুর্নীতি, যা গণতন্ত্রের মৌলিক নীতিগুলোকে দুর্বল করে দেয়।

সত্যিকারের রাজনৈতিক সংস্কারের জন্য এই চক্র ভাঙা জরুরি, যা কঠোর প্রচারণা অর্থায়ন আইন প্রয়োগ, করপোরেট অনুদান নিষিদ্ধকরণ এবং সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত নির্বাচন প্রচারের মাধ্যমে সম্ভব। এ ধরনের পদক্ষেপ ছাড়া মার্কিন রাজনৈতিক ব্যবস্থা ধনী অভিজাতদের খেলার মাঠ হিসেবেই রয়ে যাবে, যেখানে আইন জনগণের জন্য নয়, বরং তাদের জন্য তৈরি হয় যারা প্রভাব কিনতে সক্ষম।

বাংলাদেশে অর্থনীতি ও রাজনীতির বিষাক্ত মিশ্রণ বছরের পর বছর ধরে আরও গভীর হয়েছে। ফলে এমন একটি ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, যেখানে করপোরেট স্বার্থ রাজনৈতিক সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে। দশকের পর দশক ধরে বেক্সিমকো গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ, এস আলম গ্রুপের মতো শক্তিশালী ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য দেশের শাসনব্যবস্থার ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে। তারা শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলে, নিজেদের জন্য সুবিধাজনক নীতি, লাভজনক চুক্তি ও লাগামহীন অর্থনৈতিক আধিপত্য নিশ্চিত করেছে। শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসনামলে এই ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো আরও সমৃদ্ধ হয়েছে, সরকারকে জবাবদিহির বাইরে রাখতে সহায়তা করেছে এবং বিপুল আর্থিক সুবিধা ভোগ করেছে।

২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একটি পরিবর্তন আনবে, শুরু থেকে এটিই আমাদের প্রত্যাশা। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে সেই আশা ফিকে হয়ে আসছে যেন। অভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারীরা নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেছে। তাদের অর্থের জোগান নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। তা ছাড়া অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর অর্থায়ন নিয়ে আমাদের প্রশ্ন তো আছেই। কিন্তু আমরা সেই প্রশ্ন কখনো তুলিনি। একটি রাজনৈতিক দল কীভাবে চলবে, কে বা কারা কীভাবে তাদের অর্থ সহায়তা বা পৃষ্ঠপোষকতা দেবে—এসব নিয়ে আমাদের মধ্যে কোনো ভাবনাই নেই। এখন রাজনৈতিক দলগুলো যেভাবে চলে আসছে, এখনো যদি সেভাবে চলে এবং নতুন রাজনৈতিক দলও যদি সেই চর্চা নিজেদের যুক্ত করে, তাহলে পরিবর্তনের কী আশা করতে পারি আমরা?

বড় বড় ব্যবসায়ী বা করপোরেট কোম্পানিগুলোর চাঁদা বা অনুদান নিয়ে যদি রাজনৈতিক দলগুলোকে চলতে হয় তাহলে বুঝতে হবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির মৌলিক কাঠামো অপরিবর্তিত রয়ে গেছে। পৃষ্ঠপোষকতার যে চক্রটি করপোরেট অভিজাতদের কৌশলগত অনুদানের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণের সুযোগ দেয়, তা কোনো বাধা ছাড়াই অব্যাহত রয়েছে। রাজনৈতিক অনুদান এখন আর সদিচ্ছা বা গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণের মাধ্যম নয়, বরং এটি প্রভাব কেনাবেচার হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে, যা ক্ষমতাকে কিছু নির্দিষ্ট প্রভাবশালী গোষ্ঠীর হাতেই সীমাবদ্ধ রাখে।

বাংলাদেশের রাজনীতি যদি আর্থিক স্বার্থান্বেষণের কবল থেকে মুক্ত হতে চায়, তবে রাজনৈতিক অর্থায়নের স্বচ্ছতা, লবিংয়ের নৈতিকতা এবং পরিবর্তনের দাবিদারদের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে গভীর আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। এই বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণের বাইরে থাকলে ক্ষমতা, সুবিধাভোগিতা ও দুর্নীতির চক্র অব্যাহত থাকবে, যা সমাজের জন্য দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতিকর হয়ে উঠবে।

যদি রাজনৈতিক অর্থায়নে স্বচ্ছতার জন্য কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া না হয়, তবে গভীরতর সংস্কারের প্রতিশ্রুতি শুধুই একটি মরীচিকা হয়ে থাকবে। করপোরেট অনুদানের লাগাম টানতে এবং অর্থনৈতিক অভিজাতদের শাসনব্যবস্থার ওপর কর্তৃত্ব কমাতে কার্যকর বিধিনিষেধ ছাড়া বাংলাদেশ গণতন্ত্রের মুখোশ পরা একটি ধনিকতন্ত্রে পরিণত হওয়ার ঝুঁকিতে থেকে যাবে।

এন এন তরুণ অর্থনীতির অধ্যাপক, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ। সাউথ এশিয়া জার্নালের এডিটর অ্যাট লার্জ। [email protected]

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ল দ শ র র জন ত ক ন র জন ত ক র জন ত ক স গণতন ত র অন দ ন র আর থ ক স ব যবস থ চ ত কর কর ছ ল আম দ র র জন য ন কর ছ সরক র র ওপর ক ষমত

এছাড়াও পড়ুন:

গাজায় জাতিগত নিধনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে

মানবাধিকার, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী যারা, তাদের হাতেই ফিলিস্তিনে জাতিগত নিধন, স্বাধীনতা হরণ ও গণতন্ত্রের সমাধি রচিত হচ্ছে। এই প্রহসন যেন সভ্যতার সঙ্গে উপহাস। আসলে এরা বর্ণচোরা মুনাফিক। ১৯১৭ সালে ইংরেজরা ফিলিস্তিনে অনুপ্রবেশ করে ও ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে এবং ইহুদিরা ফিলিস্তিনে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করে। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা অন্যায়ভাবে মুসলমানদের ফিলিস্তিন ভূমিকে মুসলমান ও ইহুদিদের মধ্যে ভাগ করে দেয়। ১৯৪৮ সালের ১৫ মে বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে জায়নবাদী অবৈধ ইসরায়েল রাষ্ট্র ঘোষিত হয়। তখন থেকে মুসলমানদের প্রতি ইহুদিদের জুলুম, নির্যাতন ও অত্যাচারের মাত্রা বাড়তে থাকে, যা আজও চলছে।

১৯৬৭ সালে অবৈধ রাষ্ট্র ইসরায়েল ‘মসজিদুল আকসা’ জবরদখল করে। এর পর থেকে মুসলিম জনগণ স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ সূচনা করে। ১৯৭৯ সাল থেকে ‘আল–আকসা’ মসজিদ মুক্তির লক্ষ্যে সমগ্র মুসলিম উম্মাহ প্রতিবছর রমজান মাসের শেষ দশকের শুক্রবার ‘আল–কুদস’ দিবস পালন করে। তখন থেকে সারা বিশ্বে এ দিনটি ফিলিস্তিন মুক্তির ও বিশ্ব মুসলিম ঐক্যের প্রতীক রূপে পালিত হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে সম্মিলিতভাবে দৃঢ়রূপে ধারণ করো, আর পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না।’ (সুরা-৩, আল–ইমরান, আয়াত: ১০৩)

মুসলিম বিশ্বকে দাবিয়ে রাখার জন্য এবং মধ্যপ্রাচ্যের তেলসম্পদ লুণ্ঠনের জন্য আমেরিকা ও ইউরোপ দাবার ঘুঁটি হিসেবে ইসরায়েলকে ব্যবহার করছে এবং আরব শাসকদের জুজুর ভয় দেখিয়ে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোতে তাদের ঘাঁটি স্থাপন করেছে। ইরান ও ইয়েমেন ছাড়া প্রতিটি মুসলিম রাষ্ট্রকে আমেরিকা তাঁবেদার বানিয়ে নিয়েছে। এভাবে ছলে-বলে-কলে–কৌশলে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর কাছ থেকে ইসরায়েলের স্বীকৃতি ও ইসরায়েলের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি করতে বাধ্য করা হচ্ছিল। এ সময় ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার কথা ভুলে যাওয়ার উপক্রম হলো। বিশ্ব জনসংখ্যার ২৫ ভাগ মুসলিম পৃথিবীর ৭৫ ভাগ প্রাকৃতিক সম্পদের মালিক হয়েও মানবতাবিরোধী আমেরিকার কাছে দাসখত দিল।

আন্তর্জাতিক আদালত অবৈধ ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলের জালিম প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলেও আমেরিকা তাদের বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করছে। জাতিসংঘে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্ত এলেও আমেরিকা তাতে ভেটো দিয়ে তা বানচাল করে দিচ্ছে।

অন্যদিকে ইসরায়েল ফিলিস্তিনে ত্রাণসহায়তা প্রবেশে বাধা দিয়ে গৃহহীন ফিলিস্তিনিদের দুর্ভিক্ষের দিকে ঠেলে দিয়েছে। স্কুল, হাসপাতাল ও আশ্রয়কেন্দ্রে বোমাবর্ষণ করছে। জাতিসংঘের স্থানীয় অফিস ও কর্মীদের গাড়িতে, ত্রাণবাহী গাড়িতে, ত্রাণকর্মীদের ওপর, এমনকি সংবাদকর্মীদেরও হামলা চালিয়ে নির্বিচার হত্যা করে যাচ্ছে।

সারা পৃথিবী তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। আরব শাসকেরা গদি হারানোর ভয়ে নিশ্চুপ। ইউরোপ-আমেরিকায় ছাত্র-জনতা ও সচেতন নাগরিক সমাজ প্রতিবাদ জানাচ্ছে, স্বৈরাচার শাসকগোষ্ঠী তা কঠোর হস্তে নিপীড়নের মাধ্যমে দমন করছে। বাংলাদেশসহ কিছু মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিবাদ জানাচ্ছে। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন। বাংলাদেশসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশের জনগণ প্রতিবাদ সমাবেশ করে যাচ্ছে। কিন্তু ওআইসি, ওপেক, আরব লিগ ও জাতিসংঘ বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধতে নির্বিকার।

এ অবস্থা চলতে থাকলে জনরোষ ও জনবিস্ফোরণ পরিবর্তিত হবে, যুদ্ধ বন্ধ না করলে খোদ আমেরিকা তাদের অবস্থান হারাবে। তাদের ঘাঁটিগুলো অনিরাপদ হবে, তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হবে।

আসুন মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও স্বাধীনতা সুরক্ষায় সোচ্চার হই। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ যদি কোনো অন্যায় দেখে, তবে তা স্বহস্তে (বলপ্রয়োগের মাধ্যমে) পরিবর্তন করবে, যদি তা সম্ভব না হয়, তবে মুখের কথায় (কূটনৈতিক সমঝোতায়) তা পরিবর্তন করবে, যদি তা–ও সম্ভব না হয়, তবে মনের (পরিকল্পনা) দ্বারা তা পরিবর্তনের সচেষ্ট থাকবে; এটা হলো দুর্বলতম ইমান, এরপর ইমানের কোনো অংশ অবশিষ্ট নেই।’ (সহিহ মুসলিম শরিফ)

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী, যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম

[email protected]

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • আপনারা অবশ্যই অনির্বাচিত, প্রতিদিন স্মরণ করিয়ে দেওয়া হবে: সালাহউদ্দিন আহমেদ
  • আপনারা অবশ্যই অনির্বাচিত, প্রতিদিন স্মরণ করিয়ে দেওয়া হবে: সালাহ উদ্দিন
  • আপনারা অবশ্যই অনির্বাচিত, প্রতিদিন স্মরণ করিয়ে দেওয়া হবে: সালাহউদ্দিন
  • আপনারা অবশ্যই অনির্বাচিত, প্রতিদিন স্মরণ করিয়ে দেওয়া হবে: সালাহ উদ্দিন আহমদ
  • আপনারা অবশ্যই অনির্বাচিত, সেটা প্রতিদিন স্মরণ করিয়ে দেওয়া হবে: বিএনপি নেতা সালাহ উদ্দিন
  • জুলাই বিপ্লবের স্বপ্ন বাস্তবায়নে গণতন্ত্রে ফিরতে হবে: গিয়াস উদ্দিন
  • শিক্ষার্থীদের আর বঞ্চিত রাখা না হোক
  • মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সবচেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন শেখ হাসিনা
  • সামাজিক মাধ্যমকেন্দ্রিক গণতন্ত্রচর্চার ঝুঁকি
  • গাজায় জাতিগত নিধনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে