এক পাউন্ড জিলাপি ৯ ডলার। এক বাক্স ইফতারি—তাতে বেগুনি, পেঁয়াজু, জিলাপি, খেজুরের সঙ্গে খানিকটা তেহারিও আছে দাম ১০ ডলার। নিউইয়র্কের বাংলাদেশি পাড়া জ্যাকসন হাইটসের রেস্তোরাঁগুলো বিকেল থেকেই পসরা সাজিয়ে বসেছে। আর সারি সারি ট্রে-ভরা মুরগি, খাসি, গরুর মাংসের নানা ধরনের কাবাব, চপ, পরোটা আর বিভিন্ন মিষ্টান্ন তো আছেই। আছে খেজুরের গুড়ের জিলাপি কিংবা দুধসেমাই।
কিন্তু জ্যাকসন হাইটসের ডাইভারসিটি প্লাজায় বিকেল পাঁচটার সেই ভিড়টা কই, যা গত বছর রোজার দিনগুলোতেও ছিল? ১৮ মার্চ ২০২৫ বিকেলে ডাইভারসিটি প্লাজা এত ফাঁকা লাগছে কেন? ইফতারের সময় ৭টা ৬ মিনিট। রেস্তোরাঁর দোকানি, কর্মচারী—যাঁরা বেশির ভাগই বাঙালি, বাংলায় কথা বলেন; জানালেন, হঠাৎ করেই রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে গেছে এ বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েছেন, তারপর অভিবাসীদের বিরুদ্ধে নানা ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করেছে ইমিগ্রেশন পুলিশ; আর তাতেই বাংলাদেশি, নেপালি, ভারতীয়, পাকিস্তানিতে গমগম করা এসব এলাকা এখন অনেকটাই ফাঁকা। ঈদের আগে পসরা সাজিয়ে রেখেছেন যে শাড়ি, কামিজ, পাঞ্জাবি-পায়জামার দোকানিরা, তাঁরাও অনেকটাই বেজার মুখে তাকিয়ে থাকেন প্রায় জনশূন্য ফুটপাতের দিকে।
এক বাক্স ইফতারি—তাতে বেগুনি, পেঁয়াজু, জিলাপি, খেজুরের সঙ্গে খানিকটা তেহারিও আছে দাম ১০ ডলার.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ইফত র
এছাড়াও পড়ুন:
ভালোবাসাশূন্য ঘুম
ভালোবাসামুক্ত মানুষ নিশ্চিন্তে ঘুমাতে যায়। এমদাদ সাহেবের ওস্তাদ নুরু ফকির এ কথা বলতেন। কিন্তু অতীত থেকে খুঁজে নেওয়া সত্য-বইয়ের আঠালো পাতা ঘাঁটলে দেখা যাবে যে নুরু ফকির কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত শব্দ ব্যবহার করে বলেছিলেন– “ভালোবাসাশূন্য মানুষ নিশ্চিন্তে ঘুমায়। অন্তরে ভালোবাসা থাকলে নিশ্চিন্তে কেউ ঘুমাতে পারে না।” বলেছিলেন গভীর অনুতাপ, পাপ ও বিরহ বোধ থেকে। কিন্তু এমদাদ সাহেব নুরু ফকিরের আধ্যাত্মিক দর্শনের অনেকখানি গ্রহণ করে তাকে আদর করে ওস্তাদ বলে ডাকলেও সবটুকু মেনে নেয়নি। সে জানে যে দোষের ঊর্ধ্বে কেউ নয়, ওস্তাদেরাও ভুল বলে। অতীতেও তাদের শাগরেদরা নিজ প্রয়োজনে, সময়ের দাবিতে গুরুদের বাণীর সময়োপযোগী ব্যাখ্যা করেছে। এতে দোষের কিছু নেই। এমদাদ সাহেবও তেমনি নুরু ফকিরের বাণী প্রয়োজনে বদলেছে। এমদাদ সাহেব বিশ্বাস করে যে, ভালোবাসাশূন্য মানুষের চেয়ে ভালোবাসামুক্ত মানুষ শক্তিমান, জাগতিক ভালোবাসা থেকে মুক্ত হলেই, মানুষ নিশ্চিন্ত রাত লাভ করতে পারে।
আদতে এমদাদ খন্দকার কোনো ঋষি ধ্যানী মানুষ না। আপাদমস্তক গৃহী মানুষ। তিনবেলা ভরপেট ভাত খায়। ডালে নুন কম হলে চোটপাট করে। তার ওস্তাদ বলে যে নুরু ফকিরের পরিচয় দেয় সেই লোক পুরান ঢাকার এক স্বঘোষিত পাগল ছিল। টিকাটুলীর কাজী কাদেরের উঁচু হলুদ দালানের পাশের যে গলি, সেখানে মমিনুলের চায়ের দোকানে বসে তাকে গুলতানি করতে দেখা যেত। চায়ের দোকান থেকে দুই কদম পরে শেরেবাংলা বালিকা বিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান ও পৌরনীতি পড়াত এমদাদ সাহেব। স্কুল ছুটির পরে অন্য শিক্ষকেরা প্রাইভেট কোচিং ক্লাসে ব্যস্ত হয়ে যেত। সমাজবিজ্ঞান কিংবা পৌরনীতির মতন অহেতুক সাবজেক্ট কেউ টাকা খরচ করে কোচিংয়ে পড়ে না। এমদাদ সাহেবের তাই বিকেল তিনটার পর কোনো কাজ থাকত না। স্কুল থেকে বেরিয়ে মমিনুলের দোকানে বসে চা শিঙাড়া আর বেলা বিস্কুট খেতে খেতে নুরু ফকিরের বয়ান শুনত। নুরু ফকির এমন কোনো আহামরি গল্প বলত না। কিন্তু তার বলবার ঢং মনে আঁচড় কাটত। কী কায়দা কী চোখের নাচুনি, লালনের গানকে উচ্চকণ্ঠে মজলিসি কায়দায় আওড়ে যেত– আসবার কালে কী জাত ছিলে, এসে তুমি কী জাত নিলে। কী জাত হবা যাবার কালে! মনে হতো সাক্ষাৎ লালন ফকির যেন নুরা পাগলা হয়ে ওই বেঞ্চিতে উপুড় হয়ে বসে আছে। সাদা লুঙ্গি হাঁটুর ওপর উঠিয়ে উবু হয়ে বসে নুরা পাগলা যখন কথা বলত, মাদকতা খেলা করত চোখে-মুখে। কখনও গলা চড়িয়ে, কখনও নামিয়ে, কখনও মৃদু হেসে একটা মজলিস তৈরির ক্ষমতা, তা এমদাদ সাহেবকে খুব আকৃষ্ট করল। এমদাদ সাহেব নুরু ফকিরকে অনুসরণ করা শুরু করল। একটু আবেগ, দর্শন, তত্ত্ব মিলিয়ে তার ভরাট গলায় এমদাদ সাহেব যখন পাড়া-মহল্লায় আলাপ শুরু করে, আসর জমে যায়। এমদাদ সাহেবের গমগমে ভারী কণ্ঠস্বরের জন্য গার্লস স্কুলে তার খুব সুখ্যাতি ছিল। কলেজের বন্ধু ফরিদ নিশ্চিত ছিল, এমন বিশেষ কণ্ঠের কারণেই এমদাদ সাহেবের জীবন প্রেমে ভরপুর থাকবে। তেমন কিছু এমদাদ সাহেবের জীবনে ঘটেনি। জীবনে প্রেম হয়নি, একবারও না। প্রেমে পড়েনি তা তো না। কিন্তু প্রেমটুকু তার একার ছিল, অন্যপক্ষ কখনও সেই প্রেম গ্রহণ করেনি। পারিবারিকভাবে যে বিয়ে হয়েছিল, তা নিতান্তই শুকনো, খসখসে এবং দিন যেতে যেতে তা তিতে হয়ে উঠেছিল। একসময় স্ত্রী তার বাপের বাড়িতে চলে গেল, মাঝে মাঝে ফিরে, বেশির ভাগ সময় ফিরে না। বিয়েটা ভাঙেনি, জোড়াও লাগেনি। সময়ের সাথে সাথে পরিপাটি করে কথা বলার কৌশল শিখেছে সে। এই বলতে পারার ক্ষমতাটুকুই তাকে বাঁচিয়ে রাখে। বাড়ির ভাড়া তোলা আর বাড়ির বিদ্যুৎ পানি গ্যাসের বিল প্রতি মাসে পরিশোধ করা ছাড়া এ জীবনে সে নিজের প্রয়োজনীয়তা খুঁজে পায় না তেমন। চুড়িহাট্টায় ওয়াহিদ ম্যানশনের পাশে বসে আড্ডা দেয় প্রতি বিকেলে। বহু বহু বছর ধরে দুপুরের পর এই চুড়িহাট্টাতে আসে, বৃষ্টি হোক কিংবা রোদ, এমনকি ঈদ কিংবা উৎসবের দিনও। বয়সের সাথে সাথে তার আড্ডা জমানোর প্রতিভা ধারালো হয়ে উঠেছে। তার গল্প শুনতে আশপাশ থেকে মানুষ জড়ো হয়। সে খেয়াল করেছে যে গল্পে কোনো অতীত টেনে আনলে মানুষের কৌতূহল তৈরি হয়। তারই সূত্র ধরে নুরু ফকিরকে টেনে আনে, “শোনেন আজকে আমার ওস্তাদের একটা আজব বিষয় বলি। সে বসত সব সময় পিঠ উঁচা করে। আমি বলতাম, ওস্তাদ কাহিনি কী? ওস্তাদ বলত, এই যে পিঠের কুঁজ এ আমার পাপের বোঝা। মানুষকে না বুঝতে পারার পাপ।” এমদাদ সাহেব স্কুলের চাকরি ছেড়েছে সে কবে। কিছু জমানো টাকা, বাড়ি ভাড়ার টাকাতে একা মানুষের দিন চলে যায়। এতটুকু নিয়েই এমদাদ সাহেব। পঞ্চান্ন বছরের এমদাদ সাহেবের জীবনে আলাদা কোনো গল্প নেই আর।
তবে এমদাদ সাহেবের একটা বৈশিষ্ট্য আছে, তার স্বপ্ন। সে স্বপ্ন দেখে না। ছোটবেলায় একবার স্বপ্নে দেখেছিল যে সে তালগাছ থেকে পরে যাচ্ছে, যাচ্ছে, যাচ্ছে, কী প্রাণপণ চিৎকার করছিল, কিন্তু সে আওয়াজ
কোথাও পৌঁছাচ্ছে না, ঘুম ভেঙে দেখে গোঁ গোঁ করে আওয়াজ করছে আর পাশে ঘুমিয়ে থাকা দাদির গাল কামড়ে দিয়েছে। আর দাদি রেগে থপাস করে গালে চড় মারছে, “কুত্তার বাচ্চার এই বয়সে দাঁতের ধার কী! এই জুলেখা দেখে যা তোর জংলি পোলা আমার কী দশা করছে।” দাদির গালে দগদগে ঘা, সেই ঘায়ে মলম লাগাতে লাগাতে দাদি খুব কেঁদেছিল। তার কয়েক বছর পর দাদি মারা গিয়েছিল।
সে স্বপ্ন দেখেনি কখনও আর। ম্যাট্রিকের আগে বন্ধুরা যখন সবাই একই স্বপ্ন দেখছে যে, পরীক্ষা শেষের ঘণ্টা বাজছে ঢং ঢং, কিন্তু অঙ্ক প্রশ্নের উত্তর তারা শেষ করতে পারেনি, এমদাদ তখনও স্বপ্নশূন্য কিংবা স্বপ্নমুক্ত। নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছে, যা ভেবেছে সবটুকু জেগে জেগে, কিন্তু স্বপ্ন দেখেনি। কলেজের বন্ধুরা যখন মেয়েদের ভেজা শরীর স্বপ্নে দেখতে পেত, এমদাদ সাহেব গুলিস্তানের মোড়ে দাঁড়িয়ে চটি পড়তে পড়তে, নানা কিসিমের রগরগে ভাবনা ভাবতে ভাবতে রাতে জব্বর স্বপ্নহীন ঘুম দিত। বিয়ের পর বউ ক্যাটক্যাট করে বলত, “তোমার জীবনে কোনো স্বপ্ন নাই ক্যান? ভাদাইম্মা ব্যাটা।” ক্লাসের টিচাররা যখন জিজ্ঞেস করত, “তোমাদের স্বপ্ন কী?” এমদাদ তো উত্তর খুঁজে পেত না। সে তো জেগেও স্বপ্ন দেখতে জানে না। ক্লাসের ভালো ছাত্রদের উত্তর নকল করে বলত। তা শুনে একবার বিজ্ঞান স্যার কী হাসা হেসেছিল, যখন সে ফার্স্ট বয় সোহেলের উত্তরের মতন করে উত্তর দিল, “আমিও পাইলট হতে চাই স্যার।”
স্যার হাসতে হাসতে মরে আর কী, “বিজ্ঞানে ঊনত্রিশ পেয়ে তুই পাইলট হবি!”
এই যে শেরেবাংলা গার্লস স্কুলের শিক্ষকতার চাকরি, সেও তার আব্বার কল্যাণে পাওয়া। বিএ পাসের পর আব্বা তার বন্ধু প্রিন্সিপাল সাহেবকে ধরে ক্লাস চাকরি জুটিয়ে দিলেন। আব্বা বেঁচে থাকা পর্যন্ত টুকটাক ব্যবসা নিজেই দেখাশোনা করেছে। আব্বা মরে যাওয়ার পর সেসব ব্যবসা সব গুটিয়ে ফেলছে, ওসব তার দ্বারা হবে না। ছোকরা জীবনে স্বপ্নহীনতা ভাবাত মাঝে মাঝে। আর জীবনের এ সময়ে এসে এমদাদ সাহেবের কোনো দুঃখবোধ নেই। কারণ সে বিবেচনা করে দেখেছে, স্বপ্নহীন ঘুম আরামের। একটানে রাত সকাল হয়।
তার জীবন অহেতুক চাহিদামুক্ত, ভালোবাসামুক্তও। ভালোবাসা আসলে চাপিয়ে দেওয়া প্রত্যাশার হিসাব-নিকাশের গরমিল ছাড়া তো কিছু নয়। তাই সে নুরু ফকিরের বাণীকে এদিক-ওদিক পাল্টে সগর্বে বলতে পারে, নিশ্চিন্ত ঘুম ঘুমাতে পারে শুধু ভালোবাসামুক্ত মানুষেরা।
সেদিন ছিল আষাঢ়ের প্রথম দিন, মানে প্রথম রাত। এসব বাংলা মাসের দিনক্ষণ তার মনে থাকে না, শুধু পয়লা বৈশাখে হালখাতার দিনটি চারপাশের আয়োজন দেখে বুঝতে পারে। সেদিন বিকেলে চুড়িহাট্টার মোড়ে আড্ডায় লোকজন ফ্যাচফ্যাচ করছিল, “দ্যাখ আজ বর্ষাকাল শুরু আর এদিকে এক ফোঁটা বৃষ্টির দেখা নাই! কুত্তা গরম।” সে রাতে এমদাদ সাহেব স্বপ্ন দেখল। জীবনে দ্বিতীয়বার। দেখল ওই যে ঢ্যাংগা লম্বা লোকটা গান গায় যে, সবাই যাকে গুরু বলে ডাকে, তার কনসার্ট। সেই কনসার্টে গান হচ্ছে এমদাদ সাহেব হাত-পা ছুড়ে, ওই গানটা গাচ্ছে, খুব চেনা গান। সে বুঝতে পারছে সেই গানটা গাইছে, কিন্তু শুনতে পাচ্ছে না কেন যেন।
লোকটা এমদাদ সাহেবের পাশে দাঁড়িয়ে বলছে, “সুরে গাও, সুরে গাও।”
এমদাদ সাহেব গাইতে গাইতে চিৎকার করছেন, “আমি গাইতে জানি না।”
গায়ক লোকটা দু’হাত মেলে দিয়ে ঘুরছে আর বলছে, “কাহারবায় গাও, কাহারবা।”
সকালে ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর বিছানায় শুয়ে এমদাদ সাহেব কিছুক্ষণ ভাবল। বুঝল যে ঘুমের মধ্যে যা ঘটল তা হচ্ছে স্বপ্ন। সেই কবে দেখেছে এক তালগাছের স্বপ্ন। ওই তালগাছ থেকে পরে যাওয়ার স্বপ্নের চেয়ে এ স্বপ্ন মজাদার, বড্ড ভাবাচ্ছেও। গায়কটার নাম কী যেন! লম্বা টিঙটিঙে লোকটা, কোথায় যেন একবার দেখেছেও তাকে। আর ওই যে গানটা! এতবার শোনা, কিন্তু মনে পড়ছে না এখন। কিন্তু কাহারবা কী! ঘুম থেকে উঠে খাতায় কাহারবা শব্দটা লিখে রাখল যাতে ভুলে না যায়। বিকেলে চুড়িহাট্টায় মোড়ে ঝুমবৃষ্টিতে একা দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে স্বপ্নের কথা ভুলে গেল প্রায়। সেদিন রাতে একই স্বপ্ন। স্বপ্নের মধ্যে ঝপাৎ করে এমদাদ সাহেবের মনে পড়ে যায় লোকটার সাথে তার কমলাপুরে দেখা হয়েছিল। স্বপ্নে আজও তারা গান গাইছে। আজ সে গানটা শুনতে পায়, স্পষ্ট শুনতে পায়, সে গাইছে, লোকটাও পাশে দাঁড়িয়ে গাইছে, “ওরে সালেকা, ওরে মালেকা, ওরে ফুলবানু, পারলি না বাঁচাতে।”
এমদাদ সাহেবের ঘুম ভেঙে যায়। ওহ এই গান, এই গান সে কত শুনেছে স্কুলে। দুপুরে আব্বার দোকানে যেয়ে সে যখন কুলফি খেত আর পুরোনো কাগজ কেটে কেটে নকশা তৈরি করত, এ গানটা আশপাশের দোকানের রেডিও থেকে ভেসে আসত। লোকজন গানের তালে তালে দুই এক পাক নেচেও ফেলত। সে গাইতে পারে না, কিন্তু এই লোকের গান শুনলে তো রক্ত চনমন করে উঠত, মাঠের মধ্যে ডিগবাজি খেতে খেতে, ফুটবলের শেষ গোলটা দিতে দিতে এই গানটাই সে গেয়েছে। আজম খান! মনে পড়েছে, কলেজ আমলের কথা, একবার কমলাপুরের জসীমউদ্দীন রোডে বসে আড্ডা দিচ্ছিল, পাশ দিয়ে হনহন করে লোকটা হেঁটে যাচ্ছিল। বন্ধুরা বলল, দেখ দেখ গুরু যায় গুরু। স্পষ্ট মনে পড়ছে। প্রতিদিনের মতন চুড়িহাট্টার মোড়ে বিকেলে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ভাবে, কাহারবা কী? ইন্টারনেট সে ব্যবহার করে না, বুঝেও না। নিচতলার ভাড়াটিয়া ছেলেটা ইন্টারনেট খুঁজে জানায়, কাহারবা নাকি একটা তাল।
“কোন জাতের তাল?”
“চাচা, এটা গানের তাল।”
কী তাজ্জব। গানের সে কী বোঝে! তাল তাও আবার কাহারবা নাকি এক খটমটে নাম, সে তালের নাম জানল কোত্থেকে। পাশের গলিতে চাচাতো বোন সুফিয়া আপা থাকে। তার চেয়ে বছর দশেকের বড়। পরিবারে সবাই ডাকে কালের সাক্ষী বটগাছ। বয়স হয়েছে, স্মৃতি হারায়নি।
নানা ফন্দি ফিকির করে ইনিয়ে বিনিয়ে প্রশ্ন করে, সুফিয়া আপাকে জানতে দেওয়া যাবে না এই স্বপ্নের কথা। বিশ্বাস করবে না উল্টো হাসাহাসি করবে।
“বুবু এই আমরা কি ছোটবেলায় গানটান শিখতাম নাকি?”
“ক্যান?”
“নাহ ছোটবেলার অনেক কথাই তো মনে নাই। কী করতাম না করতাম।”
“তুই গান শিখলে ভালোই করতি, কিন্তু আমাদের পরিবারে ব্যাটা মানুষেরা কী গান করছে কখনও!”
“হুম তাও ঠিক।”
“তবে চাচাজান তো কী ভালো তবলা বাজাত। তোর মনে নাই, চাচাজানের পাশে বসে আমরা উঠোনে তবলা বাজানো শুনতাম।”
“আব্বা তবলা বাজাত?”
“হুম, মাঝে মাঝে। তারপর তো একসময় ছেড়ে দিল। আমরা কত বলতাম, বাজাত না।”
কাহারবা রহস্যের একটা সমাধান মিলল তাহলে। হয়তো আব্বার কাছ থেকে কখনও শুনেছে সে নাম।
“বুবু দাদিজানের কথা মনে পড়ে তোমার?”
“হু, কী আদর করত আমাদের।”
“দাদি?”
“হ্যাঁ, তোকে তো কলিজার মধ্যে ঢুকায় রাখত। মনে নাই নারকেলের নাড়ু বানাত, কী সুন্দর ঘিয়া রং। জীবনেও অমন বানাতে পারলাম না।”
“ধুর। আমার ওপর তো বিল্লা ছিল। ওই যে ছোটবেলায় একবার ঘুমের মধ্যে কামড় দিলাম।”
“তুই কি পাগল! তুই দাদিরে কামড় দিলি আর দাদি তোকে সারারাত বুকে চেপে বসে ছিল, যাতে তুই স্বপ্ন দেখে ভয় না পাস।”
“দাদি মরছিল কীভাবে?”
“হার্টের অসুখ ছিল না কত বছর ধরে। তোর মনে নাই, না!”
এমদাদ সাহেবের জীবন কেমন বদলে যেতে লাগল। প্রতিরাত জুড়ে স্বপ্ন দেখে। আজম খান আর সে গান গাইছে। একটাই গান ওরে সালেকা ওরে মালেকা। প্রতিদিন সে আসরে নতুন নতুন দর্শক আসে। তাদেরকে এমদাদ সাহেব চেনে। একদিন দর্শকের সারিতে ছিল নুরু ফকির, এমদাদের দুই গালে দুটো থাপ্পড় মেরে চলে গেল। ঘুম ভেঙে গেল। একরাতে এল চন্দ্রশেখর দাদা, পাড়ার মোড়ে রুপার দোকানের সেকরা। স্কুল জীবনে এমদাদ সাহেব সেই দোকান থেকে রুপার একটা আংটি চুরি করে পাড়ার সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে পারুলকে উপহার দিয়েছিল। দোকানের মালিক ভেবেছিল চন্দ্রশেখরদা আংটিটা চুরি করেছে, দাদা চাকরিটা খুইয়েছিল। একদিন স্বপ্নে গান শুনতে এসেছিল স্ত্রী মিনু। কতবার এমদাদ সাহেব মিনু মিনু করে ডাকল। গলা দিয়ে কোনো আওয়াজই বের হলো না। মিনু হনহন করে হেঁটে চলে গেল একটা পুকুরের পার ধরে। এ যেন এক নতুন জীবন। স্বপ্নে আসক্ত এক মানুষ হয়ে উঠছে এমদাদ খন্দকার। এই শেষ জীবনে এত স্বপ্ন কথা থেকে আসে! প্রতিদিন বিকেলের মোড়ে চুড়িহাট্টার মোড়ে একা দাঁড়িয়ে ভাবে। আর স্বপ্নে গুরু আজম খানকে যখন প্রশ্নটা করে, উনি বলেন, “সুরে গাও সুরে।”
সেদিন যে এলো দর্শক সারিতে তার গালে একটা তিল, ইয়া বড়। এমদাদ সাহবে সেই গালের তিলটুকুই দেখতে পাচ্ছিল শুধু, কেমন ধীরে ধীরে রক্তগোলাপের মতন লাল হয়ে উঠছে, দাদি, নিশ্চিত দাদি। “দাদি!”
“আমার তো যেতে হবে, মাঠে বল খেলতে যাব। তারপর তোর জন্য নাড়ু বানাব।”
“তুমি কই দাদি?”
“এই যে। তুই কি আজমকে খুঁজে পাইছিস?”
“এই যে গান গাচ্ছে আমার পাশে আজম খান।”
দাদি এমন দৌড় দিল ধানক্ষেতের পাশ দিয়ে, দৌড়োতে দৌড়োতে বলল, “চুড়িহাট্টার আজম মনে নাই? তোর মনে নাই? আজম কই, আজম কোথায়, ওর জাহাজটা?”
আজম! আজম কই? চুড়িহাট্টার আজম। ছোটবেলার তার প্রাণের সাথি আজম। এমদাদ সাহেবদের পারিবারিক গজ কাপড়ের দোকানে আজমের আব্বা রইস চাচা দোকানদার ছিল। আজম দুপুরে স্কুলের পর তার আব্বার সাথে দোকানে বসে কাপড় বিক্রি করত। নতুন কাপড়ের লট গুনে গুনে হিসাবের খাতায় টুকে রাখত। আশেপাশের সবাই বিশ্বাস করত এমদাদ এক বেকুব যাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। আজম ভাবত না এমনটা। আজম বিশ্বাস করত এমদাদ একদিন অনেক বড় হবে, সবচেয়ে বড় মানুষ। কুড়িয়ে পাওয়া রঙিন বল আর হাতের মুঠোয় কাঠি চকলেট নিয়ে তারা দুপুরে দোকানে বসে গল্প করত, বড় হয়ে তারা কী হবে? তারা একদিন মস্ত বড় জাহাজ বানাবে, সে জাহাজে সমুদ্রে সমুদ্রে পুরো পৃথিবী ঘুরে বেড়াবে। আজম তো স্বপ্নে দেখেছে কেমন করে জাহাজ বানাতে হয়। বড় হলে তারা সেই জাহাজ বানাবে। তারপর পৃথিবী ঘুরে বেড়াবে। সেইদিন ভোরবেলায় আজম এসেছিল তাদের বাসায়।
“এমদু তুই দুপুরে দোকানে আসিস। তোরে একটা জিনিস দিব।”
“কী?”
“সেই জিনিস পেলে তোর সব স্বপ্ন সত্যি হবে।”
“বলিস কী! এখুনি দে।”
“না না আমার এখন দোকানে বসতে হবে, আমার আব্বার আলসারের পেইন উঠছে। আব্বা আজকে দোকানে যাইতে পারবে না।”
দুপুরে আর দেখা হলো না, কোনোদিন দেখা হয়নি আর। ওই সেদিন দুপুরের দিকে এক কেমিক্যাল গুদামে বিস্ফোরণ হলো, চুড়িহাট্টার দোকানগুলো পুড়ে গেল, আব্বার সেই গজ কাপড়ের দোকানটাও, মানুষেরাও। তখন আষাঢ় মাস, তবু সেদিন বৃষ্টি হলো না। কেমন এক মেঘশূন্য অসাড় সময়। “শরিফুল আজম মিয়া, বয়স ১২, গোলগাল ফর্সা, হলুদ রঙের শার্ট পরনে”– লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে এখানে ওখানে কত খুঁজেছে সে। পুড়ে যাওয়া আবর্জনার ফাঁকে ফাঁকে খুঁজেছে আজমের সেই জিনিস যা পেলে স্বপ্নপূরণ হবে। আজম ছেলেটা সব নিয়ে পুড়ে গেল। দুনিয়া ঘুরে বেড়ানোর জাহাজ বানানোর কায়দাটাও শেখা হলো না। সে কত কত বছর আগের কথা। সবাই জানে এখানে এমদাদ সাহেবের বাপের একটা দোকান ছিল। সেই পুড়ে যাওয়া দোকানের টানে হয়তো সে প্রতিদিন এখানে আসে, গুলতানি করে, কিংবা ভরা বর্ষায় চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
সেদিন স্বপ্নে গুরু আজম খান কথা দিয়েছে তাদের গানের আসর চলবে, একদিন নিশ্চয়ই হারিয়ে যাওয়া শরিফুল আজম মিয়া ফিরে আসবে। তার আগ পর্যন্ত স্বপ্ন চলবে। এমদাদ সাহেবের পিঠে একটু একটু করে কুঁজ জমছে আজকাল, নুরু ফকিরের মতন। এমদাদ সাহেব হারিয়ে ফেলেছে স্বপ্নহীন নিশ্চিন্ত ঘুম।