শূন্য থেকে পৃথিবীর স্বস্তিতে সুনিতারা
Published: 20th, March 2025 GMT
মহাকাশে গিয়েছিলেন আট দিনের মিশনে। কিন্তু থাকতে হয়ে ৯ মাস। জানতেন না, কখন ফিরবেন। নানা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কাটিয়ে অবশেষে পৃথিবীতে ফিরে এসেছেন নাসার দুই মহাকাশচারী বুচ উইলমোর, সুনিতা উইলিয়ামসসহ চারজন। গতকাল বুধবার ভোর ৩টা ৫৭ মিনিটে তাদের বহনকারী ক্যাপসুলটি বিশেষ প্যারাসুটের সাহায্যে ফ্লোরিডা উপকূল থেকে ৫০ মাইল দূরে সমুদ্রে নেমে আসে।
পৃথিবীতে প্রত্যাবর্তনের দৃশ্যটি বিভিন্ন টেলিভিশন ও সামাজিক মাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচার হয়। ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, স্পেসএক্সের তৈরি ক্যাপসুলটি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে অতি দ্রুতগতিতে প্রবেশ করছে। ক্রমেই এটি এগিয়ে আসছে। এক পর্যায়ে দুটি প্যারাসুট খুলে দিলে গতি কমতে শুরু করে। কিছুক্ষণ পর আরও দুটি প্যারাসুট খুলে যায় এবং গতি অনেকটাই কমে যায়। এর পরই পানিতে পড়ে ভাসতে থাকে এটি। তখন ক্যাপসুলটি ঘিরে ধরে একঝাঁক ডলফিন। পরে নৌকা ও জাহাজ থেকে উদ্ধারকারী দল এটি পানি থেকে তুলে আনে।
পৃথিবীতে তাদের ফেরানোর নাসার এ অভিযানের নাম ছিল ‘ক্রু-৯’। যে মহাকাশযানে তাদের ফিরিয়ে আনা হয়েছে সেটি তৈরি করেছে ইলন মাস্কের প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্স। আইএসএসের অবস্থান পৃথিবী থেকে প্রায় ৪০৯ কিলোমিটার ওপরে। প্রায় ২৫ বছর ধরে মহাকাশচারীরা সেখানে যাতায়াত করছেন। রয়েছে ফুটবল মাঠের সমান আকৃতির গবেষণাগার, যা পরিচালনা করে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া।
দুই মার্কিনি সুনিতা উইলিয়ামস ও বুচ উইলমোর ছাড়াও আরও দু’জন ক্রু ছিলেন। তারা হলেন– নিক হেগ ও রুশ নাগরিক আলেকজান্ডার গরবানভ। ক্যাপসুলের হ্যাচ খুলে বেরিয়ে আসার সময় নভোচারীদের খোশ মেজাজে দেখা গেছে। সুনিতা উইলিয়ামস ও বুচ উইলমোর দর্শনার্থীদের উদ্দেশে হাত নাড়েন। নাসার কমার্শিয়াল ক্রু প্রোগ্রামের ব্যবস্থাপক স্টিভ স্টিচ সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ক্রুয়ের সদস্যরা দারুণ কাজ করছেন।
বিবিসি জানায়, আট দিনের জন্য গেলেও আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন বা আইএসএসে গিয়ে আটকে যান সুনিতারা। তাদের মহাকাশযানটিতে একাধিক প্রযুক্তিগত সমস্যা দেখা দেয়। নাসার স্পেস অপারেশনস মিশন ডিরেক্টরেটের ডেপুটি অ্যাসোসিয়েট অ্যাডমিনিস্ট্রেটর জোয়েল মন্টালবানো বলেন, তাদের ফিরিয়ে আনতে পেরে দারুণ লাগছে। ল্যান্ডিংটি অসাধারণ ছিল।
মহাকাশচারীদের পৃথিবীতে ফেরার যাত্রায় সময় লেগেছে ১৭ ঘণ্টা। তাদের স্ট্রেচারে করে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য নেওয়া হয়। মাধ্যাকর্ষণহীন পরিবেশে দীর্ঘ সময় কাটানোর পর এটাই নিয়ম। ব্রিটেনের প্রথম নভোচারী হেলেন সারম্যান জানান, সবচেয়ে বড় বিষয় হবে, অভিযান থেকে ফেরার পর পরিবার ও বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে যখন তারা দেখা করবেন।
বুচ উইলমোর ও সুনিতা উইলিয়ামসের সফরের গল্পটি শুরু হয় ২০২৪ সালের জুনে। বোয়িংয়ের তৈরি স্টারলাইনার স্পেসক্রাফ্টের প্রথম মনুষ্যবাহী টেস্ট ফ্লাইট বা পরীক্ষামূলক উড়ানে অংশ নিয়েছিলেন তারা। কিন্তু তারা যে ক্যাপসুলে মহাকাশ যাত্রা করেন, সেটি একাধিক প্রযুক্তিগত সমস্যার মুখোমুখি হয়। এ অবস্থায় তাদের ফেরানো ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। স্টারলাইনার গত সেপ্টেম্বরে নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরে আসে।
আইএসএসের পরিবেশ মাধ্যাকর্ষণহীন। তবে সেখানে বেঁচে থাকার জন্য পৃথিবীর খাবার মজুত রয়েছে। আটকে যাওয়া সুনিতা ও বুচ আইএসএসে ল্যাবরেটরিতে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা পরিচালনা করেন। তারা স্পেসওয়াকও করেছেন। নিউইয়র্ক পোস্ট জানায়, আইএসএসে আটকে থাকা নাসার নভোচারী বুচ ও সুনিতা পিৎজা, রোস্ট মুরগির মাংস ও চিংড়ির ককটেল খেয়েছেন। সেখানে তারা নাশতায় গুঁড়া দুধ, পিৎজা, টুনা ফিশ খাওয়ার সুযোগ পেতেন।
মহাকাশে দীর্ঘমেয়াদি অভিযান মানুষের শরীরের ওপর বিভিন্ন রকমের প্রভাব ফেলে। এ পরিস্থিতিতে নভোচারীদের হাড়ের ঘনত্ব কমে যায়। তাদের শরীরের পেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দেহে রক্ত সঞ্চালনও প্রভাবিত হয়। দৃষ্টিশক্তিও কমে যেতে পারে। এ জন্য পৃথিবীতে ফেরার পর তাদের চিকিৎসা সহায়তা আবশ্যক হয়ে পড়ে। পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে কিছুদিন সময় লাগে। যুক্তরাজ্যের নভোচারী টিম পিক জানান, (মহাকাশে) আপনার শরীর দারুণ অনুভব করে। অনেকটা ছুটি কাটানোর মতো। (সেখানে) আপনার হার্ট একটি সহজ সময় কাটায়। পেশি এবং হাড়ও সহজ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যায়। আপনি এ বিস্ময়কর শূন্য মাধ্যাকর্ষণ পরিবেশে স্পেস স্টেশনের চারপাশে ভেসে বেড়াতে থাকেন।
মহাকাশে থাকাকালে বুচ ও সুনিতা এক সাক্ষাৎকারে বলেন, প্রত্যাশার চেয়ে বেশি সময় কাটানোর জন্য তারা ভালোভাবেই প্রস্তুত। তবে এমন অনেক কিছুই ছিল, যা করার জন্য উদগ্রীব ছিলেন। সেসব কিছুর কথা ভেবেই ঘরে ফেরার দিকে তাকিয়ে ছিলেন তারা। গত মাসে সিবিএসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সুনিতা বলেন, ‘আমার পরিবার, পোষা কুকুরদের সঙ্গে দেখা করার জন্য এবং সমুদ্রে ঝাঁপ দেওয়ার অপেক্ষায় আছি। পৃথিবীতে ফিরে আসতে পারলে, পৃথিবীকে অনুভব করতে পারলে– সত্যিই দারুণ লাগবে।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব চ উইলম র র জন য উইল য
এছাড়াও পড়ুন:
সুনিতা উইলিয়ামস সম্পর্কে এই তথ্যগুলো জানেন?
সুনিতা উইলিয়ামস পুরো বিশ্বের মানুষের কাছে এখন এক বিষ্ময়ের নাম। ১৯৬৫ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর ওহিওতে জন্ম নেন সুনিতা। ছোটবেলা থেকেই আকাশে ওড়ার স্বপ্ন দেখতেন। তিনি প্রথমে মার্কিন নৌবাহিনীতে যোগ দেন এবং একজন হেলিকপ্টার পাইলট হিসেবে নিজের দক্ষতা প্রমাণ করেন। কিন্তু তার স্বপ্ন ছিল আরও বড়, আরও উচ্চতায় পৌঁছানোর। নাসার মহাকাশচারী হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর, সুনিতা তার স্বপ্ন পূরণের পথে আরও এক ধাপ এগিয়ে যান।
সুনিতা উইলিয়ামসের কিছু উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব: এই নভোচারী মহাকাশে ৩২২ দিনের বেশি সময় কাটিয়েছেন। মহাকাশে সাতটি স্পেসওয়াক করেছেন সুনিতা। যা নারীদের জন্য একটি রেকর্ড। আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সুনিতা ১৯৮৩ সালে মেরিল্যান্ড অঙ্গরাজ্যের অ্যানাপোলিসে যুক্তরাষ্ট্রের নেভাল একাডেমিতে যোগ দেন। ১৯৮৭ সালে তাকে র্যাংক দেওয়া হয় এবং নৌ বিমান চলাচল প্রশিক্ষণ কমান্ডে বিমানচালক হিসেবে প্রশিক্ষণ নেন তিনি। এরপর ১৯৮৯ সালের জুলাই মাসে জঙ্গি হেলিকপ্টারের প্রশিক্ষণ শুরু করেন। নেভাল টেস্ট পাইলট হিসেবে ১৯৯৩ সালে কাজ শুরু করেন। এরপরে তিনি টেস্ট পাইলট প্রশিক্ষক পদে উন্নীত হন তিনি। সুনিতা ৩০টির বেশি উড়োজাহাজ চালাতে সক্ষমতা অজর্ন করেন। তার ফ্লাইং সময় ছিল ২ হাজার ৭৭০ ঘণ্টা। যখন তিনি মহাকাশ কর্মসূচির নভোচারী হিসেবে নির্বাচিত হন, তখন তিনি ইউএসএস সাইপানে দায়িত্ব পালন করছিলেন। ১৯৯৮ সালে নভোচারী প্রশিক্ষণ শুরু করেন। সুনিতা ২০০৬ সালের ৯ ডিসেম্বর মহাকাশযান ডিসকভারিতে করে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে (আইএসএস)-এ যান। সেখানে তিনি এক্সপেডিশন ১৪ ও ১৫–এ ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করেন। ওই সফরে মহাকাশ স্টেশনে থাকার সময় সুনিতা চারবার মহাকাশে হাঁটেন। সব মিলিয়ে ২৯ ঘণ্টার বেশি সময় তিনি মহাকাশযানের বাইরে কাটান। এবং মহাকাশে ১৯৫ দিনেরও বেশি সময় অতিবাহিত করেন। তিনিই প্রথম নারী নভোচারী হিসেবে দুটি রেকর্ড করেন।
সুনিতা ২০১২ সালের ১৫ জুলাই সয়ুজ টিএমএ–০৫এম–এ চড়ে আবারও মহাকাশ স্টেশনে যান। ১৬ সেপ্টেম্বর তিনি এক্সপেডিশন ৩২-এর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পান। ওই দফায় তিনি তিনবারের বেশি মহাকাশে হেঁটে বেড়ান। এতে সময় লাগে ২১ ঘণ্টারও বেশি। ১২৭ দিন মহাকাশে কাটানোর পর ২০১২ সালের ১১ নভেম্বর পৃথিবীতে ফিরে আসেন সুনিতা। দুটি মহাকাশ সফরে ৩২১ দিনেরও বেশি সময় সেখানে কাটিয়েছেন তিনি।
আরো পড়ুন:
হঠাৎ ত্বক স্পর্শকাতর হয়ে পড়লে করণীয়
ঈদের আগে চুলের যত্নে যা করতে পারেন
আইএসএসের প্রথম পরীক্ষামূলক ক্রু স্টারলাইনার ফ্লাইটের জন্য ২০২২ সালে সুনিতাকে নির্বাচিত করা হয়েছিল। ২০২৪ সালের ৫ জুন ওই যান চালু হয়েছিল। ওই মিশনে বেরি উইলমোর কমান্ডার ছিলেন আর সুনিতা ছিলেন পাইলট। মিশন শুরুর পরদিনই স্টারলাইনার মহাকাশ স্টেশনে অবতরণ করেন। এক সপ্তাহ থাকার কথা থাকলেও কারিগরি জটিলতার কারণে তারা সেখানে আটকা পড়েন। প্রায় ৯ মাস মহাকাশে কাটিয়ে পৃথিবীতে ফিরেছেন এই নভোচারী।
ঢাকা/লিপি