মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আলোচনায় যে ‘ডিপ স্টেট’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়, তার প্রকৃত অর্থ কী? এটা কি শুধু বৈশ্বিক রাজনৈতিক বিষয়াবলি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে মার্কিনি রাজনৈতিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বলয়ের মধ্যে রাখতে বা তা সম্প্রসারণে ব্যবহার হয়ে থাকে? না, অন্য দেশেও এ ধরনের ‘ডিপ স্টেট’ জাতীয় বিষয়টি আছে?
সাধারণত ‘ডিপ স্টেট’ বলতে কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে কিছু সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাকে নিয়ে একটি বিশেষ নেটওয়ার্ককে বোঝানো হয়; যেখানে সরাসরি পার্লামেন্টের বাইরে এবং উচ্চ পর্যায়ের সংবেদনশীল ও গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়ে একটি গ্রুপ বা নেটওয়ার্ক বোঝায়; যাদের পরামর্শে সরাসরি কেন্দ্রীয় সরকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। এই সিদ্ধান্তের অনেক কিছুই পার্লামেন্টের আলোচনার বাইরে থাকতে পারে, যার ফলে সাধারণ জনগণের পক্ষে তা জানা সবসময় সম্ভব হয় না। অর্থাৎ ওই নেটওয়ার্ক বা গ্রুপটি বৈশ্বিক রাজনীতি ও দেশের স্বার্থে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কেউ কেউ মনে করেন, বাংলাদেশে সংঘটিত ২০২৪-এর ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে আমেরিকার একটি ভূমিকা থাকতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থানের ধারাবাহিকতা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রতিটি ঘটনা বিভিন্ন রকমের পরিবর্তন ও কার্যকারণের মধ্য দিয়ে একটি চূড়ান্ত রূপের দিকে অর্থাৎ সরকার পতনের দিকে গেছে। এখানে আমেরিকার ‘ডিপ স্টেট’ কোথায়? বা আদৌ এ ধরনের কোনো কেন্দ্রীয় গোপন শক্তির ভূমিকা ছিল?
এই আলোচনা হয়তো চলতেই থাকবে বাংলাদেশ যতদিন না নিজস্ব শক্তিতে বলীয়ান হয়ে একটি গণতান্ত্রিক সার্বভৌম শক্তির মাধ্যমে রাজনৈতিক নেতৃত্ব নির্বাচন করবে। ওই নেতৃত্ব নিয়মিতভাবে জনগণের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী দেশ পরিচালনা করবে।
পূর্ব এশিয়ায় চীন অনেক দেশকে যেমন– ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, কোরিয়া ইত্যাদি রাষ্ট্রকে সামাজিক অর্থনৈতিক প্রযুক্তিগত সুবিধা দিয়ে তার প্রতিবেশীকে আরও বেশি ক্ষমতায়িত করেছে। তাতে একটি অঞ্চলের পুরোপুরি বার্গেনিং পাওয়ার বা বিশ্বে মাথা তুলে দাঁড়ানোর সুযোগ তৈরি হয়ে গেছে। যাকে চীনারা বলে থাকেন সিল্ক রোড বা বেল্ট অ্যান্ড রুট ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) নীতি। এতে সারাবিশ্বে চায়নিজ অর্থনীতির বিকাশ হয়েছে। তাদের ভোক্তা শ্রেণি তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে ওই রাষ্ট্রগুলোও পারস্পরিক অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা কাজে লাগিয়ে বিশ্ব অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখার সুযোগ তৈরি করেছে।
পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতকে দক্ষিণ এশিয়ায় এ ভূমিকায় দেখা যায়নি। সম্ভাবনাময় সার্ককে কাজে না লাগিয়ে কোনো কোনো ক্ষেত্রে দূরত্ব ক্রমাগত বাড়িয়েছে। এ দেশে যেমন তারা গত ১৬ বছর বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে বিভিন্ন কৌশলে দুর্বল করে রাখার একটি নীতি গ্রহণ করেছে; অন্যদিকে বাংলাদেশের বিজয় দিবস ও স্বাধীনতার স্পর্শকাতর ১৬ ডিসেম্বর ভারতের রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে নরেন্দ্র মোদি সরাসরি পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে তাদের সৈনিকের বিজয় হিসেবে ব্যক্ত করেছেন। অর্থাৎ বাংলাদেশের ১৬ ডিসেম্বরের যে গুরুত্ব ও তাৎপর্য, সেটি ভারতের কাছে সেভাবে তাৎপর্যপূর্ণ নয়। এটি তাদের কাছে ‘ডিপ স্টেট’-এর ক্রিয়াকর্মেরই একটি ফল হিসেবে মনে করেছেন। এত কিছুর পরও আমরা প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চাই এবং সেটি বাংলাদেশের স্বার্থ আগের মতো বিকিয়ে দিয়ে নয়; বরং প্রতিটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ তার স্বার্থ, মর্যাদা ও আত্মসম্মান নিয়ে একটি বার্গেনিংয়ের মাধ্যমে উভয়ের জন্য মঙ্গলজনক বিষয়গুলো বাস্তবায়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে। এ জন্য আমাদের প্রতিবেশী হিসেবে উভয় দেশের দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে। এ জন্য ভারতকে এগিয়ে আসতে হবে আরও বেশি। তাহলে এই পেছনের আজ্ঞাবহ ও কলঙ্কিত ইতিহাস মুছে একটি আলোকিত সম্ভাবনাময় ইতিহাস তৈরি হতে পারে।
বর্তমান বাংলাদেশে ৫ আগস্টের পর আমরা ছয় মাসের বেশি সময় পার করে চলছি। কিছু সংস্কার কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই এখনও আমরা একটি স্বাভাবিক গতি ফিরে পাইনি। সেটা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা সামাজিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশ্লেষণ করলে প্রতিফলিত হয়। এটি একেবারেই যে অস্বাভাবিক, তা নয়। একটি স্বাধীন দেশ বা একটি নতুন গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে সৃষ্ট আকাঙ্ক্ষা একটি সঠিক থাকার আকৃতি বা পথ খুঁজে পেতে একটু তো সময় লাগতে পারে। কিন্তু জাতি ইতোমধ্যে ৫৩ বছর অতিক্রম করে গেছে। পাশাপাশি ছয় মাসের বেশি সময়ের মধ্যে যে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়, তা আশান্বিত হওয়ার খুব বেশি কারণ নেই। এ জন্য আমাদের নিশ্চয় ভাবতে হবে, আমরা অপরের কল্পনাশক্তি বা পরিকল্পিত কোনো ‘ডিপ স্টেট’-এর খেলার পুতুল হয়ে থাকব, নাকি নিজস্ব চিন্তা-চেতনা ও আকাঙ্ক্ষা অর্থাৎ জাতীয় আকাঙ্ক্ষাকে তুলে ধরে একটি জ্ঞানভিত্তিক বিজ্ঞানমনস্ক দেশপ্রেমিক তথা সংবেদনশীল জাতি হিসেবে আপামর জনসাধারণকে নিয়ে একটি সুন্দর সফল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখব? প্রশ্ন রয়ে গেল গণঅভ্যুত্থান-উত্তর অন্তর্বর্তী সরকার ও ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক/সামাজিক শক্তিগুলোর কাছে। একইভাবে সাধারণ মানুষকেও বুঝতে হবে, এত দীর্ঘ সময় যে একটি দেশ অনিয়ম, শৃঙ্খলাহীন, দুর্নীতিগ্রস্তসহ নানান সমস্যার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে, তা থেকে মুক্তির জন্য একটু সময় দরকার। প্রতিক্রিয়া বা প্রতিবাদ বা অধিকার বা দাবি আদায়ের ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত পরিবর্তন কাম্য এবং অন্যের অসুবিধার কারণ যাতে না হয়ে ওঠে, তা লক্ষ্য রাখা দরকার।
অধ্যাপক ড.
মো. আওলাদ হোসেন: পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ গবেষণা ইনস্টিটিউট, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়,গাজীপুর
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: গণঅভ য ত থ ন র জন ত ক সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
রোবটিক ফিজিওথেরাপি কেন্দ্র হচ্ছে দেশেই
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহতদের দেশেই উন্নত চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের লক্ষ্যে রিহ্যাবিলিটেশন ও রোবটিক ফিজিওথেরাপি সেন্টার স্থাপন করতে যাচ্ছে চীন। রাজধানীর শাহবাগে অবস্থিত বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (সাবেক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) এই সেন্টার স্থাপন করা হবে। এরই মধ্যে চীনের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দল এ বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করে গেছে। ফিজিওথেরাপি সেন্টার গড়ে তুলতে কিছু যন্ত্র বিনামূল্যে দিচ্ছে দেশটি। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী জুনের মধ্যে সেবাদানে প্রস্তুত হবে এ চিকিৎসা কেন্দ্র। প্রথমে জুলাই যোদ্ধাদের সেবা নিশ্চিত করা হবে। ধীরে ধীরে অন্য রোগীরাও এ কেন্দ্রে সেবা নিতে পারবেন। চীনা দূতাবাস ও বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আহত হয়েছে ২২ হাজারের বেশি মানুষ। তবে গণঅভ্যুত্থান-সংক্রান্ত বিশেষ সেলের তালিকায় ১১ হাজার ৩০৬ জন আহত স্থান পেয়েছে। এদের অধিকাংশ গুলিতে আহত। ক্ষত অনেক গভীর হওয়ায় দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা প্রয়োজন। কারও কারও উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন। এরই মধ্যে উন্নত চিকিৎসার জন্য ৩৮ জনকে বিদেশে পাঠানো হয়েছে। তাদের মধ্যে ১২ জনকে রোবটিক ফিজিওথেরাপি যন্ত্রের মাধ্যমে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে, যা অনেক ব্যয়বহুল। এ ছাড়া সঙ্গে যাওয়া অ্যাটেনডেন্টদের খাবার, বাসস্থান, অভ্যন্তরীণ যাতায়াত ও চিকিৎসা বাবদ অনেক টাকা ব্যয় হচ্ছে। তাই পক্ষাঘাতগ্রস্ত জুলাই যোদ্ধাদের উন্নত চিকিৎসা দিতে সরকার চীনের সহায়তায় একটি রোবটিক ফিজিওথেরাপি সেন্টার স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে। এতে এদিকে যেমন চিকিৎসা খরচ কমবে, অন্যদিকে বাঁচবে সময়।
এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান বলেন, জুলাই আন্দোলনে আহতদের উন্নত চিকিৎসার জন্য চীন একটি রোবটিক ফিজিওথেরাপি সেন্টার গড়তে চেয়েছে। এটি গড়তে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে জায়গা নিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়। জুলাই যোদ্ধাদের চিকিৎসা নিশ্চিতে এই পুনর্বাসন কেন্দ্রটি প্রস্তুত করা হবে। চীন তাদের চিকিৎসক দল ও আধুনিক যন্ত্র দিয়ে সহায়তা করবে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশে ফিজিওথেরাপির একটি আধুনিক প্রযুক্তির সংযোজন হবে। এই সেন্টার পরিচালনার জন্য চীনের বিশেষজ্ঞ টিম আমাদের দেশের ফিজিওথেরাপিস্টদের প্রশিক্ষণ দেবে। রোবটিক ফিজিওথেরাপি সাপোর্টের এই রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার প্রস্তুত হতে আড়াই থেকে তিন মাস সময় লাগবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এরই মধ্যে যন্ত্রপাতি আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। চলছে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য তালিকা তৈরির কাজ। প্রথমে বাংলাদেশের জনবলকে যন্ত্রপাতি পরিচালনার জন্য ১০ দিন প্রশিক্ষণ দেবে চীনের বিশেষজ্ঞ টিম। এই সেন্টার স্থাপনে চীনের একটি বিশেষজ্ঞ টিম মার্চের শুরুতে সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের বেজমেন্ট, বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এ ব্লকের ৪ তলা এবং বেতার ভবন পরিদর্শন করে গেছে। কিছুদিনের মধ্যে জায়গা নির্বাচন করে আধুনিক যন্ত্রপাতি স্থাপনের কাজ শুরু হবে। তবে সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালটি যেহেতু কোরিয়ান অর্থায়নে করা, তাই সেখানে এ সেন্টার করা যাবে কিনা, সে বিষয়ে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। তাই এই সেন্টার বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে হতে পারে।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম সমকালকে বলেন, জুলাই গণআন্দোলনে সংকটাপন্ন ফাহিম হাসানকে উন্নত চিকিৎসার জন্য থাইল্যান্ড পাঠানো হয়েছে। সেখানে রোবটিক ফিজিওথেরাপি যন্ত্রের সাহায্যে তার চিকিৎসা চলছে। ফাহিমের মতো অনেকের এমন চিকিৎসা প্রয়োজন। তবে সবাইকে বিদেশে চিকিৎসা করাতে অনেক টাকা লাগবে। এই চিকিৎসা দেশে চালু করার জন্য চীনসহ বেশ কয়েকটি দেশের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। আমাদের প্রস্তাবে চীন সাড়া দিয়েছে। এখন শুধু বাস্তবায়নের সময় লাগবে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আহত তিন শতাধিক পক্ষাঘাতগ্রস্ত ব্যক্তি এখনও দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তাদের দীর্ঘমেয়াদি সুচিকিৎসা নিশ্চিতে রোবটিক ফিজিওথেরাপি সেন্টার তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।