শাকবাড়িয়া ও কয়রা নদীর পারে বেড়িবাঁধের গা ঘেঁষে সুন্দরবন থেকে কেটে আনা গোলপাতা স্তূপ করে সাজিয়ে রাখছেন বাওয়ালিরা। তীরে ভেড়ানো আছে গোলপাতা বোঝাই বড় নৌকা। ৫০০ মণের একেকটি নৌকায় বোঝাই করা হয়েছে দুই হাজার থেকে আড়াই হাজার মণ পাতা। নৌকার চারপাশে গাছের বড় বড় গুঁড়ি ঝুলিয়ে রাখা। গোলপাতার ঝাঁপির নিচ থেকে উঁকি দিচ্ছে সুন্দরী-পশুরসহ মূল্যবান গাছের খণ্ড।

মঙ্গলবারের এই চিত্রটির পেছনে লুকিয়ে আছে বন বিভাগের অসাধু কর্মকর্তাদের ঘুষবাণিজ্যের গল্প। চলতি গোলপাতা কাটার মৌসুমে বাওয়ালিদের বিশেষ সুযোগ-সুবিধার জন্য এসব কর্মকর্তা নৌকাপ্রতি আদায় করেছেন ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত। প্রতি নৌকায় সাধারণত সর্বোচ্চ ১৮৬ কুইন্টাল বা ৫০০ মণ গোলপাতা বহনের অনুমতি দেয় বন বিভাগ। এ জন্য প্রতি কুইন্টাল গোলপাতায় বন বিভাগকে ৬০ টাকা করে রাজস্ব দিতে হয়। কিন্তু ঘুষ দেওয়ার সুযোগ কাজে লাগিয়ে বাওয়ালিরা এবার প্রতি নৌকায় চার-পাঁচ গুণ পাতা সংগ্রহ করছেন। পাশাপাশি কেটে আনছেন মূল্যবান গাছও। 

১৩ মার্চ সুন্দরবনের মূল্যবান কাঠ বোঝাই কয়েকটি নৌকাসহ ১০ বাওয়ালিকে আটক করেছিল কোস্টগার্ড। এই সূত্রে অনুসন্ধান চালিয়ে বন বিভাগ কর্মকর্তাদের দুর্নীতির তথ্য জানা গেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, খুলনা রেঞ্জে প্রথম দফায় ৮৯টি নৌকাকে গোলপাতা কাটার অনুমতি দিয়ে প্রায় ১০ লাখ টাকা রাজস্ব আদায় করেছে বন বিভাগ। তবে এর বিপরীতে বাওয়ালিদের অনৈতিক সুবিধা দিয়ে নৌকাপ্রতি ৩০ হাজার টাকা হারে আদায় করা হয়। সব মিলিয়ে এর পরিমাণ প্রায় ২৭ লাখ টাকা।

সুন্দরবনের জেলেরা জানিয়েছেন, এবার বাওয়ালিরা গোলপাতার পাশাপাশি বনের অনেক মূল্যবান গাছ কেটে নিয়ে গেছেন। বনে ঢুকে ইচ্ছামতো ছোট-বড় সুন্দরী, গেওয়া, পশুর গাছ কেটে তছনছ করে ফেলেছেন তারা। অতীতে এমন ক্ষতি ঘটেনি বলেও জেলেদের ভাষ্য।  

বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এবার সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগের খুলনা রেঞ্জে গোলপাতা কাটার মৌসুম ৩ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয়েছে, যা আগামী ৩১ মার্চ শেষ হবে। প্রথম দফায় ২৮ দিনের অনুমতি পেয়ে ৮৯টি নৌকায় গোলপাতা কেটে লোকালয়ে ফিরেছেন বাওয়ালিরা। একেকটি নৌকায় সর্বোচ্চ ১৮৬ কুইন্টাল বা ৫০০ মণ গোলপাতা বহনের অনুমতি দেয় বন বিভাগ। আহরণ করা প্রতি কুইন্টাল গোলপাতায় বন বিভাগকে ৬০ টাকা করে রাজস্ব দিতে হয়।

চলতি মৌসুমে বন কর্মকর্তাদের বাড়তি ঘুষ ও ডাকাতদলের চাঁদা দিতে গিয়ে দুই-তিন গুণ খরচ হচ্ছে বাওয়ালিদের। এমন দাবি করেন সুন্দরবন থেকে ফিরে আসা বাওয়ালি আব্দুস সালাম। এবার তাঁর নৌকায় বাড়তি খরচই হয়েছে ৭০০ হাজার টাকা। সালাম বলেন, ‘এ মৌসুমে ফরেস্টারদের ঘুষ ও ডাকাতের চাঁদার টাকা দিতে গিয়ে লোকসানের মুখে পড়তি হয়েছে। এর আগে কোনো মৌসুমে এত টাকা বাড়তি খরচ করতি হয়নি। নৌকার পাস (অনুমতি) কাটতি সরকারের খাতে ১২ হাজার টাকা জমা দিতি হলিও ফরেস্টারদের ঘুষ দিতি হয়েছে ৩০ হাজার টাকা। এরপরও ডাকাতির চাপ সামলাতে হয়েছে। এ কারণে গোলপাতার সঙ্গে কাঠও আনতি হয়েছে।’

‘বনে ঢুকলি ঘুষ দিতিই হবে। না হলি নানা হয়রানি।’ এমন মন্তব্য করেন আরেক বাওয়ালি খলিলুর রহমান। তাঁর ভাষ্য, ‘জরিমানা তো গুনতি হবে, আবার বেশি বাড়াবাড়ি করলি মামলায় ফাঁসায়ে দেবে।’ আগের চাইতে এখন আরও বেশি ঘুষ দিতে হচ্ছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘ঘুষের টাকা উসুল করতি গেলি ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত গোলপাতার সাথে কাঠ কেটে আনা ছাড়া উপায় নেই।’

চলতি মৌসুমে ১২টি নৌকার পাস সংগ্রহে সহায়তা করেন বাওয়ালি জাহাঙ্গীর আলম। তাঁর ভাষ্য, ‘প্রতিটি নৌকার পাশ নিতি ১৮ হাজার টাকা নিয়েছে বন বিভাগ। এ ছাড়া আলাদাভাবে কুপ (জোন) অফিসারকে খুশি করতি হয়েছে প্রতিটি নৌকার মহাজনকে। বন কর্মকর্তারা খুশি থাকলে বাওয়ালিরাও নানা সুযোগ-সুবিধা পান। এভাবেই মিলেমিশে ব্যবসা করতি হচ্ছে।’

সুন্দরবন বাওয়ালি ফেডারেশনের সভাপতি মীর কামরুজ্জামান বাচ্চুর দাবি, এবার বন বিভাগের ঘুষের সঙ্গে ডাকাতের চাপও বেশি। ডাকাতের চাপ সামলাতে না পারলে আগামীতে কেউ আর রাজস্ব দিয়ে বনে ঢুকতে চাইবেন না।

খুলনা রেঞ্জের গোলপাতা কুপ (জোন) কর্মকর্তা ইসমাইল হোসেন এ বিষয়ে বলেন, ‘বাওয়ালিদের কাছে আমার কোনো দাবিদাওয়া নেই। তারা কিছু দিলে ভালো কথা, না দিলেও কোনো দাবি নেই।’ গোলপাতার আড়ালে গাছ কাটার বিষয়ে প্রশ্নের জবাব তিনি এভাবে দেন, ‘প্রতিটি নৌকাকে পাহারা দেওয়া আমার একার পক্ষে সম্ভব হয় না।’ তবে এবার অতিরিক্ত গোলপাতা বহনের জন্য লক্ষাধিক টাকা জরিমানা আদায়ের তথ্যও দেন তিনি। 

সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এ জেড এম হাছানুর রহমান জানান, গোলপাতার সঙ্গে বন থেকে কোনো গাছ কাটতে পারবেন না বাওয়ালিরা। এমনকি নৌকায় ঝুল হিসেবে কাঠ নেওয়ার অনুমতিও দেওয়া হয়নি। বাওয়ালিদের কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে এমন অনৈতিক সুবিধা কেউ দিয়ে থাকলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: য় বন ব ভ গ কর মকর ত স ন দরবন ক ইন ট ল ন র অন

এছাড়াও পড়ুন:

মৌসুমের আগেই চুরি হচ্ছে সুন্দরবনের মধু

সুন্দরবনে এখন ফুল ফোটার মৌসুম। বনের খলিশা, গরানসহ বহু গাছে শোভা পাচ্ছে ফুল। আর ফুল থেকে চাকে মধু জমা করতে কর্মব্যস্ততা বেড়েছে মৌমাছির। মধুর চাকগুলো পরিণত হওয়ার পর আগামী ১ এপ্রিল থেকে মৌয়ালদের মধু আহরণে সুন্দরবনে প্রবেশের অনুমতি দেবে বন বিভাগ। বৈধ অনুমতির আগেই জেলের বেশে কিছু অসাধু ব্যক্তি বনে ঢুকে অপরিণত চাক কেটে মধু সংগ্রহ করছেন। এতে পূর্ণ মৌসুমে কাঙ্ক্ষিত মধু না পাওয়ার শঙ্কায় পড়েছেন মৌয়ালরা।

গতকাল সোমবার সরেজমিনে সুন্দরবনসংলগ্ন বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, সুন্দরবন থেকে চুরি করে সংগ্রহ করা খলিশা ফুলের মধু চড়া মূল্যে বিক্রি করা হচ্ছে। মৌয়ালদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মৌসুমের শুরুতে সুন্দরবনে খলিশা ও গরান ফুলের মধু আসে। এরপর আসে কেওড়া ফুলের মধু। এর মধ্যে সবচেয়ে দামি হচ্ছে খলিশার মধু।

কয়রা উপজেলার মদিনাবাদ গ্রামের মৌয়াল আবুল কালাম জানান, মধু সংগ্রহ করতে মৌয়ালরা আগামী এপ্রিলের ১ তারিখে সুন্দরবনে ঢুকতে বন বিভাগের অনুমতি পাবেন। অথচ মার্চ মাসেই এলাকার বিভিন্ন জায়গায় ১ হাজার ১০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকায় প্রতি কেজি সুন্দরবনের মধু বিক্রি হচ্ছে। মূলত বেশি দামের আশায় মাছ ধরার অনুমতি নিয়ে সুন্দরবনে যাওয়া জেলেরা এসব মধু সংগ্রহ করছেন। এর ফলে কর্তৃপক্ষের নির্দিষ্ট করে দেওয়া সময়ে বনে ঢুকে প্রত্যাশিত পরিমাণ মধু সংগ্রহ নিয়ে তারা চিন্তায় পড়েছেন।

সম্প্রতি সুন্দরবনে মাছ ধরার অনুমতি (পাস) নিয়ে চুরি করে মধু আহরণের অভিযোগে ছয়জনকে আটক করেছে বন বিভাগ। সুন্দরবনের আন্দারমানিক টহল ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রাশেদুল হাছান বলেন, ‘আমরা সুন্দরবনের চামটার খাল ধরে টহল দিচ্ছিলাম। সেখানে জেলেদের তিনটি নৌকা তল্লাশি করে অবৈধভাবে আহরণ করা মধু, মোমসহ আনুসঙ্গিক মালামাল জব্দ করেছি। সেই সঙ্গে নৌকায় থাকা ছয় জেলেকে গ্রেপ্তার করে বন আইনে মামলা দিয়েছি।’

সুন্দরবনে মাছ ধরার অনুমতি (পাস) নিয়ে চুরি করে মধু আহরণের অভিযোগে ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে বন বিভাগ। সম্প্রতি সুন্দরবনের আন্দারমানিক টহল ফাঁড়ির কার্যালয়ে

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সুন্দরবনের বন কর্মকর্তার ওপর হরিণশিকারিদের হামলা
  • মৌসুমের আগেই চুরি হচ্ছে সুন্দরবনের মধু
  • সুন্দরবনে ২০৫ কেজি হরিণের মাংসসহ এক শিকারি গ্রেপ্তার
  • সুন্দরবনে ৯ কেজি হরিণের মাংসসহ শিকারি আটক
  • হরিণের সাড়ে তিন মণ মাংস ফেলে পালিয়েছে শিকারিরা