শাকবাড়িয়া ও কয়রা নদীর পারে বেড়িবাঁধের গা ঘেঁষে সুন্দরবন থেকে কেটে আনা গোলপাতা স্তূপ করে সাজিয়ে রাখছেন বাওয়ালিরা। তীরে ভেড়ানো আছে গোলপাতা বোঝাই বড় নৌকা। ৫০০ মণের একেকটি নৌকায় বোঝাই করা হয়েছে দুই হাজার থেকে আড়াই হাজার মণ পাতা। নৌকার চারপাশে গাছের বড় বড় গুঁড়ি ঝুলিয়ে রাখা। গোলপাতার ঝাঁপির নিচ থেকে উঁকি দিচ্ছে সুন্দরী-পশুরসহ মূল্যবান গাছের খণ্ড।

মঙ্গলবারের এই চিত্রটির পেছনে লুকিয়ে আছে বন বিভাগের অসাধু কর্মকর্তাদের ঘুষবাণিজ্যের গল্প। চলতি গোলপাতা কাটার মৌসুমে বাওয়ালিদের বিশেষ সুযোগ-সুবিধার জন্য এসব কর্মকর্তা নৌকাপ্রতি আদায় করেছেন ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত। প্রতি নৌকায় সাধারণত সর্বোচ্চ ১৮৬ কুইন্টাল বা ৫০০ মণ গোলপাতা বহনের অনুমতি দেয় বন বিভাগ। এ জন্য প্রতি কুইন্টাল গোলপাতায় বন বিভাগকে ৬০ টাকা করে রাজস্ব দিতে হয়। কিন্তু ঘুষ দেওয়ার সুযোগ কাজে লাগিয়ে বাওয়ালিরা এবার প্রতি নৌকায় চার-পাঁচ গুণ পাতা সংগ্রহ করছেন। পাশাপাশি কেটে আনছেন মূল্যবান গাছও। 

১৩ মার্চ সুন্দরবনের মূল্যবান কাঠ বোঝাই কয়েকটি নৌকাসহ ১০ বাওয়ালিকে আটক করেছিল কোস্টগার্ড। এই সূত্রে অনুসন্ধান চালিয়ে বন বিভাগ কর্মকর্তাদের দুর্নীতির তথ্য জানা গেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, খুলনা রেঞ্জে প্রথম দফায় ৮৯টি নৌকাকে গোলপাতা কাটার অনুমতি দিয়ে প্রায় ১০ লাখ টাকা রাজস্ব আদায় করেছে বন বিভাগ। তবে এর বিপরীতে বাওয়ালিদের অনৈতিক সুবিধা দিয়ে নৌকাপ্রতি ৩০ হাজার টাকা হারে আদায় করা হয়। সব মিলিয়ে এর পরিমাণ প্রায় ২৭ লাখ টাকা।

সুন্দরবনের জেলেরা জানিয়েছেন, এবার বাওয়ালিরা গোলপাতার পাশাপাশি বনের অনেক মূল্যবান গাছ কেটে নিয়ে গেছেন। বনে ঢুকে ইচ্ছামতো ছোট-বড় সুন্দরী, গেওয়া, পশুর গাছ কেটে তছনছ করে ফেলেছেন তারা। অতীতে এমন ক্ষতি ঘটেনি বলেও জেলেদের ভাষ্য।  

বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এবার সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগের খুলনা রেঞ্জে গোলপাতা কাটার মৌসুম ৩ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয়েছে, যা আগামী ৩১ মার্চ শেষ হবে। প্রথম দফায় ২৮ দিনের অনুমতি পেয়ে ৮৯টি নৌকায় গোলপাতা কেটে লোকালয়ে ফিরেছেন বাওয়ালিরা। একেকটি নৌকায় সর্বোচ্চ ১৮৬ কুইন্টাল বা ৫০০ মণ গোলপাতা বহনের অনুমতি দেয় বন বিভাগ। আহরণ করা প্রতি কুইন্টাল গোলপাতায় বন বিভাগকে ৬০ টাকা করে রাজস্ব দিতে হয়।

চলতি মৌসুমে বন কর্মকর্তাদের বাড়তি ঘুষ ও ডাকাতদলের চাঁদা দিতে গিয়ে দুই-তিন গুণ খরচ হচ্ছে বাওয়ালিদের। এমন দাবি করেন সুন্দরবন থেকে ফিরে আসা বাওয়ালি আব্দুস সালাম। এবার তাঁর নৌকায় বাড়তি খরচই হয়েছে ৭০০ হাজার টাকা। সালাম বলেন, ‘এ মৌসুমে ফরেস্টারদের ঘুষ ও ডাকাতের চাঁদার টাকা দিতে গিয়ে লোকসানের মুখে পড়তি হয়েছে। এর আগে কোনো মৌসুমে এত টাকা বাড়তি খরচ করতি হয়নি। নৌকার পাস (অনুমতি) কাটতি সরকারের খাতে ১২ হাজার টাকা জমা দিতি হলিও ফরেস্টারদের ঘুষ দিতি হয়েছে ৩০ হাজার টাকা। এরপরও ডাকাতির চাপ সামলাতে হয়েছে। এ কারণে গোলপাতার সঙ্গে কাঠও আনতি হয়েছে।’

‘বনে ঢুকলি ঘুষ দিতিই হবে। না হলি নানা হয়রানি।’ এমন মন্তব্য করেন আরেক বাওয়ালি খলিলুর রহমান। তাঁর ভাষ্য, ‘জরিমানা তো গুনতি হবে, আবার বেশি বাড়াবাড়ি করলি মামলায় ফাঁসায়ে দেবে।’ আগের চাইতে এখন আরও বেশি ঘুষ দিতে হচ্ছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘ঘুষের টাকা উসুল করতি গেলি ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত গোলপাতার সাথে কাঠ কেটে আনা ছাড়া উপায় নেই।’

চলতি মৌসুমে ১২টি নৌকার পাস সংগ্রহে সহায়তা করেন বাওয়ালি জাহাঙ্গীর আলম। তাঁর ভাষ্য, ‘প্রতিটি নৌকার পাশ নিতি ১৮ হাজার টাকা নিয়েছে বন বিভাগ। এ ছাড়া আলাদাভাবে কুপ (জোন) অফিসারকে খুশি করতি হয়েছে প্রতিটি নৌকার মহাজনকে। বন কর্মকর্তারা খুশি থাকলে বাওয়ালিরাও নানা সুযোগ-সুবিধা পান। এভাবেই মিলেমিশে ব্যবসা করতি হচ্ছে।’

সুন্দরবন বাওয়ালি ফেডারেশনের সভাপতি মীর কামরুজ্জামান বাচ্চুর দাবি, এবার বন বিভাগের ঘুষের সঙ্গে ডাকাতের চাপও বেশি। ডাকাতের চাপ সামলাতে না পারলে আগামীতে কেউ আর রাজস্ব দিয়ে বনে ঢুকতে চাইবেন না।

খুলনা রেঞ্জের গোলপাতা কুপ (জোন) কর্মকর্তা ইসমাইল হোসেন এ বিষয়ে বলেন, ‘বাওয়ালিদের কাছে আমার কোনো দাবিদাওয়া নেই। তারা কিছু দিলে ভালো কথা, না দিলেও কোনো দাবি নেই।’ গোলপাতার আড়ালে গাছ কাটার বিষয়ে প্রশ্নের জবাব তিনি এভাবে দেন, ‘প্রতিটি নৌকাকে পাহারা দেওয়া আমার একার পক্ষে সম্ভব হয় না।’ তবে এবার অতিরিক্ত গোলপাতা বহনের জন্য লক্ষাধিক টাকা জরিমানা আদায়ের তথ্যও দেন তিনি। 

সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এ জেড এম হাছানুর রহমান জানান, গোলপাতার সঙ্গে বন থেকে কোনো গাছ কাটতে পারবেন না বাওয়ালিরা। এমনকি নৌকায় ঝুল হিসেবে কাঠ নেওয়ার অনুমতিও দেওয়া হয়নি। বাওয়ালিদের কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে এমন অনৈতিক সুবিধা কেউ দিয়ে থাকলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: য় বন ব ভ গ কর মকর ত স ন দরবন ক ইন ট ল ন র অন

এছাড়াও পড়ুন:

দুবলার চরের রাসমেলা ঐতিহ্যের সাম্প্রতিক রূপ

দুবলার চর বাংলাদেশের সুন্দরবনের অভ্যন্তরে সমুদ্রের জোয়ার-ভাটার মায়ায় জেগে ওঠা আশ্চর্য একটি দ্বীপভূমি। এর প্রধান পরিচয় হচ্ছে, এটি প্রাণবৈচিত্র্যে ভরপুর সুন্দরবনের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও সামুদ্রিক মাছের শুঁটকি উৎপাদনের প্রাণকেন্দ্র। নানান কিংবদন্তির সূত্র ধরে প্রতিবছরের কার্তিক মাসে (সাধারণত নভেম্বরে) বার্ষিক রাসমেলা এবং পুণ্যস্নানের জন্য এই চরে অনেক পুণ্যার্থী ও পর্যটকের আগমন ঘটে। কিংবদন্তি অনুসারে অনেকে বিশ্বাস করেন, দ্বাপর যুগে শ্রীকৃষ্ণ এই দ্বীপে রাধার অষ্টসখীর সঙ্গে রাসলীলা করেছিলেন। আবার অনেকে মনে করেন, ১৯২৩ সালে মতুয়া সম্প্রদায়ের প্রবর্তক হরিচাঁদ ঠাকুরের একজন বনবাসী ভক্ত পাগল হরিভজন (১৮২৯-১৯২৩) সর্বমানব ও সর্বজীবের মিলনের আকাঙ্ক্ষায় এই দ্বীপে প্রথম রাসমেলার আয়োজন করেছিলেন। মূলত তার পর থেকেই দুবলার চরে রাসমেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। সেই হিসাবে ২০২৪ সালে দুবলার চরের রাসমেলা শতবর্ষ অতিক্রম করেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ভাবনগর ফাউন্ডেশন প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ইউনেস্কো ও বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের সহযোগিতায় ২০২৪ সালে দুবলার চরে অনুষ্ঠিত রাসমেলা ও পুণ্যস্নানের সামগ্রিক তথ্য সংগ্রহে অংশগ্রহণ করে। 
পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা ২০২৪ সালের ১৪ নভেম্বর বিকেল ৪টায় দুবলার চর পৌঁছাই। সেখানে সন্ধ্যা ৭টায় ‘রাস উৎসব উদযাপন কমিটি’র সভাপতি কামাল উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে মতবিনিময় করা হয়। মতবিনিময়কালে জানা যায়, আলোরকোল, দুবলার চর, সুন্দরবনে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মাঙ্গলিক পূজা এবং রাসের পুণ্যস্নান ২০২৪ উদযাপন উপলক্ষে খুলনা ও বাগেরহাট জেলার হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, প্রতিবছরের মতো রাসমেলা ২০২৪ উদযাপনে তিনটি স্লোগান নির্ধারণ করা হয়– ১. ‘ওরে নীল যমুনার জল, কোথায় আমার কৃষ্ণ ঘন শ্যাম’; ২. ‘সাঁতার আর সমুদ্রস্নানে লক্ষ প্রাণের মিলন মেলা এবং ৩. ‘দরবেশ গাজী-কালুর পুণ্যভূমি, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পুণ্যস্নান, সবাই মিলে প্রাণের মিলন মেলা।’ ‘রাস উৎসব উদযাপন’-এর পরিকল্পনা হিসেবে গত ১৫ নভেম্বর শুক্রবার রাতে মূলত রাধাকৃষ্ণ পূজা অর্চনার জন্য নির্ধারণ করা হয়। এ ছাড়া ১৬ নভেম্বর শনিবার ভোরে সমুদ্রতীরে পুণ্যস্নানের জন্য নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু সুন্দরবনের অভ্যন্তরে আলোরকোল, দুবলার চর রাসমেলার স্থানটি যেহেতু দুর্গম সমুদ্রের মধ্যে একটি দ্বীপে অনুষ্ঠিত হয়, সেহেতু সেখানে ভক্ত, পুণ্যার্থী, পর্যটক, গবেষকদের আগমন ঘটতে থাকে দু-এক দিন আগে থেকে। দর্শনার্থীদের কাছে খাবার থেকে শুরু করে লোকশিল্পের বিভিন্ন উপাদান ও পূজার উপকরণ বিক্রি করার লক্ষ্যে রাসমেলা প্রাঙ্গণের বিস্তীর্ণ এলাকায় খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলা থেকে আসা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন ধরনের লোকশিল্পকর্মের অস্থায়ী দোকান সাজিয়ে বসেন। দোকানগুলোতে মাটি, কাঠ, ধাতব, প্লাস্টিক, কাপড়, কাগজ, শঙ্খ প্রভৃতি দিয়ে নির্মিত পুতুল, গহনা, দৈনন্দিন ব্যবহারের সামগ্রী প্রদর্শন ও বিক্রি করা হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের পূজার উপকরণ, যেমন– মোমবাতি, আগরবাতি, ধূপ, প্রসাদের জন্য বাতাসা, খাগড়া, ছাঁচখাজা, ডাব, নারকেল, কলা প্রভৃতি বিক্রি করা হয়। ১৪ নভেম্বর সন্ধ্যার পর থেকেই মেলা প্রাঙ্গণে বিভিন্ন দোকানে ঘুরে ঘুরে ঐতিহ্যগত কারুশিল্পের পাশাপাশি লোকজ খাদ্যের বিচিত্র সমাহার প্রত্যক্ষ করা যায়।
১৪ নভেম্বর রাত ৮টার দিকে আমরা রাসমন্দিরে গিয়ে সাতক্ষীরা থেকে আসা ভাস্কর সুকান্ত কুমার সানার শিল্প-সৌকর্য প্রত্যক্ষ করি। সুকান্ত কুমার সানা দীর্ঘদিন ধরে দুবলার চর রাসমেলার মন্দিরে বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি স্থাপন করে থাকেন। একজন প্রতিভাবান ভাস্কর হিসেবে তিনি এবার রাসমন্দিরে ঝুলন্ত রাধাকৃষ্ণের যুগল মূর্তি স্থাপন করেছেন। ভাবনগর ফাউন্ডেশনের গবেষক দল সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে ভাস্কর সুকান্ত কুমার সানার কাছ থেকে বনবিবিসহ রাধাকৃষ্ণ, গঙ্গা দেবী, শিব প্রভৃতি দেবদেবীর মূর্তি স্থাপন এবং মুসলিম পৌরাণিক পীর গাজী ও কালুর ভাস্কর্য স্থাপনের ঐতিহ্যগত জ্ঞান সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে। পরে তাঁর কাছ থেকে প্রাপ্ত ঐতিহ্যগত জ্ঞান রাসমেলায় আসা দর্শনার্থীদের মাঝে আলোচনার মাধ্যমে প্রচার করে। ভাস্কর সুকান্ত কুমার সানার অভিজ্ঞতার আলোকে দর্শনার্থীদের জানানো হয়, ‘সুন্দরবনকেন্দ্রিক পৌরাণিক দেবী বনবিবি। বনবিবি মূলত সুন্দরবনের যত পশু-পাখি, জীবজন্তু, বৃক্ষ প্রভৃতির রক্ষাকর্ত্রী। একই সঙ্গে তিনি সুন্দরবনে আসা পেশাজীবী মানুষ তথা জেলে, মধু আহরণকারীদের রক্ষাকারী হিসেবে কল্পিত। সুন্দরবন এলাকার হিন্দু-মুসলিমসহ সব সম্প্রদায়ের মানুষ বনবিবিকে মান্য করে থাকেন। বনবিবির পাশাপাশি সমান মর্যাদায় সুন্দরবন অঞ্চলের মানুষ মুসলিম পৌরাণিক পীর গাজী-কালুকে মান্য করে থাকেন। তাই সুন্দরবন অঞ্চলের মানুষ যে কোনো ধরনের মন্দির স্থাপনের সময় হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যান্য দেব-দেবীর পাশাপাশি বনবিবি এবং গাজী-কালুর মূর্তি স্থাপন করে থাকেন। দুবলার চরে রাসমেলার মন্দির স্থাপনের শুরু থেকেই বনবিবি এবং গাজী-কালুর মূর্তি স্থাপনের সমান্তরালে রাধা-কৃষ্ণ ও অন্যান্য দেব-দেবীর মূর্তি স্থাপন করা হয়। এই মন্দিরে হিন্দু-মুসলিম সব সম্প্রদায়ের মানুষ সমান আবেগে ভক্তি নিবেদন করে থাকেন।’
রাসমেলা ২০২৪ উদযাপন কমিটির সভাপতি কামাল উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে মতবিনিময়ের ভিত্তিতে ভাবনগর ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবক দল ১৫ নভেম্বর সকাল ৯টা থেকে ১০টা পর্যন্ত রাসমেলা প্রাঙ্গণ পরিচ্ছন্ন করে। এ ক্ষেত্রে মেলা প্রাঙ্গণে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সব ধরনের পলিথিন প্যাকেট, কোকা-কোলা ও পানির প্লাস্টিকের বোতল, ডাবের খোসা এবং অন্যান্য বর্জ্য অপসারণ করা হয়। 
১৫ নভেম্বর দুপুর ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট ও ফরিদপুর জেলা থেকে আসা মতুয়া ও হিন্দু সম্প্রদায়ের ভক্ত-অনুসারী গ্রামবাসীর সঙ্গে মতবিনিময় করা হয়। এই মতবিনিময়ের মাধ্যমে রাসমেলা ২০২৪-এ অংশগ্রহণের সুবিধা ও অসুবিধা নিয়ে নানা ধরনের তথ্য আহরিত হয়। একই সঙ্গে রাসমেলায় মতুয়া সম্প্রদায়ের মানুষের অংশগ্রহণ সম্পর্কে যেমন নিশ্চিত হওয়া যায়, তেমনি রাসমেলায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে ঐতিহ্য রক্ষায় তাদের নিবেদনের কথা জানা যায়।
রাসমেলা ২০২৪ উদযাপন কমিটির সভাপতি কামাল উদ্দিন আহমেদের অনুমতির ভিত্তিতে ভাবনগর ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ১৫ নভেম্বর বিকেল ৪টায় রাসমেলার প্রাচীন ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত পুথি পাঠের পুনর্জাগরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। উল্লেখ্য, দুবলার চর রাসমেলায় অতীতে পুথি পাঠের ঐতিহ্যগত সংস্কৃতি প্রচলিত ছিল। কিন্তু প্রায় ২০-২৫ বছর রাসমেলায় কাউকে পুথি পাঠ করতে দেখা যায়নি। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ভাবনগর ফাউন্ডেশন রাসমেলার প্রধান মন্দিরের সামনে পুথি পাঠের আসর আয়োজন করে। এই আয়োজনে গোপালগঞ্জের বিখ্যাত পুথিপাঠক নির্মলেন্দু দাস পুথি পাঠ করেন। তিনি স্বরূপেন্দু সরকার রচিত ‘পাগল হরিভজন’ শীর্ষক পুথির নির্বাচিত অংশ পাঠ করে শোনান। এই পুথি পাঠের ঐতিহ্যের সঙ্গে মুহূর্তের মধ্যে রাসমেলায় আসা শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে যুবক-যুবতী এবং বয়স্ক নর-নারী সম্পৃক্ত হন। পুথি পাঠের ভক্তিরসের স্থানগুলোতে অংশগ্রহণকারী নারী ভক্তরা উলুধ্বনি দেন। কেউবা শঙ্খ বাজান। এই সময় কারও কারও চোখ থেকে প্রেম-ভক্তির অশ্রু ঝরে পড়ে। পুথি পাঠ শেষে বিকেল ৫টায় মন্দির প্রাঙ্গণ থেকে মেলার মাঠে বাগেরহাট থেকে আসা ‘গুরুগৃহ মতুয়া মন্দির ও মতুয়া ভক্তবৃন্দ’ কর্তৃক ইউনেস্কো, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর ও ভাবনগর ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে উদযাপিত সূক্ষ্ম সনাতন মতুয়া সম্প্রদায়ের শুভ রাসমেলা ২০২৪ উপলক্ষে একটি আনন্দ শোভাযাত্রা বের করে। এতে বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, যশোর প্রভৃতি জেলা থেকে আসা মতুয়া, হিন্দু, মুসলিম প্রভৃতি সম্প্রদায়ের শতাধিক ভক্ত অংশগ্রহণ করেন। শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারী নর-নারী ভক্তের শিঙা, শঙ্খ, কাঁসি, ঢোল, একতারা, দোতারা, করতাল বাদনে এবং ‘জয় হরি বোল’ ধ্বনিতে পুরো মেলার মাঠ মুখরিত হয়ে ওঠে। শোভাযাত্রায় সামগ্রিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অংশগ্রহণ করেন বন বিভাগের পুলিশ কর্মকর্তা এবং টুরিস্ট পুলিশের সদস্যরা। ১৫ নভেম্বর বিকেল সাড়ে ৫টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত বাংলাদেশের মতুয়া সম্প্রদায়ের নর-নারীর অংশগ্রহণে যথাক্রমে একটি কর্মশালা এবং গ্রামসভা অনুষ্ঠিত হয়। কর্মশালায় ইউনেস্কো কনভেনশন ২০০৩ ফর দ্য শেফগার্ডিং অব ইন্টেনজিবল কালচারাল হেরিটেজের আলোকে রাসমেলার সঙ্গে সম্পৃক্ত ঐতিহ্যগত সংস্কৃতির তথ্য সংগ্রহ ও ইনভেন্টরিকরণের পদ্ধতি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। অন্যদিকে গ্রামসভায় অংশগ্রহণকারীরা রাসমেলায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে কীভাবে ঐতিহ্য সংরক্ষিত হয়, সে সম্পর্কে তথ্য উপস্থাপন করেন। সেই সঙ্গে তারা রাসমেলা প্রাঙ্গণে নারীদের অবস্থান এবং পুণ্যস্নান-পরবর্তীকালে পোশাক পরিবর্তনের জন্য স্থায়ী ভবন নির্মাণের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন। পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, দুবলার চর রাসমেলার সঙ্গে ঐতিহ্যগত সংস্কৃতির সম্পর্ক রয়েছে। যেমন– রাসপূজার সময় মন্দির প্রাঙ্গণে ঐতিহ্যগত বাদ্যযন্ত্র শঙ্খ, শিঙা, কাঁসি, করতাল, মৃদঙ্গ, ঢোল বাজানো হয়। একই সঙ্গে পূজার মন্ত্র, শ্লোক, নাম সংকীর্তন, নৃত্য, আরতি প্রভৃতি ঐতিহ্যগত সংস্কৃতি চর্চিত হতে দেখা যায়। এ ছাড়া কৃত্যাচার হিসেবে মোমবাতি, আগরবাতি প্রজ্বালন করে মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত দেবদেবীর প্রতি ভক্তি নিবেদন করা হয়। প্রসাদ হিসেবে অনেক ভক্ত ফল, মিষ্টান্ন প্রভৃতি মন্দিরে সমর্পণ করেন। অনেক ভক্ত মন্দিরে ভক্তি নিবেদনের পর মন্দির থেকেও প্রসাদ গ্রহণ করেন। এমনকি বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা ভক্তরা মন্দিরে পশু-পাখি সমর্পণের মাধ্যমে মানত শোধ করেন।
১৬ নভেম্বর ভোর ৪টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত দুবলার চর সমুদ্রসৈকতে রাস উৎসব উপলক্ষে পুণ্যস্নান অনুষ্ঠিত হয়। ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, খুলনা জেলার হিন্দু ও মতুয়া সম্প্রদায়ের ভক্তরা সমুদ্রকূলে ফল, মিষ্টান্ন, ফুল প্রভৃতি প্রসাদ নিয়ে বসে আগরবাতি ও মোমবাতি জ্বালিয়ে সমুদ্রকে মা-গঙ্গা কল্পনা করে ভক্তি নিবেদন করেন। ভক্তি নিবেদন শেষে সমুদ্রজলে নেমে স্নান শেষে সূর্য প্রণামের মাধ্যমে পুণ্যস্নান সম্পন্ন করেন। এ সময় একদল জাপানি পর্যটককে পুণ্যস্নান প্রত্যক্ষ করতে দেখা যায়। তারা মূলত পুণ্যস্নানের ছবি ও ভিডিওচিত্র ধারণ করেছিলেন।
রাসমেলা ও পুণ্যস্নানের প্রতিটি স্তরে প্রধানত সূক্ষ্ম সনাতন মতুয়া ও বিভিন্ন বর্ণের হিন্দু সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ প্রত্যক্ষ করা গেছে। তবে রাস উৎসব উদযাপন কমিটির নেতৃত্বে মুসলিম সম্প্রদায়ের উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়। এ ছাড়া রাসমেলার দর্শনার্থী হিসেবেও মুসলিম সম্প্রদায়ের বেশ কিছু লোকের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। পাশাপাশি মেলা প্রাঙ্গণে খাবার ও কুটিরশিল্পের দোকান দিয়েও মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ রাসমেলার সঙ্গে সম্পৃক্ততার জানান দিয়েছেন। আরেকটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখ্য, রাসমেলায় আসা অধিকাংশ নৌকা, ট্রলার, লঞ্চ, জাহাজ প্রভৃতির মাঝি, চালক ও বাবুর্চি মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ। এ ক্ষেত্রে দুবলার চর রাসমেলা ও পুণ্যস্নান প্রকৃত অর্থে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের একটি মিলনক্ষেত্র। v

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • দুবলার চরের রাসমেলা ঐতিহ্যের সাম্প্রতিক রূপ
  • সুন্দরবনে কাঁকড়া ধরতে গিয়ে জেলে গুলিবিদ্ধ