সুনিতা উইলিয়ামস কে, কীভাবে নভোচারী হয়ে উঠলেন তিনি
Published: 19th, March 2025 GMT
অবশেষে অপেক্ষার পালা ঘুচেছে। বাংলাদেশ সময় গতকাল মঙ্গলবার দিবাগত রাত ৩টা ৫৭ মিনিটে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা উপকূল থেকে ৫০ মাইল দূরে সমুদ্রে অবতরণ করেছে নভোচারী সুনিতা উইলিয়ামস ও বুচ উইলমোরকে বহনকারী ক্যাপসুল। প্রায় ৯ মাস তাঁরা মহাকাশ স্টেশনে আটকা পড়েছিলেন। সুনিতা উইলিয়ামস কে, কীভাবে মহাকাশচারী হয়ে উঠলেন তিনি। আসুন তাঁর সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।
সুনিতা উইলিয়ামসের জন্ম ১৯৬৫ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর। যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও অঙ্গরাজ্যের ইউক্লিডে তাঁর জন্ম। এ পর্যন্ত তিনি তিনবার মহাকাশ স্টেশনে গেছেন।
কর্মজীবনসুনিতা ১৯৮৩ সালে মেরিল্যান্ড অঙ্গরাজ্যের অ্যানাপোলিসে যুক্তরাষ্ট্রের নেভাল একাডেমিতে যোগ দেন। ১৯৮৭ সালে তাঁকে র্যাংক দেওয়া হয় এবং নৌ বিমান চলাচল প্রশিক্ষণ কমান্ডে বিমানচালক হিসেবে প্রশিক্ষণ নেন তিনি।
১৯৮৯ সালের জুলাই মাসে জঙ্গি হেলিকপ্টারের প্রশিক্ষণ শুরু করেন সুনিতা। তিনি পারস্য উপসাগরীয় যুদ্ধের প্রস্তুতি এবং ইরাকের কুর্দি অঞ্চলগুলোতে নো-ফ্লাই জোন প্রতিষ্ঠার সময় সহায়তার জন্য হেলিকপ্টার চালিয়েছিলেন। এ ছাড়া ১৯৯২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মায়ামিতে হ্যারিকেন অ্যান্ড্রু আঘাত হানার পরও একই দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৯৩ সালে সুনিতা নেভাল টেস্ট পাইলট হিসেবে কাজ শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে টেস্ট পাইলট প্রশিক্ষক পদে উন্নীত হন তিনি। তিনি বিভিন্ন ধরনের ৩০টির বেশি উড়োজাহাজ চালানোর দক্ষতা অর্জন করেন। এ সময় তাঁর ফ্লাইং সময় ছিল ২ হাজার ৭৭০ ঘণ্টা। যখন তিনি মহাকাশ কর্মসূচির নভোচারী হিসেবে নির্বাচিত হন, তখন তিনি ইউএসএস সাইপানে দায়িত্ব পালন করছিলেন।
মহাকাশযাত্রাসুনিতা উইলিয়ামস ১৯৯৫ সালে মেলবোর্নে ফ্লোরিডা ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং ম্যানেজমেন্টে এমএস ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৯৮ সালে নভোচারী প্রশিক্ষণ শুরু করেন।
এরপর সুনিতা রাশিয়ার রাজধানী মস্কোতে চলে যান। সেখানে রোবোটিকস ও আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন (আইএসএস) পরিচালনার প্রযুক্তি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ নেন। এ সময় তিনি রাশিয়ান ফেডারেল স্পেস এজেন্সির কাজ করেন এবং আইএসএসে অভিযাত্রার জন্য ক্রু হওয়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন।
২০০৬ সালের ৯ ডিসেম্বর মহাকাশযান ডিসকভারিতে করে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে (আইএসএস) যান সুনিতা। সেখানে তিনি এক্সপেডিশন ১৪ ও ১৫–এ ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করেন।
ওই সময় মহাকাশ স্টেশনে থাকার সময় সুনিতা চারবার মহাকাশে হাঁটেন। সব মিলিয়ে ২৯ ঘণ্টার বেশি সময় তিনি মহাকাশযানের বাইরে কাটান। তিনি মহাকাশে ১৯৫ দিনেরও বেশি সময় অতিবাহিত করেন। তিনিই প্রথম নারী নভোচারী হিসেবে দুটি রেকর্ড করেন।
কল্পনা চাওলার পরে সুনীতা হলেন দ্বিতীয় ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন নারী যিনি মহাকাশে গেছেন। কল্পনা চাওলা মহাকাশ মিশন শেষে পৃথিবীতে ফেরার সময় দুর্ঘটনায় নিহত হন।
২০১২ সালের ১৫ জুলাই সুনিতা সয়ুজ টিএমএ–০৫এম–এ চড়ে আবারও মহাকাশ স্টেশনে যান। তিনি এক্সপেডিশন ৩২–এ ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ারের দায়িত্ব পালন করেন। ১৬ সেপ্টেম্বর তিনি এক্সপেডিশন ৩২-এর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পান।
এই দফায় সুনিতা তিনবারের বেশি মহাকাশে হেঁটে বেড়ান। এতে সময় লাগে ২১ ঘণ্টারও বেশি। দুটি ফ্লাইট মিলিয়ে ৫০ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে আইএসএসের বাইরে মহাকাশে হাঁটার রেকর্ড ধরে রাখেন তিনি।
১২৭ দিন মহাকাশে কাটানোর পর ২০১২ সালের ১১ নভেম্বর পৃথিবীতে ফিরে আসেন সুনিতা। দুটি মহাকাশ সফরে ৩২১ দিনেরও বেশি সময় সেখানে কাটিয়েছেন তিনি।
আরও পড়ুনঅবশেষে পৃথিবীতে ফিরছেন সুনিতাসহ চার নভোচারী১৮ মার্চ ২০২৫২০২২ সালে সুনিতাকে আইএসএসের প্রথম পরীক্ষামূলক ক্রু স্টারলাইনার ফ্লাইটের জন্য নির্বাচিত করা হয়েছিল। ২০২৪ সালের ৫ জুন ওই যান চালু হয়েছিল। ওই মিশনে বেরি উইলমোর কমান্ডার ছিলেন আর সুনিতা ছিলেন পাইলট। মিশন শুরুর পরদিনই স্টারলাইনার মহাকাশ স্টেশনে অবতরণ করেন। এক সপ্তাহ থাকার কথা থাকলেও কারিগরি জটিলতার কারণে তাঁরা সেখানে আটকা পড়েন। প্রায় ৯ মাস পর গতকাল তিনি ও বুচ পৃথিবীতে ফিরে আসেন।
আরও পড়ুনমহাকাশ স্টেশনে ৯ মাস আটকে থেকে পৃথিবীতে ফিরলেন বুচ ও সুনিতা৮ ঘণ্টা আগে.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ফ ল ইট
এছাড়াও পড়ুন:
চিরন্তন সাংগ্রাই
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাংশে ছোট-বড় পাহাড়বেষ্টিত প্রায় সাড়ে তেরো হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তন নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল। বিঝু, সাংগ্রাই, বৈসু, বিষু, বিহু, চাংক্রান, সাংক্রাই, সাংলান, পাতা– পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রধানতম সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উৎসব। এ উৎসবকে চাকমারা বিঝু, মারমারা সাংগ্রাই, ত্রিপুরারা বৈসু বা বৈসুক, তঞ্চঙ্গ্যা ও গুর্খারা বিষু, অহমিয়ারা বিহু, ম্রোরা চাংক্রান, খুমীরা সাংক্রাই, খেয়াংরা সাংলান ও সাঁওতালরা পাতা নামে অভিহিত করেন। মারমাদের কাছে সাংগ্রাই উৎসবটি সামাজিক ও ধর্মীয়ভাবে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এ উৎসব তিন দিন ধরে চলে। প্রথম দিনটি ‘পাইংছোয়ায়’, দ্বিতীয় দিনটি ‘আক্যা’ ও শেষ দিনটি আপ্যাইং নামে পরিচিত। পাইংছোয়ায় অর্থ ফুল সংগ্রহ। পাইংছোয়ায় দিনে মূলত পানি দিয়ে বৌদ্ধবিহার, বিহারের আঙিনা, বাড়ি, বাড়ির উঠোন, রাস্তা ইত্যাদি পরিষ্কার করা হয় এবং নানান ধরনের ফুল তুলে সে ফুল দিয়ে সেসব স্থাপনা সাজানো হয়। আক্যা অর্থ অবতরণ। আক্যা বা দ্বিতীয় দিনে অনেকে বিশেষ করে বয়োজ্যেষ্ঠরা বিহারে গিয়ে অষ্টশীল (আটটি বিশেষ নিয়ম) গ্রহণ ও পালন করেন। সাধারণ গৃহীরা ‘নাইংসারে’ (এক প্রকার সুগন্ধিযুক্ত জল) দিয়ে বুদ্ধমূর্তি স্নান করান। তারপর পুণ্যার্জনের জন্য বৌদ্ধ ভিক্ষু ও বয়োজ্যেষ্ঠদের স্নান করানো হয়। তাছাড়া এ দিনে বিভিন্ন বস্তু দান করা হয়। আপ্যাইং অর্থ উড্ডয়ন বা প্রস্থান। আপ্যাইং দিন মূলত নববর্ষ। এ দিনে ‘ম্রাইমা সইকু’ (মারমা নববর্ষ) বরণ করা হয়।
ম্রাইমা সাংগ্রাই-এর অন্যতম আকর্ষণীয় পর্ব হচ্ছে ‘রিলং পোয়ে’ বা জলকেলি উৎসব। রিলং পোয়ে এর জন্ম অনেকটা পৌরাণিক এবং বলা হয়ে থাকে এটি সনাতন পৌরাণিক গল্পের বৌদ্ধ সংস্করণ। এ গল্প অনুযায়ী, ‘ব্রাইহ্মা মাং’ (ব্রহ্মা) ও ‘সাগ্রামাং’ (ইন্দ্র) এর মধ্যে একবার বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধ হয়। এতে ব্রাইহ্মা মাং হেরে যান এবং যুদ্ধের শর্ত অনুযায়ী তিনি নিজের মস্তক কর্তন করেন। পরে এক হাতির মস্তক দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হয়, যাকে আমরা হিন্দু পুরাণে গণেশ নামে চিনি। ব্রাইহ্মা মাং-এর কর্তিত মাথা এত অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন ও গরম ছিল যে এই মস্তক ভূখণ্ডে নিক্ষেপিত হলে পুরো পৃথিবী পুড়ে ধ্বংস হয়ে যাবে। সাগরে নিক্ষেপ করা হলে সাগর শুকিয়ে যাবে এবং আকাশে নিক্ষেপ করা হলে আকাশ ফেটে যাবে। এ সমস্যা সমাধানের জন্য ব্রাইহ্মা মাং-এর সাত কন্যা, যারা সপ্তাহের সাত দিনের নাম ধারণ করে, তাদের হেফাজতে রাখার দায়িত্বভার দেওয়া হয়। তারা ছিন্ন মস্তকটি একটি স্বর্গীয় গুহায় রাখেন। প্রতি বছর একজনের কাছ থেকে আরেকজন দায়িত্ব নেওয়ার সময় গুহা থেকে বের করে মস্তকটি ধৌত করা হয়। তখন থেকেই অশুচিতা ও দুর্ভাগ্যকে ধৌত করে শুচি, সৌভাগ্যপূর্ণ ও মঙ্গলময় জীবনের কামনায় রিলং পোয়ে উদযাপন করা হয় প্রতি বছর। সাংগ্রাই-এর আক্যা দিনে সাগ্রামাং তাঁর স্বর্গীয় আবাস থেকে মনুষ্যলোকে অবতরণ করেন এবং একটি প্রদত্ত সংকেতের মাধ্যমে তিনি জল নিক্ষেপ করেন। সে সময় মনুষ্যজাতি বিভিন্ন পাত্র নিয়ে প্রার্থনা সহকারে মাটিতে জল ঢেলে দেয়। প্রতীকীরূপে এ দিনে প্রথমে বুদ্ধমূর্তিকে নাইংসারের মাধ্যমে স্নান করানোর পরে পর্যায়ক্রমে বৌদ্ধ ভিক্ষু, বয়োজ্যেষ্ঠকে স্নান করানো হয় আশীর্বাদপ্রাপ্ত হয়ে পুণ্য লাভের জন্য। সবশেষে সাধারণ মানুষ নিজেদের মধ্যে জল ছিটিয়ে আনন্দে মেতে ওঠে। v
লেখক: সিনিয়র সহকারী সচিব, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়