আগামী বাজেটে ব্যক্তি খাতের করমুক্ত আয়সীমা বাড়িয়ে ৫ লাখ টাকার করার সুপাারিশ করেছেন দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক ও টেলিভিশনের শীর্ষ নির্বাহীরা। একই সঙ্গে বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বক্তৃতার কলেবর কমানো, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, নির্ভুল ডাটা পরিসংখ্যান তৈরির উদ্যোগ নেওয়ার সুপারিশ দিয়েছেন তারা। 

গতকাল (১৮ মার্চ) সচিবালয়ে অর্থ উপদেষ্টার দপ্তরে অনুষ্ঠিত এক প্রাক বাজেট আলোচনায় তারা এসব সুপারিশ তুলে ধরেন। সভা পরিচালনা ও শুভেচ্ছা বক্তব্যের সময় অর্থসচিব ড.

খায়েরুজ্জামান বলেন, মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশে নেমে আসবে আগামী জুনে। আমাদের রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বাড়ছে। সভাপতিত্ব করেন ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। 

এরপর অর্থ উপদেষ্টা প্রারম্ভিক বক্তব্যে বলেন, আমরা এমন একটা বাজেট দিয়ে যেতে চাই, যেটা পরবর্তীতে রাজনৈতিক সরকার যেই আসুক যেন ছুড়ে ফেলে দিতে না পারে, আমরা সেভাবেই একটি বাজেট দিতে চাই। একই সাথে বৈষম্যহীন, সমতাভিত্তিক সমাজ গঠনের জন্য একটি বাজেট দিয়ে যেতে চাই। আগামী বাজেটে আমরা প্রবৃদ্ধি দিকে নজর দিচ্ছি না বরং আমরা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকেই প্রধান অগ্রাধিকার হিসেবে দেখছি। আমরা শিল্প সুরক্ষার একটা বাজেট দিতে চাই। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং উৎপাদনমুখীতাকে গুরুত্ব দেওয়া হবে।  

এতে ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেস সম্পাদক শামসুল হক জাহিদ বলেন, সামনেই তো নির্বাচন। আর জুনে নতুন বাজেট। ফলে আপনারা যে বাজেট দিতে যাচ্ছেন সেটা পরবর্তী সরকারের জন্য কতটা সহায়ক হবে। এছাড়া বর্তমানে দেশে বিনিয়োগ পরিস্থিতি ভাল নয়। তাই বাজেটে বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও  মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা রাখার সুপারিশ করেন তিনি। 

আরটিভির সিইও আশিকুর রহমান বলেন, বাজেটে করহার না বাড়িয়ে করজাল বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। একক ভ্যাট হার ১৫ হলেও এখনো কোথাও কোথাও ৫/৭/১০ শতাংশ ভ্যাট আছে। এতে করকাঠামোতে বিশৃঙ্খলা হচ্ছে। এখানে একটা শৃঙ্খলা আনা দরকার। একই সঙ্গে করমুক্ত আয়সীমা বাড়িয়ে ৫ লাখ করা যেতে পারে। এছাড়া সারা দেশে ক্যাশলেস লেনদেনের প্রসারেও জোর দিতে হবে। ক্যাশলেস লেনদেনের আওতা বাড়লে কালো টাকার ছড়াছড়িও কমে আসবে। 

যুগান্তর সম্পাদক আবদুল হাই সিকদার বলেন, বিপর্যস্ত অর্থনীতি সামলাতে আপনি সফল হয়েছেন। এজন্য ধন্যবাদ আপনি পেতেই পারেন। আগামী বাজেটটা সত্যিই সত্যিই আপনার জন্য চ্যালেঞ্জ। কেননা মূল্যস্ফীতি অনেক দিন ধরেই। এটাকে আপনি কিছুটা কমিয়ে এনেছেন। এবারের রমজানে দ্রব্যমূল্য নিয়ে যে ধরনের ভয় বা আশঙ্কা করা হয়েছিল, তা হয়নি। অনেকাংশে বাজার স্থিতিশীল রয়েছে। আসছে বাজেটে করমুক্ত আয়সীমা ৫ লাখ টাকা করার প্রস্তাব করেন তিনি। এছাড়া সামাজিক নিরাপত্তা ও সুবিধা ভোগীর সংখ্যা বাড়ানো, টিসিবি কার্যক্রমের আওতা এবং ও বাজেট বাড়ানো, আবার রেশনিং সিস্টেম ফিরিয়ে আনা যায় কি না, সে বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়ার সুপারিশ করেন। আগের ১৫ বছর দেশে ছিল চাপাশিল্প এবং চোয়ালবাজি। এজন্য বাজেটগুলোও সেভাবে দেওয়া হতো। আমরা আশা করবো আগামী বাজেটের আকার হোক বাস্তবমুখী।

সিনিয়র সাংবাদিক শওকত হোসেন মাসুম বলেন, একটা অর্থবছরে প্রকৃতপক্ষে কত সংখ্যক কর্মসংস্থান হয় সে হিসাবটা কখনও আমরা পাইনি। এবার আপনারা সে হিসাব দেবেন বলে আমাদের প্রত্যাশা। গত ১৫ বছরে মানুষের প্রকৃত আয় বাড়েনি। আপনারা একটা মেকানিজম করে এই হিসাবটা বের করুন যে, এক অর্থবছরে কত সংখ্যক কর্মসংস্থান হয়। সবখানে সংস্কার হচ্ছে, আপনারা বাজেট বক্তৃতার আকারে সংস্কার আনুন। ঢাউস আকৃতির বাজেট বক্তৃতার কোনও প্রয়োজন নেই। এটাকে কমিয়ে আনুন। বাস্তবমুখী বাজেট দিন। ডিজিটাল বাংলাদেশের নামে যে বাজেট দেওয়া হত সেটা ছিল একটা অহেতুক। বাজেট উপস্থাপনের নামে দেখানো হতো এক রকমের প্রামাণ্যচিত্র। 

ইন্ডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের অ্যাসোসিয়েট এডিটর শামীম জাহেদী বলেন, কালো টাকা বৈধ করার ক্ষেত্রে কর সমান হবে কি না সেটা আপনারা নজর দেবেন। দেশে এতগুলো টেলিভিশন আছে। দেড় হাজার ক্যাবল অপারেটর আছে। সারা দেশে সাড়ে তিন কোটি বাড়ি আছে। এর ৫৪ শতাংশ বাড়িতে টেলিভিশন দেখা যায়। প্রত্যেকেই ৩০০/৫০০ টাকা দিয়ে সংযোগ নেন। এখানকার টাকাটা আমরা এক টাকাও পাই না। সরকার পায় কি না জানি না। এখানে একটা ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। তাহলে আমরা কিছু টাকার পাইলাম। সরকারও রাজস্ব পাবে। 

সময়ের আলোর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক শাহনেওয়াজ করিম বলেন, সবার জন্য সুখবর ও স্বস্তিদায়ক বাজেট দিন। করদাতাদের জন্য ট্যাক্স কার্ড প্রবর্তন করা যেতে যায় কি না, ভেবে দেখুন। এটা করতে পারলে তারা সম্মানিত বোধ করবেন। 

ডিবিসি নিউজের সম্পাদক লোটন একরাম বলেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের প্রতিফলন বাজেটে থাকবে বলে আমার প্রত্যাশা। করমুক্ত আয়সীমা বাড়িয়ে ৫ লাখ করা হোক। বেকারত্ব কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হোক। এজন্য এসএমই উদ্যোক্তাদের যথেষ্ট সহায়তা দেওয়া প্রয়োজন। সামাজিক নিরাপত্তা খাতের ভাতা বাড়ানো প্রয়োজন। নয়তো বন্ধ করে দিন। এটা মিনিমাম পাঁচ হাজার টাকা হওয়া উচিত। টেলিভিশনে কোনো ওয়েজবোর্ড নাই। একটা ওয়েজবোর্ড এখানেও থাকা প্রয়োজন। ভারতীয় চ্যানেলগুলো এখানে দেদারছে চলছে আমাদের কোন চ্যানেল ভারতে চলে না। এখানেও কাজ করা প্রয়োজন। 

এটিএন বাংলার হেড অব নিউজ মনিউর রহমান বলেন, করমুক্ত আয়সীমা ৫ লাখ করা হোক। বাজেট বাস্তবায়ন কতটুকু হলো সেটা দেখা দরকার। 

এছাড়া বক্তারা আরো বলেন, মানুষের স্বস্তি আসে এ রকম উদ্যোগ নেবেন বলে আমরা আশা করি। বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান স্থবির হয়ে গেছে। সেটা গতিশীল করতে হবে। সরকারের কাজ হবে বেসরকারি খাতকে সম্প্রসারিত করা। জটিল কর কাঠামো সহজ করা দরকার। কর ব্যবস্থা পুরোপুরি ডিজিটালাইজেশন করা দরকার। ক্যাশলেস সোসাইটি গড়ে তোলা জরুরি। স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে, মানুষ যেন বিদেশে না যায় চিকিৎসার জন্য। এলডিসি গ্রাজুয়েশনের প্রস্তুতি আমরা দেখছি না। এর জন্য দৃশ্যমান প্রস্তুতি পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। সামাজিক সুরক্ষা ভাতা বৃদ্ধি করুন। সংবাদপত্র শিল্পের নিউজপ্রিন্টের আমদানি শুল্ক কমিয়ে আনতে হবে। কর্পোরেট কর কমানো যায় কি না, বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন। দুঃখজনক বিষয় হলো, কৃষি খাতে ভর্তুকি কমানো হয়েছে সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা। এটা আগামী বাজেটে যেন করা না হয় তাতে করে কৃষক ও কৃষি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে আমাদের কর অব্যাহতি থেকে বেরিয়ে আসা প্রয়োজন। জিডিপির হিসাবে গোলমাল আছে সেটা সংশোধন করা জরুরি। এলডিসি গ্রাজুয়েশনে প্রস্তুতিটা কী। ব্যবসায়ীরা কেন ভয় পাচ্ছেন। সেটা দেখা দরকার। জুলাই আন্দোলনে যারা আহত-নিহত তাদের জন্য পৃথক বরাদ্দ রাখা যায় কি না, ভেবে দেখা দরকার। এ ছাড়া শিশুদের মানসিক বিকাশে বরাদ্দ বাড়ানো দরকার। ক্যানসার, কিডনিসহ কঠিন রোগে আক্রান্তদের জন্য রাষ্ট্রীয় সহায়তা থাকা দরকার। সরকারি হাসপাতালগুলোতে অনেক মেশিন রয়েছে। সেগুলো নষ্ট। আবার মেরামতের জন্য বাজেট বরাদ্দও দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু পরবর্তীতে তা মেরামত করা হচ্ছে কি না; সেটার মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করা। 

সবার বক্তব্য শোনার পর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা তো আগামী বছর থাকব না। আমরা একটা বাজেট দিয়ে যেতে চাই। যেটা যে কোন রাজনৈতিক সরকার এসে ছুড়ে ফেলে দিতে না পারে। সমতাভিত্তিক দেশ গঠন করতে চাই। দীর্ঘমেয়াদী বাজেট দেওয়া আমাদের ম্যান্ডেট না। আমরা ইমিডিয়েট কিছু করবো। একটা পদচিহ্ন রেখে যাবো। আমাদেরও তো সীমাহীন সংকট। আমরা চেষ্টা করছি সবগুলোকে সমন্বয় করতে। আপনাদের পরামর্শগুলো আমরা নিলাম। এলডিসি উত্তরণের ব্যাপারে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কেননা আমাদের দিকে আরো পাঁচটা দেশ তাকিয়ে আছে। তবে প্রস্তুতিতে আমরা কিছুটা পিছিয়ে আছি। এখন আর বসে থাকা যাবে না। সবাই বলছে, এলডিসি গ্রাজুয়েশন করলে গার্মেন্টস ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কিন্তু আমরা বলছি এতে গার্মেন্টস খাতে খুব একটা প্রভাব পড়বে না। আমরা আয়কর হয়রানি কমাতে চাই। এমন একটা ব্যবস্থা হবে যেখানে আয়কর কর্মকর্তা আয়কর দাতাকে চিনবেনই না। তার কাছে যাওয়ার দরকার হবে না।

ঢাকা/হাসনাত/এনএইচ

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ৫ ল খ কর ব যবস থ র জন য আম দ র সরক র দরক র আপন র এলড স

এছাড়াও পড়ুন:

ইসরায়েলি গণহত্যা ও ভারতী হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে শেকৃবিতে বিক্ষোভ

ফিলিস্তিনে ইসরাইলি গণহত্যা এবং ভারতে মুসলিমদের ওপর কট্টর হিন্দুত্ববাদীদের নির্যাতনের প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শেকৃবি) শিক্ষার্থীরা।

বুধবার (১৯ মার্চ) মাগরিবের নামাজের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের সামনে থেকে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন। এ সময় তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থান প্রদক্ষিণ করে আবার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে ফিরে সমাবেশ করেন। 

এ সময় তারা ‘ফিলিস্তিনের শিশুরা, আমাদের সন্তান’, ‘দুনিয়ার মুসলিম, এক হও এক হও’, ‘গণহত্যার বিরুদ্ধে, ডাইরেক্ট একশন’, ‘ইসরাইলের আগ্রাসন, ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও’, ‘ভারতের দালালের, হুঁশিয়ার সাবধান’সহ নানা স্লোগান দিতে থাকেন।

মিছিল শেষে শেকৃবি শিক্ষার্থী ওয়ালিউল্লাহ বলেন, “যুদ্ধবিরতির পরেও ইসরাইলি বাহিনী ফিলিস্তিনের উপর হামলা করেছে এবং অন্তত ৪১৩ জনকে শহীদ করেছে। এ হামলায় দেড় শতাধিক শিশু এবং অনেক নারী মারা গেছে। এ পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যায় তাদের হামলার উদ্দেশ্য কি।”

ভারতীয় মুসলিম নির্যাতনের ব্যাপারে তিনি বলেন, “হলির নামে ভারতে আমার মুসলিম ভাইদের উপর অত্যাচার করা হচ্ছে, এমনকি একজনকে হত্যা করা হয়েছে। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার অন্যতম মাধ্যম, তাদের অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করে দেওয়া। আমাদের একটি টাকাও যেন ইসরায়েল ও ভারত আমাদের ভাইয়ের ওপর ব্যবহার করতে না পারে।”

শেকৃবি ইসলামিক সোসাইটির উদ্যোগে আয়োজিত এ মিছিলে বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মী, সদস্য ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা উপস্থিত ছিলেন।

ঢাকা/মামুন/মেহেদী

সম্পর্কিত নিবন্ধ