অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কায় অর্থনৈতিক নীতিকৌশলের মিল-অমিল
Published: 19th, March 2025 GMT
বাংলাদেশে নতুন সরকার ক্ষমতা নিয়েছে গত আগস্টে, শ্রীলঙ্কায় সেপ্টেম্বরে। উভয় সরকার প্রায় একই ধাঁচের দুই গণ–অভ্যুত্থানের ফসল। লঙ্কার রাজনৈতিক সংগঠকেরা গণ–অভ্যুত্থান শেষে দীর্ঘ দুই বছর মাঠে সক্রিয় থেকে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা পেল। বাংলাদেশে অনির্বাচিত হলেও রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মতিতে অভ্যুত্থান-পরবর্তী অন্তর্বর্তীকালীন উপদেষ্টারা ক্ষমতায়।
দক্ষিণ এশিয়ার এই দুই পরিবর্তনের ওপর নজর রাখছে বিশ্বের অনেকে। দেখতে চাইছে উভয় সরকার কীভাবে নিজ নিজ জনগণের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রত্যাশা পূরণ করে; বিশেষ করে, যখন তাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার অনেকখানি আইএমএফের হাতে।
আন্দোলনের শক্তিগুলো লঙ্কাকে যেভাবে চালাচ্ছেশ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয় গত সেপ্টেম্বরে। নভেম্বরে হয় পার্লামেন্ট নির্বাচন। উভয় নির্বাচনে জেভিপির (জনতা বিমুক্তি পেরামুনা) নেতৃত্বে এনপিপি (ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার) ক্ষমতা পায়। প্রেসিডেন্ট হয়েছেন অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকে; প্রধানমন্ত্রী হরিণী অমরাসুরিয়া। উভয়ে প্রায় সমবয়সী এবং বয়স ষাটের নিচে।
জেভিপি শুরুতে চমক দিয়েছে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে একজন বুদ্ধিজীবীকে নিয়োগ দিয়ে। দেশটিতে মোট ভোটারের ৫৬ শতাংশ নারী। তবে গণ–অভ্যুত্থানে নারীদের বড় ভূমিকা ছিল বলে সরকার এমন করেছে, বিষয়টা তা নয়। এই নিয়োগের ভেতর দিয়ে দলটি অতীতের ‘কট্টর’ বামপন্থী ইমেজ ভেঙে মধ্যপন্থায় পক্ষপাতের কথা জানাচ্ছে।
দেশটিতে কারও স্ত্রী বা কন্যা না হয়ে কোনো নারী যোগ্যতার জোরে দেশের সর্বোচ্চ স্তরের কোনো পদে নিয়োগ পাওয়ার ঘটনা এই প্রথম। অন্যান্য নিয়োগেও এনপিপি কুলীন রাজনৈতিক অঙ্গনের বাইরের মানুষদের নিয়োগ দিয়ে চলেছে।
শ্রীলঙ্কার মানুষ দীর্ঘ সাত দশক ধরে তথাকথিত এক দ্বিদলীয় কুলীন শাসনে ক্লান্ত। অভ্যুত্থানের এক নীরব চাওয়া ছিল এই সাজানো ছক ভাঙা। জেভিপি সে কাজ করে চলেছে ধীর লয়ে।
দেশের সবকিছুকে সিংহলি-তামিল মেরুকরণে দেখার বদলে জেভিপি সমস্যাগুলো ধনী-গরিবের চোখ দিয়ে দেখছে, সেভাবে সমাধানের কথা বলছে। সে কারণেই সিংহলি প্রধান দল হয়েও নির্বাচনী প্রচারণায় তারা জাতিগত বিষয়গুলো সামনে আনা থেকে বিরত থেকেছে।
এককভাবে ক্ষমতায় যাওয়া ও থাকার সম্ভাবনার পরও জেভিপি সমমনা ছোট ছোট সংগঠনের সঙ্গে জোট গড়েছে। এই জোটে আছেন বিভিন্ন কর্মজীবী-পেশাজীবী সংগঠন ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। এ রকম জোটের কারণে অনূঢ়া প্রতিনিয়ত সমাজের সব স্তর থেকে চাওয়া-পাওয়ার বার্তা পাচ্ছেন এবং সে অনুযায়ী অর্থনৈতিক নীতিকৌশল ঠিক হচ্ছে। অনেক পেশাজীবী সংগঠকদের মন্ত্রিসভায় নেওয়া হয়েছে। জোটের সাংগঠনিক চেহারার কারণেই এনপিপি জোটের প্রথম রাষ্ট্রীয় বাজেট বেশ ব্যবহারিক ধাঁচের হয়েছে।
আরও পড়ুনশ্রীলঙ্কার নতুন প্রেসিডেন্ট অনূঢ়া দিশানায়েকে যেভাবে চমক দেখালেন২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪নতুন সরকার অর্থনৈতিক কাজে হাত লাগিয়েছে তিন অগ্রাধিকার সামনে রেখে: দারিদ্র্য কমানো, অর্থনীতিকে ক্রমে ডিজিটালাইজ করা এবং জনজীবনকে পরিবেশসম্মত করা। শেষের কাজে তারা পরিবেশসম্মত অর্থনীতির সঙ্গে নিজস্ব সংস্কৃতির যোগ ঘটাতে চায়। অনূঢ়া মনে করছেন, এতে পর্যটনশিল্প চাঙা হবে।
এ বছর লঙ্কান সরকার কেবল পর্যটন থেকে ৫ বিলিয়ন ডলার আয় করতে চায়। মার্চের শুরুর সাত দিন দেখা গেল, গড়ে সাড়ে সাত হাজার পর্যটক আসছেন এখানে। তবে বাজেট–ঘাটতি কমাতে বাড়তি রাজস্ব দরকার। সে জন্য সিগারেট, পানীয়সহ এমন কিছু খাতে কর বাড়ানো হয়েছে, যা মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্তদের চাপে ফেলবে কম। সরকারের পরিকল্পনা হলো আগামী ১২ মাসে রাজস্ব ২৩ শতাংশ বাড়ানো। একই সময়ে খরচ ১৩ শতাংশ বৃদ্ধিতে সীমিত রাখা।
আগের মতোই নতুন বাজেটে সামরিক খাত ব্যয় বরাদ্দের বেশ বড় অংশ পাচ্ছে। ১২ বিলিয়ন রুপি বাড়িয়ে দেশটির সশস্ত্র বাহিনী এবার পেল ৪৩৭ বিলিয়ন রুপি। জনসংখ্যাপ্রতি সামরিক ব্যয়ে শ্রীলঙ্কা বিশ্বে বেশ এগিয়ে। একই সময় তামিলদের খুশি করতে জাফনার কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির উন্নয়নে ১০০ মিলিয়ন রুপি দিয়েছে সরকার। গৃহযুদ্ধের সময় সিংহলি সৈনিকেরা এই লাইব্রেরি পুড়িয়ে দিয়েছিল।
তামিল এলাকাগুলোর সড়ক উন্নয়নে ৫ বিলিয়ন খরচ করছে নতুন সরকার। মালয়দের জন্যও ৭-৮ বিলিয়ন রুপি রাখা হয়েছে। এসবের মাধ্যমে জেভিপি অর্থনৈতিক পুনর্বণ্টনের ধারণায় সংখ্যালঘুদের যুক্ত করছে। সরকার অর্থনীতি নিয়ে এত বেশি মনোযোগী যে প্রেসিডেন্ট নিজে এই মন্ত্রণালয় দেখছেন।
বিদেশনীতিতে জেভিপি তার আগের তীব্র ভারতবিরোধী অবস্থান থেকে সরে এশিয়ার প্রধান দুই শক্তির সঙ্গে সমান ধাঁচে সম্পর্ক রাখার কৌশল নিয়েছে। চীন-ভারত কোনো এক পক্ষের দিকে হেলে পড়তে চায় না তারা। অনূঢ়া ইতিমধ্যে উভয় দেশই সফর করেছেন।
বাংলাদেশের এখনকার সরকারের সঙ্গে তাদের একটা মিলের জায়গা হলো, ভারতের সঙ্গে বিগত সময়ে প্রশ্নবিদ্ধ যেসব চুক্তি হয়েছে, সেগুলো পর্যালোচনা করছে এনপিপি সরকার। আগামী মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীলঙ্কা সফরে এলে এসব চুক্তির পরিণতি পরিষ্কার হবে। জেভিপির প্রবল আপত্তি টের পেয়ে ইতিমধ্যে আদানিরা বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে ফিরে গেছে। এই চুক্তির শর্ত শ্রীলঙ্কাবান্ধব ছিল না।
আরও পড়ুনগণ-অভ্যুত্থানের পরের শ্রীলঙ্কা থেকে যা শেখার আছে২৬ আগস্ট ২০২৪তবে অনূঢ়া আন্তদেশীয় সম্পর্কে ভারসাম্যের কথাও ভুলছেন না। কারণ, দেশটির পর্যটন খাতের বড় এক ভরসা আবার ভারতীয়রা। রুশদের পর তারাই বেশি আসে এ দেশে। ট্রাম্পের আমেরিকাকে দেখে অনূঢ়া বিদেশনীতিতে বেশ সতর্ক এবং চীন-ভারত উভয়কে শান্ত রেখে এগোতে চান।
আদানি প্রশ্নে জেভিপির অবস্থান বাংলাদেশের চেয়ে বেশ সাহসী বলতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকার এখন আদানির সঙ্গে করা বিতর্কিত অনুরূপ চুক্তি কেবল ‘পুনর্মূল্যায়নের’ কথা বলছে। অথচ অভ্যুত্থানের আগে এখানে আন্দোলনকারীরা এই চুক্তির শর্ত নিয়ে বেশ ক্ষুব্ধ ছিলেন। বিশেষ করে চুক্তিতে কর অব্যাহতির শর্ত ছিল বিস্ময়কর রকমের।
দুই সরকারের মিল-অমিল এবং বাধাজেভিপি ও অনূঢ়ার সঙ্গে অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশের সরকারের কাজের তুলনা করলে দেখা যায়, প্রথমোক্তরা প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে এত দিনকার কুলীন পরিবারগুলোর বদলে মাঠের মেধাবী সংগ্রামীদের নিয়োগ দিচ্ছে। বিশেষ করে বিভিন্ন পেশাজীবী ও কর্মজীবী সংগঠকদের। বাংলাদেশে সেটা ঘটছে দেশ-বিদেশের ‘সুশীল’ ব্যক্তিদের দ্বারা।
বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ পদে এমন অনেক রাজনৈতিক নিয়োগ হচ্ছে, যাঁরা মূলত ‘একাডেমিশিয়ান’। মেঠো জনসমাজকে তাঁদের পরিচয় জানতে চারদিকে খোঁজখবর করতে হয়। বড় বড় পেশাজীবী জনগোষ্ঠীর সঙ্গে যাঁদের জৈব বা অর্গানিক সম্পর্ক গড়ে উঠছে না। অভ্যুত্থানে যুক্ত উচ্চশিক্ষিত তরুণীরাও এখানে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোয় বড় সংখ্যায় সামনের কাতারে সংযুক্ত হয়নি বা হতে পারেনি।
বাংলাদেশের সরকার বিভিন্ন খাতভিত্তিক কমিশন করে সংস্কারের কাজে যখন এগোতে চাইছে, লঙ্কায় অনূঢ়াদের জোট সেই কাজটা করতে খোদ বিভিন্ন পেশার মানুষকে রাজনৈতিকভাবে জোটবদ্ধ করে নিয়েছে। তারা কমিশন-কাজের আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতার পুরো পথটা এড়িয়ে সরাসরি সংশ্লিষ্টদের প্রশাসনিক কাজের জায়গায় বসিয়েছে।
বাংলাদেশে সরকার পুনঃপুন রাজনৈতিক সমঝোতার কথা বলছে। কিন্তু অর্থনৈতিক বঞ্চনা কমানো বা সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী বাড়ানোর মতো খাতে পদক্ষেপ নিতে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের জন্য অপেক্ষা করতে হবে কেন, সেটা বোঝা মুশকিল। সচরাচর কোনো দলের এসব বিষয়ে আপত্তি ওঠার কথা নয়।
৬ মার্চ প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, গত জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দারিদ্র্যমুখী সরকারি চাল–গম বিতরণ প্রায় ১১ শতাংশ কমে গেছে। এর মধ্যে বেশি কমেছে ত্রাণমূলক বিতরণ।
দেখা যাচ্ছে, সংস্কারের নাগরিক কোলাহলের মধ্যে দরিদ্র মানুষ ও দুস্থ নারী রাষ্ট্রের মনোযোগ থেকে ছিটকে পড়েছেন। পেশাজীবী-কর্মজীবীদের মধ্যে যাঁরা কেবল মহাসড়ক বা রেলপথ অবরোধ করে জনদুর্ভোগ বাড়াতে পারছেন, তাঁদের বরাতে বাড়তি কিছু জুটছে।
এখানে অভ্যুত্থান শেষে বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক কে এ এস মুরশিদের নেতৃত্বে অর্থনৈতিক কৌশলবিষয়ক একটা টাস্কফোর্স হয়। মাস দুয়েক হলো খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদদের ১২ জনের এই দল তাদের ৫২৬ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এর সাড়ে তিন মাস আগে পণ্ডিতদের তৈরি অর্থনীতিবিষয়ক আরেকটা ‘শ্বেতপত্র’ও জমা পড়েছে।
এ রকম প্রতিবেদনগুলো থেকে এখনই করা সম্ভব কাজগুলোর পদক্ষেপ খুঁজছে মানুষ। পরিসংখ্যান ব্যবস্থা উন্নয়নের মতো রাজনৈতিক বিতর্কহীন নিরীহ, কিন্তু জরুরি কাজগুলো কেন গতি পেল না, সেটি উপরিউক্ত কমিটির সদস্যরাও বুঝতে পারছেন না। তবে সরকার বিগত আমলের অর্থ পাচারের মোটা লিকেজগুলো বন্ধ করায় অর্থনীতিতে বেশ দম ফিরেছে। হুন্ডি কমায় বৈধ পথে রেমিট্যান্সপ্রবাহ বেড়েছে।
কলম্বোয় দৃশ্যপটটি অবশ্য অন্য রকম ব্যবহারিক চেহারার। সেখানে নেতাদের গ্যালারিতে হাততালি পাওয়ার দিকে মনোযোগ খুব কম। এটাও দেখা যাচ্ছে, সরকার সিংহলি-তামিল পুরোনো বাইনারির বদলে মোকাবিলা করতে চাইছে অর্থনৈতিক বাইনারি। ফলে দরিদ্র তামিলরাও এনপিপিকে ভোট দিয়েছে। এরই ফলে বোধ হয়, তামিলদের পুলিশ বাহিনীতে নিয়োগের হার বাড়ানোর কথা বলছে সরকার।
বাংলাদেশে অভ্যুত্থান ‘বৈষম্য’ কমানোর কথা বলে সফল হলেও দিন যত এগিয়েছে ‘সাংস্কৃতিক’ যুদ্ধে ভাগ করা হয়েছে মানুষকে। সংখ্যালঘু জাতি ও ধর্মীয় সত্তাগুলো সে কারণে অভ্যুত্থানের ভরকেন্দ্র থেকে ইতিমধ্যে মানসিকভাবে ছিটকে পড়ছে।
তবে উভয় সরকারকে আইএমএফের নির্দেশনা মেনে চলতে হচ্ছে কড়াকড়িভাবে। বাজেট পরিকল্পনা পেশের পর এক আলোচনায় অনূঢ়া খোলামেলাই বলেছেন, ‘শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি এ মুহূর্তে স্বাধীন নয়। আমরা আইএমএফের নজরদারিতে আছি।’
বলা বাহুল্য, বাংলাদেশও তা–ই। শ্রীলঙ্কার বেলায় এই নিয়ে এনপিপি জোটে যথেষ্ট আপত্তি ও ভিন্নমত আছে। বাংলাদেশে সরকারে থাকা ছাত্র প্রতিনিধিদের আইএমএফের অবস্থান সম্পর্কে স্পষ্ট কিছু জানা যায় না। ফলে আসন্ন বাজেটে হয়তো আইএমএফের চাওয়ারই ছাপ থাকবে।
শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ১৭ ফেব্রুয়ারি সরকার নতুন যে বাজেট পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে, তাতে রাষ্ট্রীয় খরচ ও ভর্তুকির লাগাম টেনে রাখা হয়েছে। কর্মচারীদের বেতন প্রত্যাশা অনুযায়ী বাড়েনি।
বোঝা যাচ্ছে, জেভিপি তাদের আগের বামপন্থী ধারার সঙ্গে এক ধাপ আপস করতে চলেছে। ২০২২–এর আওয়াজ ‘সিস্টেম চেঞ্জে’ যাবে না তারা চট করে। তবে মধ্য-বাম সুশাসনমুখী কিছু সংস্কার করতে চায় তারা। স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা এবং দুর্নীতি কমানোর দিকেই এ মুহূর্তে জোর তাদের।
আপাতত বেসরকারি উদ্যোক্তাদের চালকের আসনে থাকতে দেওয়া হবে। রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত লোকসানি প্রতিষ্ঠানগুলোয় সরকারি-বেসরকারি যৌথ ব্যবস্থাপনায় পরিচালনার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে বাজেটে। এই নিরীক্ষার ওপর অনূঢ়ার অর্থনৈতিক নীতির ভাগ্য পরীক্ষা হবে। তবে বন্যার শিকার কৃষকেরা ভর্তুকির দাবিতে কিছু বিক্ষোভ করেছে এরই মধ্যে। আইএমএফের কড়া শাসনে সেসব দাবির অনেকখানি মেটানো যাচ্ছে না। চালের দামও বাড়তি। অর্থনীতির সূচকগুলো যদিও ইতিবাচক, কিন্তু খুব ধীরে পরিবর্তন ঘটছে।
বাংলাদেশ ভ্যাটের বেলায় ‘প্রেসক্রিপশন’ বেশ উদারভাবে অনুসরণ করলেও অর্থনীতিতে খুব বেশি গতি সঞ্চার করতে পারেনি এবং পণ্য-শুল্ক বাড়ায় মূল্যস্ফীতি ডাবল ডিজিটের নিচে রাখা দুরূহ হয়ে গেছে। আইএমএফ ৪৭০ কোটি ডলার চুক্তির চতুর্থ কিস্তিও ছাড় করেনি। আগামী জুনে পরের কিস্তিসহ একসঙ্গে সিদ্ধান্ত হবে বলছে তারা। সেটা পেতে স্বভাবত এই তিন মাস সরকার এখানে কৃচ্ছ্র সাধনের নীতিতেই থাকবে।
উভয় দেশ বিনিয়োগের অভাবজনিত কর্মসংস্থানের সংকটেও আছে। উভয়ের আয়ের বড় অংশ চলে যাচ্ছে ঋণ পরিশোধে। বিগত সরকারগুলোর আমলে ঋণ করে অবকাঠামো গড়ার এই উন্নয়ন মডেল দেশ দুটিকে ধরিয়ে দিয়েছিল আন্তর্জাতিক মহলই। সেই ‘পাপের’ দায় শোধ করতে আরও বহুদিন লাগবে উভয় দেশের।
ফলে শিগগিরই বাংলাদেশ বা শ্রীলঙ্কায় রাষ্ট্রীয় আয় থেকে বিনিয়োগ বাড়ানোর সুযোগ কম। ফলে অভ্যন্তরীণ কর্মসংস্থান বাড়ার সুযোগও কম। কিন্তু অভ্যুত্থান উভয় দেশের তরুণসমাজের সামনে অপেক্ষাকৃত উন্নত জীবনের যে প্রত্যাশা তৈরি করেছে, তার চাপ বাংলাদেশে ইতিমধ্যে বেশ টের পাওয়া যাচ্ছে।
মধ্য–বাম ধারার অভ্যুত্থান ইতিমধ্যে মধ্য-ডান চেহারা নিয়েছে। অভ্যুত্থানের মৌলিক রাজনৈতিক অঙ্গীকার পথ হারাতেই দক্ষিণপন্থী মহল যে সুযোগ নিতে তৎপর হবে, সেটা অস্বাভাবিক নয়। অনূঢ়া তাই মরিয়া চেষ্টা করে যাচ্ছেন, যেকোনো উপায়ে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ বাড়িয়ে বেকারত্ব কমানোর। বাংলাদেশে আগামী নির্বাচনে যারা নির্বাচিত হয়ে আসবে, তাদের সামনেও একই চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে।
আলতাফ পারভেজ: গবেষক ও লেখক
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আইএমএফ র র জন ত ক উভয় দ শ য় সরক র সরক র র ন সরক র মন ত র র বর ত এনপ প ক ষমত প রথম
এছাড়াও পড়ুন:
অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কায় অর্থনৈতিক নীতিকৌশলের মিল-অমিল
বাংলাদেশে নতুন সরকার ক্ষমতা নিয়েছে গত আগস্টে, শ্রীলঙ্কায় সেপ্টেম্বরে। উভয় সরকার প্রায় একই ধাঁচের দুই গণ–অভ্যুত্থানের ফসল। লঙ্কার রাজনৈতিক সংগঠকেরা গণ–অভ্যুত্থান শেষে দীর্ঘ দুই বছর মাঠে সক্রিয় থেকে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা পেল। বাংলাদেশে অনির্বাচিত হলেও রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মতিতে অভ্যুত্থান-পরবর্তী অন্তর্বর্তীকালীন উপদেষ্টারা ক্ষমতায়।
দক্ষিণ এশিয়ার এই দুই পরিবর্তনের ওপর নজর রাখছে বিশ্বের অনেকে। দেখতে চাইছে উভয় সরকার কীভাবে নিজ নিজ জনগণের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রত্যাশা পূরণ করে; বিশেষ করে, যখন তাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার অনেকখানি আইএমএফের হাতে।
আন্দোলনের শক্তিগুলো লঙ্কাকে যেভাবে চালাচ্ছেশ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয় গত সেপ্টেম্বরে। নভেম্বরে হয় পার্লামেন্ট নির্বাচন। উভয় নির্বাচনে জেভিপির (জনতা বিমুক্তি পেরামুনা) নেতৃত্বে এনপিপি (ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার) ক্ষমতা পায়। প্রেসিডেন্ট হয়েছেন অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকে; প্রধানমন্ত্রী হরিণী অমরাসুরিয়া। উভয়ে প্রায় সমবয়সী এবং বয়স ষাটের নিচে।
জেভিপি শুরুতে চমক দিয়েছে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে একজন বুদ্ধিজীবীকে নিয়োগ দিয়ে। দেশটিতে মোট ভোটারের ৫৬ শতাংশ নারী। তবে গণ–অভ্যুত্থানে নারীদের বড় ভূমিকা ছিল বলে সরকার এমন করেছে, বিষয়টা তা নয়। এই নিয়োগের ভেতর দিয়ে দলটি অতীতের ‘কট্টর’ বামপন্থী ইমেজ ভেঙে মধ্যপন্থায় পক্ষপাতের কথা জানাচ্ছে।
দেশটিতে কারও স্ত্রী বা কন্যা না হয়ে কোনো নারী যোগ্যতার জোরে দেশের সর্বোচ্চ স্তরের কোনো পদে নিয়োগ পাওয়ার ঘটনা এই প্রথম। অন্যান্য নিয়োগেও এনপিপি কুলীন রাজনৈতিক অঙ্গনের বাইরের মানুষদের নিয়োগ দিয়ে চলেছে।
শ্রীলঙ্কার মানুষ দীর্ঘ সাত দশক ধরে তথাকথিত এক দ্বিদলীয় কুলীন শাসনে ক্লান্ত। অভ্যুত্থানের এক নীরব চাওয়া ছিল এই সাজানো ছক ভাঙা। জেভিপি সে কাজ করে চলেছে ধীর লয়ে।
দেশের সবকিছুকে সিংহলি-তামিল মেরুকরণে দেখার বদলে জেভিপি সমস্যাগুলো ধনী-গরিবের চোখ দিয়ে দেখছে, সেভাবে সমাধানের কথা বলছে। সে কারণেই সিংহলি প্রধান দল হয়েও নির্বাচনী প্রচারণায় তারা জাতিগত বিষয়গুলো সামনে আনা থেকে বিরত থেকেছে।
এককভাবে ক্ষমতায় যাওয়া ও থাকার সম্ভাবনার পরও জেভিপি সমমনা ছোট ছোট সংগঠনের সঙ্গে জোট গড়েছে। এই জোটে আছেন বিভিন্ন কর্মজীবী-পেশাজীবী সংগঠন ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। এ রকম জোটের কারণে অনূঢ়া প্রতিনিয়ত সমাজের সব স্তর থেকে চাওয়া-পাওয়ার বার্তা পাচ্ছেন এবং সে অনুযায়ী অর্থনৈতিক নীতিকৌশল ঠিক হচ্ছে। অনেক পেশাজীবী সংগঠকদের মন্ত্রিসভায় নেওয়া হয়েছে। জোটের সাংগঠনিক চেহারার কারণেই এনপিপি জোটের প্রথম রাষ্ট্রীয় বাজেট বেশ ব্যবহারিক ধাঁচের হয়েছে।
আরও পড়ুনশ্রীলঙ্কার নতুন প্রেসিডেন্ট অনূঢ়া দিশানায়েকে যেভাবে চমক দেখালেন২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪নতুন সরকার অর্থনৈতিক কাজে হাত লাগিয়েছে তিন অগ্রাধিকার সামনে রেখে: দারিদ্র্য কমানো, অর্থনীতিকে ক্রমে ডিজিটালাইজ করা এবং জনজীবনকে পরিবেশসম্মত করা। শেষের কাজে তারা পরিবেশসম্মত অর্থনীতির সঙ্গে নিজস্ব সংস্কৃতির যোগ ঘটাতে চায়। অনূঢ়া মনে করছেন, এতে পর্যটনশিল্প চাঙা হবে।
এ বছর লঙ্কান সরকার কেবল পর্যটন থেকে ৫ বিলিয়ন ডলার আয় করতে চায়। মার্চের শুরুর সাত দিন দেখা গেল, গড়ে সাড়ে সাত হাজার পর্যটক আসছেন এখানে। তবে বাজেট–ঘাটতি কমাতে বাড়তি রাজস্ব দরকার। সে জন্য সিগারেট, পানীয়সহ এমন কিছু খাতে কর বাড়ানো হয়েছে, যা মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্তদের চাপে ফেলবে কম। সরকারের পরিকল্পনা হলো আগামী ১২ মাসে রাজস্ব ২৩ শতাংশ বাড়ানো। একই সময়ে খরচ ১৩ শতাংশ বৃদ্ধিতে সীমিত রাখা।
আগের মতোই নতুন বাজেটে সামরিক খাত ব্যয় বরাদ্দের বেশ বড় অংশ পাচ্ছে। ১২ বিলিয়ন রুপি বাড়িয়ে দেশটির সশস্ত্র বাহিনী এবার পেল ৪৩৭ বিলিয়ন রুপি। জনসংখ্যাপ্রতি সামরিক ব্যয়ে শ্রীলঙ্কা বিশ্বে বেশ এগিয়ে। একই সময় তামিলদের খুশি করতে জাফনার কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির উন্নয়নে ১০০ মিলিয়ন রুপি দিয়েছে সরকার। গৃহযুদ্ধের সময় সিংহলি সৈনিকেরা এই লাইব্রেরি পুড়িয়ে দিয়েছিল।
তামিল এলাকাগুলোর সড়ক উন্নয়নে ৫ বিলিয়ন খরচ করছে নতুন সরকার। মালয়দের জন্যও ৭-৮ বিলিয়ন রুপি রাখা হয়েছে। এসবের মাধ্যমে জেভিপি অর্থনৈতিক পুনর্বণ্টনের ধারণায় সংখ্যালঘুদের যুক্ত করছে। সরকার অর্থনীতি নিয়ে এত বেশি মনোযোগী যে প্রেসিডেন্ট নিজে এই মন্ত্রণালয় দেখছেন।
বিদেশনীতিতে জেভিপি তার আগের তীব্র ভারতবিরোধী অবস্থান থেকে সরে এশিয়ার প্রধান দুই শক্তির সঙ্গে সমান ধাঁচে সম্পর্ক রাখার কৌশল নিয়েছে। চীন-ভারত কোনো এক পক্ষের দিকে হেলে পড়তে চায় না তারা। অনূঢ়া ইতিমধ্যে উভয় দেশই সফর করেছেন।
বাংলাদেশের এখনকার সরকারের সঙ্গে তাদের একটা মিলের জায়গা হলো, ভারতের সঙ্গে বিগত সময়ে প্রশ্নবিদ্ধ যেসব চুক্তি হয়েছে, সেগুলো পর্যালোচনা করছে এনপিপি সরকার। আগামী মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীলঙ্কা সফরে এলে এসব চুক্তির পরিণতি পরিষ্কার হবে। জেভিপির প্রবল আপত্তি টের পেয়ে ইতিমধ্যে আদানিরা বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে ফিরে গেছে। এই চুক্তির শর্ত শ্রীলঙ্কাবান্ধব ছিল না।
আরও পড়ুনগণ-অভ্যুত্থানের পরের শ্রীলঙ্কা থেকে যা শেখার আছে২৬ আগস্ট ২০২৪তবে অনূঢ়া আন্তদেশীয় সম্পর্কে ভারসাম্যের কথাও ভুলছেন না। কারণ, দেশটির পর্যটন খাতের বড় এক ভরসা আবার ভারতীয়রা। রুশদের পর তারাই বেশি আসে এ দেশে। ট্রাম্পের আমেরিকাকে দেখে অনূঢ়া বিদেশনীতিতে বেশ সতর্ক এবং চীন-ভারত উভয়কে শান্ত রেখে এগোতে চান।
আদানি প্রশ্নে জেভিপির অবস্থান বাংলাদেশের চেয়ে বেশ সাহসী বলতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকার এখন আদানির সঙ্গে করা বিতর্কিত অনুরূপ চুক্তি কেবল ‘পুনর্মূল্যায়নের’ কথা বলছে। অথচ অভ্যুত্থানের আগে এখানে আন্দোলনকারীরা এই চুক্তির শর্ত নিয়ে বেশ ক্ষুব্ধ ছিলেন। বিশেষ করে চুক্তিতে কর অব্যাহতির শর্ত ছিল বিস্ময়কর রকমের।
দুই সরকারের মিল-অমিল এবং বাধাজেভিপি ও অনূঢ়ার সঙ্গে অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশের সরকারের কাজের তুলনা করলে দেখা যায়, প্রথমোক্তরা প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে এত দিনকার কুলীন পরিবারগুলোর বদলে মাঠের মেধাবী সংগ্রামীদের নিয়োগ দিচ্ছে। বিশেষ করে বিভিন্ন পেশাজীবী ও কর্মজীবী সংগঠকদের। বাংলাদেশে সেটা ঘটছে দেশ-বিদেশের ‘সুশীল’ ব্যক্তিদের দ্বারা।
বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ পদে এমন অনেক রাজনৈতিক নিয়োগ হচ্ছে, যাঁরা মূলত ‘একাডেমিশিয়ান’। মেঠো জনসমাজকে তাঁদের পরিচয় জানতে চারদিকে খোঁজখবর করতে হয়। বড় বড় পেশাজীবী জনগোষ্ঠীর সঙ্গে যাঁদের জৈব বা অর্গানিক সম্পর্ক গড়ে উঠছে না। অভ্যুত্থানে যুক্ত উচ্চশিক্ষিত তরুণীরাও এখানে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোয় বড় সংখ্যায় সামনের কাতারে সংযুক্ত হয়নি বা হতে পারেনি।
বাংলাদেশের সরকার বিভিন্ন খাতভিত্তিক কমিশন করে সংস্কারের কাজে যখন এগোতে চাইছে, লঙ্কায় অনূঢ়াদের জোট সেই কাজটা করতে খোদ বিভিন্ন পেশার মানুষকে রাজনৈতিকভাবে জোটবদ্ধ করে নিয়েছে। তারা কমিশন-কাজের আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতার পুরো পথটা এড়িয়ে সরাসরি সংশ্লিষ্টদের প্রশাসনিক কাজের জায়গায় বসিয়েছে।
বাংলাদেশে সরকার পুনঃপুন রাজনৈতিক সমঝোতার কথা বলছে। কিন্তু অর্থনৈতিক বঞ্চনা কমানো বা সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী বাড়ানোর মতো খাতে পদক্ষেপ নিতে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের জন্য অপেক্ষা করতে হবে কেন, সেটা বোঝা মুশকিল। সচরাচর কোনো দলের এসব বিষয়ে আপত্তি ওঠার কথা নয়।
৬ মার্চ প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, গত জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দারিদ্র্যমুখী সরকারি চাল–গম বিতরণ প্রায় ১১ শতাংশ কমে গেছে। এর মধ্যে বেশি কমেছে ত্রাণমূলক বিতরণ।
দেখা যাচ্ছে, সংস্কারের নাগরিক কোলাহলের মধ্যে দরিদ্র মানুষ ও দুস্থ নারী রাষ্ট্রের মনোযোগ থেকে ছিটকে পড়েছেন। পেশাজীবী-কর্মজীবীদের মধ্যে যাঁরা কেবল মহাসড়ক বা রেলপথ অবরোধ করে জনদুর্ভোগ বাড়াতে পারছেন, তাঁদের বরাতে বাড়তি কিছু জুটছে।
এখানে অভ্যুত্থান শেষে বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক কে এ এস মুরশিদের নেতৃত্বে অর্থনৈতিক কৌশলবিষয়ক একটা টাস্কফোর্স হয়। মাস দুয়েক হলো খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদদের ১২ জনের এই দল তাদের ৫২৬ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এর সাড়ে তিন মাস আগে পণ্ডিতদের তৈরি অর্থনীতিবিষয়ক আরেকটা ‘শ্বেতপত্র’ও জমা পড়েছে।
এ রকম প্রতিবেদনগুলো থেকে এখনই করা সম্ভব কাজগুলোর পদক্ষেপ খুঁজছে মানুষ। পরিসংখ্যান ব্যবস্থা উন্নয়নের মতো রাজনৈতিক বিতর্কহীন নিরীহ, কিন্তু জরুরি কাজগুলো কেন গতি পেল না, সেটি উপরিউক্ত কমিটির সদস্যরাও বুঝতে পারছেন না। তবে সরকার বিগত আমলের অর্থ পাচারের মোটা লিকেজগুলো বন্ধ করায় অর্থনীতিতে বেশ দম ফিরেছে। হুন্ডি কমায় বৈধ পথে রেমিট্যান্সপ্রবাহ বেড়েছে।
কলম্বোয় দৃশ্যপটটি অবশ্য অন্য রকম ব্যবহারিক চেহারার। সেখানে নেতাদের গ্যালারিতে হাততালি পাওয়ার দিকে মনোযোগ খুব কম। এটাও দেখা যাচ্ছে, সরকার সিংহলি-তামিল পুরোনো বাইনারির বদলে মোকাবিলা করতে চাইছে অর্থনৈতিক বাইনারি। ফলে দরিদ্র তামিলরাও এনপিপিকে ভোট দিয়েছে। এরই ফলে বোধ হয়, তামিলদের পুলিশ বাহিনীতে নিয়োগের হার বাড়ানোর কথা বলছে সরকার।
বাংলাদেশে অভ্যুত্থান ‘বৈষম্য’ কমানোর কথা বলে সফল হলেও দিন যত এগিয়েছে ‘সাংস্কৃতিক’ যুদ্ধে ভাগ করা হয়েছে মানুষকে। সংখ্যালঘু জাতি ও ধর্মীয় সত্তাগুলো সে কারণে অভ্যুত্থানের ভরকেন্দ্র থেকে ইতিমধ্যে মানসিকভাবে ছিটকে পড়ছে।
তবে উভয় সরকারকে আইএমএফের নির্দেশনা মেনে চলতে হচ্ছে কড়াকড়িভাবে। বাজেট পরিকল্পনা পেশের পর এক আলোচনায় অনূঢ়া খোলামেলাই বলেছেন, ‘শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি এ মুহূর্তে স্বাধীন নয়। আমরা আইএমএফের নজরদারিতে আছি।’
বলা বাহুল্য, বাংলাদেশও তা–ই। শ্রীলঙ্কার বেলায় এই নিয়ে এনপিপি জোটে যথেষ্ট আপত্তি ও ভিন্নমত আছে। বাংলাদেশে সরকারে থাকা ছাত্র প্রতিনিধিদের আইএমএফের অবস্থান সম্পর্কে স্পষ্ট কিছু জানা যায় না। ফলে আসন্ন বাজেটে হয়তো আইএমএফের চাওয়ারই ছাপ থাকবে।
শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ১৭ ফেব্রুয়ারি সরকার নতুন যে বাজেট পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে, তাতে রাষ্ট্রীয় খরচ ও ভর্তুকির লাগাম টেনে রাখা হয়েছে। কর্মচারীদের বেতন প্রত্যাশা অনুযায়ী বাড়েনি।
বোঝা যাচ্ছে, জেভিপি তাদের আগের বামপন্থী ধারার সঙ্গে এক ধাপ আপস করতে চলেছে। ২০২২–এর আওয়াজ ‘সিস্টেম চেঞ্জে’ যাবে না তারা চট করে। তবে মধ্য-বাম সুশাসনমুখী কিছু সংস্কার করতে চায় তারা। স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা এবং দুর্নীতি কমানোর দিকেই এ মুহূর্তে জোর তাদের।
আপাতত বেসরকারি উদ্যোক্তাদের চালকের আসনে থাকতে দেওয়া হবে। রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত লোকসানি প্রতিষ্ঠানগুলোয় সরকারি-বেসরকারি যৌথ ব্যবস্থাপনায় পরিচালনার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে বাজেটে। এই নিরীক্ষার ওপর অনূঢ়ার অর্থনৈতিক নীতির ভাগ্য পরীক্ষা হবে। তবে বন্যার শিকার কৃষকেরা ভর্তুকির দাবিতে কিছু বিক্ষোভ করেছে এরই মধ্যে। আইএমএফের কড়া শাসনে সেসব দাবির অনেকখানি মেটানো যাচ্ছে না। চালের দামও বাড়তি। অর্থনীতির সূচকগুলো যদিও ইতিবাচক, কিন্তু খুব ধীরে পরিবর্তন ঘটছে।
বাংলাদেশ ভ্যাটের বেলায় ‘প্রেসক্রিপশন’ বেশ উদারভাবে অনুসরণ করলেও অর্থনীতিতে খুব বেশি গতি সঞ্চার করতে পারেনি এবং পণ্য-শুল্ক বাড়ায় মূল্যস্ফীতি ডাবল ডিজিটের নিচে রাখা দুরূহ হয়ে গেছে। আইএমএফ ৪৭০ কোটি ডলার চুক্তির চতুর্থ কিস্তিও ছাড় করেনি। আগামী জুনে পরের কিস্তিসহ একসঙ্গে সিদ্ধান্ত হবে বলছে তারা। সেটা পেতে স্বভাবত এই তিন মাস সরকার এখানে কৃচ্ছ্র সাধনের নীতিতেই থাকবে।
উভয় দেশ বিনিয়োগের অভাবজনিত কর্মসংস্থানের সংকটেও আছে। উভয়ের আয়ের বড় অংশ চলে যাচ্ছে ঋণ পরিশোধে। বিগত সরকারগুলোর আমলে ঋণ করে অবকাঠামো গড়ার এই উন্নয়ন মডেল দেশ দুটিকে ধরিয়ে দিয়েছিল আন্তর্জাতিক মহলই। সেই ‘পাপের’ দায় শোধ করতে আরও বহুদিন লাগবে উভয় দেশের।
ফলে শিগগিরই বাংলাদেশ বা শ্রীলঙ্কায় রাষ্ট্রীয় আয় থেকে বিনিয়োগ বাড়ানোর সুযোগ কম। ফলে অভ্যন্তরীণ কর্মসংস্থান বাড়ার সুযোগও কম। কিন্তু অভ্যুত্থান উভয় দেশের তরুণসমাজের সামনে অপেক্ষাকৃত উন্নত জীবনের যে প্রত্যাশা তৈরি করেছে, তার চাপ বাংলাদেশে ইতিমধ্যে বেশ টের পাওয়া যাচ্ছে।
মধ্য–বাম ধারার অভ্যুত্থান ইতিমধ্যে মধ্য-ডান চেহারা নিয়েছে। অভ্যুত্থানের মৌলিক রাজনৈতিক অঙ্গীকার পথ হারাতেই দক্ষিণপন্থী মহল যে সুযোগ নিতে তৎপর হবে, সেটা অস্বাভাবিক নয়। অনূঢ়া তাই মরিয়া চেষ্টা করে যাচ্ছেন, যেকোনো উপায়ে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ বাড়িয়ে বেকারত্ব কমানোর। বাংলাদেশে আগামী নির্বাচনে যারা নির্বাচিত হয়ে আসবে, তাদের সামনেও একই চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে।
আলতাফ পারভেজ: গবেষক ও লেখক