নারী, বন্দী ‘কারাগারে’...মুক্তি কোথায়
Published: 19th, March 2025 GMT
নারীর মুক্তি দরকার—কথাটা বললে এটা স্বীকার করে নেওয়া হয় যে ‘নারী বন্দী’। এরপর প্রশ্ন আসে, নারী বন্দী কার কাছে? নারী কি শুধুই পুরুষের কাছে বন্দী, নাকি সে নিজের কাছেও বন্দী? নারী নিজের কাছে কীভাবে বন্দী, তা আলোচনার আগে দেখা যাক, নারী পুরুষের কাছে কীভাবে বন্দী, অর্থাৎ নারীর বন্দিত্বের রূপ কী কী।
নারী যে কারাগারে বন্দী, তার নাম ‘পুরুষের শ্রেষ্ঠত্বের ভাবনা’। পুরুষের ধারণা, নারীর কর্মক্ষমতা বা শক্তি, এমনকি মেধাও তাঁর চেয়ে কম। নারীর কর্মক্ষমতা বা শক্তি ও মেধা পুরুষের চেয়ে কম—এমন ধারণা পোষণের ক্ষেত্রে পুরুষ দুই দলে বিভক্ত। একদল মনে করে, ঈশ্বরই নারীকে কম শক্তি ও মেধা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। নিরীশ্বরবাদী পুরুষদেরও অনেকে নারীকে পুরুষের চেয়ে কম শক্তি ও মেধার অধিকারী মনে করেন। তাঁরা মনে করেন, নারী জন্মগতভাবে এমন শারীরিক গঠনপ্রাপ্ত যে তা অপেক্ষাকৃত দুর্বল; নারীকে মাসে একবার ঋতুমতী হতে হয়, যখন তাঁর মন-মেজাজ, শরীর সব কাজের জন্য উপযুক্ত নয়, বিশেষ করে ঋতুকালে নারী যুদ্ধে যাওয়ার জন্য যোগ্য নন ইত্যাদি।
একজন নারী বা পুরুষ আদতে একজন ব্যক্তি—তিনি রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবারের একজন সদস্য। রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবারের বিবেচনায় সে একটি একক সত্ত্বা, একটা ইউনিট শুধু নয়, সে একটা লিগ্যাল এনটিটি তথা একটি আইনি সত্তাও বটে এবং এই একক সত্তার বা ইউনিটের বা লিগ্যাল এনটিটির ধারণাটা জেন্ডার-নিরপেক্ষ। এ বিষয়ে দার্শনিক জন স্টুয়ার্ট মিলের বক্তব্য পরিষ্কার। তিনি লিখেছেন, লৈঙ্গিক ভিন্নতার কারণে, জৈবিকভাবে নারী-পুরুষের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। নারী-পুরুষের মধ্যে যে প্রকৃতিগত পার্থক্যের কথা বলা হয়, তা–ও পুরুষতন্ত্রের সৃষ্টি এবং প্রথাভিত্তিক।
একজন ব্যক্তিকে বিবেচনা করতে হবে হোলিস্টিক ভিউ, তথা সামগ্রিক দৃষ্টিতে; অর্থাৎ কোন কোনো কাজে পুরুষ বেশি উপযোগী আবার কোনো কোনো কাজে নারী বেশি উপযোগী। কিছু গুণ নারীর মধ্যে বেশি মাত্রায় বিদ্যমান, যেমন সহ্যশক্তি, যা সন্তান ধারণ, প্রসব ও পালনের ক্ষেত্রে বেশি প্রয়োজন। অতএব দৈবচয়নের মাধ্যমে একজন পুরুষ ও একজন নারী এনে যদি সামগ্রিক দৃষ্টিতে দুজনকে তাঁদের সমস্ত গুণ যোগ করে পরিমাপ করা হয়, দেখা যাবে দুজনই ১০০ মার্কস পেয়েছেন। অতএব পুরুষের চেয়ে নারী হেয়—এ চিন্তা অবৈজ্ঞানিক ও অযৌক্তিক।
‘পুরুষ নারীর চেয়ে শ্রেষ্ঠ’—এ ধারণা পুরুষের মস্তিষ্কে স্থায়ীভাবে উপ্ত হয়ে আছে, যা নারীর বন্দিত্বের প্রধান কারণ। বস্তুত, নারী কীভাবে নিজের কাছেও বন্দী। ‘পুরুষ নারীর চেয়ে শ্রেষ্ঠ’—এ ধারণা যখন নারী নিজেই পোষণ করেন, তখন তিনি নিজের কারাগারেই নিজে বন্দী। নারী নিজেও পুরুষের শ্রেষ্ঠত্বকে মেনে নিয়েছেন। নারী ঘরসংসারের কাজ করবেন, তা স্বামী-স্ত্রী দুজনেও যদি ঘরের বাইরে একই রকম চাকরিও করেন, তবু। নারী পুরুষকে সেবা করবেন, চা বানিয়ে হাতে তুলে দেবেন, রান্না করবেন, খাবার পরিবেশন করবেন, খাবারের থালা ধৌত করবেন, তাঁর কাপড় ধুয়ে দেবেন, জ্বর হলে মাথা টিপে দেবেন, পা টিপে দেবেন; কিন্তু স্বামী এ কাজগুলো স্ত্রীর জন্য করবেন না। আবার কোনো স্বামী যদি করতেও চান, স্ত্রী তা করতে দেবেন না; কারণ, তাতে ‘পাপ’ হতে পারে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীর মধ্যেও যে মাইন্ডসেট তৈরি করেছে, তা তাঁকে বলছে, ‘ওই সব কাজ নারীকেই মানায়।’ এভাবেই নারী নিজের কাছে নিজে বন্দী।
নারীর নোবেল প্রাপ্তির গল্প পুরুষের শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা নিশ্চিতভাবেই ভেঙে খানখান হয়ে পড়বে। ১৯০১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত নারীরা ৫৮ বার নোবেল পান। নোবেল পুরস্কারের সূচনা হয় ১৯০১ সালে আর মারি কুরি নোবেল পেয়ে যান ঠিক দুই বছর পর, অর্থাৎ ১৯০৩ সালেই। পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পাওয়ার পর তিনি আবার নোবেল পেলেন ১৯১১ সালে রসায়নে। মারি কুরি ছাড়া আর মাত্র তিনজন নোবেল পান দুবার করে। কিন্তু মারি কুরিই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি গবেষণাভিত্তিক নোবেল পান দুটি ভিন্ন বিষয়ে এবং এত আগে।
নোবেল কমিটি ‘পৃথিবীকে পাল্টে দিয়েছেন যে নারীরা’ ও ‘ইন্সপাইরেশনাল উইমেন তথা প্রেরণদায়ী নারীরা’ শিরোনামে দুটি ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে। প্রথমটিতে কানাডার ডোনা স্ট্রিকল্যান্ড, পোল্যান্ডের মারি কুরি, প্রাগের গার্টি কোরি, মার্কিন ঔপন্যাসিক টনি মরিসন, ইরানের মানবাধিকারকর্মী শিরিন এবাদি ও ফ্রান্সের অর্থনীতিবিদ এশথার ডুফলোর নাম উল্লেখ করে।
‘ইন্সপাইরেশনাল উইমেন’ ক্রোড়পত্রেও ছয়জন নারীর যুগান্তকারী অবদানের কথা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। তাঁর মধ্যে আছে মারিয়া গোপার্ট মেয়ের পদার্থবিদায় ১৯৬৩ সালে, জেনিফার আ ডোউডনা রসায়নে ২০২০ সালে, ক্যারোল ডব্লিউ গ্রেইডার ২০০৯ সালে মেডিসিনে, এলফ্রিয়েডে জেলিনেক ২০০৪ সালে সাহিত্যে, মেইরেড কোরিগান শান্তিতে ১৯৭৭ সালে এবং প্রথম নারী হিসেবে অর্থনীতিতে নোবেল পান এলিনোর অসট্রম ২০০৯ সালে।
নারীর কর্মক্ষমতা বা শক্তি ও মেধা পুরুষের চেয়ে কম—এমন ভাবনা নারীর ক্ষমতায়নে সবচেয়ে বড় বাধা। ওপরের ওই ঔৎকর্ষের গল্প এমন ভাবনাকে ভুল প্রমাণিত করে। তারপরও আমরা নারীকে দেখি বন্দী হতে—বাবার কাছে, ভাইয়ের কাছে, স্বামীর কাছে, সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে। তবে সবচেয়ে ভয়কংর হবে, যদি তিনি নিজের কাছেই বন্দী হন আর নিজের কাছে বন্দী হওয়ার অর্থ হলো নারী যদি নিজেই নিজের চেয়ে পুরুষকে শ্রেষ্ঠ মনে করেন। নিজের কাছে বন্দী হলে কেউ তাঁকে মুক্ত করতে পারবে না।
নারীর মুক্তি কীভাবে হবে, তা বলার আগে বলে নিই নারীর মুক্তির লক্ষণ কী, অর্থাৎ কীভাবে বুঝবেন নারীর মুক্তি ঘটেছে? প্রথমত পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে নারীর জন্য পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত হওয়া মানে নারীর মুক্তি ঘটা। এই অধিকার দৃশ্যমান হতে পারে নারীর সম্পদে ও উৎপাদনযন্ত্রে মালিকনা লাভের মধ্যে, কাজে ও আয়–উপার্জনে নারীর জন্য পুরুষের সমান অধিকারের মধ্যে। সম্পদে ও উৎপাদনযন্ত্রে মালিকনা লাভের প্রক্রিয়াটাও হতে হবে জেন্ডার–নিরপেক্ষ। দ্বিতীয়টি হলো পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে সিদ্ধান্ত তৈরিতে ও নীতি প্রণয়নে নারীর পুরুষের সমান অধিকার। এই অধিকার প্রাপ্তিই হলো নারীর ক্ষমতায়ন। স্থূলভাবে নারীর ক্ষমতায়নই নারীর মুক্তি। কিন্তু আদতে এই ক্ষমতায়নে কি নারীর পুরোপুরি মুক্তি ঘটে? ঘটে না। নারীর মুক্তি ঘটা মানে উল্লেখিত ‘পুরুষের শ্রেষ্ঠত্বের’ যে মাইন্ডসেট নারী ও পুরুষ উভয়ই ধারণ করে, তা থেকে মুক্তি। নারীর মুক্তির জন্য ওই মাইন্ডসেট থেকে শুধু নারী মুক্ত হলেই হবে না, মুক্ত হতে হবে পুরুষকেও। পুরুষের মুক্তি ছাড়া নারীর মুক্তি ঘটবে না।
এই মুক্তি কীভাবে ঘটবে? সংক্ষেপে উত্তর হলো বিজ্ঞানের ও মনস্তত্ত্বের শিক্ষার প্রসারের মাধ্যমে। বৈজ্ঞানিক বুদ্ধি ও মনস্তাত্ত্বিক জ্ঞানের অভাবে অর্থাৎ অজ্ঞতার কারণেই পুরুষ ও নারী উভয়েই পুরুষকে শ্রেষ্ঠ মনে করেন। এ জন্য দরকার একটা বিজ্ঞান ও যুক্তিনির্ভর শিক্ষার ব্যবস্থা (লক্ষ করুন, এখানে ‘শিক্ষাব্যবস্থা’ বলা হয়নি, বলা হয়েছে ‘শিক্ষার ব্যবস্থা’) কারণ জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থার বাইরে পরিবার থেকে, পরিপার্শ্ব থেকে শিশু প্রথম গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা পেয়ে থাকে, যা তার মাইন্ডসেট তৈরি করে দেয়, যা থেকে বের হওয়া কঠিন। এমন একটা জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা ও সর্বক্ষেত্রে একটা শিক্ষার ব্যবস্থা, প্রক্রিয়া ও সুযোগের জন্য চাই প্রগতিবাদী রাজনীতি, কারণ বিজ্ঞান-প্রযুক্তির বা উদ্ভাবনের ও ভালো অর্থনৈতিক নীতি–সুফল মানুষের জীবনে পৌঁছাবে কি না, তা নির্ধারণ করে রাজনীতি। একটা প্রগতিবাদী রাজনীতিই সেটি করতে পারে। আর একটি প্রগতিবাদী রাষ্ট্রই পারে এমন একটা শিক্ষার ব্যবস্থা ও শিক্ষার প্রক্রিয়া চালু করতে। অতএব নারী যদি মুক্তি চান, তাঁকে ব্যাপকভাবে রাজনীতিতে সক্রিয় হতে হবে, রাষ্ট্র গঠনে ভূমিকা রাখতে হবে। ক্ষমতা কাঠামোয় ভূমিকা থাকতে হবে নারীবাদী নারী ও নারীবাদী পুরুষকে। সমতার দর্শনকে মূলমন্ত্র হিসেবে গ্রহণ করে একটা জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়তে হবে, কারণ সর্বক্ষেত্রে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা ছাড়া নারীর জন্য পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব।
এন এন তরুণ অর্থনীতির অধ্যাপক, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ। সাউথ এশিয়া জার্নালের এডিটর অ্যাট লার্জ। [email protected]; nntarun.
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: শ ক ষ র ব যবস থ র র জন য র জন ত পর ব র করব ন
এছাড়াও পড়ুন:
তুলসীর কথা কি শুধু কথার কথা
কথা বড় বিচিত্র জিনিস। একই কথা—সকালে যার ওজন পাঁচ মণ, বিকেলে তার ওজন পাঁচ ছটাক না–ও থাকতে পারে। যে কথার দাম খাটের তলায় এক শ টাকা, আগরতলায় সে কথার দাম দশ পয়সা না–ও থাকতে পারে। যে কথা হাবলা হাবার মা–বাবা বললে কেউ গা করবে না; সেই একই কথা ওবামার মা–বাবা বললে তামাম দুনিয়ায় নিউজ হয়ে যাবে।
স্থান–কাল–পাত্রভেদে একই কথার ওজন যে একেক রকম, তা আমেরিকার গোয়েন্দাপ্রধান তুলসী গ্যাবার্ডের সামান্য কথা অসামান্যভাবে আবার প্রমাণ করল।
আদতে তুলসী গ্যাবার্ড খুব নতুন কিছু বলেননি। কিন্তু তাঁর কথা নিয়ে ভারতের মিডিয়ায় বিরাট চাঞ্চল্য হয়েছে। বাংলাদেশে হোয়াটসঅ্যাপ–মেসেঞ্জারে লিংক চালাচালি হচ্ছে। এত উথালিপালাথির কারণ হলো স্থান–কাল–পাত্র—তিনটি অনুষঙ্গই এত লাগসই ভূমিকা রেখেছে যে তুলসীর সাধারণ কথাগুলো বিরাট হয়ে উঠেছে।
গত সোমবার (১৭ মার্চ) এনডিটিভিকে সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় সঞ্চালক বিষ্ণু সোম তুলসীকে বলেছিলেন, ‘ভারতের প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশে আমরা অনেক পটপরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি। সেখানে সংখ্যালঘুদের ওপর ব্যাপক সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। যুক্তরাষ্ট্র কি সেখানকার পরিস্থিতিকে আমলে নিচ্ছে এবং রাজনীতির বাইরেও সব পর্যায়ে স্থিতিশীলতা রাখতে তৎপর আছে?’
এর জবাবে তুলসী বলেছেন, ‘হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর অনেক দিন ধরে নিপীড়ন, হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটে আসছে এবং এটি আমেরিকান সরকার এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও তাঁর প্রশাসনের জন্য অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয় হিসেবে রয়ে গেছে।’ তিনি বলেছেন, ‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রশাসন বিশ্বব্যাপী ইসলামপন্থী সন্ত্রাসবাদ দমন করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং সে লক্ষ্যেই তারা কাজ করছে। ট্রাম্পের নেতৃত্বাধীন নতুন ক্যাবিনেট ইতিমধ্যে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে।’
তুলসীর এই কথাগুলো সরকারি কর্মকর্তা বা কূটনীতিকদের ব্যবহার্য ফরম্যাট করা কথা। এখানে দৃশ্যত উত্তেজিত হওয়ার মতো কিছু নেই। বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ ইস্যুতে এই কথা আমরা বহু শুনেছি। এগুলো আমাদের কাছে জলভাত ছিল। কিন্তু তিনি বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন ইস্যুতে কথা বলতে গিয়ে বললেন, ‘ইসলামপন্থী সন্ত্রাসীদের হুমকি এবং বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বৈশ্বিক তৎপরতা একই মতাদর্শ ও উদ্দেশ্যকে অনুসরণ করে—এটি মূলত একটি ইসলামি খেলাফত প্রতিষ্ঠার চেষ্টা।’ মূলত তিনি এই ‘ইসলামি খেলাফত’ টার্মটি বাংলাদেশ ইস্যুতে ব্যবহার করায় আবহ গরম হয়েছে।
তুলসীর জায়গায় আজ যদি একজন শ্বেতাঙ্গ ক্যাথলিক আমেরিকান থাকতেন এবং তিনি ঠিক এই কথাগুলোই বলতেন, তাহলে সেই কথাগুলোও হয়তো চাঞ্চল্য তৈরি করত, কিন্তু তার প্রভাবের ধরন হতো অন্য রকম। সেই কথাগুলো ইউনূস সরকারবিরোধীদের জন্য সম্ভবত এতটা ‘মৃতসঞ্জীবনী সুধা’ হিসেবে ধরা হতো না। পতিত ফ্যাসিবাদী সরকারের অন্ধ অনুসারীদের হয়তো ‘শিগগিরই কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে’ মার্কা স্ট্যাটাস দিয়ে ফেসবুক গরম করতে দেখা যেত না।তুলসী বলেছেন, ‘এটি স্পষ্ট, অন্য যেকোনো ধর্মের অনুসারীরা ইসলামপন্থীদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়, যদি না তারা সেই [চরমপন্থী] গোষ্ঠীর গ্রহণযোগ্য ধর্ম অনুসরণ করে। তারা সন্ত্রাস ও চরম সহিংসতার মাধ্যমে এ মতবাদ বাস্তবায়ন করতে চায়।...প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই মতাদর্শ চিহ্নিত ও পরাজিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। একে তিনি [প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প] “কট্টর ইসলামি সন্ত্রাসবাদ” বলে অভিহিত করেন এবং এর উত্থানের সমাপ্তি ঘটাতে চান।’
প্রথমত, কথাগুলো যিনি বলেছেন, তিনি যে শুধু বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশটির গোয়েন্দাপ্রধান, তা–ই নয়; এর বাইরেও তাঁর এমন ব্যক্তি পরিচয় আছে, যা এই কথাগুলো কারও জন্য উদ্বেগ–জাগানিয়া আবার কারও জন্য ‘মৃতসঞ্জীবনী সুধা’ হিসেবে কাজ করছে।
ইংরেজি সাহিত্যের ক্লাসে কোনো কবির কবিতা বা লেখকের গল্প, গদ্য বা নাটক পড়ানোর আগে সাহিত্যের মাস্টাররা ছাত্রছাত্রীদের আগে সেই কবি বা ঔপন্যাসিক বা নাট্যকারের জীবন সম্পর্কে ধারণা দেন। সংশ্লিষ্ট কবি বা ঔপন্যাসিকের ব্যক্তিগত জীবন কেমন, তাঁর ধর্ম বা সমাজসংক্রান্ত দর্শন কী, তা সম্পর্কে আলোচনা করেন। এতে ব্যক্তি হিসেবে কবি বা লেখকের মনস্তত্ত্ব বোঝা যায়। কোন কোন বিষয়ে তাঁর পক্ষপাত আছে, তা বোঝা যায়। এসব জানা গেলে তাঁর কাব্য বা গল্প বা উপন্যাসের মর্মার্থ ধরা সহজ হয়।
আরও পড়ুনবাংলাদেশে গুতেরেস এবং আমাদের সংস্কার ১০ ঘণ্টা আগেসেই নিরিখে তুলসী গ্যাবার্ডের বাংলাদেশে ‘ইসলামি খেলাফত’ প্রতিষ্ঠাবিষয়ক উদ্বেগকে যদি বিচার করি, তাহলে তাঁর ব্যক্তি ও পেশাদারি জীবনে ঢুঁ মারা দরকার হয়ে পড়ে।
তুলসী গ্যাবার্ড ফৌজি মানুষ। মার্কিন সেনা হিসেবে তিনি ইরাক ও কুয়েত যুদ্ধে সরাসরি অংশ নিয়েছেন। পরবর্তী সময়ে লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদমর্যাদায় এসেছেন। চাকরি শেষে ডেমোক্রেটিক দলের রাজনীতি করলেও পরে রিপাবলিকান দলে ভেড়েন।
তুলসীর বাবা মাইক গ্যাবার্ড একজন ক্যাথলিক খ্রিষ্টান ছিলেন। তাঁর মা ক্যারল গ্যাবার্ড প্রথমে খ্রিষ্টান ছিলেন, পরে হিন্দুধর্ম গ্রহণ করেন। তাঁদের পরিবার মূলত ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর কৃষ্ণ কনশাসনেস (ইসকন) বা ‘হরে কৃষ্ণ’ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। মূলত এ সি ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদের শিক্ষায় অনুপ্রাণিত হয়ে তাঁরা কৃষ্ণভক্তিতে আকৃষ্ট হন। ভক্তি, জয়, আরিয়ান ও বৃন্দাবন নামে তুলসীর আরও চার ভাইবোন আছে।
তুলসী গ্যাবার্ড যদিও নিজেকে ইসকনের সদস্য হিসেবে পরিচয় দেন না, তবে তিনি স্পষ্টতই ইসকনের ভাবাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত। ব্যক্তিজীবনে তিনি প্রসাদভোজী। মাছ–মাংস খান না।
২০১৯ সালে তিনি ভারতের নাগপুরে আরএসএসের সদর দপ্তর পরিদর্শন করে আরএসএসের নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন এবং সংগঠনের কার্যক্রম সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়েছিলেন।
মা–বাবা—দুজনের কেউই ভারতীয় বংশোদ্ভূত না হওয়ার পরও হিন্দুস্তান টাইমসকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে তুলসী বলেছেন, যখনই তিনি ভারতে এসেছেন, তখনই তাঁর মনে হয়েছে, তিনি যেন তাঁর জন্মভূমিতে এসেছেন। শুধু ধর্মীয় কারণে তিনি ভারতের সঙ্গে একাত্মতা বোধ করেন। এবার ভারতে আসার পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাঁকে উপহার হিসেবে একটি ‘গঙ্গাজল কুম্ভ’ দিয়েছেন।
এ পর্যন্ত তুলসী গ্যাবার্ডের ক্যারিয়ারে দেখা যায়, তিনি ‘উগ্র ইসলামপন্থা’র ঘোর বিরোধী। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অন্য দেশে হস্তক্ষেপ করে সরকার পরিবর্তনের নীতিরও তিনি ঘোর বিরোধী হিসেবে পরিচিত।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দাপ্রধানদের একটি সম্মেলনে যোগ দিতে নয়াদিল্লিতে এসেছেন তুলসী। তবে তুলসীকে মোদি সরকার শুধু একজন মার্কিন গোয়েন্দাপ্রধান হিসেবে দেখেনি; এর বাইরেও তার চেয়ে ‘আপন কেউ’ একজন হিসেবে দেখেছে। তুলসীও সেই অভ্যর্থনাকে সেভাবেই গ্রহণ করেছেন। তিনি ‘বাংলাদেশের হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ও অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর দীর্ঘদিন ধরে চলমান দুর্ভাগ্যজনক নিপীড়ন, হত্যা ও অন্যান্য নির্যাতনকে’ যুক্তরাষ্ট্র সরকার, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও তাঁর প্রশাসনের ‘উদ্বেগের একটি প্রধান ক্ষেত্র’ হিসেবে দেখেছেন।
বাংলাদেশ সম্পর্কে তুলসীর এই দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে ভারতের ক্ষমতাসীন মোদি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির স্পষ্ট মিল দেখা গেছে।
এসব কারণে তুলসী গ্যাবার্ডের এই মন্তব্য খুব অপ্রত্যাশিত ছিল, তা বলা যাবে না। তিনি যে মুহূর্তে ভারতে অবস্থান করছেন, সেই মুহূর্তে ভারতে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের হাতে কীভাবে সংখ্যালঘু মুসলিম নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, তা তিনি বলেননি। এটিকেও অপ্রত্যাশিত বলে ভাবার সুযোগ কম।
তুলসীর জায়গায় আজ যদি একজন শ্বেতাঙ্গ ক্যাথলিক আমেরিকান থাকতেন এবং তিনি ঠিক এই কথাগুলোই বলতেন, তাহলে সেই কথাগুলোও হয়তো চাঞ্চল্য তৈরি করত, কিন্তু তার প্রভাবের ধরন হতো অন্য রকম। সেই কথাগুলো ইউনূস সরকারবিরোধীদের জন্য সম্ভবত এতটা ‘মৃতসঞ্জীবনী সুধা’ হিসেবে ধরা হতো না। পতিত ফ্যাসিবাদী সরকারের অন্ধ অনুসারীদের হয়তো ‘শিগগিরই কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে’ মার্কা স্ট্যাটাস দিয়ে ফেসবুক গরম করতে দেখা যেত না।
তুলসী গ্যাবার্ড বলেছেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ‘খুব ভালো বন্ধু’ এবং তাঁরা অভিন্ন লক্ষ্যসমূহ অর্জনের ওপর আলোকপাত করছেন। বিশ্বব্যাপী ইসলামপন্থী সন্ত্রাসকে পরাজিত করা তাঁদের লক্ষ্যের মধ্যে রয়েছে বলেও উল্লেখ করেছেন তিনি।
অনেকে বলছেন, তুলসী গ্যাবার্ড স্রেফ একজন গোয়েন্দাপ্রধান। তাঁর এই বক্তব্যের প্রভাব ততটা নেই, যতটা ভাবা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, তাঁর বক্তব্যের সম্ভাব্য প্রভাবকে খাটো করে দেখার সুযোগ কম।
ইতিমধ্যেই তুলসীর বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের সরকারের দিক থেকে একটি বিবৃতি দেওয়া হয়েছে। সেখানে যথেষ্ট শক্ত ভাষায় তুলসীর বক্তব্যকে ‘অন্যায্য’, ‘বিভ্রান্তিকর’, ‘বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ও সুনামের জন্য ক্ষতিকর’ বলে খারিজ করে দেওয়া হয়েছে। ইতিপূর্বে আনুষ্ঠানিকভাবে এত কঠোরভাবে বাংলাদেশের কোনো সরকারকে কোনো মার্কিন কর্মকর্তার বক্তব্যকে প্রত্যাখ্যান করতে দেখা যায়নি। ফলে এটি যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের কূটনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
অনেকে বলছেন, তুলসী গ্যাবার্ডের বক্তব্য থেকে বোঝা যায় না যে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ নিয়ে বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন। তিনি আসলে কোনো নতুন কথা বলেননি, শুধু তার আগের অবস্থান এবং ট্রাম্প প্রশাসনের ইসলামপন্থী জঙ্গিদের বিরুদ্ধে কঠোর নীতির কথাই পুনর্ব্যক্ত করেছেন। আর সেটিকেই ভারতীয় মিডিয়া সেনসেশন দিয়ে প্রচার করেছে। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে একটি জঙ্গিকবলিত রাষ্ট্র এবং ইউনূস সরকারকে জঙ্গি তোষণকারী সরকার হিসেবে দেখানোর একটা সূক্ষ্ম চেষ্টা রয়েছে। সে ধরনের যেকোনো চেষ্টাকে নস্যাৎ করার সক্ষমতা বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকারের আছে—আপাতত এই আস্থা রাখতে চাই।
সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
[email protected]