ইরাককে কয়েকটি স্বশাসিত অঞ্চলে ভাগ করে ফেলা এবং এমনকি ভেঙে আলাদা কয়েকটি রাষ্ট্র করার বিষয়টি আবারও আলোচনায় এসেছে। আলোচনাটি কখনো সাড়ম্বরে সামনে চলে আসে আবার কখনো ম্লান হয়ে যায়। শাসকশ্রেণির অভিজাতদের মধ্যে যে বিবাদ, সেই সূত্র ধরেই আলোচনাটি বারবার ফিরে আসে। এর সঙ্গে সাধারণ ইরাকি নাগরিকদের স্বার্থের কোনো সংযোগ নেই।

আগের মতো এবারও এই দাবি কুর্দি অথবা সুন্নি নেতাদের কাছ থেকে আসেনি। দাবিটি এসেছে শিয়া কো–অর্ডিনেশন ফ্রেমওয়ার্কের ‘গডফাদার’ ও দাওয়া পার্টির নেতা নুরি আল-মালিকির কাছ থেকে।

যে যুক্তির ওপর ভিত্তি করে তিনি এই দাবি করেছেন, সেটা হলো ইরাক বিভক্ত করে ফেলতে শিয়াদের বাধ্য করা হতে পারে। বাস্তবতা হলো, শিয়ারা এখন ইরাকের শাসকদল। তাহলে কারা তাদের বাধ্য করবে? নুরি আল-মালিকির এই দাবি যে ইঙ্গিতকে সামনে নিয়ে আসছে সেটা হলো, তেলের ওপর শিয়ারা একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এটিকে তিনি শিয়াদের অধিকার বলে দাবি করেছেন।

আল-মালিকির কাছ থেকে এই দাবি আসার পরপরই কো–অর্ডিনেশন ফ্রেমওয়ার্ক একই সুরে সুর মেলাতে শুরু করে। এই দাবিকে আত্মস্থ করতে ও এর প্রতি সমর্থন জানাতে তারা প্রাণান্ত চেষ্টা শুরু করে। পার্লামেন্টে ক্ষমতাসীন শিয়া জোটের একজন নেতা বলেছেন, ‘বাকি অন্য সম্প্রদায়ের দ্বারা শিয়াদের ব্ল্যাকমেল করা হচ্ছে।’ এই বক্তব্য ‘নয় প্রদেশজুড়ে শিয়াদের স্বাধীন রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠার দাবিকেই সামনে আনে।

ফ্রেমওয়ার্কের আরেকজন সদস্য ‘আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের’ আহ্বান জানিয়েছেন। এই বক্তব্য ‘শিয়া রিপাবলিক অব ইরাক’ প্রতিষ্ঠার জন্য গণভোটের সম্ভাবনা সামনে নিয়ে আসে। এতে কুর্দি ও সুন্নি—প্রত্যেকের মধ্যে নিজেদের আলাদা রাষ্ট্র করার ইচ্ছা জাগবে। প্রত্যেকেই তাদের নিজেদের মতো করে নতুন মাতৃভূমি প্রতিষ্ঠা করতে চাইবে।

এসব বক্তব্যের বেশির ভাগ একটি সুসংগঠিত প্রচারাভিযানের অংশ। এটি ইরাককে বিভক্ত করার ধারণাটিকেই সামনে এগিয়ে নিয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত এটি বাইরের খেলোয়াড়দের দ্বারা অনুপ্রাণিত একটি প্রচারাভিযান। আর সেই শক্তিটি হলো ইরান।
ইরানের সাম্রাজ্যবাদী প্রকল্প ব্যর্থ হওয়া, প্রতিরোধের অক্ষ ভেঙে যাওয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যে ভূরাজনৈতিক ভিত্তি হারানোর পর ইরান এখন ইরাক নিয়ে মরিয়া।

ইরাকের ৯টি প্রদেশ দিয়ে শিয়া অঞ্চল গঠন করার কথা বলা হচ্ছে। সেটা যদি বাস্তবে রূপ পায়, তাহলে সেটা হবে ইরানের ভূরাজনীতিতে ইরাককে সরাসরি অন্তর্ভুক্ত করার প্রথম বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ।

ক্ষমতাসীন শিয়া গোষ্ঠীর মাধ্যমে ইরাককে ভাগ করার ক্রমবর্ধমান দাবির পেছনের কারণ এটি। ২০০৩ সালে মার্কিন নেতৃত্বাধীন আগ্রাসন শুরুর পর থেকেই ইরাকের ওপর ইরান এমনভাবে আধিপত্য করে আসছে যে ইরাক যেন ইরানের বাধ্যগত সেবাদাস।

যা–ই হোক, বাইরের দেশে ইরানি অভিযানের স্থপতি কাসেম সোলাইমানি (১৯৫৭-২০২০) একসময় ইরাকের দায়িত্বেও ছিলেন। তিনি যখন ইরাক নিয়ে প্রথম পরিকল্পনা করেছিলেন, সেখানে আলাদা আলাদা রাষ্ট্রগঠনের ধারণার পক্ষে তিনি ছিলেন না। কেননা, তিনি এ ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন যে এই ধারণা ইরানেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। কেননা, ইরানেও অসংখ্য জাতিগত, ধর্মীয় ও সম্প্রদায়গত গোষ্ঠী রয়েছে।

ইরানের এই গোষ্ঠীগুলোও স্বশাসিত অঞ্চল ধারণায় আকৃষ্ট হতে পারে। বিশেষ করে তেহরান সরকার দীর্ঘদিন ধরেই জনগোষ্ঠীগুলোর অধিকার অস্বীকার করে আসছে এবং তাদের দাবিগুলো দমন করে আসছে।

অধিকন্তু সোলাইমানি নিজেই সেই স্বপ্ন দেখতেন, যেদিন ‘বেলায়ত-ই ফকিহ’ রাষ্ট্রটি ইরাকের সবটা গ্রাস করবে এবং ইরানের ‘৩০তম প্রদেশ’ হিসেবে স্বীকৃতি দেবে।

সোলাইমানি তাঁর সুন্নি অনুসারী ও অন্য সম্প্রদায়ের লোকদের নিয়ে তিনি এই লক্ষ্য অর্জনে কাজ করেছিলেন। গোষ্ঠীগুলোর স্বার্থ ও আকাঙ্ক্ষার প্রশ্নটিকে তিনি আশ্বস্ত করেছিলেন। তাদের সঙ্গে জোট গড়েছিলেন এবং চুক্তিতে পৌঁছেছিলেন। বাগদাদ সরকারে তাদের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। এ সবকিছুর মাধ্যমে তিনি তাঁর নিজস্ব কৌশলগত দূরদৃষ্টির বাস্তবায়ন করে চলেছিলেন।

আরও পড়ুনইরানও কেন আসাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল১৮ ডিসেম্বর ২০২৪

ইরাকের ক্ষমতাসীন শিয়ারা সব সময় বিভক্তি ইরাক ও আঞ্চলিক বিভাজনের প্রস্তাবকে আক্রমণ করেছেন ও বিরোধিতা করেছেন। ২০১৭ সালে যখন ইরাকের স্বায়ত্বশাসিত কুর্দিস্তানের শাসকেরা স্বাধীনতার জন্য গণভোট আয়োজন করেছিলেন, তাঁরা সেটার বিরোধিতা করেছিলেন।

যা–ই হোক, বর্তমান পরিস্থিতি বলছে যে ইরাক নিয়ে ইরানের এখনকার অবস্থান পুরোপুরি ভিন্ন।

মধ্যপ্রাচ্যে বড় ধরনের বিপর্যয়ের পর ইরান নতুন করে মনে করছে যে তাদেরকে কৌশল আত্মস্থ করতে হবে। নতুন এই কৌশলে ইরাকের ওপর ইরানের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে হবে এবং ইরাককে নিরাপত্তা কৌশলের সম্মুখভাগে রাখতে হবে।
বর্তমান পরিস্থিতি ইরাককে একবারে গ্রাস করার যে সম্ভাবনা, সেটাকে নাকচ করে দেয়। তার দলে ভবিষ্যতে ইরাককে টুকরা টুকরা করে ভাগ করার পথ খুলে দেয়।

ইরাকের ৯টি প্রদেশ দিয়ে শিয়া অঞ্চল গঠন করার কথা বলা হচ্ছে। সেটা যদি বাস্তবে রূপ পায়, তাহলে সেটা হবে ইরানের ভূরাজনীতিতে ইরাককে সরাসরি অন্তর্ভুক্ত করার প্রথম বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ।

যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত ইরাককে তার পক্ষে রাখার জন্য ৩ ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে, তাদের হাজারো সেনা নিহত হয়েছেন। ইরাককে টুকরা টুকরা করার দাবি নিয়ে ওয়াশিংটন কী ভাবছে?

আবদুল লতিফ আল-সাদুন, ইরাকের লেখক এবং আরব ইন্টেলেকচুয়ালস ম্যাগাজিনের প্রধান সম্পাদক
মিডল ইস্ট মনিটর থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: কর ছ ল ন কর ছ ন এই দ ব ক ত কর র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

সাধারণ ছুটি, নির্বাহী আদেশে ছুটি ও ঐচ্ছিক ছুটি কী, কখন কাদের জন্য এসব ছুটি হয়

আসন্ন পবিত্র ঈদুল ফিতরে লম্বা ছুটিতে পড়তে যাচ্ছে দেশ। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ঈদ উপলক্ষে টানা পাঁচ দিন ছুটি পাচ্ছেন।

তবে বাস্তবে এই ছুটি আরও বেশি হবে। কারণ, ঘোষিত এই পাঁচ দিনের ছুটির আগে-পরে আছে মহান স্বাধীনতা দিবস, পবিত্র শবে কদর ও সাপ্তাহিক ছুটি (শুক্র-শনিবার)।

এই হিসাবে এবার ঈদের আগে-পরে ১১ দিনের মধ্যে ৯ দিন ছুটি থাকবে। এর মধ্যে শুধু দুই দিন (ঈদের আগে ও পরে) অফিস খোলা থাকবে।

সাপ্তাহিক ছুটি, সাধারণ ছুটি ও নির্বাহী আদেশে ছুটি মিলিয়ে এসব ছুটি হচ্ছে। এখন প্রশ্ন হলো, ছুটি তো ছুটিই, সেখানে আবার সাধারণ ছুটি ও নির্বাহী আদেশে ছুটির পার্থক্য কী?

সরকারি চাকরি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব ফিরোজ মিয়ার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মোটাদাগে সাধারণ ছুটি হলো সেটি, যেটি মূলত উদ্‌যাপন বা পালনের জন্য করা হয়। এটি সর্বজনীন, সবার জন্যই এটি প্রযোজ্য। যেমন ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা, মহান স্বাধীনতা দিবস ও জাতীয় দিবস, মহান বিজয় দিবস ইত্যাদি।

আরও পড়ুনএবার ঈদে লম্বা ছুটি, কবে থেকে কত দিন২১ ঘণ্টা আগে

আর সরকার নির্বাহী আদেশে যে সরকারি ছুটি দেয়, সেটি মূলত নির্দিষ্ট শ্রেণির লোকদের জন্য। যেমন ঈদের আগে-পরে নির্বাহী আদেশে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য সরকারি ছুটি হয়।

আসন্ন ঈদের কথাই ধরা যাক। এবার ঈদ উপলক্ষে ২৯, ৩০ ও ৩১ মার্চ এবং ১ ও ২ এপ্রিল পর্যন্ত ছুটি থাকবে। এর মধ্যে ঈদের দিনটি সাধারণ ছুটি (চাঁদ দেখা সাপেক্ষে ঠিক হবে, সম্ভাব্য তারিখ ৩১ মার্চ)। এ ছাড়া ঈদের আগের দুই দিন এবং পরের দুই দিন নির্বাহী আদেশে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে।

ফিরোজ মিয়ার ভাষ্য, নির্বাহী আদেশের এই ছুটি মূলত সরকারি, আধা সরকারি, সংবিধিবদ্ধ স্বায়ত্তশাসিত ও আধা স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য প্রযোজ্য হয়। এটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রযোজ্য নয়। তারা তাদের মতো ছুটি ঘোষণা করে, কিন্তু সাধারণ ছুটি সবার জন্যই প্রযোজ্য।

আরও পড়ুন২০২৫ সালে কলেজে ছুটি ৭১ দিন, একটানা ২৫ দিন০৬ জানুয়ারি ২০২৫

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, যেসব অফিসের সময়সূচি ও ছুটি নিজস্ব আইনকানুন দিয়ে চলে (যেমন বাংলাদেশ ব্যাংক) অথবা যেসব অফিস, সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের চাকরি সরকার অত্যাবশ্যক হিসেবে ঘোষণা করেছে, সেগুলো নিজস্ব আইনকানুন অনুযায়ী জনস্বার্থ বিবেচনা করে এই ছুটি ঘোষণা করবে।

অবশ্য অতীত অভিজ্ঞতা হলো, ঈদের ছুটি সরকার যে কয়দিন নির্ধারণ করে, সাধারণত অধিকাংশ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও সেটি অনুসরণ করে।

আছে আরেক ধরনের ছুটি

সাধারণ ও নির্বাহী—এই দুই ধরনের ছুটির বাইরে আছে আরেক ধরনের ছুটি। সেটিকে বলা হয় ঐচ্ছিক ছুটি। তবে নামে ঐচ্ছিক হলেও তা ইচ্ছামতো নেওয়ার সুযোগ নেই। এটি মূলত ধর্মীয় পর্ব অনুযায়ী বছরে সর্বোচ্চ তিন দিন নেওয়ার সুযোগ আছে।

এ বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, একজন কর্মচারীকে তাঁর নিজ ধর্ম অনুযায়ী বছরে অনধিক তিন দিনের ঐচ্ছিক ছুটি ভোগ করার অনুমতি দেওয়া যেতে পারে। প্রত্যেক কর্মচারীকে বছরের শুরুতে নিজ ধর্ম অনুযায়ী নির্ধারিত তিন দিনের ঐচ্ছিক ছুটি ভোগ করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমোদন গ্রহণ করতে হবে। সাধারণ ছুটি, নির্বাহী আদেশে সরকারি ছুটি ও সাপ্তাহিক ছুটির সঙ্গে যুক্ত করে ঐচ্ছিক ছুটি ভোগ করার অনুমতি দেওয়া যেতে পারে।

আরও পড়ুনআগামী বছর ছুটি ২৬ দিন, তার মধ্যে ৯ দিনই সাপ্তাহিক ছুটি১৭ অক্টোবর ২০২৪

কোন ধর্মের কোন পর্বগুলোতে এই ঐচ্ছিক ছুটি নেওয়া যাবে, সেটিও বাৎসরিক ছুটির পঞ্জিতে উল্লেখ করে দেওয়া হয়। যেমন এ বছরের বাৎসরিক ছুটির পঞ্জিতে মুসলমানদের জন্য পাঁচটি পর্বে পাঁচ দিন ঐচ্ছিক ছুটি (সর্বোচ্চ তিন দিন নেওয়া যাবে) নেওয়ার সুযোগ আছে। এই পর্বগুলো হলো পবিত্র শবে মিরাজ, ঈদুল ফিতরের পরের তৃতীয় দিন, ঈদুল আজহার পরের চতুর্থ দিন, আখেরি চাহার শোম্বা ও ফাতেহা-ই ইয়াজদাহম।

একইভাবে হিন্দু সম্প্রদায়ের সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য ৮টি পর্বে ৯ দিন (যেমন সরস্বতী পূজা), খ্রিষ্টান ধর্মের জন্য ৭টি পর্বে ৮ দিন (যেমন খ্রিষ্টীয় নববর্ষ) ও বৌদ্ধ ধর্মের ৬টি পর্বের জন্য ৭ দিন (যেমন মাঘী পূর্ণিমা) ঐচ্ছিক ছুটি নেওয়ার সুযোগ আছে।

আরও পড়ুনঈদুল ফিতরে ৫ দিন, ঈদুল আজহায় ৬ দিন, দুর্গাপূজায় ২ দিন ছুটি১৭ অক্টোবর ২০২৪

সম্পর্কিত নিবন্ধ