সংস্কারে কোটি টাকা ব্যয় তবুও লাঘাটা শুকায়
Published: 18th, March 2025 GMT
পাহাড়ি বনাঞ্চলের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যে নিজের ভূপ্রাকৃতিক স্বকীয়তা জানান দেয় কমলগঞ্জ। উপজেলার প্রধান জলাধার ধলাই নদীর দুই পারে কমলগঞ্জের দুটি অংশ। স্থানীয়দের ভাষ্য, এই অঞ্চলের প্রান্তিক জনপদের জীবনসত্তার ধারক লাঘাটা নদী, যা সময়ের সঙ্গে প্রায় অস্তিত্বহীন।
সম্প্রতি খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এক সময়ের প্রাণসঞ্চারিণী এই লাঘাটা এখন একটি মুমূর্ষু মরা গাঙ মাত্র। গত কয়েক বছরের মধ্যে কোটি টাকা ব্যয়ে নদীটির খনন ও সংস্কার কাজ করেও লাভ হয়নি কিছুই। শুষ্ক মৌসুমের জীর্ণ লাঘাটা, বর্ষার পাহাড়ি ঢলের পানিতে হয়ে ওঠে সর্বগ্রাসী। দখল, দূষণ আর অপরিকল্পিত খনন কাজে অনিয়মের কারণে স্বাভাবিক গতিপথ ও প্রবাহ হারিয়ে এমন অবস্থা নদীটির।
স্থানীয়রা জানান, তীরে ভাঙন, বুকে নাব্য সংকটে জর্জরিত লাঘাটা নদীটি পাহাড়ি ঢল ও বন্যার পানি নিষ্কাশনের মাধ্যম। ঢলের পানির সঙ্গে আসা পলিতে নদী ভরাট হওয়ায় সেটি সংকুচিত হয়ে খালে পরিণত হয়। এর আগেও একই অবস্থা ছিল নদীটির।
বৃহত্তর সিলেটের এক সময়ের শস্যভান্ডারখ্যাত কমলগঞ্জে কৃষকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৯ সালের শেষ নাগাদ লাঘাটা নদীর খনন কাজ শুরু হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে লাঘাটা নদীর খনন কাজ শুরু হয়। পর্যায়ক্রমে নদীটির ২৪ কিলোমিটার পর্যন্ত খনন করার কথা ছিল। এতে ব্যয় নির্ধারণ করা হয় ১১ কোটি ৯৩ লাখ টাকা।
২০২২ সালের জুন মাসের বন্যায় কমলগঞ্জের পরিস্থিতি বিবেচনা করলেই বোঝা যায়, মাত্র বছর দেড়েকের কিছু বেশি সময় আগে করা কোটি টাকার খনন কাজে কতটা স্বাভাবিক গভীরতা ও প্রবাহ নিশ্চিত করা হয়েছিল নদীটির।
উপজেলার একাধিক স্থান ঘুরে দেখা যায়, লাঘাটার অনেক স্থান শুকিয়ে খাঁ খাঁ করছে। গবাদি পশুর খাবার পানিটুকুও পাওয়া যাচ্ছে না। এটি কমলগঞ্জ উপজেলার আদমপুর, আলীনগর, শমশেরনগর, পতনঊষার ও রাজনগর উপজেলার কামারচাক ইউনিয়নের ওপর দিয়ে প্রবাহিত। এসব এলাকার সুনছড়া, কামারছড়াসহ অসংখ্য পাহাড়ি ছড়া ও খাল এসে পতিত হয়েছে লাঘাটা নদীতে। এই পানির সঙ্গে আসা পলিতে লাঘাটার বুকে নাব্য সংকট তীব্র হয়।
এই নদীকে কেন্দ্র করে প্রান্তিক জনপদের জীবনযাত্রা বিশেষ করে বোরো ও রবিশস্য উৎপাদন টিকে আছে। আদমপুর, আলীনগর, শমশেরনগর, পতনঊষার ও রাজনগর ইউনিয়নের হাজারো কৃষক নদী থেকে সেচ সুবিধা ভোগ করতেন। এখন নদীতে পানি না থাকায় অনেকেই গভীর নলকূপে ঝুঁকে পড়ছেন। ফলে পানির স্তর নিচে নামছে। বিভিন্ন গ্রামে সাধারণ নলকূপেও পানি উঠছে না।
সরেজমিন নদীর কয়েকটি স্থান ঘুরে দেখা যায়, ২০১৯ সালে খনন কাজের ফলে লাঘাটার নিম্নাঞ্চলে কিছুটা পানি পাওয়া যাচ্ছে। শমশেরনগর ইউনিয়নের অর্ধেক অংশ থেকে আলীনগর, আদমপুর ইউনিয়নের অনেক স্থানেই নদী শুকনো। গবাদি পশুর খাবার পানিও পাওয়া যাচ্ছে না। নদীতে গোসল করা, বসতবাড়ির আসবাব ধৌত করাও ছিল অনেকের সুবিধাস্থল। নদীর তলদেশ ভরাট, সংকোচন, দখল, অবৈধভাবে পলিবালু উত্তোলন, বর্জ্য ফেলা, গাছ, বাঁশ ও ঝোপজঙ্গলে ভরপুর হয়ে ওঠায় অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে লাঘাটা।
লাঘাটা পারের বাসিন্দা আক্তার মিয়া, কফিল মিয়া, রাজদেও কৈরী বলেন, এই নদী থেকে আগে অনেক সুবিধা পাওয়া যেত। বর্ষায় পানি কমলে মাছ ধরা, শুষ্ক মৌসুমে সেচ দিয়ে কৃষিক্ষেত করা, প্রবহমান নদীতে গোসল করা– কত কিছুই ছিল। বর্তমানে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন, শত শত শ্যালো মেশিনে সেচ দিয়ে পানি তুলে নেওয়া, কৃষিজমিতে গভীর নলকূপ, নদী ভরাট, এসব নানা কারণে মানুষ লাঘাটার প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারছে। নদীকে পরিকল্পিতভাবে মেরে ফেলা হচ্ছে।
পরিবেশবিদ জিডিশস প্রধান সুচিয়ান বলেন, কিছু সংখ্যক মানুষের অপরিকল্পিত কার্যক্রম ও পরিবেশ বিধ্বংসী কার্যক্রমের কারণে নদী, ছড়া, জলাশয় বিপন্ন হচ্ছে। এর বাইরে লাঘাটা নদীও নয়। এটিকে বাঁচিয়ে রাখা প্রয়োজন।
লাঘাটার বর্তমান অবস্থা এবং এর সংকট উত্তরণের ব্যাপারে কথা বলতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সহকারী কমিশনারের (ভূমি) সঙ্গে কথা বলতে একাধিকবার কল করা হলেও সাড়া মেলেনি।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: নদ কমলগঞ জ উপজ ল র খনন ক জ নদ ট র র খনন
এছাড়াও পড়ুন:
চালকলমালিকদের সুবিধা দিতেই ধান সংগ্রহের পরিমাণ কমাচ্ছে সরকার
খাদ্য মন্ত্রণালয় এবারের বোরো মৌসুমে সাড়ে তিন লাখ টন ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে, যা গত বছর ছিল ছয় লাখ টন। এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে শুক্রবার বিবৃতি দিয়েছেন দেশের ৪৩ বিশিষ্ট নাগরিক। তাঁরা বলছেন, কৃষককে বঞ্চিত করে মিলারদের সুবিধা দিতে সরকার ধান সংগ্রহের পরিমাণ কমিয়েছে।
বিবৃতিদাতাদের মধ্যে রয়েছেন গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির সদস্য অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, সাবেক কৃষিসচিব আনোয়ার ফারুক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোশাহিদা সুলতানা, লেখক ও গবেষক আলতাফ পারভেজ, লেখক ও গবেষক কল্লোল মোস্তফা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন শিক্ষক মাহা মীর্জা, লেখক ও গবেষক পাভেল পার্থ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক মাহমুদুল সুমন প্রমুখ।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে শুধু ধান ও চাল ছাড়া অন্য কোনো শস্য সরকারিভাবে কেনা হয় না। আবার কৃষকদের কাছ থেকে পণ্য সংগ্রহের সময় দাম নির্ধারণে অস্বচ্ছ ও অদক্ষ পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। ফলে কৃষক বছরের পর বছর প্রতারণার শিকার হন।
ধান-চাল কেনায় সরকারি উদ্যোগ অতি সামান্য হওয়ায় ধানের বাজারে তা খুব বেশি প্রভাব বিস্তার করতে পারে না উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়, এ প্রবণতার কারণে প্রতিবছর চালকলমালিকদের (মিলার) একচ্ছত্রভাবে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে দেখা গেছে।
এই সিন্ডিকেট ভাঙার একমাত্র উপায় হিসেবে কৃষকের কাছ থেকে সরকারি ক্রয়কেন্দ্রের মাধ্যমে অধিক পরিমাণে ধান কেনার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে বিবৃতিতে।
সরকার চালকলমালিকদের কাছ থেকে চাল কিনলে কৃষকের লাভ হয় না উল্লেখ করে বিবৃতি অভিযোগ করা হয়েছে, এই প্রক্রিয়ায় লাভের একটা বড় অংশ মিলারদের পকেটে চলে যায়। কিন্তু কৃষকের থেকে সরাসরি ধান কেনা হলে বাজারে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ে।
এবার ধানের দাম প্রতি কেজিতে চার টাকা বাড়ানো হয়েছে, যা সাধুবাদযোগ্য বলে অভিমত দিয়েছেন বিবৃতিদাতারা।
খাদ্য অধিদপ্তরের শীর্ষ পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, এবার তাঁরা প্রতি কেজি ধান কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ৩৬ টাকায়, যা গত বছরের তুলনায় চার টাকা বেশি। ফলে কৃষকেরা লাভবান হবেন। অন্যদিকে চাল কেনা হবে প্রতি কেজি ৪৯ টাকায়।
৩ লাখ টন ধানের পাশাপাশি এবার সাড়ে ১৪ লাখ টন চাল (সেদ্ধ) সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে সরকার।
ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা কমেছে কেন জানতে চাইলে খাদ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, দেশে চাল আমদানি হয়েছে পর্যাপ্ত পরিমাণে। ধান কিনলে সেটা ভাঙানো ও মজুদের সক্ষমতার ঘাটতি রয়েছে খাদ্য অধিদপ্তরের। সে জন্য চাইলেও তাঁরা এই মুহূর্তে বেশি ধান সংগ্রহ করতে পারছেন না।
বিবৃতিতে ৪৩ নাগরিকের পক্ষ থেকে চারটি দাবি উত্থাপন করা হয়েছে। সেগুলো হলো ধান সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রা এখনই পরিবর্তন করে ১৭ লাখ টনে উন্নীত করা, চাল কেনার লক্ষ্যমাত্রা ৫ লাখ টনে নামিয়ে আনা, চলতি বোরো মৌসুমেই কৃষকের কাছ থেকে পর্যায়ক্রমে ধান কেনার পরিমাণ ৫০ লাখ টনে উন্নীত করা এবং আগামী অর্থবছরের মধ্যেই সরকারি গুদামের সক্ষমতা ২১ লাখ টন থেকে ৫০ লাখ টনে উন্নীত করা।
কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনার জন্য প্রাথমিকভাবে গুদামসক্ষমতা খুব বেশি বাড়ানোর প্রয়োজন পড়বে না বলে দাবি করা হয়েছে বিবৃতিতে। বলা হয়েছে, খাদ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে দেশের অধিকাংশ চালকলের একটি বার্ষিক চুক্তি হয়ে থাকে। সেই চুক্তিতে শুধু চাল সরবরাহের শর্ত থাকে।
চুক্তিতে আরেকটি শর্ত যুক্ত করার পরামর্শ দিয়ে বিবৃতিদাতারা বলেছেন, সরকার কৃষকের কাছ থেকে যে ধান কিনবে তা মাড়াই করবে বেসরকারি চালকলগুলো। চালকল থেকে মাড়াই করা চাল সরাসরি সরকারের গুদামে চলে যাবে। এর ফলে বর্তমান গুদামসক্ষমতা দিয়েই অধিক পরিমাণে ধান কেনা সম্ভব হবে।
সরকারের সংগ্রহ কার্যক্রমে আঞ্চলিক বৈষম্য দূর করতে গ্রামভিত্তিক ও ইউনিয়নভিত্তিক শস্য সংরক্ষণাগার করারও দাবি জানিয়েছেন বিবৃতিদাতারা। তাঁরা বলেছেন, শুধু সমতলের কৃষি নয়, পাহাড়ি এলাকার জুমে উৎপাদিত ধান ও ফসল ন্যায্যমূল্য দিয়ে কিনতে হবে। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের স্থানীয় মূল্য নির্ধারণ কমিটিতে নারী-পুরুষ কৃষক ও জুমিয়া প্রতিনিধি রাখার দাবি জানান তাঁরা।