ধর্ষণের শিকার হইয়া মাগুরার শিশু আছিয়ার হৃদয়বিদারক মৃত্যু সচেতন মানুষদের যদ্রূপ বেদনাহত করিয়াছে, তদ্রূপ উক্ত দুষ্কর্মের দ্রুত বিচার না হইবার বিষয়ও তাহাদের ক্ষুব্ধ করিয়াছে। আমরা দেখিয়াছি, ধর্ষণ মামলার বিচারে দীর্ঘসূত্রতা রহিয়াছে বলিয়াই অনেক সময় অপরাধী নিষ্কৃতি পাইয়া যায়। এই প্রেক্ষাপটেই শিশু ধর্ষণের বিচার দ্রুতকরণের লক্ষ্যে সরকারের বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের সিদ্ধান্তকে আমরা স্বাগত জানাই। সোমবার উপদেষ্টা পরিষদের বিশেষ সভা শেষে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এই কথা জানাইয়াছেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। আমরা মনে করি, ইহা ইতিবাচক সিদ্ধান্ত এবং ন্যায়বিচারের পথে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করিবে। সমকালের সংবাদ অনুসারে, ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০’-এর বেশ কিছু সংশোধনী প্রস্তাব ইতোমধ্যে প্রস্তুত করিয়াছে আইন মন্ত্রণালয়। প্রস্তাবগুলি যাচাই-বাছাই করিয়া বৃহস্পতিবার উপদেষ্টামণ্ডলীর অনুমোদন করিবার কথা।
অনস্বীকার্য, দ্রুত বিচারের নামে অনেক সময় বিচারকে প্রহসনে পরিণত করা হয়। কিন্তু ইহাও স্বীকার করিতে হইবে, বিশেষত অনেক পুলিশ সদস্যের পাশাপাশি বিচার ব্যস্থায়ও নারী অধিকার সম্পর্কে ইতিবাচক ধ্যানধারণার ঘাটতি রহিয়াছে। যাহার প্রভাবে ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচার হইতে বঞ্চিত হয়। এমতাবস্থায় ন্যায়বিচারের স্বার্থে শুধু ধর্ষণের তদন্ত ও বিচারের সময় হ্রাস করাই যথেষ্ট নহে, তদন্ত ও বিচারকার্যে নিয়োজিতদেরও নারী অধিকার সম্পর্কে সংবেদনশীল করিয়া তোলা জরুরি। ইতোপূর্বেও নির্দেশনা ছিল– ৩০ দিবসের মধ্যে তদন্ত শেষ করিয়া ১৮০ দিবসের মধ্যে ধর্ষণ মামলার বিচারকার্য সমাপ্ত করিতে হইবে। কিন্তু উহা কতটা বাস্তবায়িত হইয়াছে, আমরা জানি। নূতন করিয়া ১৫ দিবসের মধ্যে তদন্ত এবং ৯০ দিবসের মধ্যে বিচারকার্য সমাপ্তির সিদ্ধান্ত গুরুত্বপূর্ণ বলিয়াই আমরা মনে করি। তবে কেবল সিদ্ধান্ত লইলেই হইবে না; যথাযথ কর্তৃপক্ষের নজরদারিও এই ক্ষেত্রে জরুরি।
ধর্ষণের বিচারের পথে আরও যেই সকল বিষয় বাধা হইয়া দাঁড়ায় সেই সকল বিষয়ও সরকার যেইভাবে চিন্তা করিয়াছে, উহা সাধুবাদযোগ্য। ধর্ষণ মামলার সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনা, চাঞ্চল্যকর ধর্ষণের ক্ষেত্রে ডিএনএ টেস্টের রিপোর্টের অপেক্ষায় না থাকিয়া পারিপার্শ্বিকতা বিবেচনায় সাক্ষ্যের ভিত্তিতে রায় দিবার সুযোগ তাৎপর্যপূর্ণ বলিয়া বিবেচিত হইবে। আমরা দেখিয়াছি, ডিএনএ রিপোর্ট পাইবার অপেক্ষায় অনেক মামলা ঝুলিয়া থাকে। তজ্জন্য এই বিকল্প উপায় সময় হ্রাস করিতে ভূমিকা রাখিবে।
আমাদের বিশ্বাস, অল্প সময়ে ধর্ষণের বিচার সম্পন্ন হইলে এবং বিশেষ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে শিশু ধর্ষণের বিচারে বাস্তবে শাস্তির কিছু উদাহরণ তৈয়ার হইলে ধর্ষণ হ্রাসে ভূমিকা রাখিবে। তবে ধর্ষণ নিয়ন্ত্রণে ইহাই যথেষ্ট নহে। দেখা গিয়াছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিকটাত্মীয় ও পরিচিতজনই শিশু ধর্ষণে প্রবৃত্ত হয়। তজ্জন্য মা-বাবা ও অভিভাবকের সচেতনতাও এই ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। সন্তানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করিতে হইবে অভিভাবকদেরই। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা, আইনের শাসন নিশ্চিত করা ও ধর্ষণের বিরুদ্ধে সামাজিকভাবে সকলে সোচ্চার হইলে এহেন অপরাধ বন্ধ হইতে পারে।
দুঃখজনক হইলেও সত্য, মাগুরায় শিশু আছিয়ার ধর্ষণের ঘটনা দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করিলেও ধর্ষণ নামক অঘটনে কোনো ছেদ পড়ে নাই। আছিয়ার মৃত্যুতে ধর্ষণের বিচার দাবিতে সমগ্র দেশে প্রতিবাদ হইয়াছে। এই সময়ে তারুণ্যের ইতিবাচক জাগরণের বিষয়ও এই সম্পাদকীয় স্তম্ভে আমরা উল্লেখ করিয়াছি। ইহার পরও দেশের বিভিন্ন জায়গায় ধর্ষণের ঘটনার খবর সংবাদমাধ্যমে আসিয়াছে। এমনকি বরগুনায় মেয়েকে ধর্ষণের পর বাবা মামলা করিলে, বাবাকে হত্যা করা হইয়াছে। এই সকল বিষয়ও কঠোর হস্তে নিয়ন্ত্রণ করিতে হইবে।
ধর্ষণ শুধু সংশ্লিষ্ট ভুক্তভোগীর জীবনই তছনছ করিয়া দেয় না; উহার পরিবারও এক প্রকার সামাজিক কলংক আরোপের শিকার হয়। সর্বোপরি, রাষ্ট্র ও সমাজ এহেন পরিস্থিতিতে সহযোগিতার হস্ত প্রসারিত করে না। তাই সমাজকে এই ভয়ংকর অপরাধমুক্ত করা জরুরি হইয়া পড়িয়াছে।
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
নববর্ষে মেয়ের জন্ম, ডাক্তার খুশি হয়ে নাম রেখেছেন বৈশাখী
পহেলা বৈশাখে তৃতীয় সন্তান এসেছে চাঁদপুরের শাহাদাত হোসেন ও রিনা আক্তারের পরিবারে। বৈশাখের স্নিগ্ধ সকালে চাঁদপুর মা ও শিশু স্বাস্থ্য পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে মেয়ে সন্তান জন্ম নেয় তাদের ঘরে।
তাদের চরম এক টানাপড়েনের সংসারে বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনে মেয়ের আগমনে বেশ খুশি শাহাদাত-রিনা দম্পতি। সকালে মেয়ের মিষ্টিমুখ দেখে চিকিৎসক এবং নার্স হাসপাতালে নবজাতকের নাম তালিকাভুক্ত করার সময় পরিবারের সদস্যদের ডেকে বলেন, ‘আজ বাংলা নববর্ষ এবং পহেলা বৈশাখ। তাই মেয়ের নামটি আমরা তালিকায় বৈশাখী দিয়ে দিলাম। খুশি তো?’ নবজাতকের মা-বাবা মাথা নেড়ে সায়ও দেন।
তবে চিকিৎসক আবার সঙ্গে সঙ্গে এটাও বললেন, ইচ্ছে করলে আপনারা এই বিশেষ দিনের নামটার সঙ্গে নিজেদের পছন্দের আরও নাম জড়িয়ে রাখতেই পারেন। সেটা আপনাদের বিষয়।
নবজাতকের বাবা শাহাদাত হোসেন পেশায় একজন রিকশাচালক। ৮ বছর আগে দুই ছেলে- ৫ম শ্রেণির ছাত্র রহমত আর ছোট ছেলে মাদরাসায় পড়ুয়া ইসমাইলকে নিয়ে চলে আসেন চাঁদপুর জেলা শহরের রহমতপুর কলোনিতে। এখানে সেমিপাকা ছোট্ট এক রুমের ভাড়া বাসা নেন। তার মূল বাড়ি ফরিদগঞ্জ উপজেলার সকদী রামপুর গ্রামে। স্ত্রী রিনা আক্তারের বাড়িও একই উপজেলার পাশের গ্রামে।
শহরে এসে ভাড়ায় রিকশা চালান শাহাদাত। ৩'শ টাকা রিকশা মালিককে দেন আর এক দেড়-দুইশ টাকায় চলে সংসার।
বাংলা নববর্ষ পহেলা বৈশাখে জন্ম নেওয়া মেয়ে সন্তানটিকে নিয়ে কথা হয় শাহাদাত হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, রাত তিনটায় স্ত্রী রিনার প্রসব ব্যথা উঠে। ক্রমেই ব্যথা বাড়তে থাকলে একটা অটো ডেকে আমার এক ভাবীসহ বাসা থেকে আধা কিলোমিটার দূরে সরকারি মা ও শিশু স্বাস্থ্য পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে (মাতৃমঙ্গল নামে পরিচিত) নিয়ে যাই। সঙ্গে সঙ্গে দারোয়ান হাসপাতালের গেট খুলে দেয় এবং নার্স এসে আমার স্ত্রীকে বেডে নিয়ে যায়। পর পরই ডিউটি ডাক্তার আসেন।
তিনি বলেন, হাসপাতালের নিয়ম অনুযায়ী আমাকে গেটের বাহিরে অপেক্ষা করতে বলে। তবে চিকিৎসক নার্সরা আমার ভাবীকে বলেন, চিন্তা করবেন না, সব কিছু ঠিক আছে। ইনশাআল্লাহ, উনার নরমাল ডেলিভারিই হবে এবং মা আর গর্ভের সন্তান ভালো আছে।
শাহাদাত হোসেন বলেন, হাসপাতালের বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ভোরের আলো ফুটে যায়। আর সে সময়ই হাসপাতালের পাশের অফিসার্স ক্লাব থেকে ভেসে আসছিল নববর্ষের গান। ঠিক তখনই গেট খুলে দিয়ে দারোয়ান বলেন ভেতরে আসেন আপনি মেয়ের বাবা হয়েছেন। তখন আল্লার কাছে শুকরিয়া আদায় করলাম। ডাক্তার এবং নার্স বললেন- সকাল সাড়ে আটটায় আপনার মেয়ে জন্ম নিয়েছে। একটা স্যালাইন আর সামান্য কিছু ওষুধ দেওয়া হয়েছে। স্যালাইন শেষ হলেই ১০টার মধ্যেই বাসায় নিয়ে যেতে পারবেন। আর বাচ্চার ওজন ২ কেজি ৯ শ গ্রাম।
পহেলা বৈশাখে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আপনার মেয়েকে কি উপহার দিলো, এমন প্রশ্নের জবাবে সরল হাসি দিয়ে রিকশাচালক শাহাদাত হোসেন বলেন, এই ভোররাতে তারা আমার বউ আর সন্তানের সেবায় একটুও হেলা করেনি। এটাই আমার মতো গরীব বাবার কাছে অনেক বড় উপহার। এর আগেও এই হাসপাতালে দুই-একবার গিয়েছিলাম। তারা তখনও অনেক যত্ন নিয়ে চিকিৎসা দিয়েছিলেন।
মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের চিকিৎসক মেহেদী আল মাসুদ জানান, নববর্ষের প্রথম প্রহরের রোগী রিনা আক্তার। তার চিকিৎসার কোনরূপ হেলা করিনি আমরা। আর এখানে আগে থেকেই আমরা গর্ভবতী মায়েদের প্রসব এবং অন্যান্য চিকিৎসাগুলো দিয়ে থাকি।
শাহাদাত হোসেন বলেন, গরীব ঘরের মেয়েকে কতদিন নিজের কাছে আগলে রাখতে পারবো আল্লাহই ভালো জানেন। তবে যথাসম্ভব চেষ্টা করবো মেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মতো মনুষ করার।
তিনি আরও বলেন, আমার মেয়ে যেন সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে বেচে থাকে সবাই এই দোয়া করবেন।