বাংলাদেশ রাখাইনমুখী আন্তর্জাতিক করিডোর হবে?
Published: 18th, March 2025 GMT
বাংলাদেশে বিগত শাসনামলে করিডোর একটি অপছন্দের শব্দ ছিল জনপরিসরে। বলা হতো, ভারতকে করিডোর দিলে বহুভাবে লাভবান হবে দেশ। স্থল করিডোর দিয়ে চলাচলকারী ভারতের গাড়ির চাকায় হাওয়া দিয়ে দেশ অর্থনৈতিকভাবে বেশ এগিয়ে যেতে পারে বলেও স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন অনেকে। কেউ কেউ বলেছেন, করিডোর দেওয়া হলে আন্তঃনদীর পানি পাওয়া যাবে। ‘পানির বিনিময়ে করিডোর’ নামে একটি চোরাগোপ্তা তত্ত্ব দাঁড়িয়ে গিয়েছিল তখন।
শেষ পর্যন্ত ভারত জল-স্থল বহুপথে করিডোর পেয়েছিল, কিন্তু পানি পায়নি বাংলাদেশ। জল-স্থল কোনো করিডোর থেকে আর্থিক সুবিধাও উল্লেখ করার মতো ছিল না। করিডোরকে ‘ট্রানজিট’ নাম দিয়ে বিনিময়ে পাঁচ বছর পরপর একটি দলের ক্ষমতায় থাকার নিশ্চয়তা মিলেছিল।
চব্বিশে ক্ষমতার পালাবদল ঘটার পর এবার নতুন করে দক্ষিণ সীমান্তে করিডোরের আলাপ এলো। জাতিসংঘ মহাসচিব সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরে এসে নতুন যে বিষয় এখানকার নাগরিক সমাজে ছড়ালেন, তা হলো আরাকানে (রাখাইন) ‘মানবিক সহায়তা’ পাঠাতে বাংলাদেশকে ‘চ্যানেল হিসেবে ব্যবহার’ প্রসঙ্গ।
মহাসচিব সরাসরি করিডোর শব্দটি ব্যবহার করেননি। কিন্তু রাখাইন বা আরাকানে ‘সাহায্য’ যেতে ‘চ্যানেল’ হওয়ার কারিগরি অর্থ করিডোরই দাঁড়ায়। বিবিসিসহ আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যমগুলো সংগত কারণে ‘করিডোর’ শব্দটি ব্যবহার করছে। আন্তর্জাতিক পরিসরে ভাষ্যকাররা এক ধাপ আগ বাড়িয়ে এটিও ভাবছেন, বাংলাদেশ আলোচিত এই করিডোর দিতে যাচ্ছে কিনা এবং এই করিডোর দিয়ে কার কাছে কী ধরনের ‘সাহায্য’ যাবে।
এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার দায়িত্ব ও অধিকারী হলো বাংলাদেশ সরকার। কিন্তু সরকার বিস্তারিত কিছু বলেনি। হয়তো এ নিয়ে ভাবতে সময় নেবেন বাংলাদেশের কূটনীতিবিদরা। ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা এ বিষয়ে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। থাইল্যান্ডভিত্তিক ফোর্টিফাই রাইটস নামে একটি সংস্থা এ বিষয়ে প্রচারেও নেমেছে। ফলে জাতিসংঘ মহাসচিবের আসা বা তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো; এখানে এসে তাঁর মুখ থেকে এ রকম প্রস্তাব এবং এ সফরের আগেই সেই প্রস্তাবের পক্ষে বিভিন্ন সংস্থার সমর্থন ব্যাপক কৌতূহল ও আঁচ-অনুমান তৈরি করছে।
বিশেষ করে বাংলাদেশে একটি অনির্বাচিত সরকারের আমলে কেন এ রকম একটি প্রস্তাব এলো; কেন এটি বিগত সরকারের সময়ে আসেনি বা কেন গুতেরেস তা আগামী নির্বাচিত সরকারের জন্য অপেক্ষায় রাখলেন না– সেসবও আছে প্রশ্ন আকারে।
আবার এমন সময়ে রাখাইনে মানবিক সহায়তা পাঠানোর কথা ওঠানো হলো যখন সেখানে রোহিঙ্গারা প্রায় বিতাড়িত; ৮০-৯০ শতাংশ এলাকা রাখাইন গেরিলাদের নিয়ন্ত্রণে। রাখাইনে মানবিক ও অবকাঠামো সহায়তা চাইছে মূলত আরাকান আর্মি। তারা সেটা বিশেষভাবে বাংলাদেশের কাছেই চায়। বাংলাদেশ ওষুধের মতো কিছু মানবিক সহায়তা অনানুষ্ঠানিকভাবে সীমান্তের ওদিকে পাঠিয়েছে বলে আন্তর্জাতিক পরিসরে খবর বের হয়েছিল বিগত সময়ে। আন্তর্জাতিক মহল রাখাইনে সহায়তা করতে চাইলে আরাকান আর্মি সেটাকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত বলেও জানা যায়। সে রকম সহায়তা সমুদ্রপথে সেখানে পৌঁছানো কঠিন কিছু নয়। রাখাইনের রয়েছে দীর্ঘ উপকূল।
আবার ইউএস-এইড বন্ধ হলেও মিয়ানমারে আন্তর্জাতিক অনেক সাহায্য সংস্থার উপস্থিতি রয়েছে। তাদের মাধ্যমেও সাহায্য পাঠানো যায়। সে জন্য হয়তো জান্তা সরকারের অনুমতি ও সংশ্লিষ্টতা লাগবে। এসব বিকল্প বাদ দিয়ে বাংলাদেশকে ‘চ্যানেল’ তথা করিডোর হিসেবে ব্যবহার করে সাহায্য পাঠানো হলে আরাকান আর্মি আপত্তি না করলেও মিয়ানমার সরকার ভিন্নমত পোষণ করতে পারে। প্রশ্ন, বাংলাদেশ কি মিয়ানমার সরকারের আপত্তির মুখে রাখাইনে করিডোর হবে? হলে সেটা কি ঠিক হবে? মিয়ানমারের আপত্তি কিন্তু চীনের কাছে বেশ কদর ও সহানুভূতি পাবে। এর কারণ শুধু উভয় দেশের শাসকদের বন্ধুত্ব নয়; চীনের ভূরাজনৈতিক স্বতন্ত্র বিবেচনাও বটে।
বঙ্গোপসাগরের আশপাশে চীন-ভারত উভয়ে তৃতীয় ‘আন্তর্জাতিক’ মহলের জন্য করিডোরকে যে সন্দেহের চোখে দেখতে পারে, সেটা অস্বাভাবিক নয়। ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতজনিত বিবেচনার বাইরেও রাখাইনে তাদের উভয়ের বিপুল অর্থনৈতিক বিনিয়োগ রয়েছে। এসব বিনিয়োগের দীর্ঘস্থায়ী সুরক্ষা নিয়ে এশিয়ার এ দুই পরাশক্তি এই মুহূর্তে আরাকান আর্মির সঙ্গে দরকষাকষিতে লিপ্ত। তাদের জন্য এটি এক গুরুতর নিরাপত্তা প্রশ্নও বটে। ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে রুশ সরকারের সুসম্পর্ক মিয়ানমার প্রশ্নে সম্প্রতি চীনকে বাড়তি সতর্ক করেছে।
ঠিক এ রকম সময়ে বাংলাদেশ থেকে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর রাখাইনমুখী (‘মানবিক’!) করিডোর প্রস্তাব নিশ্চিতভাবে মিয়ানমারের মতো ভারত ও চীনের রাজধানীতেও চাঞ্চল্য বাড়িয়েছে।
সন্দেহ নেই– যুদ্ধবিধ্বস্ত রাখাইনে সহায়তা প্রয়োজন। রাখাইনকে ছোটখাটো সিরিয়া-লিবিয়াও বলতে পারি আমরা। সেখানে দুর্ভিক্ষের শঙ্কা আছে। নিয়মিত গোলাগুলিও চলছে। এই রকম জনপদে মানবিক সহায়তার অনিবার্য অনুষঙ্গ হিসেবে চলে আসে সামরিক প্রসঙ্গ। কথিত মানবিক সহায়তা অনেক সময় যুদ্ধরত পক্ষগুলোর কারও অবস্থান শক্তিশালী; কারও অবস্থান করে দুর্বল। এ কারণে বহুকাল যুদ্ধ চলমান এমন জনপদে ‘আন্তর্জাতিক মানবিক সহায়তা’র ধারণাটা বেশ স্পর্শকাতর।
বলা বাহুল্য, বাংলাদেশের সরকার ও কূটনীতিবিদদের এসব অজানা নেই। সে জন্যই প্রশ্ন উঠছে– নির্বাচিত সরকারহীন অবস্থায় এবং অভ্যন্তরীণ শান্তিশৃঙ্খলার চলতি টালমাটাল সময়ে বাংলাদেশ এ রকম পদক্ষেপে সহায়তা করতে পারে কিনা। এ প্রশ্নও আছে, বিশেষ করে জাতিসংঘ নামে প্রতিষ্ঠানের ওপর ইউরোপ-আমেরিকার যে ব্যাপক প্রভাব এবং মিয়ানমার বিষয়ে তাদের সঙ্গে চীন ও রাশিয়ার যে মতদ্বৈততা দেখা যায়, সে পটভূমিতে রাখাইনমুখী করিডোরে সব পরাশক্তির ঐকমত্য থাকবে বলে আমরা কি আশা করতে পারি? আবার সে রকম ঐকমত্য না হলে বাংলাদেশের করিডোর যে কূটনৈতিক আপত্তি, রাজনৈতিক বিরোধিতা এবং সামরিক ঝুঁকিতে থাকবে, সেটা কে সামাল দেবে?
সত্য, আন্তর্জাতিক পরিসরে এ রকম মানবিক সহায়তার কিছু সফল নজির আছে। কিন্তু এমন নজিরও কম নেই, যেখানে এ রকম আপাত নিরীহ সহায়তা চলতে চলতেই প্রতিদিন একটু একটু করে জটিলতা বেড়েছে। রাখাইনের বিষয়টি ইতোমধ্যে বেশ জটিল হয়ে আছে।
সেখানে সহায়তা অভিযানের জন্য আরাকান আর্মির সম্মতি জরুরি। আবার বাংলাদেশের দিক থেকে সেই সহায়তায় রোহিঙ্গাদের স্বার্থ, তাদের ফেরত যাওয়ার প্রসঙ্গ জুড়ে দেওয়ারও অনুমান আছে। এ দুই বিষয়ে সফলতা আসতে পারে আরাকান আর্মির সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রতিনিধি ও বাংলাদেশের অনানুষ্ঠানিক হলেও বিশ্বাসযোগ্য সমঝোতায়। এখানে নির্বাচিত সরকার ছাড়া ওই দিকের যুদ্ধজয়ী শক্তি হিসেবে আরাকান আর্মি এ রকম সমঝোতায় রাজি হবে কিনা বা নির্বাচিত সরকারের নির্দেশনা ছাড়া এখানকার সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো এ রকম সমঝোতার জন্য কাজ করতে এগিয়ে যাবে কিনা– সেসব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নেরও মুখোমুখি করে গেলেন আমাদের আন্তোনিও গুতেরেস।
আলতাফ পারভেজ: গবেষক, মিয়ানমার
বিষয়ে গ্রন্থ প্রণেতা
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ন র ব চ ত সরক র আর ক ন আর ম ত সরক র র কর ড র দ ব যবহ র র খ ইন র জন য আপত ত এ রকম
এছাড়াও পড়ুন:
যে প্রলোভনে মিয়ানমারে দুই বছর জেল খাটলেন ২০ কিশোর–তরুণ
কারও বয়স ১৬, কারও ১৮ ছুঁই ছুঁই। দালালের প্রলোভনে পড়ে মালয়েশিয়ায় ভালো বেতনে চাকরি আর উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখেছিলেন তাঁরা। পরিবারকে না জানিয়েই রওনা দিয়েছিলেন অবৈধ বিপদসংকুল সাগরপথে। কিন্তু মিয়ানমারে পৌঁছেই আটক হন তাঁরা। তারপর অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে ২২ মাস কারাভোগ করেন।
অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগে ২০২৩ সালের জুনে মিয়ানমারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক এসব কিশোর–তরুণ আজ মঙ্গলবার সকালে নৌবাহিনীর জাহাজে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছান। সেখান থেকে সন্ধ্যায় বাসে তাঁদের নেওয়া হয় চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে। সেখানে অপেক্ষারত পরিবারের সদস্যদের কাছে তুলে দেওয়া হয় এসব কিশোর–তরুণকে।
সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসের সামনে বাস থেকে একে একে নামেন তরুণেরা। ছেলে কিংবা ভাইকে এত মাস পর কাছে পেয়ে দৌড়ে যান স্বজনেরা। কেউ কেউ কান্নায় ভেঙে পড়েন।
জানা গেছে, অসাধু দালালেরা এসব কিশোর–তরুণকে মালয়েশিয়ায় পাচারের চেষ্টা করেছিল। পথে মিয়ানমারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে তাঁরা আটক হন। তাঁদের বাংলাদেশি নাগরিকত্ব যাচাইয়ের পর মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা শুরু করে সরকার। এরপর বাংলাদেশ দূতাবাস তাঁদের প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা করে।
অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ফিরে আসা কিশোর–তরুণেরা কক্সবাজার জেলার টেকনাফ ও উখিয়া অঞ্চলের বাসিন্দা। মালয়েশিয়া যাত্রার কথা কেউ পরিবারকে জানাননি। প্রায় এক মাস পর স্বজনেরা জানতে পারেন তাঁরা আটক হয়েছেন। এক বছর আগে সরকারের কাছে তাঁদের ফিরিয়ে আনতে কাগজপত্র জমা দেয় পরিবার।
ফিরে আসা এক কিশোরের বোনের স্বামী আবদুল্লাহ বলেন, ‘পরিবারকে না জানিয়েই আমার শ্যালক দালালের খপ্পরে পড়ে মালয়েশিয়া যেতে চেয়েছিল। সে মিয়ানমারে আটক হয়। প্রায় এক মাস পর আমরা জানতে পারি। এখন সে পরিবারের কাছে ফিরে এসেছে।’
কিশোর–তরুণদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর অনুষ্ঠানে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. কামরুজ্জামান বলেন, ‘তথ্য যাচাই করে তাঁদের বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। আমরা তাঁদের পরিবারের জিম্মায় হস্তান্তর করেছি।’
এর আগে গত রোববার মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুন শহরের এমআইটিটি বন্দর থেকে ২০ বাংলাদেশি নাগরিক বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জাহাজ বিএনএস সমুদ্র অভিযানে বাংলাদেশের উদ্দেশে রওনা করেন। আজ সকালে জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছায়।