ধর্ষণ প্রতিরোধের কার্যকর উপায় যা হতে পারে
Published: 18th, March 2025 GMT
মাগুরার নিজনান্দুয়ালী গ্রামে বোনের বাড়ি বেড়াতে গিয়ে ধর্ষণ ও হত্যার শিকার ৮ বছর বয়সী শিশু আছিয়া থেকে শুরু করে হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলায় ৬ বছরের শিশু ধর্ষণের ঘটনা আমাদের জানান দিচ্ছে– ভালো নেই এই সমাজ। শিশু থেকে কিশোরী, যুবতী এমনকি বৃদ্ধাও রেহাই পাচ্ছেন না ধর্ষকের হাত থেকে। হাতের কথা যেহেতু এসেই গেল– প্রশ্ন এসে যায়, ধর্ষকের হাত এত লম্বা হলো কবে থেকে এবং কীভাবে? ধর্ষকের হাত কি আইনের হাতের চেয়েও লম্বা? তবে এসব আলাপের আগে জানার চেষ্টা করব একজন পুরুষ ঠিক কখন এবং সম্ভাব্য কী কী কারণে ধর্ষণের মতো ভ্রষ্টাচারে লিপ্ত হয়।
মার্কিন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ড.
ধর্ষণের পেছনের উদ্দেশ্যগুলো ভিন্ন এবং পরিমাপ করা কঠিন। তবে গবেষণায় দেখা গেছে, ধর্ষকদের কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে– সহানুভূতির অভাব, নার্সিসিজম ও নারীর প্রতি শত্রুতার অনুভূতি।
মার্কিন টেনেসি রাজ্যের দক্ষিণ বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের এক গবেষণা অধ্যাপক বলেছেন, ‘যৌন নির্যাতন যৌন তৃপ্তি বা যৌন আগ্রহের বিষয় নয়, বরং ব্যক্তির আধিপত্য বিস্তার বা ক্ষমতাচর্চার বিষয়।’
আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের জার্নাল সাইকোলজি অব ভায়োলেন্সের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ব্যাখ্যা করেছেন, টক্সিক ম্যাস্কুলিনিটি কীভাবে ধর্ষণ সংস্কৃতিকে উৎসাহিত করে। তাঁর মতে, ‘ধর্ষণ এবং অন্যান্য যৌন নির্যাতনের অনেক অপরাধীই তরুণ পুরুষ।’ অনেক ক্ষেত্রে পুরুষ সমবয়সীদের মধ্যে সামাজিক মর্যাদা অর্জনের একমাত্র উপায় হলো অত্যন্ত যৌন অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হওয়া। যৌনভাবে সক্রিয় না থাকাকে প্রায়ই কলঙ্কিত করা হয়। এ বিষয়টি ধর্ষণকে পরোক্ষভাবে উস্কানি দেয়।
প্রথমেই এটা প্রতিষ্ঠিত করা প্রয়োজন– ধর্ষণ কোনো আচরণগত বা মানসিক ব্যাধি নয়, বরং একটি ফৌজদারি অপরাধ। যদিও কিছু ধর্ষকের মানসিক ব্যাধি থাকতে পারে, তবে এমন কোনো ব্যাধি নেই, যা মানুষকে ধর্ষণে প্রবৃত্ত হতে বাধ্য করে। কিছু সংস্কৃতিতে, এমনকি প্রায়ই মিডিয়াতেও এমন কিছু উপাদান কাজ করে, যা নকল পুরুষত্বের প্রচার করে; পুরুষকে নারীর ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য উস্কানি দেয়। সেখানে যেসব পুরুষ খুব বেশি যৌন মিলন করে না অথবা করতে পারে না, তাদের তাচ্ছিল্য করা হয়।
কেউ অস্বীকার করতে পারবে না– ধর্ষিত হওয়া সবচেয়ে কষ্টকর, ভয়াবহ এবং অবমাননাকর অভিজ্ঞতাগুলোর মধ্যে একটি। এটি প্রায় সবসময়ই ভুক্তভোগীর মনে আত্ম-ঘৃণা, আত্ম-দোষ এবং ক্রোধের অনুভূতি জাগায় এবং এটি ট্রমা-পরবর্তী স্ট্রেস ডিজঅর্ডার (পিটিএসডি) সৃষ্টি করে।
মূলত দুই ধরনের ধর্ষকের দেখা মেলে এই সমাজে। সুযোগসন্ধানী ধর্ষক, যারা যৌন তৃপ্তির জন্য যে কোনো সুযোগকে কাজে লাগায়, যেমন মদ্যপানের সময় আত্মনিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলা। আরেক ধরনের ধর্ষক আছে, যার উদ্দেশ্য হলো ভুক্তভোগীদের অপমান ও হেয় করা।
প্রতিহিংসাপরায়ণ ধর্ষকের রাগ ও আগ্রাসন সরাসরি নারীর প্রতি থাকে। এ ধরনের ধর্ষক বিশ্বাস করে, তাকে নারীর ওপর যৌন আক্রমণ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। কারণ সে মনে করে, অতীতে নারীরা তাকে আঘাত, প্রত্যাখ্যান বা অন্যায় করেছে।
যৌন নির্যাতন একটি অমার্জনীয় সহিংসতা এবং একটি ফৌজদারি অপরাধ। দুর্ভাগ্যবশত, সমাজের কলঙ্ক এবং দোষ এড়াতে অনেক ভুক্তভোগী নীরব থাকে। পক্ষান্তরে তাদের ধর্ষকরা অন্য ভুক্তভোগীকে খুঁজতে থাকে স্বাধীনভাবে।
বাংলাদেশে ধর্ষণ-সংক্রান্ত মামলার বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘ ও জটিল। ফলে ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হন। এ ছাড়াও অধিকাংশ ক্ষেত্রে অপরাধীদের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব থাকার কারণে তারা শাস্তি এড়াতে সক্ষম হয়। বিচারহীনতার এই সংস্কৃতি অপরাধীদের উৎসাহিত করে এবং সমাজে একটি বার্তা পাঠায়– ধর্ষণ করেও পার পাওয়া সম্ভব। তাই ধর্ষণের বিচার প্রক্রিয়া আরও দ্রুত ও কার্যকর করতে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন; পুলিশ ও বিচার বিভাগের সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং ভুক্তভোগীদের জন্য নিরাপদ আইনি সহায়তা নিশ্চিত করা জরুরি।
ধর্ষণ প্রতিরোধে কাঠামোগত পরিবর্তন সময়সাপেক্ষ, তবে এটি ছাড়া কোনো দীর্ঘমেয়াদি সমাধান সম্ভব নয়। বাংলাদেশে ধর্ষণ প্রতিরোধে শুধু আইনি ব্যবস্থা বা শাস্তির বিধান যথেষ্ট নয়। বরং সামাজিক মানসিকতা, শিক্ষা ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক নীতি, গণমাধ্যমের ভূমিকা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার সমন্বিত পরিবর্তন প্রয়োজন। নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল সমাজ গড়ে তুলতে হলে শুধু ধর্ষকদের শাস্তি দিলেই হবে না, বরং ধর্ষণের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ার পথগুলোও চিরতরে বন্ধ করতে হবে। এটাই ধর্ষণ প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর ও স্থায়ী উপায়।
পুরুষের সচেতনতা ও সম্পৃক্ততা ছাড়া ধর্ষণ প্রতিরোধ সম্ভব নয়। তাদের মধ্যে যদি ছোটবেলা থেকেই নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার শিক্ষা দেওয়া হয় এবং তাদের বোঝানো হয়– নারীর সম্মতি ছাড়া কোনো সম্পর্ক গ্রহণযোগ্য নয়, তাহলে সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে পারে। ‘মাচো সংস্কৃতি’ বা পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যবাদকে চ্যালেঞ্জ এবং পুরুষদের এ বিষয়ে শিক্ষিত করা ধর্ষণ প্রতিরোধের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হতে পারে।
সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকাও ধর্ষণ প্রতিরোধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে মসজিদ, মন্দির ও অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সমাজে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বিনির্মাণে বিশাল প্রভাব ফেলে। যদি এসব প্রতিষ্ঠান নারীর মর্যাদা, লিঙ্গ সমতা ও ধর্ষণবিরোধী বার্তা প্রচার করতে সক্রিয় ভূমিকা নেয়, তবে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে পারে।
রাজু আলীম: কবি, সাংবাদিক ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
ডিবি প্রধানকে সরানোর সঙ্গে মডেল মেঘনার ঘটনার সংশ্লিষ্টতা নেই: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, ডিবি প্রধানকে সরিয়ে দেওয়ার সঙ্গে মডেল মেঘনা আলমের ঘটনার সংশ্লিষ্টতা নেই। ডিবি প্রধান রেজাউল করিম মল্লিকের বদলি একটি রুটিন প্রক্রিয়া।
মঙ্গলবার দুপুরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত আইন-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত কোর কমিটির বৈঠক শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে আরও ছিলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নিয়োজিত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী খোদা বকশ চৌধুরী। মেঘনার গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মডেল মেঘনাকে বেআইনিভাবে গ্রেপ্তার করা হয়নি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আদেশে গ্রেপ্তার হননি মেঘনা। এ ঘটনা এখন উচ্চ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। তাই এটা নিয়ে কথা বলা ঠিক হবে না।
মেঘনার গ্রেপ্তার নিয়ে আইন উপদেষ্টার বক্তব্য প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, আইন উপদেষ্টা কী প্রেক্ষিতে বলেছেন, সেটা তো আমরা জানি না। সেটা তো উনাকেই জিজ্ঞাসা করতে হবে। এছাড়া উনি তো আমাদেরও বলেননি যে এই কারণে আমি ওটা বলেছি। এটা আপনারা জানেন। আপনার (সাংবাদিক) কথা থেকে উত্তরটা দিলে তো সঠিক প্রেক্ষাপট জানা যাবে না, উত্তরটাও সঠিক হবে না।
বিশেষ ক্ষমতা আইনে মডেল মেঘনা আলমকে গ্রেপ্তারের বিষয়ে সমালোচনা হচ্ছে- এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে মো. খোদা বখস চৌধুরী বলেন, এই (বিশেষ ক্ষমতা আইন) আইন তো ব্যবহার হচ্ছে। এই আইন যে ব্যবহার হচ্ছে না, তা তো নয়। এই একটি ক্ষেত্রে আইনটি ব্যবহার হয়েছে তাও তো নয়। বেআইনি কাজ তো না।
তিনি বলেন, তবে আপনি যদি বলেন এক্ষেত্রে কী হয়েছে- একটা ঘটনা ঘটেছে, একটা অভিযোগ এসেছে, এটা নিয়ে কাজ হচ্ছে। বিষয়টি হাইকোর্টে গেছে। হাইকোর্টে গেলেই এটা বিচারাধীন বিষয়। সাব-জুডিস ম্যাটারে তো কথা বলা ঠিক হবে না। দেখি কী আসে ওখান থেকে।
খোদা বখস চৌধুরী বলেন, তবে একটা জিনিস নিশ্চিত। প্রচলিত আইনে ব্যবস্থাটা নেওয়া হয়েছে, এখানে কারও প্রতি বেআইনি কোনো আচরণ করা হয়নি। হাইকোর্টে এটা নিয়ে বিচার চাচ্ছে, আমরা জবাব দেব। আপনারা সব পাবেন, অগ্রিম এই বিষয়গুলো নিয়ে তো আলোচনা ঠিক না।’
মিস আর্থ বাংলাদেশ-২০২০ বিজয়ী মডেল মেঘনা আলমকে ঢাকায় তার বাসা থেকে পুলিশ আটক করার দুদিন পর আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। আদালত তার বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইনে ৩০ দিনের আটকাদেশ দেন।