মাগুরার নিজনান্দুয়ালী গ্রামে বোনের বাড়ি বেড়াতে গিয়ে ধর্ষণ ও হত্যার শিকার ৮ বছর বয়সী শিশু আছিয়া থেকে শুরু করে হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলায় ৬ বছরের শিশু ধর্ষণের ঘটনা আমাদের জানান দিচ্ছে– ভালো নেই এই সমাজ। শিশু থেকে কিশোরী, যুবতী এমনকি বৃদ্ধাও রেহাই পাচ্ছেন না ধর্ষকের হাত থেকে। হাতের কথা যেহেতু এসেই গেল– প্রশ্ন এসে যায়, ধর্ষকের হাত এত লম্বা হলো কবে থেকে এবং কীভাবে? ধর্ষকের হাত কি আইনের হাতের চেয়েও লম্বা? তবে এসব আলাপের আগে জানার চেষ্টা করব একজন পুরুষ ঠিক কখন এবং সম্ভাব্য কী কী কারণে ধর্ষণের মতো ভ্রষ্টাচারে লিপ্ত হয়।
মার্কিন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ড.

স্যামুয়েল ডি. স্মিথম্যান ১৯৭০-এর দশকে ৫০ জন ধর্ষকের সাক্ষাৎকার নিয়ে জানতে পেরেছিলেন, এই পুরুষদের ভিন্ন পটভূমি, সামাজিক অবস্থান এবং অবশ্যই ভিন্ন ব্যক্তিত্ব ও মানসিকতা ছিল। অবাক করার বিষয়, এ অপরাধ সম্পর্কে কথা বলার সময় তারা যথেষ্ট উদাসীন ছিল।

ধর্ষণের পেছনের উদ্দেশ্যগুলো ভিন্ন এবং পরিমাপ করা কঠিন। তবে গবেষণায় দেখা গেছে, ধর্ষকদের কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে– সহানুভূতির অভাব, নার্সিসিজম ও নারীর প্রতি শত্রুতার অনুভূতি।
মার্কিন টেনেসি রাজ্যের দক্ষিণ বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের এক গবেষণা অধ্যাপক বলেছেন, ‘যৌন নির্যাতন যৌন তৃপ্তি বা যৌন আগ্রহের বিষয় নয়, বরং ব্যক্তির আধিপত্য বিস্তার বা ক্ষমতাচর্চার বিষয়।’
আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের জার্নাল সাইকোলজি অব ভায়োলেন্সের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ব্যাখ্যা করেছেন, টক্সিক ম্যাস্কুলিনিটি কীভাবে ধর্ষণ সংস্কৃতিকে উৎসাহিত করে। তাঁর মতে, ‘ধর্ষণ এবং অন্যান্য যৌন নির্যাতনের অনেক অপরাধীই তরুণ পুরুষ।’ অনেক ক্ষেত্রে পুরুষ সমবয়সীদের মধ্যে সামাজিক মর্যাদা অর্জনের একমাত্র উপায় হলো অত্যন্ত যৌন অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হওয়া। যৌনভাবে সক্রিয় না থাকাকে প্রায়ই কলঙ্কিত করা হয়। এ বিষয়টি ধর্ষণকে পরোক্ষভাবে উস্কানি দেয়।

প্রথমেই এটা প্রতিষ্ঠিত করা প্রয়োজন– ধর্ষণ কোনো আচরণগত বা মানসিক ব্যাধি নয়, বরং একটি ফৌজদারি অপরাধ। যদিও কিছু ধর্ষকের মানসিক ব্যাধি থাকতে পারে, তবে এমন কোনো ব্যাধি নেই, যা মানুষকে ধর্ষণে প্রবৃত্ত হতে বাধ্য করে। কিছু সংস্কৃতিতে, এমনকি প্রায়ই মিডিয়াতেও এমন কিছু উপাদান কাজ করে, যা নকল পুরুষত্বের প্রচার করে; পুরুষকে নারীর ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য উস্কানি দেয়। সেখানে যেসব পুরুষ খুব বেশি যৌন মিলন করে না অথবা করতে পারে না, তাদের তাচ্ছিল্য করা হয়।
কেউ অস্বীকার করতে পারবে না– ধর্ষিত হওয়া সবচেয়ে কষ্টকর, ভয়াবহ এবং অবমাননাকর অভিজ্ঞতাগুলোর মধ্যে একটি। এটি প্রায় সবসময়ই ভুক্তভোগীর মনে আত্ম-ঘৃণা, আত্ম-দোষ এবং ক্রোধের অনুভূতি জাগায় এবং এটি ট্রমা-পরবর্তী স্ট্রেস ডিজঅর্ডার (পিটিএসডি) সৃষ্টি করে।

মূলত দুই ধরনের ধর্ষকের দেখা মেলে এই সমাজে। সুযোগসন্ধানী ধর্ষক, যারা যৌন তৃপ্তির জন্য যে কোনো সুযোগকে কাজে লাগায়, যেমন মদ্যপানের সময় আত্মনিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলা। আরেক ধরনের ধর্ষক আছে, যার উদ্দেশ্য হলো ভুক্তভোগীদের অপমান ও হেয় করা।
প্রতিহিংসাপরায়ণ ধর্ষকের রাগ ও আগ্রাসন সরাসরি নারীর প্রতি থাকে। এ ধরনের ধর্ষক বিশ্বাস করে, তাকে নারীর ওপর যৌন আক্রমণ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। কারণ সে মনে করে, অতীতে নারীরা তাকে আঘাত, প্রত্যাখ্যান বা অন্যায় করেছে।
যৌন নির্যাতন একটি অমার্জনীয় সহিংসতা এবং একটি ফৌজদারি অপরাধ। দুর্ভাগ্যবশত, সমাজের কলঙ্ক এবং দোষ এড়াতে অনেক ভুক্তভোগী নীরব থাকে। পক্ষান্তরে তাদের ধর্ষকরা অন্য ভুক্তভোগীকে খুঁজতে থাকে স্বাধীনভাবে।

বাংলাদেশে ধর্ষণ-সংক্রান্ত মামলার বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘ ও জটিল। ফলে ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হন। এ ছাড়াও অধিকাংশ ক্ষেত্রে অপরাধীদের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব থাকার কারণে তারা শাস্তি এড়াতে সক্ষম হয়। বিচারহীনতার এই সংস্কৃতি অপরাধীদের উৎসাহিত করে এবং সমাজে একটি বার্তা পাঠায়– ধর্ষণ করেও পার পাওয়া সম্ভব। তাই ধর্ষণের বিচার প্রক্রিয়া আরও দ্রুত ও কার্যকর করতে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন; পুলিশ ও বিচার বিভাগের সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং ভুক্তভোগীদের জন্য নিরাপদ আইনি সহায়তা নিশ্চিত করা জরুরি।
ধর্ষণ প্রতিরোধে কাঠামোগত পরিবর্তন সময়সাপেক্ষ, তবে এটি ছাড়া কোনো দীর্ঘমেয়াদি সমাধান সম্ভব নয়। বাংলাদেশে ধর্ষণ প্রতিরোধে শুধু আইনি ব্যবস্থা বা শাস্তির বিধান যথেষ্ট নয়। বরং সামাজিক মানসিকতা, শিক্ষা ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক নীতি, গণমাধ্যমের ভূমিকা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার সমন্বিত পরিবর্তন প্রয়োজন। নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল সমাজ গড়ে তুলতে হলে শুধু ধর্ষকদের শাস্তি দিলেই হবে না, বরং ধর্ষণের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ার পথগুলোও চিরতরে বন্ধ করতে হবে। এটাই ধর্ষণ প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর ও স্থায়ী উপায়।
পুরুষের সচেতনতা ও সম্পৃক্ততা ছাড়া ধর্ষণ প্রতিরোধ সম্ভব নয়। তাদের মধ্যে যদি ছোটবেলা থেকেই নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার শিক্ষা দেওয়া হয় এবং তাদের বোঝানো হয়– নারীর সম্মতি ছাড়া কোনো সম্পর্ক গ্রহণযোগ্য নয়, তাহলে সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে পারে। ‘মাচো সংস্কৃতি’ বা পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যবাদকে চ্যালেঞ্জ এবং পুরুষদের এ বিষয়ে শিক্ষিত করা ধর্ষণ প্রতিরোধের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হতে পারে।

সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকাও ধর্ষণ প্রতিরোধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে মসজিদ, মন্দির ও অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সমাজে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বিনির্মাণে বিশাল প্রভাব ফেলে। যদি এসব প্রতিষ্ঠান নারীর মর্যাদা, লিঙ্গ সমতা ও ধর্ষণবিরোধী বার্তা প্রচার করতে সক্রিয় ভূমিকা নেয়, তবে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে পারে।

রাজু আলীম: কবি, সাংবাদিক ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র জন য অপর ধ

এছাড়াও পড়ুন:

জাতীয় কবিতা পরিষদের কার্যনির্বাহী কমিটির সভা

জাতীয় কবিতা পরিষদের কার্যনির্বাহী কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। মঙ্গলবার বিকেল ৪টায় রাজধানীর সাওল হার্ট সেন্টারের কাজল মিলনায়তনে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন জাতীয় কবিতা পরিষদের সভাপতি কবি মোহন রায়হান। তিনি বলেন, জাতীয় কবিতা পরিষদ এরশাদবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করে। বর্তমানেও কবিতা পরিষদ তার আন্দোলন, সংগ্রামের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে। কবিতা চর্চার পাশাপাশি জাতীয় ও সামাজিক বিভিন্ন ইস্যুতে আমরা প্রতিবাদ ও আন্দোলন সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছি। ভবিষ্যতেও রাখব।  

সভায় আগামীতে কবিতা পরিষদের কার্যক্রম কীভাবে পরিচালিত হবে, নতুন কাব্য আন্দোলন গড়ে তুলতে, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাষ্ট্রিক পরিবর্তনে জাতীয় কবিতা পরিষদ কী ভূমিকা পালন করবে সেসব বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্যরা।  
 
আলোচনায় অংশ নেন জাতীয় কবিতা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রেজাউদ্দিন স্টালিন, সহ-সভাপতি শহীদুল্লাহ ফরায়েজী, সহ-সভাপতি এবিএম সোহেল রশীদ, সহ-সভাপতি মানব সুরত, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সম্পাদক শাহীন রেজা, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শ্যামল জাকারিয়া, সাংগঠনিক সম্পাদক নুরুন্নবী সোহেল, আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক সম্পাদক মাসুদ করিম, অর্থ সম্পাদক ক্যামেলিয়া আহমেদ, প্রকাশনা সম্পাদক শওকত হোসেন, সেমিনার সম্পাদক মঞ্জুর রহমান, পরিবেশ ও প্রকৃতিবিষয়ক সম্পাদক মিতা অলী, দপ্তর সম্পাদক রোকন জহুর প্রমুখ।  

সভায় উপস্থিত ছিলেন- প্রচার সম্পাদক আসাদ কাজল, জনসংযোগ সম্পাদক রফিক হাসান, শান্তি ও শৃঙ্খলা সম্পাদক ইউসুফ রেজা, সদস্য জমিল জাহাঙ্গীর, সদস্য আবীর বাঙালী প্রমুখ।  

আলোচনা শেষে ইফতার পর্বের মধ্য দিয়ে সভার সমাপ্তি ঘোষণা করেন জাতীয় কবিতা পরিষদের সভাপতি কবি মোহন রায়হান।

সম্পর্কিত নিবন্ধ