দেশে স্বৈরশাসন উত্থানের জন্য কি শুধু সংবিধান দায়ী
Published: 18th, March 2025 GMT
বাংলাদেশে বারবার কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের উত্থানের কারণ অনুসন্ধান এবং তার একটি বস্তুনিষ্ঠ পর্যালোচনা খুবই দরকার। রোগ যথাযথভাবে নিরূপিত না হলে রোগের চিকিৎসাও যথাযথ হয় না।
গত বছরের ৫ আগস্টের গণ–অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারী সরকার পতনের পর ছাত্রনেতৃত্ব সংবিধান পুনর্লিখনসহ যেভাবে দাবিদাওয়া উপস্থাপন করছে, তাতে কর্তৃত্ববাদ উত্থানের সব দায় বিদ্যমান সংবিধানের ওপর চাপানো হচ্ছে। নতুন বাংলাদেশ নির্মাণের জন্য গণপরিষদ গঠনের মাধ্যমে নতুন সংবিধান প্রণয়নসহ দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র ঘোষণার দাবিতে তারা খুব সোচ্চার।
১৯৭১ সালে এক সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনার প্রতিফলনসহ গণতন্ত্রকে অন্যতম মূলনীতি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার মাধ্যমে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান রচিত হয়।
সংবিধানের প্রস্তাবনা ও মূলনীতিতে গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের প্রাধান্য এবং পুরো সাংবিধানিক কাঠামো গণতান্ত্রিক হলেও বারবার এখানে স্বৈরতন্ত্র ও কর্তৃত্ববাদী শাসন মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। শাসকগোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থে বিভিন্ন সময় সংবিধানে নানা সংশোধন এনেছে যা সংবিধানের মূল চরিত্রকে বিকৃত করেছে এবং নানান বিতর্ক তৈরি করেছে।
এরপরও যে বিষয় খতিয়ে দেখা দরকার তা হলো, বারবার কর্তৃত্ববাদী শাসন প্রত্যাবর্তনের দায় কি বর্তমান সংবিধানের নাকি এর বীজ লুকিয়ে রয়েছে অন্য কোথাও? এর জন্য প্রথমেই প্রয়োজন আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির দিকে বিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টি ফেলা। রাজনীতির প্রাণভোমরা হলো রাজনৈতিক দল। সমাজ ও রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক রাজনীতি ও গণতান্ত্রিক চেতনা বিকাশের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন দলে গণতন্ত্রের চর্চা। দলে গণতন্ত্রের চর্চা না থাকলে সমাজ ও রাষ্ট্রে তার প্রতিফলন অবশ্যই ঘটবে।
আমাদের দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো স্বাধীনতার পর কয়েক যুগ ধরে অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পরিচালিত হয়ে আসছে। অগণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্রের মাধ্যমে ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতি ও নেতৃত্বের বংশানুক্রমিক ধারা চলছে দীর্ঘ সময় ধরে। ফলে আদর্শের জায়গা দখল করে নিয়েছে ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি। টাকা ও পেশিশক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজনীতির নিয়ামক শক্তি। নেতা নির্বাচনের বিষয়টি হয়েছে ব্যক্তির ইচ্ছা ও পছন্দনির্ভর। ফলে চাটুকারিতা, তোষামোদি, অন্ধ আনুগত্য ও দুর্নীতি দলগুলোর রাজনৈতিক কার্যক্রমের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনীতি হয়েছে টাকা উপার্জনের লাভজনক পেশা।
এ ছাড়া নির্বাচন টাকার খেলায় পরিণত হওয়ায় নিবেদিতপ্রাণ রাজনীতিবিদেরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। এসব কারণে চিরকালীন ক্ষমতার নেশা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে এমনভাবে পেয়ে বসে যে ক্ষমতায় থাকার জন্য নির্বাচনসহ রাষ্ট্রীয় সব প্রতিষ্ঠানকে অনৈতিকভাবে ব্যবহার করে এসব প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল ও অকার্যকর করা হয়েছে। যখন যে দলই ক্ষমতায় এসেছে, তারা নিজেদের স্বার্থে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করেছে, তাদের ঠিকভাবে কাজ করতে দেওয়া হয়নি। প্রশাসন, বিচার বিভাগ থেকে আরম্ভ করে সর্বত্র এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে যে প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেনি।
আরও পড়ুনহাসিনার পতন হলেও স্বৈরাচারী শাসনের যেসব খুঁটি এখনো অক্ষুণ্ন১০ আগস্ট ২০২৪অন্যদিকে দেখা গেছে, যখন কেয়ারটেকার সরকার স্বল্পকালের জন্য এসেছে, তখন সব প্রতিষ্ঠান নির্ভয়ে নিজ নিজ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছে। সুষ্ঠুভাবে নির্বাচনও করেছে। সুতরাং রাজনৈতিক সংস্কৃতির গণতন্ত্রায়ণ ও পরিশুদ্ধকরণ ছাড়া শুধু কাঠামোগত সংস্কারে সুষ্ঠু গণতন্ত্রের চর্চা বা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা কখনো সম্ভব নয়। এ দেশে সামরিক শাসন, স্বৈরতান্ত্রিক শাসনসহ নানা কারণে গণতন্ত্রের চর্চা ব্যাহত হয়েছে। ফলে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের যেমন বিকাশ ঘটেনি, তেমনি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোও শক্তিশালী হতে পারেনি।
অথচ দলগুলোর মধ্যে গণতন্ত্রহীনতা, ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির চর্চা, টাকা ও পেশির দৌরাত্ম্য—সব মিলিয়ে রাজনীতিতে যে অগণতান্ত্রিক ও অবক্ষয়ের রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, তার সংস্কারের কোনো অর্থবহ ব্যবস্থা না নিয়ে শুধু সংবিধানকে ফ্যাসিবাদী বলে ছুড়ে ফেলে নতুন সংবিধান রচনার কথা একধরনের অপরিপক্ব ও অবাস্তব চিন্তা ছাড়া আর কিছু নয়।
রাজনীতিতে ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা ও পারিবারিক রাজনীতির চর্চা বহাল রেখে বর্তমানের দুর্বৃত্তায়ন বন্ধ করা একেবারেই অসম্ভব। দলের মধ্যে পরিশীলিত রাজনীতি, গণতন্ত্রের চর্চা ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার জন্য একটি ‘পলিটিক্যাল পার্টি আইন’ করে ব্যাপক সংস্কারমূলক ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। অথবা নির্বাচন কমিশন আইনে সংশোধন এনে কাউন্সিলের মাধ্যমে নেতা নির্বাচনসহ নিবন্ধনসংক্রান্ত কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা দরকার। একই ব্যক্তি যাতে সরকারপ্রধান ও দলের প্রধান না হতে পারেন, সে-সংক্রান্ত আইন করা দরকার।
বাংলাদেশে স্বৈরশাসন বা কর্তৃত্ববাদী শাসনের উত্থানের জন্য শুধু সংবিধানকে দোষারোপ করার একদেশদর্শী মনোভাব থেকে বেরিয়ে এসে অপশাসনের পেছনের কারণ যথাযথ বিশ্লেষণের মাধ্যমে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির দায়কে চিহ্নিত করতে হবে। কারণ, সংবিধানের কোথাও একদলীয় নির্বাচনের কথা বলা হয়নি। নির্বাচন কমিশন আইনেও নেই। শুধু সব প্রতিষ্ঠানে দলীয় নিয়ন্ত্রণ বহাল করার মাধ্যমে ক্ষমতার অপব্যবহার করে দলীয় সরকার এটা করেছে। একমাত্র নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল ছাড়া সব সময় এটা হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো এটা করে দলে ও সামগ্রিক রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশ না হওয়ার কারণে।বাংলাদেশের রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নের কারণ রাজনৈতিক সংস্কৃতির মধ্যে না খুঁজে শুধু সংবিধানকে দোষারোপ করে রাজনীতির প্রকৃত সংস্কার কখনো হবে না। ১৯৭২ সালের মূল সংবিধান একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এই সংবিধান প্রণীত। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা একটি বহুমাত্রিক চেতনা। ৯০ ও ২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের চেতনার আধার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।
কারণ, ৯০-এর গণতন্ত্র ও ২৪-এর বৈষম্যবিরোধী চেতনা মুক্তিযুদ্ধের চেতনারই অংশ। এ চেতনার বাস্তবায়ন না হওয়ায় মূলত জাতি তথা ছাত্র-জনতা ফুঁসে উঠেছে এবং গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে। সুতরাং, অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জাগ্রত গণ-আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য অবশ্যই সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে কিছু সংস্কার করতে হবে। সে ব্যাপারে ইতিমধ্যে প্রক্রিয়া চলমান।
বিভিন্ন সংশোধনীর কারণে বর্তমানে সংবিধানে নানান সীমাবদ্ধতা ও দোষত্রুটি থাকা সত্ত্বেও আমি মনে করি সংবিধানের কাঠামো গণতান্ত্রিক। এ ছাড়া সময়ের চাহিদা অনুযায়ী সংবিধান হালনাগাদ করা ও জনস্বার্থে সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন হয়। যেমন ৭০ অনুচ্ছেদের বিলুপ্তি, দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী না হওয়া, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পুনঃপ্রবর্তন, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা সীমিতকরণের জন্য একই ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী ও দলের প্রধান না হওয়ার সাংবিধানিক বিধান ইত্যাদি। এ ছাড়া সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে সন্নিবেশিত জনস্বার্থবিরোধী অনুচ্ছেদগুলো বাতিল করা—সেটা অবশ্যই করতে হবে।
এ জন্য সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে। তারা সুপারিশও প্রদান করেছে। ঐকমত্য ও যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে পরবর্তী সংসদ এটা বাস্তবায়ন করবে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সংবিধান-বিশারদ ড.
বাংলাদেশে স্বৈরশাসন বা কর্তৃত্ববাদী শাসনের উত্থানের জন্য শুধু সংবিধানকে দোষারোপ করার একদেশদর্শী মনোভাব থেকে বেরিয়ে এসে অপশাসনের পেছনের কারণ যথাযথ বিশ্লেষণের মাধ্যমে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির দায়কে চিহ্নিত করতে হবে। কারণ, সংবিধানের কোথাও একদলীয় নির্বাচনের কথা বলা হয়নি। নির্বাচন কমিশন আইনেও নেই। শুধু সব প্রতিষ্ঠানে দলীয় নিয়ন্ত্রণ বহাল করার মাধ্যমে ক্ষমতার অপব্যবহার করে দলীয় সরকার এটা করেছে। একমাত্র নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল ছাড়া সব সময় এটা হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো এটা করে দলে ও সামগ্রিক রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশ না হওয়ার কারণে।
সংবিধানে নেতা নির্বাচন, সরকার গঠনবিষয়ক সব বিধানই গণতান্ত্রিক। শুধু ৭০ অনুচ্ছেদ ছাড়া নির্বাহী, আইন ও বিচার বিভাগসংক্রান্ত বিধানগুলো গণতান্ত্রিক বিধিবিধানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। তবে বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য বিচার বিভাগের সচিবালয় অবশ্যই সুপ্রিম কোর্টের অধীনে দিতে হবে।
সুতরাং রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন বা স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের পুনরাবৃত্তি যাতে না হয়, সে জন্য ইতিবাচক রাজনৈতিক সংস্কৃতির ধারা শুরু করতে হবে। পাশাপাশি কাঠামোগত সংস্কারও প্রয়োজন। তবে সুষ্ঠু রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও দলে গণতন্ত্রচর্চার সংস্কৃতি না গড়ে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা কখনো সম্ভব নয়। গণতন্ত্রের অবিরাম চর্চার মধ্য দিয়েই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে ওঠে এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বিকশিত হয়। প্রতিষ্ঠানগুলোও কার্যকর ও শক্তিশালী হয়। সেটাই নিশ্চিত করা দরকার।
হাসান চৌধুরী প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক, সাবেক সরকারি কর্মকর্তা
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: গণত ন ত র ক স স ক ত র র জন ত ক স স ক ত র জন ত ক স স ক ত র ব যবহ র কর র জন ত ক দ র ক র জন ত র জন ত র র জন ত ত ক সরক র র প কর দল য় ন আম দ র ণ র জন র জন য ন র জন ক ষমত দরক র দলগ ল
এছাড়াও পড়ুন:
দলগুলোর নানা মত গুতেরেস চান ঐক্য
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের সঙ্গে বৈঠকে সংস্কার এবং নির্বাচন নিয়ে দলীয় অবস্থান তুলে ধরেছে রাজনৈতিক দলগুলো। সংস্কার দ্রুত সম্পন্ন করে নির্বাচন আয়োজনের পক্ষে মত দিয়েছে বিএনপি। জামায়াতে ইসলামী জানিয়েছে, টেকসই গণতন্ত্র এবং সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। এনসিপির চাওয়া গণপরিষদের সংবিধান সংস্কার। সংস্কার কমিশনগুলো বৈঠকে সংস্কারের সারসংক্ষেপ তুলে ধরে। জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, ‘সংস্কার প্রয়োজনীয়। জাতিসংঘ এতে পাশে থাকবে।
সংস্কার কীভাবে, কতটুকু হবে, তা জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোকে একমত হয়ে করতে হবে।’ পর্তুগালের উদাহরণ দিয়ে তিনি আশাবাদ জানিয়েছেন, জনগণ এবং রাজনৈতিক দলগুলো মিলে এই পথ পাড়ি দিতে পারবে।
গতকাল শনিবার রাজধানীর ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে জাতিসংঘের ঢাকা কার্যালয়ের আয়োজনে বৈশ্বিক সংস্থাটির মহাসচিবের সঙ্গে বৈঠকে সাতটি দল অংশ নেয়। রাজনৈতিক নেতারাও বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সামনে নিজ নিজ দলের অবস্থান তুলে ধরেন।
বৈঠকে ছিলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ; জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের, সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার; নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, সিপিবি সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, এবি পার্টির সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান আসাদ, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ও জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন।
অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল ও তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলমও ছিলেন। বৈঠকে সরকারের সংস্কার পরিকল্পনা এবং চলমান কার্যক্রম জাতিসংঘ মহাসচিবের বৈঠকে তুলে ধরা হয়। ছিলেন সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ, দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশনের প্রধান ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার, পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান সফর রাজ হোসেন ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী। সংস্কারের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য তৈরিতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন কমিশন সমন্বয়কারী তথা সরকারপ্রধানের বিশেষ সহকারী মনির হায়দারও ছিলেন বৈঠকে।
মনির হায়দার সমকালকে জানিয়েছেন, জাতিসংঘ মহাসচিব বলেছেন, ‘গণতান্ত্রিক উত্তরণে ক্ষমতার ভারসাম্য থাকা জরুরি। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে সক্ষম করতে হবে। নির্বাহী এবং বিচার বিভাগের সত্যিকারের পৃথক্করণ জরুরি।’
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসনের পতন ঘটে। এই স্বৈরশাসক ভারতে পালিয়ে গেছেন। ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেওয়া পর গণঅভ্যুত্থানে চালানো হত্যাযজ্ঞ জাতিসংঘকে তদন্তের আহ্বান জানায় ইউনূস সরকার। জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধান অনুযায়ী, অভ্যুত্থান দমনে গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে শেখ হাসিনা সরকার। সহযোগীর ভূমিকায় ছিল আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গসংগঠনগুলো। শেখ হাসিনা মানবতাবিরোধী অপরাধের মূল হোতা।
অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র সংস্কারে ১৫টি কমিশন গঠন করেছে। ছয়টি কমিশনের দেওয়া সংস্কারের সুপারিশ নিয়ে সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনা শুরু করেছে। অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া সব দল সংস্কারকে সমর্থন করলেও পদ্ধতি এবং সময়সীমা নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে।
দ্রুত নির্বাচন চাইল বিএনপি
বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের মির্জা ফখরুল বলেন, ‘জাতিসংঘের উদ্যোগে গোলটেবিল আলোচনা আয়োজন করা হয়েছিল। এতে কমিশনপ্রধানরা ছিলেন। সংস্কারের যেসব বিষয় সম্পর্কে আলোচনা হচ্ছে, তা জাতিসংঘ মহাসচিবকে জানানো হয়েছে।’
বিএনপি কী বলেছে– প্রশ্নে দলটির মহাসচিব বলেছেন, ‘আমরা এতদিন যে কথা বলে আসছি, তাই বলেছি। সংস্কার অবশ্যই করতে হবে। সংস্কারের কথা বিএনপিই আগে বলেছে। নির্বাচনকেন্দ্রিক যেসব বিষয় আছে, সেসব সংস্কার করে দ্রুত নির্বাচন করা এবং সংসদের মাধ্যমে বাকি বিষয়গুলো করতে হবে। আর সংস্কার চলমান প্রক্রিয়া। সেই বিষয়গুলো বলে এসেছি।’
জাতিসংঘের মহাসচিব কিছু বলেছেন কিনা– প্রশ্নে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।’
নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে কথা হয়েছে কিনা– প্রশ্নে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আমরা সংস্কার কমিশনের সঙ্গে কথা বলছি। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে। তারা যা চাচ্ছে, সব তাদের দিয়েছি। এরই মধ্যে একটি বৈঠক হয়েছে। জাতিসংঘের মহাসচিবকে কেন সময়সীমা দিতে যাব?’
বৈঠকে সংস্কার কমিশনগুলোর প্রধানরা নিজ নিজ কমিশনের সংস্কারের সারসংক্ষেপ তুলে ধরেন এবং রাজনৈতিক দলগুলো দলীয় অবস্থান তুলে ধরেছে জানিয়ে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, জাতিসংঘ বলেছে, সংস্কার ও নির্বাচন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। কী সংস্কার হবে, তা বাংলাদেশই ঠিক করবে। জাতিসংঘ মহাসচিব বাংলাদেশে শক্তিশালী গণতান্ত্রিক সরকার আসবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন। তিনি আশা করছেন, বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন পৃথিবীর মধ্যে নজির সৃষ্টি করবে।
সুষ্ঠু নির্বাচন, টেকসই গণতন্ত্র ও জাতীয় ঐক্য চায় জামায়াত
ডা. তাহের বলেন, জামায়াত সংস্কারের কথা বলেছে জাতিসংঘ মহাসচিবকে। একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে বলেছি। টেকসই গণতন্ত্র ও জাতীয় ঐক্যের বিষয়ে কথা বলেছি। জাতিসংঘের মহাসচিব জামায়াতের অধিকাংশ বক্তব্য সমর্থন করেছেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশকে সহযোগিতা করবেন। গুতেরেস সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে আশাবাদ জানিয়েছেন।
গণপরিষদে সংবিধান সংস্কার চায় এনসিপি
নাহিদ ইসলাম বলেন, জুলাই গণহত্যার বিচার এবং রাষ্ট্র সংস্কার অভ্যুত্থানের অঙ্গীকার। অন্তর্বর্তী সরকারেরও এ বিষয়ে জনগণের আছে অঙ্গীকার রয়েছে। মৌলিক সংস্কারের ভিত্তি এই সরকারের সময়ে তৈরি করতে হবে। সব রাজনৈতিক দলকে ঐকমত্য পোষণ করতে হবে, যা হবে জুলাই সনদ। এতে সবাইকে সই করতে হবে।
নাহিদ বলেন, ‘এনসিপির অবস্থান হলো, গণপরিষদের মাধ্যমেই সংবিধান সংস্কার করতে হবে। সংসদের মাধ্যমে হলে সংস্কার টেকসই হবে না। দলীয় অবস্থান থেকে আমাদের কথা বলেছি। জাতিসংঘ মহাসচিব বলেছেন, বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলো যাতে নিজেরাই সমঝোতায়, ঐকমত্যে আসে। গণতন্ত্রের যে মূল ধারণা, তা মাথায় রেখে যাতে একসঙ্গে কাজ করি। তিনি এ প্রত্যাশা করেছেন।’
নির্বাচন সম্পর্কে নাহিদ বলেন, ‘সংস্কারবিহীন নির্বাচন কাজে দেবে না। অন্যান্য রাজনৈতিক দলও এতে একমত। মতপার্থক্যগুলো হচ্ছে, কোন সংস্কার কখন হবে, নির্বাচনের আগে কতটুকু হবে, নির্বাচনের পরে কতটুকু হবে। জুলাই সনদের মাধ্যমে সংস্কার হলে মতপার্থক্য দূর হবে, ঐকমত্যে আসতে পারব।’
জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে জুলাই গণহত্যার বিচার নিশ্চিতে জাতিসংঘের সহায়তা চাওয়া হয়েছে। এ ছাড়া সংস্কার ও নির্বাচনের বিষয়ে ঐকমত্য নিয়ে গণসংহতির অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে।’
এবি পার্টির সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান ফুয়াদ বলেন, ‘গণহত্যা নিয়ে জাতিসংঘের প্রতিবেদন দেওয়া সুপারিশ বাস্তবায়নে সংস্থাটির সাহায্য প্রয়োজন। এখনও জাতিসংঘের তিনটি প্রতিষ্ঠানে শেখ হাসিনার আত্মীয়রা কাজ করছেন। এগুলো জানানো হয়েছে মহাসচিবকে।’
জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক গোয়েন লুইস, ইউএনএইচসিআরের আবাসিক প্রতিনিধি সুম্বুল রিজভী, আইএলওর কান্ট্রি ডিরেক্টর টুমো পুটিআইনেন, ডব্লিউএফপির আবাসিক প্রতিনিধি ডমিনিকো স্কেলপেনি, ইউএনডিপির আবাসিক প্রতিনিধি স্টেফান লিলার, ডব্লিউএইচওর আবাসিক প্রতিনিধি বর্ধন জং রানা, ইউএনওপিএসের আবাসিক প্রতিনিধি সুধীর মুরালিধরন, আইওএমের মিশন প্রধান ল্যানস বনেউ প্রমুখ বৈঠকে ছিলেন।