শ্রমিকনেতাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক মামলার অধিকাংশই বাতিল, সত্য কতটুকু
Published: 18th, March 2025 GMT
শ্রমিক ও ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে দায়ের হওয়া মামলাগুলোর অধিকাংশই বাতিল করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। শ্রমিক, মালিক ও সরকারের সমন্বয়ে গঠিত ত্রিপক্ষীয় কমিটিগুলোতে প্রকৃত শ্রমিক ও মালিকদের থাকাও এ সরকার নিশ্চিত করেছে।
সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ৩৫৩তম গভর্নিং বডির অধিবেশনে শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন এ কথা বলেছেন বলে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় আজ মঙ্গলবার এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে।
বাংলাদেশের শ্রম খাতের উন্নয়ন নিয়ে ওই অধিবেশনে বক্তব্য দেন শ্রম উপদেষ্টা। এ সময় বাংলাদেশের শ্রম খাতে সাধিত অগ্রগতির প্রতিবেদন তুলে ধরেন তিনি। বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের সদস্য প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন।
আইএলওর গভর্নিং বডির বৈঠকে যোগ দিতে শ্রম উপদেষ্টার নেতৃত্বাধীন দল ঢাকা ছাড়ে ৯ মার্চ। ১০ মার্চ শুরু হয়ে এ বৈঠক চলবে ২০ মার্চ পর্যন্ত। লুৎফে সিদ্দিকী ছাড়াও দলের অন্য সদস্যরা হচ্ছেন শ্রমসচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো.
মামলা বাতিলের বিষয় নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার ফেডারেশনের (বিজিআইডব্লিউএফ) সভাপতি ও নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সদস্য কল্পনা আক্তার আজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘৭ থেকে ৮টি মামলা প্রত্যাহার হয়েছে। আমরা ৩৪ জনের বিরুদ্ধে হওয়া রাজনৈতিক মামলার তথ্য দিয়ে তিনবার সরকারকে লিখেছি; কিন্তু কাজ হয়নি। অনেক রাজনৈতিক মামলা নির্বাহী আদেশে প্রত্যাহার হলেও শ্রমিক ও শ্রমিকনেতাদের বিরুদ্ধে হওয়া মামলাগুলো রয়েই গেছে।’
আইএলও গভর্নিং বডির অধিবেশনে শ্রম উপদেষ্টা যে বললেন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে দায়ের হওয়া মামলাগুলোর অধিকাংশই বাতিল হয়েছে—এ বিষয়ে জানতে চাইলে কল্পনা আক্তার বলেন, হয়তো তাঁর জানা নেই অথবা তিনি পুরো সত্য তুলে ধরেননি।
গত বছরের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত গভর্নিং বডির বৈঠকে আগের প্রতিবেদন তুলেছিলেন তখনকার শ্রম উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া। দেশে ফিরে এসে অভিজ্ঞতা তুলে ধরে গত বছরের ১০ নভেম্বর আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, আগের সরকারের আইনমন্ত্রীর (আনিসুল হক) নেতৃত্বাধীন দলকে আইএলও পর্ষদে অপদস্থ করা হয়েছিল। অথচ এবারের চিত্র ভিন্ন। বাংলাদেশের পদক্ষেপগুলো নিয়ে বরং প্রশংসাই পাওয়া গেছে। কয়েকটা দেশ বাংলাদেশের বিরুদ্ধে হওয়া মামলা তুলে নেওয়ার কথাও বলেছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এবারের অধিবেশনে ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার সম্প্রসারণ, অন্যায্য শ্রম আচরণ ও ইউনিয়নবিরোধী বৈষম্যের শাস্তি তিন গুণ বৃদ্ধি, শিশুশ্রমের শাস্তি পাঁচ গুণ বৃদ্ধি, জবরদস্তিমূলক শ্রম নিষিদ্ধকরণ, কর্মক্ষেত্রে নারীর প্রতি বৈষম্য, লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য ও সহিংসতা এবং জবরদস্তিমূলক শ্রমের শাস্তি নির্ধারণ, শ্রমিকদের কালো তালিকাভুক্তকরণ নিষিদ্ধ ও এর শাস্তির বিধান সংযোজন করে বিদ্যমান শ্রম আইন সংশোধন করা হচ্ছে বলে জানানো হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আইএলওর গভর্নিং বডির অধিবেশনে শ্রম উপদেষ্টা বলেছেন, রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলগুলোর (ইপিজেড) জন্য শ্রম আইন সংশোধনে অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা চলমান। বিদ্যমান ইপিজেড শ্রম আইন ও সংশোধিত শ্রম আইনের মধ্যে ফারাক বিশ্লেষণ করে সরকার এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবে।
প্রতিবেদন নিয়ে অনুষ্ঠিত আলোচনায় অংশ নিয়ে এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশের উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রতিনিধিরা শ্রম অধিকার উন্নয়ন ও শোভন কর্মপরিবেশ নিশ্চিতকল্পে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপগুলোর প্রশংসা করেন বলে বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়।
আরও বলা হয়, চলতি অধিবেশনে গভর্নিং বডির কোনো সদস্য বাংলাদেশের বিরুদ্ধে থাকা অভিযোগ তদন্তের দাবি জানায়নি। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে চলমান মামলার বিষয়ে শুনানিও পিছিয়েছে। চলতি বছরের নভেম্বরের বদলে এ শুনানি হবে ২০২৬ সালের মার্চে। অধিবেশনের পর শ্রম উপদেষ্টা আইএলও সেক্রেটারি জেনারেল গিলবার্ট হুংবোর সঙ্গে একান্ত বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে শ্রম উপদেষ্টা তাঁকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র জন ত ক সদস য গভর ন সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
বৈশাখের মালিকানা যেন ফিরেছে জনগণের কাছে
বাংলা বছরের প্রথম দিন, পয়লা বৈশাখ, কেবল একটি দিন নয়—এটি একটি জাতিসত্তার প্রকাশ, বাঙালির আত্মপরিচয়ের এক অমোঘ নিদর্শন। বহু শতাব্দী ধরে এই উৎসব বাঙালির জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। কালের বিবর্তনে, নানা রাজনৈতিক সংকট আর সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মধ্য দিয়ে এই উৎসবও কখনো সংকুচিত হয়েছে, কখনো হয়ে উঠেছে নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর প্রতীক। যেন তা আটকে ছিল কিছু নির্দিষ্ট বলয়ে, একটি দল বা ঘরানার নিজস্ব আয়োজন হিসেবে। এবারের বৈশাখ সেই নীরব অবরোধ ভেঙে দিয়েছে।
মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ, জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে উৎসবে মেতে ওঠা এবং শহরের সীমানা পেরিয়ে গ্রাম পর্যন্ত এর ছোঁয়া—সব মিলিয়ে ১৪৩২ বঙ্গাব্দের প্রথম দিনটি যেন ছিল এক সাংস্কৃতিক জাগরণের সূচনা।
বৈশাখের ইতিহাস ঘেঁটে দেখলে বোঝা যায়, এই উৎসব কখনোই কোনো একক গোষ্ঠীর সম্পত্তি ছিল না। মোগল সম্রাট আকবর কৃষিব্যবস্থাকে সংগঠিত করতে বাংলা সন প্রবর্তন করেছিলেন, যার মাধ্যমে রাজস্ব আদায় সহজ হতো। কিন্তু সময়ের সঙ্গে এই হিসাবের বর্ষপঞ্জি পরিণত হয় উৎসবে। পরিণত হয় বাঙালির মাটির সঙ্গে মিশে থাকা সংস্কৃতির এক অপরিহার্য অংশে।
গ্রামীণ বাংলার বৈশাখ তাই ছিল বটতলার মেলা, হালখাতা, ঢাকঢোল, নাচ-গান, আর লাল-সাদা শাড়ি-পাঞ্জাবির আনন্দ। মানুষের মুখে মুখে থাকা পল্লিগীতি, মুরব্বিদের মুখে নতুন বছরের শুভেচ্ছা, আর বাচ্চাদের হাতে বাতাসা-মুড়ির ঠোঙা—এসব ছিল এই উৎসবের বাস্তব রূপ।
এটি কখনোই শহরের চারুকলা বা ছায়ানটের একক সত্তা ছিল না। তবে শহরকেন্দ্রিক আধুনিকতার ছোঁয়ায়, বৈশাখ ধীরে ধীরে একটি নির্দিষ্ট শ্রেণি ও রাজনৈতিক বলয়ের দখলে চলে যেতে থাকে। বিশেষ করে সামরিক শাসনের পরবর্তী সময়ে, যখন জাতীয়তাবাদী চেতনার বিপরীতে দাঁড় করানো হলো বাঙালি সংস্কৃতিকে, তখন আওয়ামী লীগ এবং সংশ্লিষ্ট সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো বৈশাখকে তাদের পরিচয় নির্মাণের হাতিয়ার করে তোলে। চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা, ছায়ানটের রমনা বটমূলে গান—এসব হয়ে ওঠে বৈশাখের মূল চিত্র। অথচ এতে গ্রামীণ মানুষের উপস্থিতি ছিল না, ছিল না পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠী, সাঁওতাল, রাজবংশী, চাকমা কিংবা মারমাদের সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব।
বৈশাখ যদি বাঙালির হয়, তবে তাকে হতে হবে সর্বজনীন। তাতে থাকতে হবে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান; শহরের উচ্চবিত্ত, গ্রামের কৃষক, আদিবাসী গোষ্ঠী এবং প্রান্তিক মানুষের সমান অংশগ্রহণ। সংস্কৃতি কখনোই সংখ্যালঘু গোষ্ঠী বা সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের অনুগত নয়, বরং এটি জনমানুষের আত্মা, যা কেবল তখনই সত্যিকারভাবে প্রসারিত হয়, যখন সেটি সবার জন্য উন্মুক্ত থাকে।এই একচেটিয়া সংস্কৃতিচর্চা একসময় এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছায় যে ধর্মীয় রক্ষণশীলদের একটি বড় অংশ এবং রাজনৈতিকভাবে ভিন্নমতাবলম্বী মানুষদের কাছে পয়লা বৈশাখ হয়ে উঠে বিতর্কিত—যেন এটি একটি ‘লিবারেল’ বা ‘আওয়ামী’ উৎসব। এই মনোভাব সমাজে যে সাংস্কৃতিক বিভাজন তৈরি করেছিল, তা আমাদের জাতিসত্তার বৈচিত্র্যময় রূপকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। কিন্তু এবারের বৈশাখ ছিল এক অন্য রকম অভিজ্ঞতা। শহর আর গ্রাম একসঙ্গে মিশে গেল যেন একসুতোয় বাঁধা উত্সবে। আর এই উৎসব ছিল সবার—কোনো নির্দিষ্ট ঘরানার রাজনৈতিক পরিচয়ে বিশ্বাসীদের নয়, বরং প্রত্যেক সেই মানুষের, যিনি নিজেকে বাঙালি বলে ভাবেন, এমনকি বাঙালি ছাড়া অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মানুষেরও।
এই বছর রাজপথে ছিল ছায়ানটের গান, স্কুলপড়ুয়া বাচ্চাদের নাচ, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী পোশাকে র্যালি এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক অরাজনৈতিক সংগঠনের তত্ত্বাবধানে আয়োজিত লোকজ মেলা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ভিডিওগুলোতে দেখা গেছে, কোথাও গ্রামের স্কুলমাঠে ব্যানারহীন বৈশাখী অনুষ্ঠান, আবার কোথাও পাহাড়ি অঞ্চলে মারমা বা ত্রিপুরা সংস্কৃতির অংশ নিয়ে বৈশাখ উদ্যাপন। এসব আয়োজন প্রমাণ করেছে—মানুষ নিজের উৎসব নিজের মতো করে ফিরিয়ে নিচ্ছে।
এই অংশগ্রহণ শুধু সাংস্কৃতিক নয়, একধরনের রাজনৈতিক প্রতিবাদও বটে। উৎসবের ওপর একচেটিয়া অধিকার প্রত্যাখ্যান করে মানুষ এবার বলেছে—এটি তাদের দিন, তাদের আনন্দ, তাদের পরিচয়। এটা যেন ছিল নিঃশব্দ এক সাংস্কৃতিক অভ্যুত্থান, যেখানে না আছে দলীয় পতাকা, না আছে আদর্শগত হম্বিতম্বি। আছে কেবল ভালোবাসা, শিকড়ের টান আর জাতিসত্তার মৃদু অথচ দৃঢ় ঘোষণা।
বৈশাখ যদি বাঙালির হয়, তবে তাকে হতে হবে সর্বজনীন। তাতে থাকতে হবে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান; শহরের উচ্চবিত্ত, গ্রামের কৃষক, আদিবাসী গোষ্ঠী এবং প্রান্তিক মানুষের সমান অংশগ্রহণ। সংস্কৃতি কখনোই সংখ্যালঘু গোষ্ঠী বা সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের অনুগত নয়, বরং এটি জনমানুষের আত্মা, যা কেবল তখনই সত্যিকারভাবে প্রসারিত হয়, যখন সেটি সবার জন্য উন্মুক্ত থাকে।
সুতরাং এবারের বৈশাখ একটি বার্তা দিয়েছে। বার্তা দিয়েছে যে সাংস্কৃতিক মালিকানা ফিরে যাচ্ছে জনগণের হাতে। এই ধারা যেন অব্যাহত থাকে। বৈশাখ হবে আরও বৈচিত্র্যপূর্ণ, আরও অংশগ্রহণমূলক অর্থাৎ সব ধরনের রুচি, চিন্তা ও সংস্কৃতিকে ধারণক্ষম। এই সমাজচিত্রই হোক আগামীর বাংলাদেশ, যেখানে উৎসব মানে বিভাজন নয়, বরং মিলনের সেতুবন্ধন।
শাহরিয়ার মোহাম্মদ ইয়ামিন যুগ্ম সদস্য সচিব, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়