হত্যার অভিযোগ তুলে কেশবপুরে খ্রিষ্টান মিশনারি ঘেরাও করে বিক্ষোভ
Published: 18th, March 2025 GMT
যশোরের কেশবপুর উপজেলার সাহাপাড়ায় খ্রিষ্টান মিশনারির ছাত্রীনিবাস থেকে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর এক কিশোরীর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধারের ঘটনায় মিশনারি কার্যালয় ঘেরাও করে বিক্ষোভ করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মী-সমর্থকেরা। আজ মঙ্গলবার সকালে ওই কিশোরীকে নির্যাতন করে হত্যার অভিযোগ তুলে তাঁরা ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবি করেন।
গত শুক্রবার রাতে রাজেরং ত্রিপুরা (১৫) নামের ওই কিশোরীর মরদেহ ছাত্রীনিবাসে তার কক্ষের গ্রিলের সঙ্গে ওড়না দিয়ে ‘ঝুলন্ত’ অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। বান্দরবানের থানচি উপজেলার কালুপাড়া গ্রামের রমেশ ত্রিপুরার মেয়ে রাজেরং মিশনারির একটি প্রকল্পের অধীনে কেশবপুর পাইলট মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণিতে পড়ত।
পুলিশ ও মিশনারি কর্তৃপক্ষ জানায়, কেশবপুরের সাহাপাড়ার খ্রিষ্টান মিশনারির ছাত্রীনিবাসে থেকে ‘খ্রিষ্টান আউটরিস্ট সেন্ট্রাল ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ’ প্রকল্পের অধীনে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ৪৪ জন মেয়ে পড়ালেখা করে। শুক্রবার সন্ধ্যার পর কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে ছাত্রীনিবাসের ম্যাট্রন জেসিকা সরকার রাজেরং ত্রিপুরার কক্ষের তালা খুলে তার মরদেহ গ্রিলের সঙ্গে ফাঁস দেওয়া অবস্থায় দেখতে পান। আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে কেশবপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নিলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
ছাত্রীনিবাসের সুপার প্রদীপ সরকার বলেন, রাজেরং ত্রিপুরা বাড়ি থেকে এত দূরে এসে লেখাপড়া করতে চায়নি। পরিবার তাকে জোর করে পাঠানোয় সে মানসিক অবসাদগ্রস্ত ছিল। সেই কষ্ট থেকে সে গলায় ফাঁস দিয়ে ‘আত্মহত্যা’ করেছে।
এদিকে মিশনারির পক্ষ থেকে কিশোরীর পরিবারকে তার মৃত্যুর খবর দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেছেন স্বজনেরা। গতকাল সোমবার মেয়ের মৃত্যুর খবর পেয়ে কেশবপুরে আসেন বাবা রমেশ ত্রিপুরা ও তিন স্বজন। তাঁরা কেশবপুর প্রেসক্লাবে গিয়ে অভিযোগ করেন, চার দিন আগে মেয়ে মারা গেলেও মিশনারি তাঁদের কোনো খবর দেয়নি। তাঁদের ধারণা, মেয়েকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। তাঁরা মেয়েটির লাশ পেতে চান। পাশাপাশি তাঁদের এলাকার আরও তিন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মেয়েকে আবাসিক থেকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চান।
এ ঘটনায় রাজেরং ত্রিপুরার বাবা রমেশ ত্রিপুরা কেশবপুর থানায় একটি লিখিত অভিযোগ করেন। অভিযোগে তিনি ‘খ্রিষ্টান আউটরিস্ট সেন্ট্রাল ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ’ প্রকল্পের পরিচালক খ্রীষ্টফার সরকারসহ ছয়জনকে বিবাদী করেন। অভিযোগে বলা হয়, তাঁর মেয়েকে নির্যাতন করে ‘আত্মহত্যা’ করতে বাধ্য করা হয়েছে। বান্দরবানের লামা উপজেলার সত্য মানিক ত্রিপুরা ও হানিচরণ ত্রিপুরাকে টাকার লোভ দেখিয়ে তাঁর মেয়ের অভিভাবক সাজিয়ে নিয়ে যেতে ভাড়া করে আনা হয়। তাঁর মেয়ের লাশ নিতে তাঁদের খ্রীষ্টফার সরকার কেশবপুরে আসতে বলেন।
অভিযোগের বিষয়ে খ্রীষ্টফার সরকার প্রথম আলোকে বলেন, মেয়েটির বাড়ি দুর্গম এলাকায়। সেখানে মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকায় তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। পরে থানার মাধ্যমে বার্তা পাঠিয়ে যোগাযোগ করা হয়। একেবারেই যোগাযোগ করা হয়নি, এ অভিযোগ সত্য নয়।
এদিকে ওই কিশোরীর মরদেহ হস্তান্তর ও হত্যার অভিযোগ তুলে বিচারের দাবিতে মিশনারির সামনে বিক্ষোভ করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা। আজ সকাল সাড়ে নয়টায় শুরু হওয়া বিক্ষোভে তাঁরা ছাত্রীনিবাসে ঢোকার দাবি জানিয়ে ছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলতে চান। বেলা ১১টার দিকেও সেখানকার দায়িত্বশীলরা বিক্ষোভকারীদের ভেতরে ঢুকতে দেননি। একপর্যায়ে কেউ কেউ প্রাচীর টপকে ভেতরে ঢুকে মূল ফটক খুলে দিলে বিক্ষোভকারীরা ভেতরে ঢুকে বিক্ষোভ শুরু করেন। পরে থানা-পুলিশ ও সেনাসদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের আশ্বাস দিলে পরিস্থিতি শান্ত হয়। পাশাপাশি ছাত্রীনিবাসে থাকা অন্য তিন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর কিশোরীকে হস্তান্তর করার আশ্বাস দেওয়া হয়।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছাত্রপ্রতিনিধি মাশফি আরেফিন চৌধুরী বলেন, খ্রিষ্টান মিশনারির একটি মেয়ে মারা যাওয়ার পরও তার পরিবারকে জানানো হয়নি। এ ঘটনায় থানায় অভিযোগ দিলেও মামলা না হওয়ায় তাঁরা মিশনারিতে গিয়েছিলেন। তাঁদের দাবি ছিল, এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার।
যশোরের সহকারী পুলিশ সুপার (মনিরামপুর সার্কেল) ইমদাদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, মেয়েটির বাবার অভিযোগ পুলিশ পেয়েছে। এতে নির্যাতন করে হত্যার অভিযোগ করা হয়েছে। মেয়েটির লাশ ময়নাতদন্ত করা হয়েছে। লাশ এখনো হাসপাতালের মর্গে আছে। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে সেই অনুযায়ী আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, ভুল–বোঝাবুঝি থেকে মিশনারিতে ছাত্র-ছাত্রীরা ঢুকে পড়েছিলেন। পরে সবাইকে বুঝিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করা হয়। এখন পরিবেশ শান্ত আছে।
এ বিষয়ে মিশনারির প্রকল্প পরিচালক খ্রীষ্টফার সরকার বলেন, পুলিশ বাদী হয়ে মামলার পাশাপাশি সংস্থার পক্ষ থেকেও থানায় একটি অভিযোগ করা হয়েছে। ছাত্রীদের নির্যাতন করা ও তাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করার অভিযোগ সত্য নয়। তিনি বলেন, তাঁরা এখানে এসেছেন সেবা করতে। এ জন্যই তাঁদের মিশনারি ও ছাত্রীনিবাসে হামলা করা হয়েছে। এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানান তিনি।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ক শবপ র প রকল প এ ঘটন তদন ত উপজ ল ঘটন র
এছাড়াও পড়ুন:
কুবি শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) এক শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে ফেসবুকে হিন্দুধর্ম অবমাননার অভিযোগ উঠেছে।
এ নিয়ে ক্ষোভ জানিয়ে মঙ্গলবার (১৫ এপ্রিল) দুপুরে অভিযুক্তের শাস্তি দাবি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর বরাবার লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন সনাতন ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থীরা। তারা উপাচার্যকে অভিযোগপত্রের একটি কপি দিয়েছেন।
অভিযুক্ত আব্দুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ২০২৩-২৪ বর্ষের শিক্ষার্থী। সোমবার (১৪ এপ্রিল) সন্ধ্যায় তার পোস্টটির স্ক্রিনশট ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে তা নিয়ে সমালোচনা হয়।
আরো পড়ুন:
কুবি শিক্ষার্থীদের ভাবনায় ফ্যাসিবাদমুক্ত নববর্ষ
৫ বছর পর কুবিতে নববর্ষ উদযাপন
অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, সম্প্রতি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী (আব্দুর রহমান, আইন বিভাগ ১৮তম আবর্তন) লাগাতার সনাতন ধর্মের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কটুক্তি করে যাচ্ছে। এর মধ্যে সোমবার (১৪ এপ্রিল) একটি পোস্টে সনাতন ধর্মকে ঘৃণিত ভাষায় উপস্থাপন করা হয়েছে। সেখোনে ‘হিন্দুধর্ম। ইট'স রিকোয়াইর্স টু বি অ্যাগ্রেসিভলি রেপড, (গালি) ইন আ রুড ওয়ে। (গালি)।’ বলা হয়েছে।
অভিযোগপত্রে আরো বলা হয়, এই বক্তব্য শুধু কুরুচিপূর্ণ নয়, বরং আমাদের ধর্মীয় বিশ্বাসকে অপমান এবং ঘৃণিত করে। এ ধরনের বক্তব্য কোনো সভ্য সমাজ বা শিক্ষাঙ্গনে মেনে নেওয়া যায় না। এছাড়া সাইবার নিরাপত্তা আইন ২০২৩ অনুযায়ী ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত একটি দণ্ডনীয় অপরাধ। যার সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে বর্তমানে ২ বছর কারাদণ্ড বা ৫ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় একটি জ্ঞান ও সম্প্রীতির স্থান। এখানে এমন কোনো মত প্রকাশের সুযোগ থাকা উচিত নয়, যা অন্যের ধর্মীয় অনুভূতিকে আঘাত করে এবং সাম্প্রদায়িক বিভাজন তৈরি করে।
অভিযোগপত্রে তাদের দাবি, ওই শিক্ষার্থীকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করে দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে হবে। যাতে ভবিষ্যতে কেউ এ ধরনের ঘৃণিত কাজ না করে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সোমবার (১৪ এপ্রিল) এম এ হোসাইন নামের একটি পেইজে জ্বলন্ত আগুনের মধ্যে জীবন্ত ছাগলকে পুড়িয়ে ফেলার একটি ভিডিও শেয়ার করা হয়। সেটার ক্যাপশন অপশনে লেখা ছিল ‘জনশ্রুতি আছে, পৃথিবীর নিকৃষ্ট ধর্ম হচ্ছে হিন্দু ধর্ম। একটা নিরীহ জীবন্ত প্রাণীকে এভাবে আগুনে পুড়ে মারার অধিকার কি কোনো ধর্মে আছে?’
পরবর্তীতে স্ক্রিনশটটি আরো ছড়িয়ে পড়লে শেয়ারকৃত পোস্টটি ডিলিট করে ক্ষমা চেয়ে নতুন আরেকটি পোস্ট শেয়ার করেন। বর্তমানে অভিযুক্ত আবদুর রহমানের ফেসবুক অ্যাকাউন্টটি ডিঅ্যাক্টিভেট করে রাখা হয়েছে।
আইন বিভাগের ১৫তম আবর্তনের শিক্ষার্থী সজীব বিশ্বাস বলেন, “আব্দুর রহমান যেভাবে ফেসবুকে আমাদের ধর্মকে নিয়ে কটুক্তি করেছে, আমি তার তীব্র নিন্দা এবং প্রতিবাদ জানাচ্ছি। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থী কিভাবে একটা ধর্মকে নিয়ে এমনভাবে গালি দিতে পারে? আমি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে বলবো, বিগত বছরগুলাতে যেভাবে ধর্মকে অবমাননার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করেছে, এবারো যেন তার ব্যতিক্রম না ঘটে।”
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্ত আবদুর রহমান বলেন, “আমি আমার বক্তব্য প্রক্টর অফিসে দিয়েছি।”
আইন বিভাগের বিভাগের বিভাগীয় প্রধান সহকারী অধ্যাপক মো. আলী মোর্শেদ কাজেম বলেন, “আমি এই বিষয়ে অবগত নই। ঘটনা সম্পূর্ণ না জেনে আমি তো কোন বক্তব্য দিতে পারছি না।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক আবদুল হাকিম বলেন, “আমরা অভিযোগপত্রটি পেয়েছি অভিযুক্ত শিক্ষার্থী যেহেতু আইন বিভাগের, সেহেতু আমরা ওই বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের মাধ্যমে অভিযুক্তের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি শৃংখলা কমিটির কাছে হস্তান্তর করবো।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. হায়দার আলী বলেন, “আমি অভিযোগপত্রটি পেয়েছি। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী অভিযুক্ত শিক্ষার্থীকে ডেকে শোকজ করা হবে। তার লিখিত ব্যাখ্যা গ্রহণের পর নিয়ম অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।”
ঢাকা/এমদাদুল/মেহেদী