অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ও স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার পদত্যাগ দাবি করেছে গণ অধিকার পরিষদ। উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের কড়া সমালোচনা করে দলটির সাধারণ সম্পাদক মো. রাশেদ খান বলেছেন, ‘মাহফুজ আলম বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিচ্ছেন। এ রকম অনৈক্য সৃষ্টিকারী কী করে সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে বহাল থাকেন? তিনি যদি এত তাত্ত্বিক জ্ঞান ছড়াতে চান, তাহলে পদত্যাগ করে কেন জ্ঞানের ভান্ডার খুলে বসছেন না?’

আজ মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর বিজয়নগরে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে রাশেদ খান এসব কথা বলেন। সংবাদ সম্মেলনে রাশেদ ছাড়াও গণ অধিকার পরিষদের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ফারুক হাসান বক্তব্য দেন।

সংবাদ সম্মেলনে রাশেদ খান বলেন, ‘অভ্যুত্থানের কোনো শক্তি বলেনি ছাত্ররা তিনজন উপদেষ্টা হবে। শুরুতে দুজন উপদেষ্টা হলেন। মাহফুজ আলম তাঁদের সহযোগিতায় প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী হলেন। এটি একটি চাল ও টেকনিক ছিল। পরে তাঁকে দপ্তরবিহীন উপদেষ্টা করা হলো। এরপর তাঁকে তথ্য উপদেষ্টা করা হলো। তথ্য উপদেষ্টাকে বলা হয় সরকারের মুখপাত্র। তিনি (মাহফুজ) কখনো হেফাজতের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিচ্ছেন; কখনো জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে, কখনো বিএনপির বিরুদ্ধে, কখনো গণ অধিকার পরিষদের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিচ্ছেন। তাঁর দায়িত্ব কি অনৈক্য সৃষ্টি করা?’

উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের কড়া সমালোচনা করে রাশেদ খান বলেন, ‘তিনি (মাহফুজ আলম) যদি এত তাত্ত্বিক জ্ঞান ছড়াতে চান, তাহলে পদত্যাগ করে কেন জ্ঞানের ভান্ডার খুলে বসছেন না? এ রকম অনৈক্য সৃষ্টিকারী কী করে সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে বহাল থাকেন?’

উপদেষ্টা মাহফুজ ও আসিফ মাহমুদ সরকারে থাকলে নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে না বলে মন্তব্য করেন রাশেদ খান। এর পক্ষে যুক্তি দিয়ে তিনি বলেন, ‘কারণ ইতিমধ্যে উপদেষ্টারা তাঁদের আশীর্বাদ জানিয়েছেন। অন্যান্য উপদেষ্টা এই ছাত্রদের অনুগত। প্রধান উপদেষ্টা নিজে তাঁদের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হয়েছেন। সুতরাং এই উপদেষ্টারা সরকারে থাকলে কোনোভাবেই নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে না। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে এই দুজন ছাত্র উপদেষ্টাকে পদত্যাগ করতে হবে। পাশাপাশি সরকারের বিভিন্ন দপ্তর ও সেক্টরে যেসব ছাত্র প্রতিনিধিদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, অবশ্যই তাঁদের নিয়োগ বাতিল করতে হবে।’

লিখিত বক্তব্য

সংবাদ সম্মেলনে একটি লিখিত বক্তব্যও পাঠ করা হয়। এতে বলা হয়, ‘অন্তর্বর্তী সরকারে তিনজন ছাত্র উপদেষ্টা হয়েছিলেন। তাঁদের একজন (নাহিদ ইসলাম) পদত্যাগ করে একটি দলের প্রধান হয়েছেন। বাকিরাও সরকারে থাকার নৈতিকতা হারিয়েছেন। দল গঠন একটি চলমান প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় কি পদত্যাগকৃত উপদেষ্টা সম্পৃক্ত ছিলেন না? অবশ্যই ছিলেন। আর তিনজন ছাত্র উপদেষ্টার একই নেক্সাস। সুতরাং আমরা সরকারের নিরপেক্ষতা নিশ্চিতে বাকি দুজন ছাত্র উপদেষ্টারও পদত্যাগ দাবি করছি।’

বৈষম্যবিরোধী বা সমন্বয়কের কোনো অস্তিত্ব বিদ্যমান নেই বলে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের সাম্প্রতিক এক বক্তব্যের কথা উল্লেখ করে গণ অধিকার পরিষদ বলেছে, সে ক্ষেত্রে সরকারের নিরপেক্ষতা নিশ্চিতে সরকারের সব সেক্টর ও দপ্তর থেকে ছাত্র প্রতিনিধিদের পদত্যাগ করা অতীব জরুরি।

ঢাকা ওয়াসায় আউটসোর্সিং নিয়োগ নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, আউটসোর্সিংয়ে নিয়োগ হলেও পরে এগুলো স্থায়ী করার সুযোগ আছে। সুতরাং এই নিয়োগ অনৈতিক। এই নিয়োগের তদন্তসহ সরকারের সব দপ্তরে নিয়োগের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতের দাবি জানাচ্ছেন তাঁরা।

বাংলাদেশের সংখ্যালঘু নির্যাতন ও ‘ইসলামপন্থী সন্ত্রাসবাদ’ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দাপ্রধান তুলসী গ্যাবার্ডের বক্তব্যের নিন্দা জানিয়েছে গণ অধিকার পরিষদ। দলটি বলেছে, বাংলাদেশে কোনো ইসলামপন্থী সন্ত্রাসবাদ নেই, সংখ্যালঘুদের ওপর অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো ঘটনা ঘটেনি।

গণ অধিকার পরিষদের উচ্চতর পরিষদের সদস্য আবু হানিফ, শাকিল উজ্জামান প্রমুখ সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: জন ছ ত র উপদ ষ ট উপদ ষ ট র য উপদ ষ ট ন উপদ ষ ট সরক র র ইসল ম

এছাড়াও পড়ুন:

সবাই ভয়ে পালিয়েছে, ভারতের নন্দনগরে এক মুসলিম পরিবারের টিকে থাকার লড়াই

নন্দাকিনী নদীর তীরে রোজ সকাল আটটায় নিজের ড্রাই ক্লিনিংয়ের দোকানের বাদামি শাটার খুলে কাজ শুরু করেন আহমেদ হাসান। উত্তর ভারতের হিমালয় অঞ্চলের উত্তরাখন্ড রাজ্যের নন্দনগরে বংশপরম্পরায় বসবাস করে আসছেন তিনি।
সকালে দোকান খুলে নিত্যদিনের কাজ শুরু করেন হাসান। শুকনো পদ্ধতিতে পরিষ্কার (ড্রাই ক্লিনড) করা কাপড় নিজের দোকানের গোলাপি দেয়ালের প্লাস্টিক কভারে সুচারুভাবে ঝুলিয়ে রাখেন। এরপর ৪৯ বছর বয়সী এই ব্যক্তি গ্রাহকের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন।

২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মধ্যাহ্নভোজের আগে প্রতিদিন ২০ থেকে ২৫ জন গ্রাহক হাসানের কাছে আসতেন। শেরওয়ানি, স্যুট, কোট, প্যান্ট এবং শীতকালীন পোশাক তাঁর কাছে পরিষ্কার করতে দিতেন। কোনো কোনো গ্রাহক তাঁর সঙ্গে আড্ডা দিতেন। চা খেতে খেতে রাজনীতি নিয়ে আলাপ ও মজা করতেন, হাসি–আনন্দ ও সুখ-দুঃখ বিনিময় করতেন। গ্রাহকদের বেশির ভাগ ছিলেন হিন্দু, অল্প কিছু ছিলেন মুসলিম।
কিন্তু ১২ এপ্রিল দুপুর পর্যন্ত পাঁচজনেরও কম হিন্দু গ্রাহক হাসানের দোকানে এসেছেন। তিনি জানান, কোনো মুসলিম গ্রাহকের আশায় থাকা বৃথা। এ সম্ভাবনা শেষ হয়ে গেছে।

নন্দনগরে এখন হাসানই একমাত্র মুসলিম পুরুষ। অথচ এই শহরে কয়েক মাস আগেও ১৫টি মুসলিম পরিবার ছিল, যারা বংশপরম্পরায় এখানে বসবাস করে আসছিল। হাসানের জন্ম ও বেড়ে ওঠা এখানেই। প্রতিবেশী হিন্দুদের সঙ্গে তাঁর পরিবারের সুসম্পর্ক ছিল। পূজা-পার্বণে হিন্দুরা তাঁদের নিমন্ত্রণ করতেন। আর ঈদের সময় হিন্দু প্রতিবেশীদের তাঁরা দাওয়াত দিতেন। প্রতিবেশী হিন্দু মারা গেলে শবদাহের জন্য তিনি কাঠ সংগ্রহ করতেন, হিন্দু বন্ধুদের মরদেহ কাঁধে বহন করে শ্মশানে নিয়ে গেছেন।

কিন্তু গত সেপ্টেম্বরে এই এলাকায় মুসলিমবিরোধী সহিংসতা শুরুর পর এ সবকিছু রাতারাতি বদলে গেছে। এক হিন্দু মেয়েকে যৌন হয়রানির অভিযোগে এ সহিংসতা শুরু হয়েছিল। তবে নন্দনগরে সংখ্যালঘু মুসলিমদের বিরুদ্ধে মন–মানসিকতায় আরও আগে থেকেই বড় পরিবর্তন সূচনা হয়েছিল, যা করোনাকাল থেকে খেয়াল করে আসছিলেন হাসান।

গত সেপ্টেম্বরে মুসলিমদের বিরুদ্ধে শারীরিক হামলার আগে তাঁদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের ঘৃণামূলক স্লোগান দেওয়া হতো। মুসলিমবিরোধী কিছু বিক্ষোভও হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় হিন্দু মেয়েকে যৌন হয়রানির অভিযোগে তাঁদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে। দোকানপাট ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে প্রাণভয়ে মুসলিম জনগোষ্ঠীর মানুষেরা রাতের আঁধারে নন্দনগর ছেড়ে পালিয়ে যান।

হাসানও পালিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু কিছুদিন পর তিনি স্ত্রী, দুই মেয়ে ও দুই ছেলেকে নিয়ে ফিরে আসেন। ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলের এই ছোট্ট শহর আবার মুসলিমদের বসবাসের উপযোগী করার ব্যাপারে তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। কারণ, এটাই তাঁদের জন্মভূমি। কিন্তু হাসানের পরিবারকে সেখানে এখনো ভয়ে ভয়েই থাকতে হচ্ছে।

হিন্দু প্রতিবেশীরা এখন হাসানের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন না। আগে তিনি সন্ধ্যায় নিয়মিত নন্দাকিনী নদীর তীরে হাঁটতে গেলেও এখন যান না। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তিনি নিজের স্ত্রী ও সন্তানদের কারও সঙ্গে দেখা করতে দেন না। তাঁর আশঙ্কা, আবারও সহিংসতা দেখা দিতে পারে।

হাসান বলেন, ‘আমি সোজা দোকানে যাই, দোকান থেকে বাসায় আসি। সারাটি জীবন এই শহরে কাটালেও নিজেকে আমার এখন ভূত বলে মনে হয়। আমি যেন সম্পূর্ণ অদৃশ্য। এমনকি কেউ আমার সঙ্গে কথা পর্যন্ত বলছেন না।’

‘মুসলিমদের জুতা দিয়ে পেটাও’

রাজধানী নয়াদিল্লি থেকে গাড়িতে করে নন্দনগর যেতে সময় লাগে প্রায় ১০ ঘণ্টা। ভারত-চীন সীমান্তের কাছাকাছি স্থানের এই শহরটি নন্দাকিনীর কয়েকটি উপনদীর সংগমস্থলে অবস্থিত। গঙ্গার ছয়টি উপনদীর একটি হলো নন্দাকিনী, যাকে হিন্দুরা পবিত্র বলে বিশ্বাস করেন। শহরটি জনসংখ্যা প্রায় দুই হাজার।

হাসানের দাদা পার্শ্ববর্তী উত্তর প্রদেশ রাজ্যের বিজনৌর জেলার নাজিবাবাদ শহর থেকে ১৯৭৫ সালে নন্দনগরে এসেছিলেন। তাঁদের পরিবার সেখানেই বসতি গড়ে। পরের বছর হাসানের জন্ম হয়।

এক মুসলমান নরসুন্দরের যৌন হয়রানির অভিযোগের বিরুদ্ধে অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ মিছিলে হাসান ও নন্দনগরের অন্য মুসলমানরাও অংশ নিয়েছিলেন

সম্পর্কিত নিবন্ধ