১৫ দিনের মধ্যে দুই ‘ছাত্র উপদেষ্টার’ পদত্যাগ দাবি গণঅধিকার পরিষদের
Published: 18th, March 2025 GMT
অন্তর্বর্তী সরকারের দুই ‘ছাত্র উপদেষ্টা’ মাহফুজ আলম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার পদত্যাগ দাবি করেছে গণঅধিকার পরিষদ। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে তারা পদত্যাগ না করলে গণঅভ্যুত্থানের সকল শক্তিকে নিয়ে কঠোর কর্মসূচির হুঁশিয়ারি দেন দলটির নেতারা।
আজ মঙ্গলবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে রাজধানীর পুরানা পল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানান সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান।
তিনি বলেন, ১৫ দিনের মধ্যে তারা পদত্যাগ না করলে গণঅভ্যুত্থানের সকল শক্তিকে নিয়ে কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। প্রয়োজনে যমুনা ঘেরাও করা হবে।
জুলাই গণঅভ্যত্থানে ছাত্র-জনতার ওপর গণহত্যা চালানোর দায়ে দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবি জানান রাশেদ খান। এ সময় তিনি বলেন, সম্প্রতি ওয়াসা নিয়োগ নিয়ে যে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে সেই নিয়োগ বাতিল করতে হবে। সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে যারা নিয়োগ পেয়েছেন, তাদের নিয়োগ বাতিল করতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে গণ অধিকার পরিষদের সহসভাপতি ফারুক হাসান বলেন, শিক্ষার্থীদের দল গঠনের মাধ্যমে ড.
তিনি বলেন, হাইকোর্টের নির্দেশে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে দ্রুত নিবার্চন দিতে হবে। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচন আদালতের মাধ্যমে বাতিল ঘোষণা করতে হবে। পাশাপাশি এসব নির্বাচনে যারা ‘ডামি-আমি’ এমপি হয়েছিলেন, তাদের সম্পদ জব্দ করতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে অন্যান্যের মাঝে আরও উপস্থিত ছিলেন দলের উচ্চ পরিষদ সদস্য দপ্তর সম্পাদক শাকিলউজ্জামান ও গণমাধ্যম সম্পাদক আবু হানিফ।
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
নির্বাচনের লক্ষ্যে স্থির থাকা জরুরি
জাতীয় নির্বাচনের ‘রোডম্যাপ’ ঘোষণার দাবি জোরালো হওয়ার পর এর দুটি সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিলেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। ‘অল্প সংস্কার’ হলে চলতি বছরের ডিসেম্বর; ‘অধিকতর সংস্কার’ হলে আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন অবশ্যই হবে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নির্বাচনের সময় নিয়ে যাদের সংশয় রয়েছে, তাদের আস্থা জোগাতেই তিনি এটা করেছিলেন। পরে কোনো এক সাক্ষাৎকারে এমনটাও বলেছেন– যত যা-ই ঘটুক, ঘোষিত সময়সীমার বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কেউ যেন ভিন্ন কিছু চিন্তাও না করে।
হালে অবশ্য চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনার কথাটাই তিনি বেশি করে বলছেন। ‘অত্যাবশ্যকীয় সংস্কার’ করে দ্রুত নির্বাচনের দিকে যাওয়ার দাবি সবচেয়ে জোরালোভাবে জানাচ্ছে বিএনপি। তাদের একটি প্রতিনিধি দলকেও তিনি এ ব্যাপারে আশ্বস্ত করেছিলেন। এর পর একাধিক সাক্ষাৎকারেও সেটা উল্লেখ করেছেন। পুনর্গঠিত নির্বাচন কমিশনও (ইসি) ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে প্রস্তুতি নেওয়ার কথা জানিয়েছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজনের দাবি কেউ কেউ তুললেও ইসি জাতীয় নির্বাচনের কথাই বলছে।
নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আবার ‘গণপরিষদ’ গঠনের জন্য নির্বাচন জরুরি বলে মনে করে। এ প্রশ্নে মাঠে থাকা দলগুলোর ঐকমত্য নেই। জাতীয় নির্বাচন যে হতেই হবে– সে ব্যাপারে বরং ঐকমত্য রয়েছে। তবে ডিসেম্বরের মধ্যেই হতে হবে কিনা– এ প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান বিভিন্ন। এনসিপির মুখ্য আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম সম্প্রতি বলেছেন, বিদ্যমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন করা ‘কঠিন’। কিছুদিন আগ পর্যন্ত তিনি নিজেও উপদেষ্টা পরিষদের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নির্বাচনের অনুকূল না হয়ে প্রতিকূল হলে এর দায় তাঁকেও নিতে হবে। এমন মতও রয়েছে, বেড়ে যাওয়া অরাজকতা নিয়ন্ত্রণেও নির্বাচনের রোডম্যাপ সুস্পষ্ট করতে হবে। তাতে স্থবির হয়ে পড়া বেসরকারি খাতও পাবে দিকনির্দেশনা। গণঅভ্যুত্থানের পর সৃষ্ট পরিস্থিতিতে নতুন বিনিয়োগ হচ্ছে না বললেই চলে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধে কর্মহীনতা বাড়ছে বরং; মূল্যস্ফীতিও উচ্চ পর্যায়ে। এখান থেকে উত্তরণেও দ্রুত নির্বাচন এবং নির্বাচিত সরকার অর্জন প্রয়োজন বলে মত এখন জোরালো।
পরপর তিনটি অগ্রহণযোগ্য নির্বাচন করে কার্যত অবৈধভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চেয়েছিল শেখ হাসিনার সরকার। এর অনিবার্য পরিণতিতে নজিরবিহীন গণঅভ্যুত্থানে তাঁর পতন ঘটে গত বছরের ৫ আগস্ট। এতে দেশে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, সে সম্পর্কে অবশ্য কারও স্পষ্ট অনুমান ছিল না। ক্ষমতাচ্যুতদের ওপর প্রতিশোধসহ নানা উপাদান ঘিরে পরিস্থিতি কতটা জটিল হতে পারে, তাও ছিল অনেকটা অজানা।
সত্যি বলতে, ২০১৮ সালের নির্বাচনেই স্থির হয়ে যায়, হাসিনা সরকার কোন দিকে যাচ্ছে! শান্তিপূর্ণ আন্দোলন দমনে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের দায়ও এখন তাদের কাঁধে। জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের প্রতিবেদনেও সেটি স্পষ্ট। শেখ হাসিনাসহ অভিযুক্তদের বিচার নিশ্চিত করার দাবি তাই কম জোরালো নয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা জোরদার করতে রাষ্ট্র সংস্কারের দাবিও জোরালো। এক-এগারো সরকারের সময়ও কিন্তু সংস্কারের ব্যাপারে কম আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়নি। সেদিক থেকে দেখলে সংস্কারের দাবিটি পুরোনো ও অবহেলিত। তা সত্ত্বেও দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি সামনে এসেছে কেন, সেটাও কারও অজানা নয়।
এক-এগারোর সরকার যে দৃঢ়তায় দেশ পরিচালনা করতে পেরেছিল, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দৃশ্যতই তাতে ব্যর্থ। পরিস্থিতি এখন অনেক বেশি জটিল, তাতেও কোনো সন্দেহ নেই। অর্থবিত্ত আর আঞ্চলিক শক্তির সহায়তায় বলবান পরাজিত পক্ষের কর্মকাণ্ডও রয়েছে মাঠে। প্রধান উপদেষ্টা যখন সফররত জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছে ‘অপতথ্য মোকাবিলা’য় সহায়তা চান, তাতেও বোঝা যায় চ্যালেঞ্জটা। তবে পরিস্থিতি জটিল হয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ সংস্কার করে এর দক্ষতা এবং ‘রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা’ বাড়ানো হয়নি বলেও। এতে গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব থেকে আসা তরুণদের অংশগ্রহণ ও ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ক্রমে বেড়েছে। পাশাপাশি মাঠে গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর মতভেদ বেড়েছে ক্রমে। তাদের মধ্যে বাড়তে থাকা ‘কাদা ছোড়াছুড়ি’ নিয়ে এরই মধ্যে গভীর উদ্বেগ জানিয়ে বক্তব্য রেখেছেন সেনাপ্রধান। এর বেশ আগে তিনি ১৮ মাসের মধ্যে সংস্কার শেষ করে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সরকারকে সহায়তা করে যাওয়ার দৃঢ় অঙ্গীকারের কথা জানিয়েছিলেন। এখন ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন করা গেলে সে বক্তব্যের বাস্তবায়ন ঘটে। প্রধান উপদেষ্টার কথাবার্তাও একই ধারায় রয়েছে বলে প্রতীয়মান। সৃষ্ট পরিস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ এ দু’জনের সঙ্গে ভিন্নমত জানিয়ে অন্য কোনো এজেন্ডা সামনে আনা কঠিন।
গণঅভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের পতন ঘটেছিল জনমনে পুঞ্জীভূত ক্রোধের কারণে। রাষ্ট্র সংস্কার কার্যক্রম নয়; বরং বিদ্যমান বিধি-ব্যবস্থা, বিশেষত গণতন্ত্রের ন্যূনতম শর্ত নির্বাচনী প্রক্রিয়াও ধ্বংস করে দেওয়ার কারণে। নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ হস্তান্তর আর ন্যূনতম গণতন্ত্র চর্চা চলতে থাকলেও পরিস্থিতির এতটা অবনতি হতো না। শেখ হাসিনার দীর্ঘ শাসনামলের এক পর্যায়ে বাকস্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক বিলুপ্তি ঘটানোর লক্ষ্যে আইনও পাস করা হয়। সামাজিক মাধ্যমে মতপ্রকাশও ছিল বিপজ্জনক।
এ অবস্থায় স্বৈরাচারী সরকার গেড়ে বসার আগে যেটুকু গণতন্ত্র চর্চা ছিল, তাতে প্রত্যাবর্তন করতে পারাও কম অর্জন বলে বিবেচিত হবে না। এর চাইতে বেশি কিছু অর্জন করা গেলে তাতে কারও আপত্তির সুযোগ অবশ্য নেই। কিন্তু একবারে প্রত্যাশিত সবকিছু অর্জন করতে চাইলে চলমান অরাজকতায় পরিস্থিতি এমন দিকে চলে যেতে পারে, যেখান থেকে ন্যূনতম গণতন্ত্রে ফেরাও কঠিন। তার চাইতে বরং আগামী ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচনের লক্ষ্যে স্থির থেকে এ মুহূর্তের জরুরি সংস্কার সম্পন্ন করা প্রয়োজন বলে মনে হচ্ছে। সে ধারায় ‘রাজনৈতিক সংলাপ’ আয়োজনও জরুরি।
নির্বাচনে কারা জিতবে– সে প্রশ্ন সামনে আনা অপ্রয়োজনীয়। জনগণ তার সার্বভৌম ইচ্ছায় যে দলকে চাইবে, তারাই সরকার গঠন করবে। সেটা মাঠে থাকা কোনো পক্ষের আশা-আকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে গেলেও কিছু করার নেই। গণতন্ত্র এভাবেই কাজ করে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জাতীয় নির্বাচন যেন আন্তর্জাতিকভাবেও গ্রহণযোগ্য হয়, সে চেষ্টা করতে হবে অন্তর্বর্তী সরকারকে। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে অসাফল্যের মধ্যে শুধু নির্বাচনটা সফলভাবে করতে পারলেও তারা কম স্মরণীয় হয়ে থাকবেন না।
রাষ্ট্র সংস্কারের দাবি কিন্তু এর পরও বহাল থাকবে। থাকবে এ-সংক্রান্ত চাপ। নির্বাচিত সরকারকে তো দীর্ঘ অপশাসন আর অরাজকতায় এলোমেলো দেশটাও ঠিকমতো চালাতে হবে। সে চ্যালেঞ্জ থাকছে অনিবার্যভাবেই। তবে বিরাজমান পরিস্থিতিতে ‘বিপথগামী’ হওয়ার ঝুঁকি এড়ানো সামান্য বলে বিবেচিত হবে না। স্বাধীনতার পাঁচ দশক পরও একটা জাতি ঝুঁকিমুক্তভাবে গণতন্ত্র চর্চা করে অভীষ্ট লক্ষ্যে যাওয়ার অধিকার কি রাখে না?
হাসান মামুন: সাংবাদিক, কলাম লেখক