দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর যমুনা নদীর ওপর নির্মিত রেলসেতুর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়েছে। আজ মঙ্গলবার সকালে সেতুর পূর্ব প্রান্ত থেকে অতিথিদের নিয়ে উদ্বোধনী ট্রেনটি তিন মিনিটে সেতু পার হয়ে সিরাজগঞ্জের সয়দাবাদে পৌঁছায়।

দুপুর ১২টা ৬ মিনিটে সেতুর পূর্ব প্রান্তের ইব্রাহিমাবাদ স্টেশন থেকে উদ্বোধনী ট্রেন যাত্রা শুরু করে। দুপুর ১২টা ১২ মিনিটে ট্রেনটি পূর্ব প্রান্ত থেকে সেতুতে ওঠে। মাত্র ৩ মিনিটে ১২টা ১৫ মিনিটে সেতু পার হয়। পরে পশ্চিম প্রান্তের সয়দাবাদ স্টেশনে দুপুর ১২টা ২১ মিনিটে পৌঁছে যায়।

সকাল ১০টা ২০ মিনিটে ইব্রাহিমাবাদ রেলস্টেশন প্রাঙ্গণে আয়োজিত উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব ফাহিমুল ইসলাম। বিশেষ অতিথি হিসেবে বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত সাইদা শিনইচি ও জাইকার দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের মহাপরিচালক ইতো তেরুয়ুকি উপস্থিত ছিলেন। স্বাগত বক্তব্য দেন যমুনা রেলওয়ে সেতু নির্মাণ প্রকল্প পরিচালক আল ফাত্তাহ মো.

মাসউদুর রহমান এবং অনুষ্ঠানের সভাপতি হিসেবে সমাপনী বক্তব্য দেন বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আফজাল হোসেন।

অতিথিরা অনুষ্ঠানের মঞ্চে টাম্বলার লিভার (রেলের লাইন পরিবর্তনের যন্ত্র) টেনে রেলসেতুর উদ্বোধন করেন। পরে অতিথিরা বেলুন ও শান্তির প্রতীক পায়রা ওড়ান।
যমুনা নদীর ওপর বর্তমান সড়কসেতুর পাশে নতুন রেলসেতুটি নির্মাণ করা হয়েছে।

এই রেলসেতুতে আসা–যাওয়ার দুটি লাইন (ডুয়েল গেজ ডাবল ট্র্যাক) রয়েছে। গত ১২ ফেব্রুয়ারি থেকেই নতুন সেতুর একটি লাইন দিয়ে ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে। আজ আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পর থেকে সেতুটির দুটি লাইনেই ট্রেন চলাচল করবে।
যমুনা রেলসেতু প্রকল্পের পরিচালক আল ফাত্তাহ মো. মাসুদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, মূল সেতু পার হতে ট্রেনে লাগবে দুই-তিন মিনিট। সেতুর দুই পাড়ের স্টেশন সয়দাবাদ ও ইব্রাহিমাবাদের মধ্যে দূরত্ব ১৩ কিলোমিটার। এই অংশ পার হতে ৭ মিনিটের বেশি লাগবে না। আগে যমুনা সড়কসেতু পার হতে ট্রেনের সময় লাগত ২০–২৫ মিনিট। নতুন সেতু দিয়ে ট্রেনের সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি যাতায়াতের সময়ও কমবে। নতুন সেতু চালুর ফলে পুরোনো যমুনা সড়কসেতুর রেলপথ দিয়ে আর ট্রেন চলাচল করছে না।

১৯৯৮ সালে যমুনা নদীর ওপর সড়কসেতু চালু হয়। ওই সেতুতে শেষ মুহূর্তে রেল ট্র্যাক যুক্ত করা হয়। এর মাধ্যমে ঢাকার সঙ্গে সরাসরি উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রেল যোগাযোগ স্থাপিত হয়। তবে ২০০৬ সালে সেতুটিতে ফাটল দেখা দেওয়ার পর সেতুর ওপর দিয়ে ট্রেন চলাচলে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়। তখন থেকে সেতু দিয়ে ঘণ্টায় ২০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলাচল করত। এ সমস্যার সমাধানে সরকার যমুনা নদীর ওপর পৃথক রেলসেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়।

৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ নতুন রেলসেতু নির্মাণের প্রকল্প নেওয়া হয় ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে। প্রকল্পের নকশা প্রণয়নসহ সেতুর নির্মাণ ব্যয় প্রথমে ধরা হয়েছিল ৯ হাজার ৭৩৪ কোটি ৭ লাখ টাকা। ২০২৩ সালের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা ছিল। পরে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১৬ হাজার ৭৮০ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। মেয়াদ বাড়ানো হয় ২০২৫ সাল পর্যন্ত।

৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ নতুন রেলসেতু নির্মাণের প্রকল্প নেওয়া হয় ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে। প্রকল্পের নকশা প্রণয়নসহ সেতুর নির্মাণ ব্যয় প্রথমে ধরা হয়েছিল ৯ হাজার ৭৩৪ কোটি ৭ লাখ টাকা। ২০২৩ সালের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা ছিল। পরে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১৬ হাজার ৭৮০ কোটি ৯৬ লাখ টাকা।

প্রকল্পের শুরুতে এই সেতুর নাম ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতু। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গত বছরের ডিসেম্বরে সেতুর নাম পাল্টে যমুনা রেলসেতু রাখা হয়। নতুন রেলসেতু ৫০টি পিলারের ওপর ৪৯টি স্প্যানে নির্মিত হয়েছে। এই সেতুতে ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলাচল করতে পারবে। রেলওয়ে সূত্র জানিয়েছে, তারা সর্বোচ্চ ১০০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলাচল নির্ধারিত করে দিয়েছে। তবে এর চেয়েও কম গতিতে ট্রেন চলাচল করবে।

রেলওয়ের পাকশী বিভাগীয় কার্যালয়ের বাণিজ্যিক কর্মকর্তা (ডিসিও) গৌতম কুমার কুণ্ডু প্রথম আলোকে বলেন, এই সেতুতে ট্রেন চলাচলের মাধ্যমে উত্তরবঙ্গের সঙ্গে যোগাযোগের এক নতুন দুয়ার উন্মোচিত হলো। এখন থেকে এই সেতু দিয়ে অনেক কম সময়ে দ্রুতগতিতে ট্রেন পারাপার করতে পারবে।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: প রকল প র এই স ত র লওয় প রথম

এছাড়াও পড়ুন:

একজন চা-ওয়ালার স্বপ্ন 

আমি পেশায় চা–বিক্রেতা। সংসারের হাল ধরতে গিয়ে আমার পড়াশোনার ইতি ঘটে মাধ্যমিকে। তিন ভাই আর তিন বোনের মধ্যে আমি
পঞ্চম। বড় দুই বোনের বিয়ে হয়ে গেছে আর দুই ভাই বিয়ে করে অন্যত্র সংসার করছেন। তবু আট সদস্যের এই বিশাল পরিবারের
বেশির ভাগ নির্ভর করত বাবার আয়ের ওপর। বাবা ছিলেন সবজি বিক্রেতা। গৌরীপুর শহরের অলিগলিতে ফেরি করে তিনি সবজি বিক্রি করতেন।

পড়াশোনায় ইতি ঘটলে আমি হাল ধরি পরিবারের। ২০১০ সালে গৌরীপুর পৌর শহরে একটি মুদিদোকানে দৈনিক ১০০ টাকা বেতনে কাজ নিই। এক বছর মুদিদোকান থেকে আশানুরূপ বেতন না পাওয়ায় সেখান থেকে সরে আসি। পরে গৌরীপুর পৌর শহরের কালীখলা এলাকায় আমার মামার জালাল হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টে কাজ শুরু করি সেই ১০০ টাকা বেতনেই। সেখানেও বেশ কয়েক মাস কাজ করার পর পারিশ্রমিক ঠিকমতো না পাওয়ায় চলে আসি।

ওই হোটেলের বারান্দায় একটা চায়ের দোকান দেওয়ার স্বপ্ন দেখি। মাসে ৬০০ টাকা ভাড়ায় ২০১২ সালের শেষ দিকে হোটেলটির বারান্দায় হারুন টি হাউসের যাত্রা শুরু হয়। চায়ের দোকানটি আলাদা পরিচিতি লাভ করে। দোকানটিতে চা–প্রেমীর ভিড় লেগেই থাকত। কারণ, আমি গরুর খাঁটি দুধের চা বিক্রি করতাম। যে কারণে নানা সময়ে হোটেলটির মালিকের কটুকথাও সহ্য করতে হয়েছে আমাকে। চায়ের দোকানে ভিড়ের কারণে হোটেলে বেচাকেনায় সমস্যা হচ্ছে—এই ছিল তাঁর কথা। দোকান ছেড়ে দিতে চাপ দেন তিনি।

তবু হাল না ছেড়ে ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করি। চায়ের দোকানটি না ছেড়ে গরুর দুধের চা বিক্রি করা বন্ধ করে দিই। কমে যায় চা–প্রেমীদের ভিড়। এতে মনোমালিন্য বন্ধ হয় হোটেলের মালিকের সঙ্গে।

 চা বিক্রির পাশাপাশি একসময় উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার স্বপ্ন দেখি। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে এসএসসিতে ভর্তি হই। ২০২১ সালে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করি। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০২৩ সালে এইচএসসি পাস করি। আমার চা বিক্রি চলতে থাকে।

চা বিক্রি, পড়াশোনা, পরিবারের দেখভাল করার পাশাপাশি শতাধিক বই নিয়ে ২০২৩ সালে একই হোটেলের বারান্দায় হারুন পাঠাগার নামে আমার এই উদ্যোগের যাত্রা শুরু করি। ব্যতিক্রমী এই উদ্যোগের প্রশংসাও করেন অনেকে। বাংলাদেশের প্রথম সারির সব গণমাধ্যমেও খবরটি প্রকাশিত হয়। দোকানে নিয়মিত চা খেতে আসা গ্রাহকদের প্রতিবছর বর্ষসেরা চা–প্রেমী সম্মাননা দিই ২০১৭ সাল থেকে। চা বিক্রির পাশাপাশি এই কাজও ব্যতিক্রম হওয়ায় আলোচিত হই।

মানুষকে বইমুখী করার লক্ষ্যে ২০২৩ সালে যাত্রা শুরু হওয়া আমার পাঠাগারে বইয়ের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে দেড় হাজার। পাঠক বেড়ে হয়েছে তিন শতাধিক।

২০২৩ সালের জুন মাসে বাবাকে হারাই। মরণব্যাধি ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করে মৃত্যু হয় তাঁর। সংসারের দায়িত্ব এসে পড়ে আমার কাঁধে।

মা আর ছোট বোনকে নিয়ে তিনজনের সংসারের একমাত্র আয়ের উৎস ছিল চায়ের দোকানটি। ২০২৪ সালের নভেম্বরে ওই জায়গায় থাকা চারটি প্রতিষ্ঠান সরিয়ে নেওয়ার জন্য নোটিশ দেন জায়গার মালিক। যে কারণে দেড় হাজার বই আর চায়ের দোকানটি নিয়ে বিপাকে পড়ে যাই।

বইগুলো নিরাপদে রাখার জন্য একাধিক মানুষের শরণাপন্ন হই; কিন্তু কেউ জায়গা দিতে সম্মত হননি। শেষ পর্যন্ত এগিয়ে আসেন গৌরীপুর কালীখলা মন্দিরের সাধারণ সম্পাদক শংকর ঘোষ। তিনি মন্দিরের পাশে একটি ঘরে পাঠাগারটি পরিচালনার সুযোগ দেন; কিন্তু চায়ের দোকানটি শুরু করতে পারিনি। এখন শুধু বই আর পত্রিকা পড়েই সময় কাটছে আমার।

ছোট বোন বর্তমানে গৌরীপুর সরকারি কলেজে ডিগ্রি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। আমি বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন স্নাতক শ্রেণিতে পড়াশোনা করছি। একজন চা–বিক্রেতা হিসেবে জীবন আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। তবু আশা রাখি এই লড়াই চালিয়ে যাওয়ার।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • এনসিটিবির কারিকুলাম কমিটি থেকে রাখাল রাহাকে অপসরণের দাবি
  • বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে, হুতিদের ওপর মার্কিন হামলার জের
  • বিচারে দীর্ঘসূত্রতা, কুমিল্লায় বাড়ছে নারী ও শিশু ধর্ষণ
  • নাটোরে গ্রেপ্তার যুব মহিলা লীগ নেত্রীকে আদালতে প্রেরণ
  • হাজিরা দিতে এসে মারধরের শিকার কুমিল্লা বারের সাবেক সম্পাদক
  • এসবিএসি ব্যাংকের এমডি হাবিবুর রহমানের পদত্যাগ
  • একজন চা-ওয়ালার স্বপ্ন 
  • ইউরোপে পড়ালেখার এই জনপ্রিয় বৃত্তির সুযোগ কি আপনিও নিতে চান
  • ২০২৩ সালের অনার্স তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষার রুটিন প্রকাশ