প্রায় এক বছর হয়ে গেছে রাসুল মুহাম্মদ (সা.) তার সকল সাহাবিকে নিয়ে মক্কা থেকে মদিনায় চলে এসেছেন। মদিনায় এসে তিনি একটি স্থিতিশীল সমাজ গড়ে তুলতে চান। কিন্তু সহ্য হচ্ছিল না মক্কার কুরাইশদের। যেকোনো মূল্যে এই সৌহার্দ্যপূর্ণ সমাজ এবং ধর্মের ভিত ভেঙে ফেলতে তারা বদ্ধপরিকর। বিশ্বাসগত বিরুদ্ধাচরণ তো ছিলই, নতুন করে শঙ্কা দেখা দিয়েছে দামেস্ক অভিমুখী তাদের বাণিজ্যিক মহাসড়ক নিয়ে। তাই দেরি না করে কুরাইশরা মক্কা থেকে সিরিয়া সীমান্ত পর্যন্ত বাণিজ্যপথের পার্শ্ববর্তী অনেক গোত্রের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি সম্পাদন করতে শুরু করে, যাতে তারা রাসুল (সা.
কিন্তু কুরাইশরা বুঝতে পেরেছিল, এভাবে কেবল প্রতিরোধমূলক কর্মকাণ্ডের দ্বারা তারা তাদের বাণিজ্যপথ নিরাপদ রাখতে পারবে না। মদিনার সব শাখা গোত্র যদি এক জোট হয়ে আক্রমণে বেরোয়, তাহলে সহজেই যেকোনো বাণিজ্য কাফেলা তছনছ করে ফেলতে পারবে। তাই সব দিক বিবেচনা করে কুরাইশরা সিদ্ধান্ত নিল, যেকোনোভাবে নতুন উত্থিত মদিনার শক্তিকে গোড়া থেকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলতে হবে। গোপনে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে লাগল তারা।
আরও পড়ুনঅলৌকিক তিন ঘটনা০২ মার্চ ২০২৫ওদিকে রাসুল (সা.)ও জানেন, মদিনা মুসলিমদের শেষ আশ্রয়স্থল। কোনোভাবে যদি এ আশ্রয় তাঁদের হাতছাড়া হয়ে যায়, তাহলে বেদুইনদের মতো যাযাবর জীবন বেছে নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। ইসলামের আলো অনেকটা নিষ্প্রভ হয়ে পড়বে মরুর ঝঞ্ঝা বাতাসে। আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম আবারও বাধাগ্রস্ত হবে। অবিশ্বাস আর জাহেলিয়াত গ্রাস করে নেবে ইসলামের দীপ্য আলোকশিখা।
সুতরাং সব দিক বিবেচনা করে প্রতিরোধ চিন্তা বাদ দিয়ে তিনি শক্তি প্রদর্শনের সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি কুরাইশদের বাণিজ্য কাফেলায় আক্রমণ করতে উদ্যত হলেন। সাহাবিদের ছোট ছোট দল প্রেরণ করে কুরাইশী বাণিজ্য কাফেলায় আক্রমণের নির্দেশ দিলেন।
কুরাইশদের আয়ের অন্যতম উৎস দামেস্ক ও জেরুজালেমের বিশ্ববাজারের সঙ্গে নানা প্রকার পণ্যের ব্যবসা। তাদের এই দুই শহরে যাওয়ার প্রধান পথ ছিল বদরের পার্শ্ববর্তী এলাকার প্রাচীন পথগুলো। এ পথ গুলোই শত শত বছর ধরে মক্কা ও হেজাজের সঙ্গে বিশ্ববাজারের প্রধান ব্যবসায়িক পথ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। পথগুলো সহজ এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও সহজ।
আরও পড়ুন১৭ রমজান ছিল বদর যুদ্ধ ২৮ মার্চ ২০২৪রাসুল (সা.) কুরাইশদের এ দুর্বলতা ভালোভাবেই জানতেন। আমদানি নির্ভর মক্কার কুরাইশদের অর্থনীতিকে দুর্বল করতে পারলে তাদের আত্মগৌরব তলানিতে এসে ঠেকবে। আয়ের প্রধান উৎস বন্ধ হয়ে গেলে একসময় তারা রাসুলের(সা.) সঙ্গে আপস করতে বাধ্য হবে। ফলে নবীজি (সা.) মদিনা ছাড়িয়ে আরবের প্রতিটি প্রান্তে ইসলামের দাওয়াতকে বিস্তৃত করতে পারবেন। সুতরাং, অনেক কিছুই নির্ভর করছে কুরাইশদের বাণিজ্যপথগুলো অধিকারের ওপর। অবস্থানগত দিক দিয়েও তিনি সুবিধাজনক অবস্থায় আছেন। আরবের এমন এক স্থানে মদিনার অবস্থান, মক্কা থেকে উত্তরে সিরিয়ায় যেতে হলে মদিনাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। নবীজি (সা.) সেই সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করছেন।
মক্কার কুরাইশরা নিজেদের বাণিজ্যপথ নিরুপদ্রব রাখতে মক্কা থেকে সিরিয়া সীমান্ত পর্যন্ত সব আরবীয় গোত্রের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতামূলক চুক্তি সম্পন্ন করে নিয়েছিল। এবার রাসুল(সা.)ও সে পন্থা অনুসরণ করলেন। যেহেতু এর আগে আশপাশের অঞ্চলে কয়েকটি সামরিক অভিযান পরিচালনা করে ইসলামি সেনাদলের প্রাথমিক পরিচয়পর্ব সম্পন্ন হয়েছে, এবার সেটা জানান দেওয়ার পালা। আরবের সব গোত্র ইতিমধ্যে জেনে গেছে, মুহাম্মদ (সা.) বংশ-গোত্রনির্বিশেষে নতুন এক সেনাদলের অধিপতি হয়েছেন। তাঁর বাহিনীতে রয়েছে আউস-খাজরাজের ঐতিহ্যবাহী যোদ্ধারা, আছে হামজার মতো সিংহ হৃদয়, উমরের মতো সাহসী আর আলি এবং সাদের মতো একদল তরুণ যুবা, যারা যেকোনো সময় বদলে দিতে পারে পুরোনো আরবের ভূরাজনৈতিক মানচিত্র।
আরও পড়ুনবদর যুদ্ধের ইতিহাস: বদর যুদ্ধক্ষেত্রে একটি দিন০৯ এপ্রিল ২০২৩এবার কুরাইশ এবং সব গোত্রীয় জনপদকে জানাতে হবে—এরা আর সেই নির্যাতিত মুসলিম নেই। চাবুকের আঘাতে যারা কখনো প্রত্যুত্তর করত না, আজ তাদের তরবারি স্ফুলিঙ্গের মতো কথা বলতে শুরু করেছে। মরুভূমির তপ্ত পাথরে শুইয়ে যাদের রক্ত-ঘামে রঞ্জিত হতো সোনালি বালি, আজ সেই সোনালি মরু তাদের পদভারে কম্পমান।
হিজরতের পর এক বছর পার হয়ে গেল। বেশ একটা সংক্ষুব্ধ সময় যাচ্ছিল তখন। প্রতি মাসে মদিনা থেকে সেনাদল বের হচ্ছিল আক্রমণের উদ্দেশ্যে। তাদের আক্রমণে তটস্থ ও অস্থির হয়ে উঠছিল মক্কার কুরাইশরা। মক্কা ও মদিনা—উভয় জনপদই ভেতরে-ভেতরে ফুঁসছিল একে অপরকে পরাভূত করার জন্য। তাদের ফুঁসে ওঠা অগ্নি লাভার দরুন আশপাশের গোত্রগুলো শঙ্কিত হয়ে প্রহর গুনছিল যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠার।
আরও পড়ুনযে জুব্বা পরে তিনি বদর যুদ্ধে অংশ নেন সেটি দিয়েই তাঁকে দাফন করা হয়০৬ মার্চ ২০২৪রাসুলের (সা.) শক্তি প্রদর্শনের আরেকটি কারণও ছিল। তিনি মক্কার কাফেলাগুলোতে আক্রমণ করে তাদের উসকে দিচ্ছিলেন যুদ্ধের জন্য। কেননা, গোয়েন্দা প্রতিবেদন এবং ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ দিয়ে তিনি বুঝতে পারছিলেন, কুরাইশরা মোটেও বসে নেই। মুসলিমদের মদিনা থেকে উৎখাত করতে খুব শিগগির তারা বড় ধরনের আক্রমণ শানাবে। কিন্তু রাসুল (সা.) চাচ্ছিলেন, কুরাইশদের সঙ্গে সম্ভাব্য লড়াইটা যেন মদিনা ও তার নিকটবর্তী অঞ্চলে না হয়ে দূরবর্তী কোথাও সংঘটিত হয়। মদিনায় আক্রমণ হলে তার পরিণতি ভয়াবহ হবে—এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ কারণে তিনি মদিনা থেকে দূরবর্তী স্থানে কুরাইশদের আক্রমণ করে সম্ভাব্য যুদ্ধের গতিপথ ঠিক করছিলেন। একই সঙ্গে সেনাদল পাঠিয়ে বাণিজ্য কাফেলার নিরাপত্তা-সংক্রান্ত তথ্যও সংগ্রহ করছিলেন।
মক্কা থেকে যেসব সাহাবি নিঃস্ব অবস্থায় মদিনায় চলে এসেছিলেন, তাঁদের সকল স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি মক্কাতেই রয়ে গিয়েছিল। কুরাইশরা তাদের কোনো সম্পদ নিয়ে আসতে দেয়নি। দেশান্তরী এসব সাহাবির সব সম্পদ মক্কার কুরাইশ নেতারা নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে ভোগ করছিল। এ কারণে বাণিজ্য কাফেলায় আক্রমণ করে সে ক্ষতি কিছুটা হলেও পুষিয়ে নেওয়ার সুযোগ ছিল তাঁদের সামনে।
সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর : আলেম ও লেখক
আরও পড়ুনদুই কিশোরের বীরত্বে মারা গেল আবু জাহেল১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: বদর য দ ধ ক র ইশর মদ ন র স ন দল মদ ন য় অবস থ আরব র ইসল ম
এছাড়াও পড়ুন:
শেখ পরিবারের ৩৯৪ কোটি টাকা অবরুদ্ধ
ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, ছোট বোন শেখ রেহানা ও তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্টদের নামে বিভিন্ন ব্যাংকে থাকা ৩১টি হিসাব অবরুদ্ধের আদেশ দিয়েছেন ঢাকার আদালত। এসব ব্যাংক হিসাবে ৩৯৪ কোটি ৬০ লক্ষ ৭২ হাজার ৮০৫ টাকা জমা রয়েছে। এ নিয়ে শেখ হাসিনা পরিবারের মোট অবরুদ্ধ টাকার পরিমাণ দাঁড়ালো ১ হাজার ৪৯ কোটি ৬৫ লক্ষ ৭২ হাজার ১১৮ টাকা।
মঙ্গলবার ঢাকা মহানগর জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ জাকির হোসেন গালিবের আদালত দুদকের আবেদন মঞ্জুর করে এ আদেশ দেন।
এদিন এসব ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধের আবেদন করেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উপ-পরিচালক মনিরুল ইসলাম।
আবেদনে বলা হয়, অভিযোগ সংশ্লিষ্ট শেখ হাসিনা, তার ছেলে সজীব আহমেদ ওয়াজেদ জয়, তার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, তার ছোট বোন রেহানা সিদ্দিক ও তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্টরা বর্ণিত অ্যাকাউন্টের অস্থাবর সম্পদসমূহ অন্যত্র হস্তান্তর, স্থানান্তর বা বেহাত করার চেষ্টা করছেন। সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে উক্ত হিসাবসমূহ অবিলম্বে অবরুদ্ধ করা আবশ্যক।
এর আগে গত ১১ মার্চ শেখ হাসিনা, তার স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ও পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা ১২৪টি ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধের আদেশ দেন একই আদালত। এর মধ্যে ১২৩টি ব্যাংক হিসাবে মোট ৬৫৫ কোটি চার লাখ ৯৯ হাজার ৩১৩ টাকা রয়েছে। অন্য একটি অ্যাকাউন্টে শূন্য দশমিক ৬৮ ডলার রয়েছে বলে দুদকের আবেদন সূত্রে জানা যায়।
এদিকে একই দিন শেখ হাসিনা, তার ছেলে জয়, মেয়ে পুতুল, বোন শেখ রেহেনা, রেহেনার সন্তান রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ও টিউলিপ রিজওয়ানা সিদ্দিকের নামে থাকা জমিসহ বাড়ি ও ফ্ল্যাট জব্দের আদেশ দেওয়া হয়। জব্দ হওয়া সম্পদের মধ্যে রয়েছে, টিউলিপ সিদ্দিকের নামে গুলশানের ফ্ল্যাট, যার দলিল মূল্য ৪৩ লাখ ২৪ হাজার ৯২০ টাকা। সজীব ওয়াজেদ জয় ও সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের নামে ধানমন্ডিতে থাকা ১৬ কাঠা জমিসহ বাড়ি, যার দলিল মূল্য তিন কোটি ৩০ লাখ টাকা।
রেহেনা সিদ্দিকের জব্দকৃত সম্পত্তির মধ্যে রয়েছে, গাজীপুরের কালিয়াকৈরে আট লাখ ৭৫ হাজার ৫০০ টাকার সাড়ে ৮ শতাংশ জমি, একই জায়গার তিন লাখ টাকা মূল্যের ১ দশমিক ৫৫ শতাংশ জমি ও সেগুনবাগিচায় ১৮ লাখ টাকা মূল্যের ফ্ল্যাট। এছাড়াও রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিকের নামে গুলশানে থাকা ছয়টি ফ্ল্যাট জব্দের আদেশ দেওয়া হয়েছে।