Prothomalo:
2025-04-15@13:07:22 GMT

পুলিশ কেন স্বাধীন কমিশন চায়

Published: 18th, March 2025 GMT

গত ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যদের অভূতপূর্ব ও অনাকাঙ্ক্ষিত অভিজ্ঞতা ও তিক্ত পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে।

এরপর সমস্বরে সব স্তরের পুলিশ সদস্যরা একটি দাবি তুলেছিলেন। তা হলো, পুলিশ স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে চায়।

পুলিশ কোনো রাজনৈতিক নেতৃত্বের আর তাঁবেদারি করতে চায় না। বাংলাদেশ পুলিশে কর্মরত ২ লাখ ১২ হাজারের বেশি পুলিশ সদস্যের মধ্যে বিভিন্ন ইস্যুতে ভিন্ন মত-পথ থাকলেও এই ইস্যুতে তাঁরা সবাই একমত হয়েছিলেন, তাঁরা সবাই রাষ্ট্রের বাহিনী হিসেবে নিরপেক্ষ ও স্বাধীনভাবে কাজ করতে চান।

৫ আগস্ট–পরবর্তী সময়ে পুলিশের সংস্কার নিয়ে ইউনিট পর্যায় থেকে আসা বিভিন্ন সংস্কার প্রস্তাবের প্রায় শতভাগ ইউনিটের প্রধান দাবি বা প্রস্তাব ছিল, বাংলাদেশ পুলিশকে পরিচালনার জন্য স্বাধীন একটি কমিশন গঠন করা হোক।

আরও পড়ুনপুলিশের যে সমস্যাগুলোর কথা কেউ বলে না ০৯ মার্চ ২০২৫

বাংলাদেশ পুলিশের সব পর্যায়ের সব স্তরের পুলিশ সদস্যরা কেন এমন দাবি তুলেছিলেন, তার সবচেয়ে ভালো ব্যাখ্যা দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, পতিত স্বৈরাচার পুলিশকে দলীয় কর্মীর মতো ব্যবহার করেছে। বাধ্য হয়ে তাঁদের অনেকেই গণহত্যায় অংশ নিয়েছেন। খুবই স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে তাঁরা জনরোষের শিকার হয়েছেন (ঢাকা পোস্ট, ১৭ নভেম্বর ২০২৪)।

প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য থেকে একটি বিষয় নিশ্চিত যে পতিত সরকার আইনকে তোয়াক্কা না করে পুলিশকে তাদের কর্মীর মতো ব্যবহৃত হতে বাধ্য করেছে। ফলে এই আন্দোলনে কমপক্ষে ৪৪ জন পুলিশ সদস্য হত্যার শিকার হয়েছেন (প্রথম আলো, ১৮ আগস্ট ২০২৪)।

থানা, পুলিশ অফিস, পুলিশ লাইনসসহ অন্তত ৪৬০টি পুলিশ অবকাঠামো এবং পুলিশের ১ হাজার ৭৪টি যানবাহন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে (বার্তা বাজার, ১ ডিসেম্বর ২০২৪)।

২০২৪–এর পয়লা জুলাই থেকে শুরু হওয়া কোটা আন্দোলন পরবর্তী সময়ে সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নেওয়ার এই ৩৬ দিনের জার্নিতে বাংলাদেশ পুলিশের সঙ্গে সরকারের বিভিন্ন বাহিনী, সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানগুলো মাঠে থেকে কাজ করেছে।

কিন্তু এককভাবে পুলিশ সদস্য, পুলিশ স্থাপনা ও পুলিশের যানবাহনকে টার্গেট করে আক্রমণ করা নিশ্চিতভাবেই পুলিশের প্রতি মানুষের দীর্ঘদিনের ক্ষোভ কিংবা পুলিশের নেতিবাচক ভূমিকার প্রতি মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ।

আরও পড়ুনপুলিশ সংস্কারের সুপারিশ: যা কিছু বাদ পড়ে গেল২২ জানুয়ারি ২০২৫

কিন্তু প্রশ্নটি হলো, এটি কেন হলো? আইনানুযায়ী পুলিশের প্রতিটি পদক্ষেপ আইনের মাধ্যমে নির্ধারিত ও লিখিত হওয়ার কথা।

এ ছাড়া বিদ্যমান সরকারি নিয়ন্ত্রণ কাঠামোতে পুলিশ সরকারের অধীনে থাকা একটি প্রতিষ্ঠানমাত্র।

তাহলে প্রশ্ন হলো, বিদ্যমান আইন, বিধি ও নিয়ন্ত্রণ কাঠামো থাকার পরও পুলিশ কীভাবে দলীয় কর্মীর মতো ব্যবহৃত হলো বা হতে বাধ্য হলো?

কেন পুলিশ এই নির্দেশের বাইরে যেতে পারেনি?

কার ভুলে পুলিশ সদস্যরা জীবন হারালেন?

কেন আজও পুলিশ মাঠপর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে জনরোষের শিকার হচ্ছেন?

পুলিশের ওপর এমন অকল্পনীয় ঝড় বয়ে যাওয়ার পর কেন পুলিশ সদস্যরা সমস্বরে স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনের দাবি জানালেন?

সত্যিকার অর্থেই যদি বাংলাদেশ পুলিশকে জনগণের পুলিশ কিংবা এই রাষ্ট্রের পেশাদার বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলতে হয়, অতীতের এসব ভুলের কারণ ও এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা জরুরি।

১৮২৯ সালে ব্রিটিশ মেট্রোপলিটন পুলিশ অ্যাক্ট পাস হয়। অন্যদিকে সিপাহি বিদ্রোহের পর ভারতীয় উপমহাদেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শাসনের অবসান হলে সরাসরি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে যাওয়ার পর ১৮৬১ সালে পুলিশ অ্যাক্ট ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাস হয়, যা বর্তমান বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানসহ ওই সময়ের ব্রিটিশ শাসনের অধীনে থাকা উপমহাদেশের সব অঞ্চলের জন্য প্রযোজ্য হয়।

আরও পড়ুনআমরা পুলিশ, বিশ্বাস করুন আমরা আপনাদের শত্রু নই০৬ আগস্ট ২০২৪

আপনি যদি এই দুটি আইনের প্রথম পাঠকে পাশাপাশি রেখে তুলনা করেন, তাহলে দেখবেন, ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাস হওয়া এই দুটি পুলিশ আইনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন।

যেখানে ব্রিটিশ মেট্রোপলিটন পুলিশ অ্যাক্ট অনুযায়ী, পুলিশকে জনগণের আস্থা অর্জনের প্রতি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, সেখানে ভারতীয় উপমহাদেশের জন্য পাস করা পুলিশ অ্যাক্ট–১৮৬১–এর অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ শাসনকে টিকিয়ে রাখা।

আরও অবাক করা বিষয় হলো, সময়ের সঙ্গে ব্রিটিশ মেট্রোপলিটন পুলিশ অ্যাক্টকে পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংযোজন, বিয়োজন, আধুনিকায়ন করা হয়েছে।

পক্ষান্তরে আমাদের বিদ্যমান পুলিশ অ্যাক্টকে পাকিস্তান আমলে কিছু নাম আর টার্মকে পরিবর্তন করেছি, আরেকবার বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও কিছু নাম আর টার্মকে পরিবর্তন করেছি।

এর বাইরে আপনি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনটি দেখবেন, তা হলো ব্রিটিশ আমলে ইন্সপেক্টর জেনারেলকে যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল, যা পর্যায়ক্রমিকভাবে সংকুচিত করে দেওয়া হয়েছে।

আরও সহজ করে বললে ব্রিটিশ আমলের করা আইনে ইন্সপেক্টর জেনারেল যেসব বিষয়ে স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন, সময়ের সঙ্গে তাঁর ক্ষমতাকে সংকুচিত করে পুরোপুরি সরকারের আজ্ঞাবহ করে ফেলা হয়েছে।

আরও মজার বিষয় হলো, রাস্তায় সংঘটিত বিভিন্ন অপরাধের (জন উপদ্রব বা পাবলিক নুইসেন্স) জন্য পুলিশ আইনানুযায়ী অনূর্ধ্ব ৫০ টাকার জরিমানা করার বিধানটি এখনো বহাল আছে (দেখুন পুলিশ অ্যাক্ট ১৮৬১–এর ৩৪ ধারা)!

অথচ মানুষ পুলিশের কাজকে সরকারি কাজ হিসেবে বিবেচনা না করে বরং পুরো ক্ষোভটাই পুলিশের ওপর ঝাড়ল। নিহত হলেন, আহত হলেন অসহায় পুলিশ সদস্যরা। কিছু ব্যতিক্রম বাদে নিজের অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাঁদের দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। জনগণের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়েছে। সত্যিকার অর্থে, স্বাধীন পুলিশ কমিশন ও পুলিশ আইন সংস্কার করার দাবির মাধ্যমে পুলিশ যেকোনো কর্তৃপক্ষের অবৈধ, অন্যায় ও বেআইনি হুকুমকে জোরালোভাবে ‘না’ বলার সুযোগ চায়।

গত জুলাই আন্দোলনকে ঘিরে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন।

প্রশ্ন তোলার মতো যথেষ্ট কারণও আছে। কিন্তু এখন যদি পাল্টা প্রশ্ন করা হয়, বিদ্যমান আইনে সরকারি সিদ্ধান্তকে মান্য না করার জন্য পুলিশের কি আইনি সুযোগ বা সুরক্ষা আছে?

পুলিশ আইন ১৮৬১–এর ২৩ ধারা অনুযায়ী, ‘প্রত্যেক পুলিশ কর্মকর্তার দায়িত্ব ও কর্তব্য হইবে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রদত্ত সকল বৈধ আদেশ ও পরোয়ানা দ্রুত পালন ও কার্যকর করা।’

অথচ এই আইনের কোথাও আপনি উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ থেকে প্রাপ্ত আদেশের বৈধতা বা অবৈধতা নিরূপণ বা চ্যালেঞ্জ করার কোনো সুযোগ নেই।

এমনকি অবৈধ আদেশ না মানার সুযোগ বা এ–সংক্রান্ত কোনো আইনি সুরক্ষা দেওয়া হয়নি। কাজেই বিদ্যমান আইনে পুলিশ সরকারের হুকুম মানতে বাধ্য।

এ কারণেই গত জুলাই আন্দোলনে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তৎকালীন সরকারের নির্দেশনা মেনেই পুলিশকে বল প্রয়োগ করতে হয়েছে।

আপনি হয়তো আমার সঙ্গে দ্বিমত হতে পারেন, তবে বিদ্যমান আইনানুযায়ী এর বিকল্প কিছু করার সুযোগ কি পুলিশের ছিল বা আছে?

পুলিশ যদি সরকারের আদেশ না মানত, তাহলে সেটি কি পুলিশ আইনের লঙ্ঘন হতো না?

অথচ মানুষ পুলিশের কাজকে সরকারি কাজ হিসেবে বিবেচনা না করে বরং পুরো ক্ষোভটাই পুলিশের ওপর ঝাড়ল। নিহত হলেন, আহত হলেন অসহায় পুলিশ সদস্যরা। কিছু ব্যতিক্রম বাদে নিজের অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাঁদের দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। জনগণের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়েছে।

সত্যিকার অর্থে, স্বাধীন পুলিশ কমিশন ও পুলিশ আইন সংস্কার করার দাবির মাধ্যমে পুলিশ যেকোনো কর্তৃপক্ষের অবৈধ, অন্যায় ও বেআইনি হুকুমকে জোরালোভাবে ‘না’ বলার সুযোগ চায়।

রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত থেকে বিদ্যমান আইনানুযায়ী দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে সত্যিকার অর্থেই একটি পেশাদার বাহিনী হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াতে চায়।

যেখানে যেকোনো রাজনৈতিক শক্তি তাদের নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য পুলিশকে ব্যবহার করতে পারবে না।

পুলিশ এমন একটি ব্যবস্থা চায়, যেখানে জবাবদিহির আওতায় থেকেই বাংলাদেশ পুলিশ স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারবে।

বাংলাদেশ পুলিশের এই চাওয়া কি খুব বেশি অযৌক্তিক? এটি কি গণমানুষের চাওয়া নয়? আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মাণে এর বিকল্প আছে কি?

মো.

ইমরান আহম্মেদ, পিপিএম, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, বাংলাদেশ পুলিশ এবং বর্তমানে পিএইচডি গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব ওয়ারউইক, যুক্তরাজ্য।
ই–মেইল: [email protected]

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: প ল শ সদস য আইন ন য য় প ল শ আইন র জন য প সরক র র জনগণ র ক জ কর অন য য় পর য য় আগস ট ব যবহ আইন র

এছাড়াও পড়ুন:

মেঘনা আলমকে আটক কেন জাতীয় ইস্যু হলো

মডেল মেঘনা আলমকে আটক এবং তাঁকে কারাগারে পাঠানোর বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একজন মন্তব্য করেছিলেন, এ ঘটনা অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য ‘পচা শামুকে পা কাটা’র মতো হতে পারে। ব্যক্তিপর্যায়ের একটি ‘সাধারণ’ বিষয়কে ‘জাতীয় ইস্যু’তে পরিণত করা এবং এর ফলে সরকারের জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি হওয়া—এমন কিছু বোঝাতেই তিনি হয়তো মন্তব্যটি করেন। বাস্তবে তেমনটাই ঘটেছে আর এর মধ্য দিয়ে আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং খোদ সরকারসংশ্লিষ্ট কারও কারও ‘অপরিণামদর্শিতা’ আবারও জনসমক্ষে প্রকাশিত হয়েছে।

২.

একাধিক সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মডেল মেঘনা আলমের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের একটি শক্তিশালী দেশের বাংলাদেশে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। পরে সেই সম্পর্কে টানাপোড়েন তৈরি হয়। এর জেরেই মেঘনা আলমকে আটক করা হয়।

গত বুধবার রাতে মেঘনা আলমকে রাজধানীর বসুন্ধরার বাসা থেকে আটক করতে যায় ডিবি পুলিশ। এ সময় তিনি ফেসবুক লাইভে ছিলেন। সেই লাইভে তিনি বলছিলেন, তাঁর দরজার বাইরে পুলিশ পরিচয়ধারীরা তাকে নিতে এসেছে। মেঘনা আলমের ফেসবুক লাইভ চলার সময়ই তাঁর বাসায় পুলিশ প্রবেশ করে এবং তখন লাইভ বন্ধ হয়ে যায়।

আটক হওয়ার আগমুহূর্তে সেই লাইভে মেঘনা আলম বলছিলেন, ‘বাসায় কিছু মানুষ আক্রমণ করেছে। তারা নিজেদেরকে পুলিশ পরিচয় দিচ্ছে। আমি বলেছি থানায় এসে কথা বলব, তারা কথা শুনছে না।’ লাইভ ভিডিওতে মেঘনা আলমকে দরজার বাইরে থাকা লোকদের উদ্দেশে বলতে শোনা যায়, ‘আপনারা আমার দরজা ভাঙার চেষ্টা করছেন।...’ (বিবিসি বাংলা, ১১ এপ্রিল ২০২৫)

ঘটনাক্রম থেকে স্পষ্ট, পুলিশ সদস্যরা জোরপূর্বক বাসায় প্রবেশ করে মেঘনা আলমকে তুলে নিয়ে যান। তাঁকে তুলে নেওয়ার বিষয়টি থানা ও ডিবি পুলিশের পক্ষ থেকে স্বীকার করা হয়নি। এর ফলে তাঁকে অপহরণ করা হয়েছে কি না, এমন একটি আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল।

বুধবার রাতে মেঘনা আলমকে তুলে নেওয়ার পর বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১০টায় তাঁকে চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে উপস্থাপন করা হয়। এরপর বিশেষ ক্ষমতা আইনে ৩০ দিনের আটকাদেশ দিয়ে মেঘনা আলমকে কারাগারে পাঠানো হয়। আটক করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারের পাঠানোর পরও পুলিশের পক্ষ থেকে তাঁর অবস্থান সম্পর্কে কোনো কিছু জানানো হয়নি।

মেঘনা আলমকে যেভাবে আটক করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে, সেই ঘটনাটি জানাজানি হলে দেশে-বিদেশে আলোচনা-সমালোচনা ও প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। দেশের মানবাধিকারকর্মীদের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো বিষয়টি নিয়ে তাদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা-নিন্দা জানায়। এতে সরকারের ওপর একরকম দৃশ্যমান চাপ তৈরি হয়।

মেঘনা আলমের গ্রেপ্তার নিয়ে ঢাকা মেট্রোপলিট্রন পুলিশ (ডিএমপি) শুক্রবার তাদের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে একটি পোস্ট দেয়। এতে মেঘনা আলমকে অপহরণ করার অভিযোগ সঠিক নয় দাবি করে বলা হয়, ‘রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত করা, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি সম্পর্ক মিথ্যাচার ছড়ানোর মাধ্যমে আন্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক অবনতির অপচেষ্টা করা এবং দেশকে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার অভিযোগে মেঘনা আলমকে সকল আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে নিরাপত্তা হেফাজতে রাখা হয়েছে।...’

পুলিশের এ ‘বিবৃতি’টি ছিল অস্পষ্ট ও অসংগতিপূর্ণ । এতে একধরনের ঢালাও অভিযোগ করা হয়েছে, যেখানে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। ৩০ দিনের আটকাদেশ দিয়ে মেঘনা আলমকে কারাগারে পাঠানোর বিষয়টিকে তারা ‘নিরাপত্তা হেফাজত’ বলে বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করেছে; ‘সকল আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ’ করার দাবিটি ছিল অসত্য ও বানোয়াট।

লক্ষণীয় হলো, পুলিশের পক্ষ থেকে দেওয়া ওই পোস্টটি শুক্রবার নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে শেয়ার দিয়েছিলেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। এর ফলে মেঘনা আলমকে আটক ও কারাগারে পাঠানোর সিদ্ধান্তে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের সায় বা সম্মতি আছে, এমনটাই প্রতীয়মান হয়েছিল। তবে শফিকুল আলম পরে সেই পোস্টটি সরিয়ে নেন।

৩.

মেঘনা আলমকে যেভাবে আটক করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে, সেই ঘটনাটি জানাজানি হলে দেশে-বিদেশে আলোচনা-সমালোচনা ও প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। দেশের মানবাধিকারকর্মীদের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো বিষয়টি নিয়ে তাদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা-নিন্দা জানায়। এতে সরকারের ওপর একরকম দৃশ্যমান চাপ তৈরি হয়।

এ রকম অবস্থায় রোববার (১৩ এপ্রিল) ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) প্রধানের পদ থেকে রেজাউল করিম মল্লিককে সরিয়ে দেওয়ার খবর পাওয়া যায়। এরপর দুপুরের দিকে এক সংবাদ সম্মেলনে আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল জানান, মেঘনা আলমকে বিশেষ ক্ষমতা আইনে যে প্রক্রিয়ায় আটক করা হয়েছে, সেটা সঠিক হয়নি। (প্রথম আলো অনলাইন, ১৩ এপ্রিল ২০২৫)

আইন উপদেষ্টার এ বক্তব্যের পর যে প্রশ্নগুলো সামনে আসে তা হলো, যে প্রক্রিয়ায় আটক করা হয়েছে, সেটা সঠিক না হলে মেঘনা আলমকে আটক রাখা হচ্ছে কেন? এ আটকাদেশ কি বেআইনি বা অবৈধ নয়? তাঁর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ থাকলে সেই অভিযোগে কেন মামলা করা হয়নি?

মেঘনা আলমকে আটকের প্রক্রিয়া ও আটকাদেশের বৈধতা নিয়ে তাঁর বাবা বদরুল আলম হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করেছিলেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে মেঘনা আলমকে পরোয়ানা ছাড়া গ্রেপ্তার, কারণ উল্লেখ না করে গ্রেপ্তার, ২৪ ঘণ্টার বেশি গোয়েন্দা কার্যালয়ে হেফাজতে রাখা এবং তাঁর মুক্তি প্রশ্নে রুল দেন হাইকোর্ট। বিশেষ ক্ষমতা আইনে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে মেঘনা আলমকে দেওয়া আটকাদেশ কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, তা রুলে জানতে চাওয়া হয়। (মডেল মেঘনা আলমের আটকাদেশ কেন অবৈধ নয়: হাইকোর্ট, প্রথম আলো অনলাইন, ১৩ এপ্রিল ২০২৫)

৪.

মেঘনা আলমের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের অভিযোগ থাকলে সুনির্দিষ্ট সেই অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করা যেত এবং ফৌজদারি কার্যবিধি অনুসরণ করে ব্যবস্থা নেওয়া যেত। কিন্তু তাঁকে বিশেষ ক্ষমতা আইনে আটক করে কারাগারে পাঠানোর ফলে এটি ‘জাতীয় ইস্যু’তে পরিণত হয়েছে। এর কারণ, বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বিতর্কিত ও সমালোচিত আইনগুলোর একটি হলো বিশেষ ক্ষমতা আইন।

একটি বিশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ১৯৭৪ সালে এ আইনটি প্রণয়ন করা হয়েছিল। এ আইনের বড় সমস্যা হলো, এ আইনে আটক ব্যক্তি আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পান না; আইনের পরিধি এতটাই বিস্তৃত, সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ ছাড়াই যে কাউকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে আটকে রাখা যায়। বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে দমনের জন্য বিভিন্ন সময়ে এ আইনটি ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, এ রকম বহু অভিযোগ রয়েছে।

আরও পড়ুনগণতান্ত্রিক প্রতিশ্রুতি প্রশ্নবিদ্ধ১৩ এপ্রিল ২০২৫

অতীতে বিশেষ ক্ষমতা আইন রাজনৈতিক দলের নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে বেশি ব্যবহৃত হয়েছে; সাধারণ নাগরিকের ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ ছিল বিরল। তা ছাড়া নানা রকম সমালোচনার কারণে সাম্প্রতিক সময়ে এ আইন প্রায় ‘অব্যবহৃত’ ছিল। এ রকম অবস্থায় একজন নারীর বিরুদ্ধে এ আইনের প্রয়োগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার হিসেবেই প্রতীয়মান হচ্ছে।

বিশেষ ক্ষমতা আইন ব্যবহার করে মেঘনা আলমকে আটকের পর কারাগারে পাঠানোর ঘটনায় গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক অফিস নিজেদের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দেওয়া এক পোস্টে বলেছে, ‘এ কালো আইন ঐতিহাসিকভাবে দীর্ঘদিন ধরে মানুষকে অভিযোগ ও বিচারিক তত্ত্বাবধান ছাড়াই নির্বিচার আটকের জন্য ব্যবহার করা হয়ে আসছে। এসব কাজের মধ্য দিয়ে প্রক্রিয়াগত সুরক্ষা এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের মান ও প্রয়োগ গুরুতরভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে।’ (প্রথম আলো অনলাইন, ১২ এপ্রিল ২০২৫)

মেঘনা আলমকে যেভাবে বা যে প্রক্রিয়ায় আটক করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে, তা নাগরিক অধিকার হরণে আমাদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির চরম অভাবকে স্পষ্ট করেছে। একই সঙ্গে তা আমাদের আইনি কাঠামোর বিশ্বাসযোগ্যতা, মানবিকতা এবং অন্তর্বর্তী সরকারের গণতান্ত্রিক প্রতিশ্রুতিকে ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

বিশেষ ক্ষমতা আইনে মেঘনা আলমের আটকাদেশকে ফ্যাসিবাদী তৎপরতা ও স্বৈরাচারী আচরণের প্রকাশ বলে অভিহিত করেছে গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি। তারা বলেছে, বিশেষ ক্ষমতা আইন একটি ফ্যাসিবাদী আইন। গণ–অভ্যুত্থান পরবর্তী রাষ্ট্রে বিশেষ ক্ষমতা আইনসহ নিপীড়নমূলক কোনো আইন থাকতে পারে না। জুলাইয়ে ছাত্র–জনতার বিপুল রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তর যখন জনগণের আকাঙ্ক্ষা হয়ে উঠেছে, তখন এ রকম আইনের ব্যবহার আবার ফ্যাসিবাদী তৎপরতার প্রকাশ ঘটিয়েছে। (প্রথম আলো অনলাইন, ১২ এপ্রিল ২০২৫)

৫.

বিশেষ ক্ষমতা আইনে মেঘনা আলমকে আটক করা নিয়ে মঙ্গলবার (১৫ এপ্রিল) প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী খোদা বখস চৌধুরী বলেন, ‘মেঘনা আলমের সঙ্গে এই আইন প্রথম ব্যবহৃত হচ্ছে, বিষয়টা তা নয়।’ (প্রথম আলো অনলাইন, ১৫ এপ্রিল ২০২৫)। তাঁর এ বক্তব্যের পর প্রশ্ন ওঠে, একটি বিতর্কিত আইন আগে ব্যবহৃত হয়েছে, শুধু এই যুক্তিতেই কি সেটা বৈধ বা গ্রহণযোগ্য হতে পারে? এ রকম হলে বিগত স্বৈরাচারী আমলের অনেক কিছুই এখন বৈধ বা গ্রহণযোগ্য বলে মেনে নিতে হবে!

গণ–অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসনের পতনের মধ্য দিয়ে আট মাসের বেশি সময় আগে দায়িত্ব নিয়েছিল অন্তর্বর্তী সরকার। এ সরকারের কাছে জনগণের প্রত্যাশা হলো, তারা রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তর বা সংস্কার করবে। এ রকম অবস্থায় বিশেষ ক্ষমতা আইনের মতো একটি ‘স্বৈরাচারী’ আইনের প্রয়োগ অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। আইন–আদালতসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিপীড়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার সংস্কৃতি যে এখনো বহাল রয়েছে, এটা খুবই স্পষ্ট।

লক্ষণীয় হলো, বেশ কয়েকজন মানবাধিকারকর্মী অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁরা দায়িত্বে থাকা অবস্থায় বিশেষ ক্ষমতা আইনের এ রকম প্রয়োগ খুবই হতাশাজনক।

এ আইন গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসনের প্রতি হুমকিস্বরূপ, এটা তাঁদের অজানা নয়। এই আইন বাতিল না করলে মানবাধিকার নিয়ে তাঁদের অঙ্গীকার প্রশ্নবিদ্ধ হবে এবং জনমনে এমন ধারণাই পোক্ত হবে, ‘যে যায় লঙ্কায়, সেই হয় রাবণ’।

মনজুরুল ইসলাম প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক

সম্পর্কিত নিবন্ধ