হাতিরঝিল পার হওয়ার আগেই মুঠোফোনের মেসেজে দেখলাম লেখা, ‘মিটিং অ্যাট ১.০০ পিএম।’ বেশ অবাক হলাম। এ রকম তো হওয়ার কথা নয়। এটা জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের সঙ্গে সভা। প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফোন করে আমাকে জানিয়েছেন (১৫ মার্চ) বেলা ১টা ৩০ মিনিটে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে এ সভা অনুষ্ঠিত হবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকেও এ কথা জানানো হয়েছে এবং আমাকে কনফার্ম করতে বলা হয়েছে। আমি কনফার্ম করেছি। সেই অনুযায়ী আমি রওনা হয়েছি। এখন ফোনে পৌনে একটা বাজে। হঠাৎ এই ফোনে এই মেসেজ দেখলাম। আমি ঢাকার জাতিসংঘের মিশনের মিনা খানকে ফোন করলাম। বললাম, ঢাকার যা ট্রাফিক, সরাসরি যেতে পারলে পৌঁছাতে পারতাম। কিন্তু তা তো পারব না, দেরি হবে। তিনি বললেন, আমাদের একটু মুশকিল হয়েছে। অসুবিধা নেই। আপনার দেরি হলেও আমি ভেতরে ঢুকিয়ে নেব।

একটা সাসপেন্স তো মনের মধ্যে ছিল। জাতিসংঘের মহাসচিব বলে কথা। নোবেল বিজয়ীদের নিয়েও একটা সাসপেন্স কাজ করত। কিন্তু অধ্যাপক ইউনূসকে দেখতে দেখতে (আর আমি তো তিনি নোবেল পাওয়ার আগে থেকেই তাঁকে দেখছি) ব্যাপারটা কেমন ডালভাতের মতো হয়ে গেছে।

কিন্তু জাতিসংঘের মহাসচিবের ব্যাপার তো তা নয়। আমাকে বলা হয়েছিল, নির্ধারিত ছয়জন মিনিট দুই-তিনেক করে বক্তৃতা করার সুযোগ পাবেন। আপনিও সে রকম একটা বিরল সুযোগের অধিকারী হবেন। ৭৫ বছর বয়সেও একটা থ্রিল কাজ করা শুরু করল আমার মধ্যে। কী ব্যাপারে বলব তাঁর সামনে? নির্দিষ্ট কোনো বিষয় আছে? আমি জানতে চেয়েছিলাম। জবাবে আমাকে বলা হয়েছিল, এই যে আমরা আমাদের দেশে সংস্কার করার চেষ্টা করছি, তার ওপরে বলবেন।

এখন সভা-টভা সব শেষ হয়ে গেছে। আন্তোনিও গুতেরেস তাঁর কর্মস্থলে ফিরে গেছেন। এখন মনে হয়, এই সভা ডাকা হয়েছিল জাতিসংঘের মহাসচিবকে বাংলাদেশের সংস্কার কার্যক্রম সম্পর্কে সম্যক ধারণা দিতে। এ জন্যই সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যানদের ডাকা হয়েছিল। ডাকা হয়েছিল রাজনৈতিক দলের নেতাদের। তাঁরা সংস্কার নিয়ে কথা বলেছিলেন। কে, কী বলেছিলেন, সেটা আপনারা মিডিয়ার মাধ্যমে আশা করি শুনেছেন। আমি তেমন কিছু বলিনি। কারণ, আমার মনে হয়েছিল, আমাদের সরকার সম্ভবত চায় জাতিসংঘের মহাসচিব আমরা যে গুণগতভাবে গণতন্ত্রকে নির্মাণ করতে চাচ্ছি, তার একটা ধারণা নিয়ে যান।

আমি খারাপ কিছু মনে করছি না। এবার ফ্যাসিবাদের নৃশংসতার বিরুদ্ধে জাতিসংঘ, বিশেষ করে ফলকার টুর্কের নেতৃত্বে গঠিত কমিশন যেভাবে শেখ হাসিনার হত্যাযজ্ঞকে উন্মোচিত করেছে বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে, তা আমাদের লড়াইকে এক বিশেষ আন্তর্জাতিক উচ্চতায় নিয়ে গেছে।

জাতিসংঘের মহাসচিব বলেছেন, গণতন্ত্র নির্মাণে বাংলাদেশের সংস্কার কার্যক্রমকে তাঁরা সহায়তা করবেন। এই বক্তৃতা যখন আমি পড়েছি, তখন আমার মনের মধ্যে প্রশ্ন উদয় হয়েছে, কীভাবে তিনি সহায়তা করবেন? সংস্কার করার জন্য তো অনেক টাকাপয়সা লাগবে না। হ্যাঁ, বুদ্ধি-পরামর্শ লাগবে, যাতে সংস্কারটা ঠিকমতো পরিচালনা করা যায়। সুদূর ওয়াশিংটন থেকে গুতেরেস আমাদের কী পরামর্শ দেবেন? সভা শেষে জাতিসংঘের মহাসচিব যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেটা এ ক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য তিনি বলেছেন, আমি সংস্কারকাজে সাহায্য করতে চাই মানে আমি আপনাদের কোনো পরামর্শ দিতে চাই না। সংস্কারের কাজ আপনাদের করতে হবে। কীভাবে করবেন, কখন করবেন—এ সবকিছুর ব্যাপারে আপনারা সিদ্ধান্ত নেবেন।

যদি কখনো কোনো ব্যাপারে সাহায্য চান, তবেই আমরা আপনাদের সাহায্য করব।

তবে হ্যাঁ, অধ্যাপক ইউনূসের মতো আন্তোনিও গুতেরেসও জাতীয় ঐকমত্যের কথা বলেছেন। কিন্তু স্পষ্টত, ১৫ মার্চের ওই সভায় দলগুলোর মধ্যে ভিন্নমত উঠে এসেছে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একপ্রকার হতাশা ব্যক্ত করে বলেছেন, এই যে সভাটা হলো, এটা কেন হলো, তা ভালো করে বোঝা গেল না। আগের মতোই বিএনপির নেতা এই সভায় নির্বাচনকেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে তুলে ধরেছেন। কিন্তু জামায়াত ভিন্ন কথা বলেছে। আর নবগঠিত এনসিপি গণপরিষদের নির্বাচনের মাধ্যমে সংস্কারের কথা বলেছে। তাদের মতে, অন্যথায় সংস্কার টেকসই হবে না।

আমি এসব বিষয়ে কোনো কথা বলিনি। আমি আগেই বলেছি, এসব কথা শোনার জন্য কিংবা শোনানোর জন্য জাতিসংঘের মহাসচিব এই বৈঠকে বসেছেন বলে আমার মনে হয়নি। তিনি আমাদের জাতীয় ঐক্য দেখতে চেয়েছেন। আমি বলেছি, ভিন্নতা সত্ত্বেও আমরা একটা টেকসই গণতন্ত্র নির্মাণের জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে পারব বলে আশা করি।

একটু ভিন্ন, কিন্তু একটা প্রাসঙ্গিক কথা বলি। গত  লেখায় (সামনে কী? জাতীয় নির্বাচন? কত দূর?) আমি বলেছিলাম, অধ্যাপক ইউনূস যে বললেন, নির্বাচন এ বছরের ডিসেম্বরে অথবা আগামী বছরের মার্চে কিংবা জুনে হতে পারে, তাতে একধরনের বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে।

অনেকে আমাকে জিজ্ঞেস করেছেন, ভাই, নির্বাচন আসলে কবে হবে? কেউ কেউ এমন প্রশ্নও করেছেন, নির্বাচন ঠিক ঠিক হবে তো? ১৬ মার্চ একটি দৈনিক পত্রিকায় দেখলাম, ইফতার মাহফিলে বক্তৃতাকালে জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান বলেছেন, ইতিমধ্যে সরকারপ্রধান জাতীয় নির্বাচনের ব্যাপারে কিছু কথা বলেছেন। আশা করি, অবিলম্বে বিষয়টি তিনি আরও স্পষ্ট করবেন। তাহলে জাতি আশাবাদী হবে। প্রতিটি দল নিজেদের নির্বাচনী পরিকল্পনা সাজানোর সুযোগ পাবে।

এ ব্যাপারে পরিষ্কার করার সুযোগ নিশ্চয়ই প্রধান উপদেষ্টা পাবেন। কিন্তু ইতিমধ্যে তিনি আবারও তাঁর পুরোনো কথা বলেছেন। দুই দিন আগে তিনি বলেছিলেন, রাজনৈতিক দল যদি ছোট সংস্কার চায়, তবে এ বছরের ডিসেম্বরে নির্বাচন হতে পারে; আর যদি বড় সংস্কার চায়, তবে আগামী বছরের জুনে নির্বাচন হতে পারে।

ব্যাপারটা কারও কাছে পরিষ্কার নয়। ছোট সংস্কার কী আর বড় সংস্কার কী? ছয়টি সংস্কার কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে ১৬৬টি প্রশ্ন দিয়েছে। এগুলোর মধ্য থেকে কি ছোট সংস্কার চিহ্নিত করতে হবে? কীভাবে? এটা কি সংখ্যা দিয়ে নির্ধারিত হবে? মানে যেমন কোনো দল যদি ১৬৬টি প্রশ্নের মধ্যে মাত্র ৩০টির ব্যাপারে একমত হয়, তবে কি ধরে নিতে হবে যে তারা ছোট সংস্কার চায়? আর যদি ১০০টির ওপরে করতে চায়, তাহলে কি বুঝতে হবে তারা বড় সংস্কার চায়?

এখন পর্যন্ত সংস্কার সম্পর্কে সরকারের পক্ষ থেকে যেসব প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে কোথাও ছোট কিংবা বড় সংস্কারের কথা বলা হয়নি।

অধ্যাপক ইউনূস একসময় বলেছিলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলো যতগুলো প্রস্তাবে একমত হবে, আমরা ততগুলো সংস্কার করব। যা বাকি থাকবে, সেগুলো পরবর্তী সরকার বা সংসদ করবে। আমি কোনো কিছু চাপাব না।’

এই কথাই কি তিনি বলতে চাইছেন? কিন্তু এটা তো কোনো জেদাজেদির ব্যাপার নয়। এটা একটা প্রক্রিয়ার ব্যাপার। সেই প্রক্রিয়ায় যতগুলো ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্য পোষণ করবে, ততগুলো বিষয়ে সংস্কারে হাত দেবে সরকার। অধ্যাপক ইউনূসের এই চিন্তা খুবই বাস্তবসম্মত ও গণতান্ত্রিক। কিন্তু এখন তিনি যা বলছেন, তা কনফিউজিং।

আমি আশা করি, সত্বর বিভ্রান্তি দূর হবে।

মাহমুদুর রহমান মান্না নাগরিক ঐক্যের সভাপতি

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: বড় স স ক র বল ছ ল ন র জন য বল ছ ন হয় ছ ল ক র কর আম দ র বছর র করব ন দলগ ল সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

ব্যতিক্রমী একাডেমিক ক্যালেন্ডারে সেশনজট মুক্ত খুবি

ভর্তি পরীক্ষা তুমুল প্রতিযোগিতায় উত্তীর্ণ হয়ে শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে শুরু হয় স্বপ্নের পথচলা। কিন্তু সেই স্বপ্ন সেশনজটের কবলে পড়ে অনেক সময়ই রূপ নেয় দুঃস্বপ্নে। সেশনজট শুধু একজন শিক্ষার্থীর শিক্ষা জীবনেই বিঘ্ন ঘটায় না, বরং এর প্রভাব পড়ে তার ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও আর্থ-সামাজিক জীবনেও।

নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শিক্ষা জীবন শেষ না হওয়ায় অনেক শিক্ষার্থী কর্মজীবনে প্রবেশ করতে দেরি করে ফেলেন। ফলে বাড়ে মানসিক চাপ, আর্থিক অসন্তোষ, এমনকি আত্মহননের মতো চূড়ান্ত পরিণতির দিকেও ঠেলে দেয় অনেককে। 

তবে এ বাস্তবতায় এক ভিন্নচিত্র খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে (খুবি)। দেশের অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে সেশনজটে নাকাল, সেখানে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় সময়মতো শিক্ষা কার্যক্রম সম্পন্ন করে হয়ে উঠেছে শিক্ষার্থীদের কাছে এক স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান।
 
২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে যেখানে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় তাদের একাডেমিক কর্মকাণ্ড স্বাভাবিক করতে পারেনি, সেখানে খুবি নির্ধারিত সময়ে মধ্যেই তার একাডেমিক ক্যালেন্ডার অনুযায়ী সব কার্যক্রম সফলভাবে সম্পন্ন করেছে। এর পেছনে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সুপরিকল্পিত ও বাস্তবভিত্তিক কেন্দ্রীয় একাডেমিক ক্যালেন্ডার।

আরো পড়ুন:

খুবিতে ভর্তি পরীক্ষা শুরু বৃহস্পতিবার

হল না খোলায় ক্যাম্পাসে অবস্থানের ঘোষণা কুয়েট শিক্ষার্থীদের

প্রতিটি ডিসিপ্লিন সে ক্যালেন্ডার অনুসরণ করে নির্ধারিত সময়েই ক্লাস, পরীক্ষা সম্পন্ন করছে। এই পরিকল্পিত ও সুশৃঙ্খল একাডেমিক ক্যালেন্ডার শুধু শিক্ষার্থীদের জন্য নয়, বরং দেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার জন্যও একটি রোল মডেল হয়ে উঠেছে।

অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে ছাত্র রাজনীতির কারণে একাডেমিক কার্যক্রম বিঘ্নিত হয়। সেখানে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ। এই নীতিমালাও একাডেমিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে সহায়ক হয়েছে বলে মনে করেন শিক্ষার্থীরা।


প্রিন্ট মেকিং ডিসিপ্লিনের শিক্ষার্থী খাইরুন নাহার বলেন, “বাংলাদেশে সময় নষ্ট করাটা যেন শিক্ষা জীবনের অংশ হয়ে গেছে। কিন্তু খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে বুঝেছি, সময়ের মধ্যে থেকে স্নাতক শেষ করাও সম্ভব। এটা আমার জীবনের গতি বদলে দিয়েছে।”

বাংলা ডিসিপ্লিনের শিক্ষার্থী মিরাজুল ইসলাম বলেন, “আমার পরিবার সবসময় ভেবেছে আমি কত বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটাব। কিন্তু এখানে এসে দেখেছি সময়মতোই সব শেষ হয়। পরিবারের দুশ্চিন্তাও কমেছে।”

সয়েল, ওয়াটার অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ডিসিপ্লিনের শিক্ষার্থী মালাচেং রাখাইন বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার আগে সেশনজট নিয়ে অনেক ভয় ছিল। কিন্তু এখানে এসে বুঝেছি, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যালেন্ডার বাস্তবেই কার্যকর।”

বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ডিসিপ্লিনের শিক্ষার্থী তান্না তাবরিজ জিমহা বলেন, “আমরা নির্দিষ্ট সময়েই সব কোর্স শেষ করতে পারি। এতে করে স্কিল ডেভেলপমেন্টের জন্যও বাড়তি সময় পাওয়া যায়, যা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে খুব কম হয়।”

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. এসএম মাহবুবুর রহমান বলেন, “খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় শুরু থেকেই কেন্দ্রীয়ভাবে একাডেমিক ক্যালেন্ডার পরিচালনা করে। কোনো ডিসিপ্লিন আলাদা করে নিজের মতো করে সময় নির্ধারণ করতে পারে না। ফলে সার্বিক একাডেমিক কার্যক্রমে সুশৃঙ্খলতা বজায় থাকে।”

তিনি বলেন, “আমরা শুরু থেকেই শিক্ষার্থীদের জন্য সেশনজটমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে চেয়েছি। এর ফলে শিক্ষার্থীরা নির্ধারিত সময়ে স্নাতক সম্পন্ন করতে পারে এবং কর্মজীবনে দ্রুত প্রবেশ করতে পারে। এর ইতিবাচক প্রভাব দেখা যাচ্ছে সমাজ ও পরিবারেও।” 

ঢাকা/হাসিব/মেহেদী

সম্পর্কিত নিবন্ধ