হাওরের বুক চিরে হচ্ছে সড়ক, কৃষক-ফসলি জমির সর্বনাশ
Published: 18th, March 2025 GMT
হাওরে এখন বোরো ধানের সমারোহ। শ্রমে-ঘামে ফলানো সোনার ধান বৈশাখে গোলায় তুলবেন কৃষক। লাখো মানুষের জীবন-জীবিকার এই হাওরের বুক চিরে সড়ক নির্মাণের কর্মযজ্ঞ চলছে। সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলার সাংহাই হাওরে চার কিলোমিটার লম্বা সড়কের জন্য জমির ক্ষতিপূরণ দূরে থাক, ধান নষ্টের বিষয়েও কৃষকদের কেউ বলার প্রয়োজন মনে করছেন না।
কৃষক ও পরিবেশবাদীরা বলছেন, হাওরের মাঝখান দিয়ে এভাবে সড়ক হওয়ায় প্রকৃতি ও পরিবেশের সঙ্গে বিপুল পরিমাণ ফসলি জমির ক্ষতি হচ্ছে। এতে বর্ষায় স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হবে। উজানে দেখা দেবে জলাবদ্ধতা। হাওরের সর্বনাশা এই কাণ্ড ঘটছে প্রশাসনের চোখের সামনে।
উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের একটি বিশেষ প্রকল্পে সাংহাই হাওরে সড়কের কাজ হচ্ছে। সড়ক নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৪ কোটি টাকা। অর্থায়ন করছে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা)। ঢাকার জেবি ইনোভেশন নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজটি বাস্তবায়ন করছে। গত বছর কাজ শুরুর পর পানি চলে আসায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল কাজ। চলতি বছর কয়েক দিন ধরে কয়েকটি খননযন্ত্র দিয়ে ফসলি জমিতে মাটি কাটা শুরু হয়েছে।
জমিতে লাগানো ধানের চারা নষ্ট করে এখন মাটি কাটা হচ্ছে। খননযন্ত্র দিয়ে জমি থেকে মাটি তুলে আবার জমিতেই রাস্তার জন্য ফেলে উঁচু করা হচ্ছে। সড়ক ও দুই পাশে মাটি তুলে খালের মতো করায় প্রস্থে ১০০ ফুটের মতো করে ফসলি জমি নষ্ট হচ্ছে।সরেজমিনে দেখা গেছে, পূর্ব পাড়ের ডুংরিয়া গ্রাম থেকে হাওরের মাঝখান দিয়ে সড়কটি যাবে পশ্চিম পাড়ের হাসনাবাদ গ্রামে। প্রকল্পটি সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানের একান্ত ইচ্ছায় নেওয়া। ডুংরিয়া এম এ মান্নানের নিজ গ্রাম। হাওরের এ অংশে ডুংরিয়া, হাসনাবাদ, জামলাবাজ গ্রামের কৃষকদের জমি। উত্তরে উজানীগাঁও, মির্জাপুর, ফতেপুর গ্রামের কৃষকদের জমি।
জমিতে লাগানো ধানের চারা নষ্ট করে এখন মাটি কাটা হচ্ছে। খননযন্ত্র দিয়ে জমি থেকে মাটি তুলে আবার জমিতেই রাস্তার জন্য ফেলে উঁচু করা হচ্ছে। সড়ক ও দুই পাশে মাটি তুলে খালের মতো করায় প্রস্থে ১০০ ফুটের মতো করে ফসলি জমি নষ্ট হচ্ছে।
স্থানীয় কৃষকেরা জানান, গত বছর কাজের শুরুতেই তাঁরা বাধা দেন। পরে স্থানীয় আওয়ামী লীগের লোকজন তাঁদের ডেকে নিয়ে যান এম এ মান্নানের বাড়িতে। তখন জমিতে লাগানো ধানের দাম হিসেবে কৃষকদের কিছু টাকা দিতে ঠিকাদারের লোকজনকে বলে দেন তিনি। গত বছর আওয়ামী লীগের লোকজন ঠিকাদারের হয়ে ক্ষমতা দেখিয়েছেন। এখন আওয়ামী লীগ না থাকলেও অন্যরা যুক্ত হয়েছেন।
কিশোরগঞ্জে হাওরের এক সড়ক নিয়ে সারা দেশে সমালোচনা হচ্ছে। সুনামগঞ্জের হাওরে এমন সড়ক হলে হাওরের জীববৈচিত্র্য, কৃষি ও কৃষকের সর্বনাশ হয়ে যাবে। এই হাওর রক্ষায় তাঁরা পরিবেশ উপদেষ্টা ও জেলা প্রশাসনের দ্রুত হস্তক্ষেপ চান। বিজন সেন রায়, সাধারণ সম্পাদক, হাওর বাঁচাও আন্দোলনস্থানীয় কৃষক তারিফ মিয়ার (৭০) সাংহাই হাওরে প্রায় ৪ একর জমি আছে। সড়ক ও মাটি কেটে পাশে খাল করায় এক একরের বেশি জমি নষ্ট হয়েছে তাঁর। তিনি বলেন, ‘সড়ক বানাইবার আগে আমরারে কুনতা জিগাইছে না। এখনো কেউ কুনতা কয় না। আমরার জমি শেষ, ধানও শেষ।’ আরেক কৃষক সেলিম মিয়া (৫৫) বলেন, ‘হাওরের এই জমির ওপর আমরা নির্ভরশীল। একে তো সড়কের নিচে জমি যাচ্ছে। আবার মাটি কেটে আরও জমি নষ্ট করা হচ্ছে।’
মাটি কাটার কাজ তদারক করা আশরাফ উদ্দিন জানান, তাঁরা চারজন মিলে ঠিকাদারের কাছ থেকে এই কাজ করছেন। কৃষকদের ধানের ক্ষতিপূরণ দিতে একটি তালিকা করা হয়েছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি প্রকৌশলী মুরাদ আহমদ সড়কের জন্য জমি অধিগ্রহণ না করে ফসলি জমির মাটি নেওয়ার বিষয়ে বলেন, ‘মান্নান স্যার কৃষকদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে সব ব্যবস্থা করেছেন।’
আগে আওয়ামী লীগ, এখন বিএনপির লোকদের দিয়ে জোর করে কাজ করানোর অভিযোগ সঠিক নয়। এ প্রকল্পে জমি অধিগ্রহণ বা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কোনো বরাদ্দ নেই বলে জানান শান্তিগঞ্জ উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) জাহাঙ্গীর আলম।
প্রকল্পের আগে জাইকা নিশ্চয় বাস্তবায়নযোগ্যতা যাচাই করেছে জানিয়ে শান্তিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুকান্ত সাহা বলেন, তবু কারও কোনো অভিযোগ পেলে তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানাবেন। তিনি নিজেও হাওরে সড়ক নির্মাণের কাজ একদিন দেখে এসেছেন বলে জানান।
এ বিষয়ে হাওর বাঁচাও আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক বিজন সেন রায় বলেন, কিশোরগঞ্জে হাওরের এক সড়ক নিয়ে সারা দেশে সমালোচনা হচ্ছে। সুনামগঞ্জের হাওরে এমন সড়ক হলে হাওরের জীববৈচিত্র্য, কৃষি ও কৃষকের সর্বনাশ হয়ে যাবে। এই হাওর রক্ষায় তাঁরা পরিবেশ উপদেষ্টা ও জেলা প্রশাসনের দ্রুত হস্তক্ষেপ চান।
সড়ক বানাইবার আগে আমরারে কুনতা জিগাইছে না। আমরার জমি শেষ, ধানও শেষ। তারিফ মিয়া, কৃষক, সাংহাই হাওর, সুনামগঞ্জসুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া এ ব্যাপারে ইউএনওর কাছে বিস্তারিত জানতে চেয়েছেন বলে জানান। তিনি বলেন, হাওরের প্রকৃতি, পরিবেশ এবং কৃষকদের ক্ষতি করে কোনো কাজ করা ঠিক হবে না।
যোগাযোগ করলে সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান গত বছর কাজ শুরুর সময় ধানের ক্ষতির জন্য ঠিকাদারের কাছ থেকে টাকা নিয়ে কৃষকদের দেওয়ার কথা জানান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এবার তো আমি নাই। কীভাবে কী হচ্ছে জানি না। আমাকে কেউ কিছু জানায়নি।’
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: এম এ ম ন ন ন স ন মগঞ জ র ক ষকদ র প রকল প গত বছর র জন য পর ব শ আমর র আওয় ম সড়ক র সড়ক ন উপজ ল বছর ক
এছাড়াও পড়ুন:
ওয়াক্ফ আইনের বাস্তবায়ন স্থগিতেও রাজনৈতিক বিতর্ক চলছে
ভারতের বিতর্কিত সংশোধিত ওয়াক্ফ আইনের বাস্তবায়ন স্থগিত করেছেন দেশটির সুপ্রিম কোর্ট। বুধবার আইনটির বিরুদ্ধে করা ৭৩টি পিটিশনের শুনানি শুরু হয়। পরে বৃহস্পতিবার শুনানি শেষে প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্নার নেতৃত্বে বিচারপতি সঞ্জয় কুমার ও কেভি বিশ্বনাথনের বেঞ্চ সংশোধিত ওয়াক্ফ আইন স্থগিতের ঘোষণা দেন। বৃহস্পতিবার ছিল ওয়াক্ফ মামলায় সুপ্রিম শুনানি। আইন স্থগিতের পর সরকারের পক্ষ থেকে আদালতকে নিশ্চিত করা হয়, পরবর্তী শুনানি পর্যন্ত ওয়াক্ফ বোর্ডে নতুন নিয়োগ বা সম্পত্তির অবস্থা পরিবর্তন করা হবে না। পুরোনো ওয়াক্ফ এবং ‘ওয়াক্ফ বাই ইউজার’ সম্পত্তিও আগের মতো থাকবে। তবে আদালতের এই সিদ্ধান্তের পরও দেশজুড়ে বিক্ষোভ ও রাজনৈতিক বিতর্ক অব্যাহত রয়েছে।
বৃহস্পতিবার সরকার জানায়, নতুন আইনের ৯ ও ১৪ নম্বর ধারা অনুযায়ী কোনো নিয়োগ করা হবে না। এই ধারাগুলো কাউন্সিল ও বোর্ডে সদস্য নিয়োগের বিষয়ে। সরকারের আইনজীবী তুষার মেহতা মামলার জবাব দেওয়ার জন্য এক সপ্তাহ সময় চান, যা আদালত মঞ্জুর করেছেন। আদালত বলেছেন, আবেদনকারীরা সরকারের জবাবের পর পাঁচ দিনের মধ্যে তাদের প্রতিক্রিয়া জানাতে পারবেন।
সুপ্রিম কোর্ট ৭৩টি পিটিশনের মধ্যে পাঁচটি নিয়ে আলোচনা করবেন। প্রধান বিচারপতি বলেন, ১০০ বা ২০০টি পিটিশন নিয়ে আলোচনা সম্ভব নয়। বাকিগুলো নিষ্পত্তি হয়েছে বলে ধরা হবে।
‘ওয়াক্ফ বাই ইউজার’ এমন একটি ব্যবস্থা, যেখানে মুসলমানরা দীর্ঘদিন ধর্মীয় বা দানের কাজে ব্যবহৃত সম্পত্তিকে ওয়াক্ফ হিসেবে দাবি করতে পারে, এমনকি কাগজপত্র না থাকলেও। নতুন আইনে বলা হয়েছে, বিরোধপূর্ণ বা সরকারি জমিতে এটি প্রযোজ্য হবে না। শুনানিতে প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্না এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
তিনি বলেন, আমরা শুনেছি, দিল্লি হাইকোর্ট ওয়াক্ফ জমির ওপর। সব ওয়াক্ফ বাই ইউজার ভুল নয়। তিনি জানান, ১৩০০, ১৪০০ বা ১৫০০ শতাব্দীর মসজিদের জন্য কাগজপত্র পাওয়া অসম্ভব। তিনি সরকারকে প্রশ্ন করেন, ‘আপনারা কি বলছেন, আদালতের রায়ে প্রতিষ্ঠিত ওয়াক্ফ এখন বাতিল হবে? আইন দিয়ে আদালতের রায় বাতিল করা যায় না।’
আইনজীবী কপিল সিবাল বলেন, ‘হাজার বছর আগে ওয়াক্ফ তৈরি হলে এখন কাগজপত্র চাওয়া সমস্যা।’ আইনজীবী অভিষেক সিংভি জানান, ভারতের ৮ লাখ ওয়াক্ফ সম্পত্তির মধ্যে ৪ লাখই ওয়াক্ফ বাই ইউজার।
নতুন আইনে কেন্দ্রীয় ওয়াক্ফ কাউন্সিল ও রাজ্য ওয়াক্ফ বোর্ডে অমুসলিম সদস্য রাখার বিধান আছে। এতে মুসলিম সদস্যের সংখ্যা কমিয়ে আনা হয়েছে। কাউন্সিলে ২২ জনের মধ্যে আটজন এবং রাজ্য বোর্ডে ১১ জনের মধ্যে চারজন মুসলিম থাকবে। এই বিধান মুসলিম সম্প্রদায় ও বিরোধী দলগুলোর তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে।
পশ্চিমবঙ্গে গ্রেপ্তার ২৭৪ জন: মুর্শিদাবাদে ওয়াক্ফ আইন নিয়ে সাম্প্রতিক অশান্তি ও হিংসার ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত এনজামুলকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। বৃহস্পতিবার বিকেলে কলকাতার ভবানী ভবনে এক সাংবাদিক বৈঠকে এ তথ্য জানান এডিজি (দক্ষিণবঙ্গ) সুপ্রতিম সরকার। তিনি জানান, এই ঘটনার তদন্তে বর্তমানে সিট-এ সদস্য সংখ্যা ১১। এই দলের নেতৃত্বে রয়েছেন মুর্শিদাবাদ রেঞ্জের ডিআইজি সৈয়দ ওয়াকার রেজা। বিগত কয়েকদিন ধরে জঙ্গিপুর মহকুমার শামসেরগঞ্জ থানা থেকে পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছেন তিনি।
সাংবাদিকদের সামনে এডিজি জানান, অশান্তির ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৬০টি এফআইআর দায়ের হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে মোট ২৭৪ জনকে। এই প্রসঙ্গে সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর ঘটনা হলো- জাফরাবাদে বাবা ও ছেলেকে নৃশংসভাবে খুনের মামলায় অন্যতম মূল অভিযুক্ত এনজামুল হককে গ্রেপ্তার করেছে রাজ্য পুলিশের স্পেশাল টাস্ক ফোর্স। সুতি এলাকা থেকে বুধবার রাতে তাকে ধরা হয়। পেশায় রাজমিস্ত্রি, এনজামুল সুলিপাড়ার বাসিন্দা।
এডিজি জানান, নিহত হরগোবিন্দ দাস ও চন্দন দাসকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে খুন করা হয়। ওই মামলায় এরই মধ্যে কালু ও দিলাবর নাদাব নামে দুই অভিযুক্তকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এনজামুল বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে এবং সিসিটিভি ক্যামেরা ভাঙার চেষ্টা করে প্রমাণ লোপাট করতে চেয়েছিল। তদন্তে উঠে এসেছে, এই হত্যাকাণ্ডের অন্যতম মাস্টারমাইন্ড সে-ই।
অশান্ত মুর্শিদাবাদের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে এডিজি আশ্বস্ত করে বলেন, পরিস্থিতি এখন অনেকটাই স্বাভাবিক। প্রায় ৭০ শতাংশ দোকান ও বাজার ইতোমধ্যেই খুলে গেছে। আমরা আশাবাদী শনিবারের মধ্যে বাকি দোকানগুলোও খুলে যাবে।
এদিন বিকেল পর্যন্ত ৮৫ জন ঘরছাড়া মানুষকে পুলিশি নিরাপত্তায় বাড়ি ফিরিয়ে আনা হয়েছে বলেও জানান তিনি। ধুলিয়ান, সুতিসহ বেশ কিছু স্পর্শকাতর এলাকায় মোতায়েন রয়েছে রাজ্য পুলিশ ও কেন্দ্রীয় বাহিনী।