লাল-নীল আলোকবাতির শহর। সূর্যের আয়ু ফুরানোর আগেই এ শহর আলোকিত হয় নানা রঙে। দিবারাত্রি এক করে অসহ্য ছুটে চলা। শিকড়হীন এই ছুটে চলা। যেখানে সবটাই অনিশ্চিত। উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরুতেই সুপ্ত স্বপ্নগুলো গা-ঝাড়া দিয়ে ওঠে। হাজার কাঠখড় পুড়িয়ে একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নিজের পরিচয়ের সঙ্গে যুক্ত করা। যুক্ত তো হলো, এবার বাড়ি ছাড়ার পালা। একবার যে এই বাড়ি ছাড়ল, তার আর বাড়ি ফেরা হলো না। নতুন শহর, হাজারো নতুন মানুষের ভিড়ে নিজেকে বড্ড অসহায় অনুভব হতে থাকে। তারপর ক্যাম্পাসে আসতেই সিনিয়র-জুনিয়র ফ্যাক্ট। পরিবার-পরিজন ছেড়ে নতুন শহরে আসা মানুষটার অসহায়ত্বে যেন দূর থেকে চোখ রাঙানো।
দিন যায়, মাস যায় শঙ্খচিল নিজেকে মানিয়ে নিতে থাকে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে। কর্মব্যস্ত দিনগুলোর শেষাংশে সে যেন সূর্যের দীর্ঘায়ু কামনা করতে থাকে। কারণ দিনশেষে মেস, হোস্টেল কিংবা হলের প্রাচীন দেয়ালগুলো তাকে বড্ড কোণঠাসা করে তোলে। একাকিত্বের চরম উপলব্ধি অনুভব করায় কর্মব্যস্ত দিন, দিনের পর রাত এক বাধ্যতামূলক ছুটে চলা। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে তখন মায়ের স্নেহের আঁচল, বাবার যত্ন, পরিজনের অতিরিক্ত করা ব্যাপারগুলোর অবাধ প্রয়োজনীয়তা অনুভব হয় আর নিজেকে জগতের সবচেয়ে অসহায়বোধ হতে থাকে। চলতি পথে সঙ্গী হয় অনেকে কিন্তু আপনজন পাওয়া এই চাকচিক্যে মুশকিল। অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ একসঙ্গে নিয়ে চলা। উপলব্ধির বয়সে মানসিক চাপে জর্জরিত হয়ে পড়ে সবাই। কখনও কখনও বোধ হয় নিঃশ্বাসটাও যেন রুটিনের গ্যাঁড়াকলে পড়েছে। হতাশা, ক্লান্তি, মানসিক চাপের সঙ্গে যুক্ত হয় অর্থনৈতিক চাপ– সর্বোপরি লোকসমাগমে থেকেও একাকিত্বের যে ব্যাপারটা।
অনিশ্চিত এক ঘরের খোঁজে শঙ্খচিল হয় বাড়িছাড়া। সেই কাঙ্ক্ষিত ঘর কি সে পাবে? নাকি সহস্রের মতো ঝরে পড়বে সভ্যতার অতল গহ্বরে? এই উত্তর কেউ জানে না।
এভাবেই দিবারাত্রি এক হয়ে যায় অনিশ্চিত ঘরের খোঁজে। শঙ্খচিলের আর বাড়ি ফেরা হয় না। v
সুহৃদ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
আবুল মনসুর আহমদকে কেন মনে রাখব
আবুল মনসুর আহমদকে কেন মনে রাখব? আমার জানা-বোঝায় তাঁর রচনার যে দুটি গুণ আমাকে বিশেষভাবে আকর্ষণ করে, সে হচ্ছে প্রবলতা ও রাজনীতি-সচেতনতা। গুণ বলা যায়; বৈশিষ্ট্যও বলা যায়। বৈশিষ্ট্যই গুণ হয়ে উঠেছে। লেখক সে সময়ে আরও ছিলেন, প্রবলতাও ছিল, তবে অনেকের মধ্যে নয়। কারও কারও রাজনীতি-সচেতনতাও ছিল। কিন্তু সচেতনতাকে এমনভাবে সব সময় সজাগ রাখা, কখনও হারিয়ে না ফেলা আবুল মনসুর আহমদের মধ্যে যেমন দেখি, তেমন দেখি না অন্য কারও মধ্যে। এর একটা কারণ, তিনি জড়িত ছিলেন প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গে।
মুসলিম মধ্যবিত্ত যখন বিকশিত হচ্ছিল, তখন সেই বিকাশের প্রক্রিয়ার মধ্যে ছিল যে একটা প্রবলতা, তা-ই প্রজ্বলিত হয়েছে এই লেখকের রচনায়। তাঁর চিন্তা-চেতনায়, আবেগে ও ভাবে। মৃত্যুক্ষুধা কাজী নজরুল ইসলামের উপন্যাসের নাম। সেখানে জীবন আছে, কিন্তু সেই জীবনের ওপর বারবার লম্বা করে ছায়া পড়েছে মৃত্যুর। নজরুল ইসলামের বন্ধু আবুল মনসুরের উপন্যাসের নাম জীবন-ক্ষুধা। এখানেও মৃত্যুর ছায়া আছে, কিন্তু আবুল মনসুর দেখিয়েছেন জীবনের যে তেজস্বিতা, তা কেমন করে সবকিছুকে ছাপিয়ে উঠতে চায়। উপন্যাসের নায়ক হালিম সামন্ত পরিবেশ থেকে বেরিয়ে এসে ক্রমান্বয়ে বুর্জোয়া পরিবেশের প্রতিকূলতাকে ঠেলে দিচ্ছে দু’হাতে। এই যাত্রার মধ্যে একটা শক্তি রয়েছে। আবুল মনসুর আহমদের সব রচনায় এই শক্তিটাকে দেখেছি।
আবুল মনসুর আহমদ যা-ই লিখুন না কেন, রাজনৈতিক প্রবন্ধ বা ব্যঙ্গ রচনা কিংবা উপন্যাস– সর্বত্রই দেখি অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে কথা বলছেন। ফুড কনফারেন্স ও আয়নার লেখক হিসেবে একদা তিনি অনায়াসে সাড়া জাগিয়েছিলেন। সেই যে ব্যঙ্গ, তার মধ্যে স্বরটা ছিল চড়া, ছবিগুলো ছিল ভয়ংকর। অত্যন্ত সহজে বলা যাবে এ কথা যে, অভাব ছিল সূক্ষ্মতার। আসলে সূক্ষ্মতা তাঁর পরিবেশেই ছিল না, সমাজকে তিনি উচ্চকিত করেছেন। বীভৎস ও নিকুণ্ঠ সমালোচনায় সে-সমাজের কিছুই আসে যায় না। আজকের দিনেও দেখি, উৎকৃষ্ট ব্যঙ্গ রচনা লেখা হচ্ছে না। অথচ বলা হয়, ব্যঙ্গের উপাদান যত্রতত্র ছড়িয়ে আছে আমাদের জীবনে। এই ছড়িয়ে থাকার কথাটা সত্যও বটে, মিথ্যাও বটে। সমাজে অসংগতি আছে। কিন্তু সে অসংগতি এমনই স্থূল যে, তাকে নিয়ে হাসাহাসি করাটাও কঠিন কাজ। আবুল মনসুর করেছেন সেই কঠিন কাজটা। তাঁর সাহস ছিল। অসংগতির স্বরকে ছাপিয়ে ওঠার স্বর ছিল আয়ত্তে। তিনি হাসির মধ্য দিয়ে ধমকে দিয়েছেন ভয়ংকরকে।
এই প্রবলতা তাঁর আত্মজীবনীতেও দেখি। আত্মজীবনী তাঁর দুটি। প্রথমে পাওয়া গেছে আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর, তার পরে এলো আত্মকথা। একটিতে রাজনীতির ইতিহাস, অন্যটিতে ব্যক্তির ইতিহাস। কিন্তু দুই গ্রন্থ এক হয়ে এক জায়গায় এসে গেছে, সে তার আত্মনির্ভরতায়। সেই যে প্রবলতার কথা বলেছিলাম, সে আছে দুটি বইতেই। রাজনীতি সত্য এবং আমিও সত্য। বিশেষ করে তিনি কোনো অজ্ঞাতকুলশীল বলে পরিচয় দেননি নিজের, যেমন নীরদ চৌধুরী দিয়েছিলেন নিজেকে তাঁর শ্রেণির প্রতিনিধি হিসেবে। উপস্থিত করতে চাননি, যা দেখি কামরুদ্দিন আহমদের আত্মজীবনীতে, যদিচ শ্রেণিপ্রতিনিধিত্ব আবুল মনসুরের রচনাতে অবশ্যই রয়েছে।
তাঁর কিছু কিছু ধারণা অবশ্যই বিতর্কমূলক। বিশেষ করে ভাষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে আমার নিজের নৈকট্য তো নেই-ই; হিসাব করলে দেখব কোথাও কোথাও ব্যবধান আছে। আমার মতো অনেকেই বলেন এই একই কথা। কিন্তু সর্বদাই দেখা গেছে, নিজের মত প্রচারে তিনি কোনো কার্পণ্য করেননি এবং বলতে গেলে একাই ছিলেন সেখানে তিনি। পরোয়া করেননি কেউ জানে কি জানে না। ভারী তৎসম শব্দের সঙ্গে একদিকে খাঁটি দেশি ও অন্যদিকে একেবারে বিদেশি শব্দ যেমন অনায়াসে মিলিয়ে দিয়েছেন, তাতে বোঝা যায়, এই মানুষটির মনের ভেতর আত্মসচেতনতা ছিল না। মধ্যবিত্ত শ্রেণির সমালোচকেরা অন্তত এই বিষয়ে মিথ্যে বলেননি যে, আত্মসচেতনতা মধ্যবিত্তের একটি অনিরামেয় ব্যাধি। আবুল মনসুরের এই ব্যাধি ছিল না।
কিন্তু আমরা খুব ভুল করব যদি আবুল মনসুর আহমদকে বুঝতে চাই তাঁর রাজনীতিকে বাদ দিয়ে। রাজনীতিতে সবসময়ই তিনি জনসাধারণের সঙ্গেই ছিলেন। যতটা থাকা সম্ভব তাঁর বিশেষ অবস্থানের মধ্য থেকে। পেশায় রাজনীতিবিদ নন, নেশায় রাজনীতিবিদ। রাজনীতি কখনও আসেনি তাঁর কাছে একটি বিশেষ পেশা হিসেবে, কিংবা অনেকের কাছে যেমন এসেছে তেমনি একটি সুবিধাজনক ব্যবসা হিসেবে। তিনি মন্ত্রী হয়েছেন, কিন্তু তাঁর পরিচয় মন্ত্রিত্ব দিয়ে নয়।
রাজনীতি যে সমস্ত কিছুর নিয়ামক– এই চেতনাটি অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন এবং সদা সজাগভাবে উপস্থিত ছিল তাঁর মধ্যে। তাই তো দেখি উপন্যাস লিখছেন যখন তখনও ভুলছেন না রাজনীতিকে এবং তাঁর নায়ক হালিম তার মতোই প্রজার স্বার্থ, কৃষকের স্বার্থকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিল সামনে। জনতার শত্রু কে, কেই বা মিত্র– সেটা চিনতে ভুল হয়নি আবুল মনসুর আহমদের। কখনও কখনও ব্যক্তিগত স্বার্থকে জনতার স্বার্থের ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে পারেননি তিনি, অথচ একই সঙ্গে বলতেই হবে, জনতার স্বার্থ নিয়ে অকারণে কোনো ভাবালুতা নেই তাঁর লেখায়। রাজনীতিকে যারা ব্যবসা মনে করেন, সেই রাজনীতিবিদদের লজ্জা দিয়েছে তাঁর জীবন, যদি তাদের লজ্জা পাওয়ার ক্ষমতা থাকে। সাহিত্যকে যারা রাজনীতি-নিরপেক্ষ বলে মনে করেন, তাদের সে ধারণার প্রতি প্রবল প্রতিবাদ তাঁর রচনাবলি। তাঁর প্রতিভা বিরল মাত্রার, বিশেষ করে প্রবলতা ও রাজনীতি-সচেতনতার এই সাহিত্যিক সমন্বয়ের কারণেই।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ইমেরিটাস অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক, গবেষক