আবুল মনসুর আহমদকে কেন মনে রাখব? আমার জানা-বোঝায় তাঁর রচনার যে দুটি গুণ আমাকে বিশেষভাবে আকর্ষণ করে, সে হচ্ছে প্রবলতা ও রাজনীতি-সচেতনতা। গুণ বলা যায়; বৈশিষ্ট্যও বলা যায়। বৈশিষ্ট্যই গুণ হয়ে উঠেছে। লেখক সে সময়ে আরও ছিলেন, প্রবলতাও ছিল, তবে অনেকের মধ্যে নয়। কারও কারও রাজনীতি-সচেতনতাও ছিল। কিন্তু সচেতনতাকে এমনভাবে সব সময় সজাগ রাখা, কখনও হারিয়ে না ফেলা আবুল মনসুর আহমদের মধ্যে যেমন দেখি, তেমন দেখি না অন্য কারও মধ্যে। এর একটা কারণ, তিনি জড়িত ছিলেন প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গে।
মুসলিম মধ্যবিত্ত যখন বিকশিত হচ্ছিল, তখন সেই বিকাশের প্রক্রিয়ার মধ্যে ছিল যে একটা প্রবলতা, তা-ই প্রজ্বলিত হয়েছে এই লেখকের রচনায়। তাঁর চিন্তা-চেতনায়, আবেগে ও ভাবে। মৃত্যুক্ষুধা কাজী নজরুল ইসলামের উপন্যাসের নাম। সেখানে জীবন আছে, কিন্তু সেই জীবনের ওপর বারবার লম্বা করে ছায়া পড়েছে মৃত্যুর। নজরুল ইসলামের বন্ধু আবুল মনসুরের উপন্যাসের নাম জীবন-ক্ষুধা। এখানেও মৃত্যুর ছায়া আছে, কিন্তু আবুল মনসুর দেখিয়েছেন জীবনের যে তেজস্বিতা, তা কেমন করে সবকিছুকে ছাপিয়ে উঠতে চায়। উপন্যাসের নায়ক হালিম সামন্ত পরিবেশ থেকে বেরিয়ে এসে ক্রমান্বয়ে বুর্জোয়া পরিবেশের প্রতিকূলতাকে ঠেলে দিচ্ছে দু’হাতে। এই যাত্রার মধ্যে একটা শক্তি রয়েছে। আবুল মনসুর আহমদের সব রচনায় এই শক্তিটাকে দেখেছি।
আবুল মনসুর আহমদ যা-ই লিখুন না কেন, রাজনৈতিক প্রবন্ধ বা ব্যঙ্গ রচনা কিংবা উপন্যাস– সর্বত্রই দেখি অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে কথা বলছেন। ফুড কনফারেন্স ও আয়নার লেখক হিসেবে একদা তিনি অনায়াসে সাড়া জাগিয়েছিলেন। সেই যে ব্যঙ্গ, তার মধ্যে স্বরটা ছিল চড়া, ছবিগুলো ছিল ভয়ংকর। অত্যন্ত সহজে বলা যাবে এ কথা যে, অভাব ছিল সূক্ষ্মতার। আসলে সূক্ষ্মতা তাঁর পরিবেশেই ছিল না, সমাজকে তিনি উচ্চকিত করেছেন। বীভৎস ও নিকুণ্ঠ সমালোচনায় সে-সমাজের কিছুই আসে যায় না। আজকের দিনেও দেখি, উৎকৃষ্ট ব্যঙ্গ রচনা লেখা হচ্ছে না। অথচ বলা হয়, ব্যঙ্গের উপাদান যত্রতত্র ছড়িয়ে আছে আমাদের জীবনে। এই ছড়িয়ে থাকার কথাটা সত্যও বটে, মিথ্যাও বটে। সমাজে অসংগতি আছে। কিন্তু সে অসংগতি এমনই স্থূল যে, তাকে নিয়ে হাসাহাসি করাটাও কঠিন কাজ। আবুল মনসুর করেছেন সেই কঠিন কাজটা। তাঁর সাহস ছিল। অসংগতির স্বরকে ছাপিয়ে ওঠার স্বর ছিল আয়ত্তে। তিনি হাসির মধ্য দিয়ে ধমকে দিয়েছেন ভয়ংকরকে।
এই প্রবলতা তাঁর আত্মজীবনীতেও দেখি। আত্মজীবনী তাঁর দুটি। প্রথমে পাওয়া গেছে আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর, তার পরে এলো আত্মকথা। একটিতে রাজনীতির ইতিহাস, অন্যটিতে ব্যক্তির ইতিহাস। কিন্তু দুই গ্রন্থ এক হয়ে এক জায়গায় এসে গেছে, সে তার আত্মনির্ভরতায়। সেই যে প্রবলতার কথা বলেছিলাম, সে আছে দুটি বইতেই। রাজনীতি সত্য এবং আমিও সত্য। বিশেষ করে তিনি কোনো অজ্ঞাতকুলশীল বলে পরিচয় দেননি নিজের, যেমন নীরদ চৌধুরী দিয়েছিলেন নিজেকে তাঁর শ্রেণির প্রতিনিধি হিসেবে। উপস্থিত করতে চাননি, যা দেখি কামরুদ্দিন আহমদের আত্মজীবনীতে, যদিচ শ্রেণিপ্রতিনিধিত্ব আবুল মনসুরের রচনাতে অবশ্যই রয়েছে।
তাঁর কিছু কিছু ধারণা অবশ্যই বিতর্কমূলক। বিশেষ করে ভাষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে আমার নিজের নৈকট্য তো নেই-ই; হিসাব করলে দেখব কোথাও কোথাও ব্যবধান আছে। আমার মতো অনেকেই বলেন এই একই কথা। কিন্তু সর্বদাই দেখা গেছে, নিজের মত প্রচারে তিনি কোনো কার্পণ্য করেননি এবং বলতে গেলে একাই ছিলেন সেখানে তিনি। পরোয়া করেননি কেউ জানে কি জানে না। ভারী তৎসম শব্দের সঙ্গে একদিকে খাঁটি দেশি ও অন্যদিকে একেবারে বিদেশি শব্দ যেমন অনায়াসে মিলিয়ে দিয়েছেন, তাতে বোঝা যায়, এই মানুষটির মনের ভেতর আত্মসচেতনতা ছিল না। মধ্যবিত্ত শ্রেণির সমালোচকেরা অন্তত এই বিষয়ে মিথ্যে বলেননি যে, আত্মসচেতনতা মধ্যবিত্তের একটি অনিরামেয় ব্যাধি। আবুল মনসুরের এই ব্যাধি ছিল না।
কিন্তু আমরা খুব ভুল করব যদি আবুল মনসুর আহমদকে বুঝতে চাই তাঁর রাজনীতিকে বাদ দিয়ে। রাজনীতিতে সবসময়ই তিনি জনসাধারণের সঙ্গেই ছিলেন। যতটা থাকা সম্ভব তাঁর বিশেষ অবস্থানের মধ্য থেকে। পেশায় রাজনীতিবিদ নন, নেশায় রাজনীতিবিদ। রাজনীতি কখনও আসেনি তাঁর কাছে একটি বিশেষ পেশা হিসেবে, কিংবা অনেকের কাছে যেমন এসেছে তেমনি একটি সুবিধাজনক ব্যবসা হিসেবে। তিনি মন্ত্রী হয়েছেন, কিন্তু তাঁর পরিচয় মন্ত্রিত্ব দিয়ে নয়।
রাজনীতি যে সমস্ত কিছুর নিয়ামক– এই চেতনাটি অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন এবং সদা সজাগভাবে উপস্থিত ছিল তাঁর মধ্যে। তাই তো দেখি উপন্যাস লিখছেন যখন তখনও ভুলছেন না রাজনীতিকে এবং তাঁর নায়ক হালিম তার মতোই প্রজার স্বার্থ, কৃষকের স্বার্থকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিল সামনে। জনতার শত্রু কে, কেই বা মিত্র– সেটা চিনতে ভুল হয়নি আবুল মনসুর আহমদের। কখনও কখনও ব্যক্তিগত স্বার্থকে জনতার স্বার্থের ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে পারেননি তিনি, অথচ একই সঙ্গে বলতেই হবে, জনতার স্বার্থ নিয়ে অকারণে কোনো ভাবালুতা নেই তাঁর লেখায়। রাজনীতিকে যারা ব্যবসা মনে করেন, সেই রাজনীতিবিদদের লজ্জা দিয়েছে তাঁর জীবন, যদি তাদের লজ্জা পাওয়ার ক্ষমতা থাকে। সাহিত্যকে যারা রাজনীতি-নিরপেক্ষ বলে মনে করেন, তাদের সে ধারণার প্রতি প্রবল প্রতিবাদ তাঁর রচনাবলি। তাঁর প্রতিভা বিরল মাত্রার, বিশেষ করে প্রবলতা ও রাজনীতি-সচেতনতার এই সাহিত্যিক সমন্বয়ের কারণেই।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ইমেরিটাস অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক, গবেষক
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: স মরণ র জন ত ক উপন য স আহমদ র র রচন
এছাড়াও পড়ুন:
পরিবেশকে স্বাস্থ্যকর রাখার বিষয়টি মানব সভ্যতার সঙ্গে সম্পর্কিত
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমদ খান বলেছেন, “পরিবেশকে স্বাস্থ্যকর রাখার বিষয়টি প্রকৃত অর্থে মানব সভ্যতার সঙ্গে সম্পর্কিত। পরিবেশকে সুন্দর রাখতে হলে প্রতিনিয়তই কিছু না কিছু করে যেতে হবে। এসব কাজ একা একা কখনোই করা যায় না। ব্যক্তি ও সামষ্টিক উভয়ভাবেই করতে হয়। তাহলে কাজগুলোর পরিপূর্ণতা আসে।”
মঙ্গলবার (১৫ এপ্রিল) বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবন মিলনায়তনে ‘উন্নয়নের স্বার্থে পরিচ্ছন্ন সবুজ ক্যাম্পাস’ অনুষ্ঠানের সমাপনী পর্বে প্রধান অতিথির বক্তব্যে উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান এসব কথা বলেন।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়, ইউনিডো, ঢাকাস্থ নরওয়ে দূতাবাস এবং প্রাণ আরএফএল গ্রুপের সহযোগিতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
আরো পড়ুন:
ডাকসু নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা
নববর্ষে ডুজায় পান্তা-ইলিশ উৎসব
এ সময় উপাচার্য বলেন, “এ প্রশিক্ষণ কর্মসূচি মানুষের অস্তিত্বের যে সংগ্রাম, সেটাতে ভূমিকা রাখবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সবসময় এসব কাজের সঙ্গে থাকবে। আমাদের এখানে পরিবেশ ক্লাবগুলো কাজ করছে। আমি খুব আশাবাদী। তবে খেয়াল রাখতে হবে, এ কাজগুলো যাতে থেমে না যায়। কোনো না কোনোভাবে কাজগুলো নিয়ে লেগে থাকতে হবে। চেষ্টা করে যেতে হবে। তাহলেই সফলতা পাওয়া সম্ভব হবে।”
অনুষ্ঠানটি তিনটি পর্বে বিভক্ত ছিলো। উদ্বোধনী ও সমাপনী পর্বে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. মামুন আহমেদ। উদ্বোধনী পর্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. ফাহমিদা খানম।
এ সময় অন্যদের মাঝে বক্তব্য দেন, পরিবেশ অধিদপ্তরের ডিজি মো. কামরুজ্জামান, ইউনিডোর বাংলাদেশ প্রতিনিধি জাকি উজ জামান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মো. রিদওয়ানুল হক, পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক আব্দুল আল মামুন, প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের সুমাইয়া তাবাসসুম আহমেদ প্রমুখ।
দ্বিতীয় পর্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল ও বুয়েটের প্রায় ৪০০ শিক্ষার্থীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। পরে শিক্ষার্থীদের হাতে সনদ তুলে দেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান।
ঢাকা/সৌরভ/মেহেদী