মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সমস্যা একটি ঐতিহাসিক এবং ভূরাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি না পেয়ে নিজ ভূখণ্ডে রাষ্ট্রবিহীন নাগরিক হিসেবে তারা দীর্ঘদিন বসবাস করে আসছে। গত শতাব্দীর সত্তরের দশকের শেষ থেকে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের জন্য বৈরী পরিবেশ সৃষ্টি হয়। সেই সময়ে প্রথম বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঘটে।

এরপর নিয়মিত বিরতিতে তাদের আগমন ঘটতে থাকে। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ বিগত সময়ে বেশির ভাগ রোহিঙ্গার নিজ দেশে প্রত্যাবাসন করতে পারলেও ৩০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা কয়েক দশক ধরে শরণার্থী হিসেবে কক্সবাজারের উখিয়ায় রেজিস্টার্ড ক্যাম্পে বসবাস করছিল। ২০১৭ সালে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। মিয়ানমারের সাম্প্রতিক যুদ্ধ পরিস্থিতির জন্যও অনেক রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ করে।  

এই নতুন রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শরণার্থী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। তবে তাদের সামগ্রিক ভরণ-পোষণ দেখাশোনা এবং ক্যাম্পের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব বাংলাদেশকেই বহন করতে হচ্ছে। বিগত সরকারের সময়ে মূলত রোহিঙ্গাদের প্রতিদিনের ব্যবস্থাপনা এবং ভরণপোষণ ব্যতীত এই সমস্যা সমাধানের তেমন কোনো ইতিবাচক পদক্ষেপ এবং সাফল্য দেখা যায়নি। এখানে আমাদের কূটনৈতিক ব্যর্থতা ছিল, ছিল অদূরদর্শী পরিকল্পনা। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সমস্যাকে আন্তর্জাতিক পরিসরে তুলে ধরার ক্ষেত্রেও রাষ্ট্র হিসেবে আমরা চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ ছিলাম।

এই বিশালসংখ্যক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণের অষ্টম বছর প্রায় শেষের দিকে। বিগত আট বছরে আমরা একজন রোহিঙ্গাকেও তার নিজ দেশে পাঠানোর মতো অবস্থা তৈরি করতে পারিনি। রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যাটি আমাদের জন্য একটি গুরুতর সমস্যা হলেও বিগত সময়ে আমরা একটি রোড ম্যাপ তৈরি করতে পারিনি। পারিনি একটি সামগ্রিক শরণার্থী পলিসি বা জাতীয় কর্মপরিকল্পনা তৈরি করতে।

এতসব ব্যর্থতার মধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সমস্যাকে যথাযথ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করছে। তার বেশ কিছু নমুনা দেখা গেছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো একজন উপদেষ্টার পদমর্যাপ্রাপ্ত প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা সমস্যা ও অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়াবলি–সংক্রান্ত হাইরিপ্রেজেন্টেটিভ এর নিয়োগ দেওয়া। এর মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যার মোকাবিলার জন্য একটি নিবেদিত দপ্তর তৈরি হয়েছে, যার প্রধান কাজ হলো রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান নিয়ে নিবেদিতভাবে কাজ করে যাওয়া।

এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে আমরা দেখতে পারি। কেননা, বিগত সময়ে রোহিঙ্গা সমস্যাটি শুধু দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের অধীনই দেখা হতো। বর্তমান সরকারের এই উদ্যোগ রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানের জন্য একটি বাস্তবসম্মত উদ্যোগ।

রাখাইন অঞ্চলে চীন ও ভারতের কোনো অন্তর্নিহিত স্বার্থ রয়েছে কি না, সেটিও আমাদের মূল্যায়ন করতে হবে। যদি তা–ই থাকে, তাহলে সেটিও মাথায় রেখে একটি কার্যকর এবং বাস্তবসম্মত কূটনৈতিক পদক্ষেপ হাতে নিতে হবে। যাতে ভারত ও চীনকে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করা সম্ভব হয়। কেননা, ভারত ও চীন তাদের নিজেদের স্বার্থ বলি দিয়ে বাংলাদেশের কথা চিন্তা করবে বলে মনে হয় না।

রোহিঙ্গা সমস্যাটাকে আন্তর্জাতিক পরিসরে গুরুত্বের সাথে তুলে ধরার কথা বিভিন্ন মহল থেকে বারবার বলা হয়েছে। যাতে করে আমরা রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে জাতিসংঘসহ অন্যান্য শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর প্রত্যক্ষ সহায়তা পেতে পারি। এরই ধারাবাহিকতায় আমরা দেখতে পাচ্ছি, রোহিঙ্গা সমস্যাকে সামনে নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজন করার কাজ চলছে।

এ প্রসঙ্গে ইউএন রিফিউজি এজেন্সির প্রধান ফিলিপো গ্র্যান্ডির একটি মন্তব্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলছেন ‘আমাদের উচিত এই বিষয়টাকে বৈশ্বিক পরিসরে নিয়ে যাওয়া। ইউএন সম্মেলনের মাধ্যমেই আমরা এই বিষয়টাকে আবারো বৈশ্বিক এজেন্ডাতে নিয়ে আসতে পারি।’

এরই ধারাবাহিকতায় জাতিসংঘের বর্তমান মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস চার দিনের সফরে বাংলাদেশে এসেছেন। বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তিনি কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রায় এক লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সঙ্গে ইফতার ও মতবিনিময় করেন। এটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ বলে আমি মনে করি। জাতিসংঘের মহাসচিবের এই ভ্রমণকে রোহিঙ্গা সমস্যাকে বিশ্বদরবারের একটি গুরুত্বের জায়গায় নিয়ে যাওয়ার প্রথম ধাপ হিসেবে আমরা দেখতে পারি। তিনি আন্তর্জাতিক সংস্থা ও সম্প্রদায়কে এই সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসার জন্য আহ্বান জানান।

বিগত সময়ে রোহিঙ্গা সমস্যাটি দুটি বড় কারণে আরও জটিল একটি জায়গায় চলে গেছে। এর একটি হলো মিয়ানমারে সামরিক ক্যু; এবং দ্বিতীয়টি হলো সাম্প্রতিক সময়ে রাখাইনে আরাকান আর্মির উত্থান। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমাদের ভিন্নতর কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিতে হবে, যেটি হতে হবে কার্যকর এবং বাস্তবসম্মত। এ প্রেক্ষাপটে প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা সমস্যা ও অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়াবলি–সংক্রান্ত হাইরিপ্রেজেন্টেটিভ আর কূটনৈতিক দক্ষতার পরিচয় রাখবেন বলে প্রত্যাশা করা যায়।

প্রথাগত দ্বিপক্ষীয় কূটনৈতিক ধ্যানধারণা থেকে বের হয়ে বহুমাত্রিক কূটনৈতিক ব্যবস্থার কথাও বিবেচনায় রাখতে হবে। আরাকান আর্মির সঙ্গেও যোগাযোগ রাখা জরুরি বলে মনে করা হয়। তাদের বোঝাতে হবে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে তাদের নিজেদের জন্যও জরুরি একটি বিষয় এবং এর সমাধান হলে তারাও একটি শান্তিপূর্ণ ও অন্তর্ভূক্তিমূলক সমাজ গঠনের মাধ্যমে লাভবান হবে।

আমরা যেমন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কথা গুরুত্বের সঙ্গে চিন্তা করার কথা বলছি, ঠিক তেমনি আঞ্চলিক এবং প্রভাবশালী রাষ্ট্রের কথাও মাথায় রাখতে হবে। এর মধ্যে চীন ও ভারত দুটি দেশই রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। চীন ও ভারত কেন আমাদের রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানের জন্য সহায়তা করবে সেই বিষয়ে আমাদের গভীর পর্যালোচনা করতে হবে।

রাখাইন অঞ্চলে চীন ও ভারতের কোনো অন্তর্নিহিত স্বার্থ রয়েছে কি না, সেটিও আমাদের মূল্যায়ন করতে হবে। যদি তা–ই থাকে, তাহলে সেটিও মাথায় রেখে একটি কার্যকর এবং বাস্তবসম্মত কূটনৈতিক পদক্ষেপ হাতে নিতে হবে। যাতে ভারত ও চীনকে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করা সম্ভব হয়। কেননা, ভারত ও চীন তাদের নিজেদের স্বার্থ বলি দিয়ে বাংলাদেশের কথা চিন্তা করবে বলে মনে হয় না।

আন্তর্জাতিক পরিসরে কাজ করার পাশাপাশি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর শরণার্থী শিবিরের জীবনযাপন এর দিকেও নজর রাখতে হবে, যেন তারা একটি সম্মানজনক জীবনযাপন করতে পারে। এ ক্ষেত্রে পরবর্তী প্রজন্মের শিক্ষার বিষয়টিও আমাদের মাথায় রাখতে হবে যা একটি বড় চ্যালেঞ্জের বিষয়। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সন্তানেরাও যেন উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করার সুযোগ পেতে পারে সেদিকেও আমাদের নজর দিতে হবে।

তা না হলে একটি বিরাট তরুণ সমাজ হতাশাগ্রস্ত জীবনযাপন করবে, যা আমাদের স্থানীয় জনগোষ্ঠী এবং শরণার্থীদের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনবে না। শরণার্থীদের ব্যবস্থাপনায় অর্থের জোগান একটি বড় চ্যালেঞ্জের বিষয় বাংলাদেশের জন্য।

প্রতিবছর অর্থের জোগান কমে যাওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ব্যবস্থাপনার জন্য একটি অশনিসংকেত। তাই যথাযথ জোগানের ব্যবস্থা করাও আমাদের জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ। এ প্রসঙ্গে জাতিসংঘের মহাসচিব রোহিঙ্গাদের জন্য খাদ্যসহায়তা কমানোকে একটি ‘অপরাধ’ বলে বিবেচনা করেন। তিনি তাদের সহায়তা বৃদ্ধির জন্য কাজ করার জোরালো আশ্বাস দেন।

এমন একটি জটিল অবস্থায় একটি সামগ্রিক, ব্যাপক ও বাস্তবসম্মত রোডম্যাপ তৈরি করা জরুরি বিষয়। সেখানে বিভিন্ন ধাপে আমাদের কাজ করতে হবে। আন্তর্জাতিক পরিসরে রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে যাওয়া যেমন গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়, পাশাপাশি তাদের স্বেচ্ছায় ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন নিয়ে কূটনৈতিক আলাপ চালিয়ে যেতে হবে। এর সঙ্গে শরণার্থী শিবিরে বসবাসরত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নের জন্যও কাজ করতে হবে, যেন তারা একটি মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপন করতে পারে।

বুলবুল সিদ্দিকী নৃবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক, রাজনীতি ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: শরণ র থ দ র ন উপদ ষ ট র র জন য একট জনগ ষ ঠ র ক পদক ষ প ও আম দ র ন র জন য ক টন ত ক দ র জন য ন য একট সমস য ক ক জ করত সমস য ট ক জ কর

এছাড়াও পড়ুন:

গুতেরেসের সফর: রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান কোন দিকে

মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সমস্যা একটি ঐতিহাসিক এবং ভূরাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি না পেয়ে নিজ ভূখণ্ডে রাষ্ট্রবিহীন নাগরিক হিসেবে তারা দীর্ঘদিন বসবাস করে আসছে। গত শতাব্দীর সত্তরের দশকের শেষ থেকে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের জন্য বৈরী পরিবেশ সৃষ্টি হয়। সেই সময়ে প্রথম বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঘটে।

এরপর নিয়মিত বিরতিতে তাদের আগমন ঘটতে থাকে। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ বিগত সময়ে বেশির ভাগ রোহিঙ্গার নিজ দেশে প্রত্যাবাসন করতে পারলেও ৩০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা কয়েক দশক ধরে শরণার্থী হিসেবে কক্সবাজারের উখিয়ায় রেজিস্টার্ড ক্যাম্পে বসবাস করছিল। ২০১৭ সালে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। মিয়ানমারের সাম্প্রতিক যুদ্ধ পরিস্থিতির জন্যও অনেক রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ করে।  

এই নতুন রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শরণার্থী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। তবে তাদের সামগ্রিক ভরণ-পোষণ দেখাশোনা এবং ক্যাম্পের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব বাংলাদেশকেই বহন করতে হচ্ছে। বিগত সরকারের সময়ে মূলত রোহিঙ্গাদের প্রতিদিনের ব্যবস্থাপনা এবং ভরণপোষণ ব্যতীত এই সমস্যা সমাধানের তেমন কোনো ইতিবাচক পদক্ষেপ এবং সাফল্য দেখা যায়নি। এখানে আমাদের কূটনৈতিক ব্যর্থতা ছিল, ছিল অদূরদর্শী পরিকল্পনা। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সমস্যাকে আন্তর্জাতিক পরিসরে তুলে ধরার ক্ষেত্রেও রাষ্ট্র হিসেবে আমরা চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ ছিলাম।

এই বিশালসংখ্যক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণের অষ্টম বছর প্রায় শেষের দিকে। বিগত আট বছরে আমরা একজন রোহিঙ্গাকেও তার নিজ দেশে পাঠানোর মতো অবস্থা তৈরি করতে পারিনি। রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যাটি আমাদের জন্য একটি গুরুতর সমস্যা হলেও বিগত সময়ে আমরা একটি রোড ম্যাপ তৈরি করতে পারিনি। পারিনি একটি সামগ্রিক শরণার্থী পলিসি বা জাতীয় কর্মপরিকল্পনা তৈরি করতে।

এতসব ব্যর্থতার মধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সমস্যাকে যথাযথ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করছে। তার বেশ কিছু নমুনা দেখা গেছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো একজন উপদেষ্টার পদমর্যাপ্রাপ্ত প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা সমস্যা ও অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়াবলি–সংক্রান্ত হাইরিপ্রেজেন্টেটিভ এর নিয়োগ দেওয়া। এর মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যার মোকাবিলার জন্য একটি নিবেদিত দপ্তর তৈরি হয়েছে, যার প্রধান কাজ হলো রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান নিয়ে নিবেদিতভাবে কাজ করে যাওয়া।

এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে আমরা দেখতে পারি। কেননা, বিগত সময়ে রোহিঙ্গা সমস্যাটি শুধু দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের অধীনই দেখা হতো। বর্তমান সরকারের এই উদ্যোগ রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানের জন্য একটি বাস্তবসম্মত উদ্যোগ।

রাখাইন অঞ্চলে চীন ও ভারতের কোনো অন্তর্নিহিত স্বার্থ রয়েছে কি না, সেটিও আমাদের মূল্যায়ন করতে হবে। যদি তা–ই থাকে, তাহলে সেটিও মাথায় রেখে একটি কার্যকর এবং বাস্তবসম্মত কূটনৈতিক পদক্ষেপ হাতে নিতে হবে। যাতে ভারত ও চীনকে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করা সম্ভব হয়। কেননা, ভারত ও চীন তাদের নিজেদের স্বার্থ বলি দিয়ে বাংলাদেশের কথা চিন্তা করবে বলে মনে হয় না।

রোহিঙ্গা সমস্যাটাকে আন্তর্জাতিক পরিসরে গুরুত্বের সাথে তুলে ধরার কথা বিভিন্ন মহল থেকে বারবার বলা হয়েছে। যাতে করে আমরা রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে জাতিসংঘসহ অন্যান্য শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর প্রত্যক্ষ সহায়তা পেতে পারি। এরই ধারাবাহিকতায় আমরা দেখতে পাচ্ছি, রোহিঙ্গা সমস্যাকে সামনে নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজন করার কাজ চলছে।

এ প্রসঙ্গে ইউএন রিফিউজি এজেন্সির প্রধান ফিলিপো গ্র্যান্ডির একটি মন্তব্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলছেন ‘আমাদের উচিত এই বিষয়টাকে বৈশ্বিক পরিসরে নিয়ে যাওয়া। ইউএন সম্মেলনের মাধ্যমেই আমরা এই বিষয়টাকে আবারো বৈশ্বিক এজেন্ডাতে নিয়ে আসতে পারি।’

এরই ধারাবাহিকতায় জাতিসংঘের বর্তমান মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস চার দিনের সফরে বাংলাদেশে এসেছেন। বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তিনি কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রায় এক লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সঙ্গে ইফতার ও মতবিনিময় করেন। এটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ বলে আমি মনে করি। জাতিসংঘের মহাসচিবের এই ভ্রমণকে রোহিঙ্গা সমস্যাকে বিশ্বদরবারের একটি গুরুত্বের জায়গায় নিয়ে যাওয়ার প্রথম ধাপ হিসেবে আমরা দেখতে পারি। তিনি আন্তর্জাতিক সংস্থা ও সম্প্রদায়কে এই সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসার জন্য আহ্বান জানান।

বিগত সময়ে রোহিঙ্গা সমস্যাটি দুটি বড় কারণে আরও জটিল একটি জায়গায় চলে গেছে। এর একটি হলো মিয়ানমারে সামরিক ক্যু; এবং দ্বিতীয়টি হলো সাম্প্রতিক সময়ে রাখাইনে আরাকান আর্মির উত্থান। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমাদের ভিন্নতর কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিতে হবে, যেটি হতে হবে কার্যকর এবং বাস্তবসম্মত। এ প্রেক্ষাপটে প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা সমস্যা ও অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়াবলি–সংক্রান্ত হাইরিপ্রেজেন্টেটিভ আর কূটনৈতিক দক্ষতার পরিচয় রাখবেন বলে প্রত্যাশা করা যায়।

প্রথাগত দ্বিপক্ষীয় কূটনৈতিক ধ্যানধারণা থেকে বের হয়ে বহুমাত্রিক কূটনৈতিক ব্যবস্থার কথাও বিবেচনায় রাখতে হবে। আরাকান আর্মির সঙ্গেও যোগাযোগ রাখা জরুরি বলে মনে করা হয়। তাদের বোঝাতে হবে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে তাদের নিজেদের জন্যও জরুরি একটি বিষয় এবং এর সমাধান হলে তারাও একটি শান্তিপূর্ণ ও অন্তর্ভূক্তিমূলক সমাজ গঠনের মাধ্যমে লাভবান হবে।

আমরা যেমন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কথা গুরুত্বের সঙ্গে চিন্তা করার কথা বলছি, ঠিক তেমনি আঞ্চলিক এবং প্রভাবশালী রাষ্ট্রের কথাও মাথায় রাখতে হবে। এর মধ্যে চীন ও ভারত দুটি দেশই রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। চীন ও ভারত কেন আমাদের রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানের জন্য সহায়তা করবে সেই বিষয়ে আমাদের গভীর পর্যালোচনা করতে হবে।

রাখাইন অঞ্চলে চীন ও ভারতের কোনো অন্তর্নিহিত স্বার্থ রয়েছে কি না, সেটিও আমাদের মূল্যায়ন করতে হবে। যদি তা–ই থাকে, তাহলে সেটিও মাথায় রেখে একটি কার্যকর এবং বাস্তবসম্মত কূটনৈতিক পদক্ষেপ হাতে নিতে হবে। যাতে ভারত ও চীনকে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করা সম্ভব হয়। কেননা, ভারত ও চীন তাদের নিজেদের স্বার্থ বলি দিয়ে বাংলাদেশের কথা চিন্তা করবে বলে মনে হয় না।

আন্তর্জাতিক পরিসরে কাজ করার পাশাপাশি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর শরণার্থী শিবিরের জীবনযাপন এর দিকেও নজর রাখতে হবে, যেন তারা একটি সম্মানজনক জীবনযাপন করতে পারে। এ ক্ষেত্রে পরবর্তী প্রজন্মের শিক্ষার বিষয়টিও আমাদের মাথায় রাখতে হবে যা একটি বড় চ্যালেঞ্জের বিষয়। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সন্তানেরাও যেন উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করার সুযোগ পেতে পারে সেদিকেও আমাদের নজর দিতে হবে।

তা না হলে একটি বিরাট তরুণ সমাজ হতাশাগ্রস্ত জীবনযাপন করবে, যা আমাদের স্থানীয় জনগোষ্ঠী এবং শরণার্থীদের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনবে না। শরণার্থীদের ব্যবস্থাপনায় অর্থের জোগান একটি বড় চ্যালেঞ্জের বিষয় বাংলাদেশের জন্য।

প্রতিবছর অর্থের জোগান কমে যাওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ব্যবস্থাপনার জন্য একটি অশনিসংকেত। তাই যথাযথ জোগানের ব্যবস্থা করাও আমাদের জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ। এ প্রসঙ্গে জাতিসংঘের মহাসচিব রোহিঙ্গাদের জন্য খাদ্যসহায়তা কমানোকে একটি ‘অপরাধ’ বলে বিবেচনা করেন। তিনি তাদের সহায়তা বৃদ্ধির জন্য কাজ করার জোরালো আশ্বাস দেন।

এমন একটি জটিল অবস্থায় একটি সামগ্রিক, ব্যাপক ও বাস্তবসম্মত রোডম্যাপ তৈরি করা জরুরি বিষয়। সেখানে বিভিন্ন ধাপে আমাদের কাজ করতে হবে। আন্তর্জাতিক পরিসরে রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে যাওয়া যেমন গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়, পাশাপাশি তাদের স্বেচ্ছায় ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন নিয়ে কূটনৈতিক আলাপ চালিয়ে যেতে হবে। এর সঙ্গে শরণার্থী শিবিরে বসবাসরত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নের জন্যও কাজ করতে হবে, যেন তারা একটি মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপন করতে পারে।

বুলবুল সিদ্দিকী নৃবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক, রাজনীতি ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়

সম্পর্কিত নিবন্ধ