১৯৮০-এর দশকে ব্যাংক অব ক্রেডিট অ্যান্ড কমার্স ইন্টারন্যাশনাল (বিসিসিআই) ও তার করিতকর্মা চেয়ারম্যান আগা হাসান আবেদির সঙ্গে স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বিশেষ সম্পর্ক ছিল। কিন্তু সম্পর্কটা যে কতটা বিশেষ, তা খুব কম মানুষই জানতেন।

এরশাদের আত্মীয়দের চাকরির প্রয়োজন হলে আবেদি গোপনে তাঁদের উচ্চ বেতনে বিসিসিআইয়ের হংকং, ব্রিটেন ও কানাডা শাখায় নিয়োগ দিতেন। এরশাদও প্রতিদান দিতেন। মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশ ব্রুনেইয়ের লাভজনক ব্যাংকিং খাতে ব্যবসা করতে আবেদির কূটনৈতিক আশ্রয়ের প্রয়োজন হলে এরশাদ সেই দেশে নতুন দূতাবাসই খুলে বসলেন এবং ব্যাংকের একজন ডাকসাইটে কর্মকর্তাকে রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দেন। সে জন্য রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অর্থ ব্যয় হলো। বাস্তবতা হলো, ওই দূতাবাস কার্যত বিসিসিআইয়ের বিক্রয় কার্যালয় হিসেবেই মূলত ব্যবহৃত হয়, ঠিক দূতাবাস হিসেবে নয়।

এরপর ক্ষমতায় শেষ দিকে বিদেশি সহায়তার কমিশন ও কোটি কোটি ডলার অবৈধ অর্থ বিদেশে পাচার করার জন্য এরশাদের সহায়তা প্রয়োজন হলে এগিয়ে আসেন সেই আবেদি।

অর্ধশতাধিক দুর্নীতির মামলায় ক্ষমতাচ্যুত এরশাদের তখন বিচার চলছিল। সরকারের প্রধান কৌঁসুলির তথ্যানুসারে, বিসিসিআই নিজের আন্তর্জাতিক ব্যাংক শাখার নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে ইউরোপ, কানাডা, ক্যারিবীয় অঞ্চল ও দূর প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে এরশাদের ব্যাংক হিসাবে এসব অর্থ পাঠিয়েছে।

সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে অ্যাটর্নি জেনারেল আমিনুল ইসলাম (তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল) দুঃখ করে বলেছেন, ‘এরা দুজনেই দেশকে লুণ্ঠন করেছে।’ ওই সাক্ষাৎকারে তিনি প্রথমবার এরশাদের বিরুদ্ধে টাকা পাচারের অভিযোগের বিষয়ে সবিস্তার বলেছেন, অর্থাৎ কীভাবে বিসিসিআইয়ের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে ১০০ কোটি ডলারের বেশি পরিমাণ অর্থ পাচার করা হয়েছে।

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘এই বিসিসিআই ব্যাংকটি পাচারকারীদের স্বর্গরাজ্য। সব দুর্নীতিবাজ ও পাচারকারীর ব্যাংকিং সেবা দিত বিসিসিআই। আমাদের দেশ ধ্বংসে তারা মদদ দিয়েছে।’

কে এই আবেদি

পাকিস্তানি নাগরিক আগা হাসান আবেদির নিজস্ব একটা স্টাইল ছিল—ভাবখানা এমন ছিল যে তিনি নানা জনদরদি কাজের মাধ্যমে তৃতীয় বিশ্বকে উদ্ধার করছেন। কিন্তু দ্য টাইমসের হাতে আসা বিভিন্ন নথি ও বিসিসিআইয়ের বিভিন্ন কর্মকর্তার সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, এই ব্যাংক তৃতীয় বিশ্বের উপকারের চেয়ে অপকারই বেশি করেছে। লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস আগা হাসান আবেদিকে বিপণনের জাদুকর হিসেবেও আখ্যা দিয়েছে। বিশ্বের ৭০টির বেশি দেশে এই ব্যাংক গরিবের কল্যাণে নিয়োজিত বলে প্রচারণা চালানো হতো।

সংবাদে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মতো গরিব দেশে বিসিসিআই ব্যাংকিং আইনের সর্বোচ্চ সুবিধা নিয়েছে—সরকারকে কর না দেওয়া থেকে শুরু করে দেশ থেকে যত পরিমাণ মুনাফা নিয়ে যাওয়া সম্ভব তা নেওয়া। মুনাফার এই অর্থ ব্যাংকটি তাদের আন্তর্জাতিক বিভিন্ন করপোরেশন ও সাবসিডিয়ারি কোম্পানিতে নিয়ে গেছে। তদন্তে উঠে আসছে, সেই অর্থ ব্যাংকটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও তাঁদের বন্ধুদের ভোগে গেছে।

১৯৯০ সালে গণ–অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এরশাদ সরকারের পতন ও বিশ্বব্যাপী বিসিসিআই ব্যাংক বন্ধ হয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে এখন টের পাওয়া যাচ্ছে, তারা কীভাবে মানুষকে শোষণ করেছে। বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশে তারা এভাবেই কাজ করেছে। ব্যাংকটির সাবেক এক কর্মকর্তার ভাষায়, তারা ছিল ন্যায়ভ্রষ্ট—রবিন হুডের ঠিক উল্টো। রবিন হুড ধনীদের কাছ থেকে অর্থ কেড়ে গরিবদের দিত—তারা গরিবদের অর্থ কেড়ে নিয়ে ধনীদের দিত।

বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশে শাখা খোলার কয়েক বছরের মধ্যে ব্যাংকটি দেশ থেকে ১২ মিলিয়ন বা ১ কোটি ২০ লাখ ডলার মুনাফা নিয়ে যায়।

বিসিসিআইয়ের কুটিল পরিকল্পনা

কিন্তু ১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক পুঁজি পাচার রোধে কঠোর ব্যবস্থা নেয় এবং মন্দ ঋণের বিপরীতে সঞ্চিতি বাড়ানোর চাপ দিলে লন্ডনে ব্যাংকটির শীর্ষ কর্তারা কুটিল এক পরিকল্পনা করেন। কর ফাঁকি দিতে তাঁরা পৃথক একটি ব্যাংক চালু করেন।

প্রথমত, বিসিসি ফাউন্ডেশন গঠন করে বিসিসিআই। গরিব ছাত্রদের বৃত্তি দিতে মূলত এই ফাউন্ডেশন গঠন করা হয়। তার সঙ্গে গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র ও বিদ্যালয়ে পাঠাগার তৈরিতে অনুদান দিত তারা। ব্যাংকটির বাংলাদেশ শাখার পরিচালন মুনাফা থেকে এর অর্থায়ন করা হয়েছে। এর বিপরীতে তাদের কার্যক্রম কার্যত কর মওকুফ করে দেওয়া হয়।

কিন্তু বাস্তবতা হলো, বিসিসিআইয়ের মুনাফার ১০ শতাংশেরও কম জনদরদি কাজে ব্যয় হতো। ঠিক তারা যে কায়দায় পাকিস্তানে কর ফাঁকি দিত, বাংলাদেশেও সেই কায়দা করেছে। বাংলাদেশের বিসিসি ফাউন্ডেশন যে পরিমাণ সুদ আয় করত, তার চেয়ে অনেক কম পরিমাণ অর্থ জনদরদি কাজে ব্যয় করত।

ফাউন্ডেশনর মূল কর্মসূচি ছিল মেধা সহায়ক কর্মসূচি। এর মাধ্যমে দরিদ্র কলেজছাত্রদের সুদবিহীন ঋণ দেওয়া হতো। এই কার্যক্রমের আওতায় ১৯৯০ সালে মাত্র ৪ লাখ টাকা বা তৎকালীন ১০ হাজার ৫০০ ডলার অনুদান দেওয়া হয়েছে। অথচ ফাউন্ডেশন নিজে ১০ মিলিয়ন বা ১ কোটি টাকা সুদ আয় করেছে।

সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, ফাউন্ডেশনের সবচেয়ে বড় অঙ্কের অনুদান জনদরদি কাজে দেওয়া হয়নি, ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে তারা নিজেরাই সেই টাকা নিয়েছে। ব্যাংক অব স্মল ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যান্ড কমার্স বা বেসিক ব্যাংক গঠনে ১ দশমিক ৫ মিলিয়ন বা ১৫ লাখ ডলার বিনিয়োগ করে তারা। সেই ব্যাংকের কর্মকর্তারা ছিলেন প্রায় সবাই বিসিসিআই থেকে আসা। ফাউন্ডেশনের এমন লাভজনক কাজে বিনিয়োগ সরকার কেবল আইনি স্বীকৃতিই দিল না, বরং স্বৈরশাসক এরশাদ ও তাঁর আর্থিক উপদেষ্টা সেই ব্যাংকে বিনিয়োগ করেন। তাঁরা ব্যাংকের এক-তৃতীয়াংশ মালিকানা কিনে নিয়ে তারল্য জোগান দেন।

বিসিসিআইয়ের সাবেক কর্মকর্তারা বলেন, এরশাদ নিজে বেসিক ব্যাংককে লাইসেন্স দিয়েছেন, যেখানে অন্যান্য ব্যাংকের লাইসেন্স আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। ১৯৮৭ সালে বেসিক ব্যাংকের জমকালো উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এরশাদ নিজে উপস্থিত ছিলেন। এই বিনিয়োগের ন্যায্যতা প্রমাণে ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তারা বলেন, নতুন ব্যাংককে অবশ্যই সব মুনাফা ফাউন্ডেশনে ফেরত দিতে হবে। কিন্তু তাঁরা স্বীকার করেছেন, কার্যত ব্যাংকের সব মুনাফা ব্যবসা সম্প্রসারণে ব্যয় হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত ফাউন্ডেশনের পর্ষদ নিয়েছে, যাদের সঙ্গে বিসিসিআই পর্ষদের কার্যত পার্থক্য ছিল না। অর্থাৎ ফাউন্ডেশনের লক্ষ্য ছিল শত শত কোটি টাকার কর ফাঁকি দেওয়া।

সরকার ও বিসিসিআই একাকার

শুধু এরশাদ নয়, বিসিসিআইয়ের কাছ থেকে আরও অনেক রাজনৈতিক নেতাই লাভবান হয়েছেন। ফলে রাজনৈতিক আশীর্বাদ পেতে ব্যাংকটিকে বেগ পেতে হয়নি। এরশাদের জমানায় তাঁর তিনজন জামাতা ব্যাংকে কাজ করেছেন এবং এর মধ্য দিয়ে ব্যাংকটিতে রাজনৈতিক নিয়োগ শুরু হয়। পরবর্তী পর্যায়ে এত বেশিসংখ্যক রাজনৈতিক নিয়োগ হয়েছে যে বিসিসিআই ও সরকারের ভেদরেখা একরকম মুছে যায়।

যে দুই দশক তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয় বিসিসিআই ব্যবসা করেছে, ওই সময় তারা প্রতিটি দেশেই গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীদের দু–একজন বা তাঁদের আত্মীয়দের নিয়োগ দিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে তারা ক্ষমতাসীন দলের আশীর্বাদ নিশ্চিত করেছে। কিন্তু বাংলাদেশে সেই সংখ্যা ১৫-এর কম নয়। প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, পুলিশপ্রধান, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নরদের ছেলেমেয়ে ও আত্মীয়স্বজন এই ব্যাংকে কাজ করেছেন।

এ নিয়োগের মধ্য দিয়ে সরকারের সঙ্গে বিসিসিআইয়ের সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হয়। সরকার ও বিসিসিসিআই যে একাকার হয়ে গিয়েছিল, তার সবচেয়ে নাটকীয় উদাহরণ হচ্ছে ১৯৮৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর জামাতা ইফতেখার করিমকে ব্রুনেইয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দেওয়া।

ইফতেখার করিম তখন ফ্রান্সের প্যারিসে বিসিসিআইয়ের নির্বাহী হিসেবে কাজ করছিলেন। কিন্তু আবেদির ব্যক্তিগত অনুরোধে এরশাদ ইফতেখারকে শুধু বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দিলেন না, তাঁকে ব্রুনেইয়ে বাংলাদেশের দূতাবাসের দায়িত্ব দিয়ে পাঠালেন। বিষয়টি হলো, বিসিসিসিআই তখন ব্রুনেইয়ে শাখা খোলার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছিল। তারা মূলত সুলতানের ২৫ বিলিয়ন ডলার সরকারি তহবিলের ভাগ নিতে মরিয়া।

কিন্তু করিম শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হন। সেখানে চারটি ব্রিটিশ ব্যাংক আগে থেকেই সুলতানের পেছনে লাইন ধরে ছিল। ফলে তাদের ডিঙিয়ে বিসিসিআইয়ের পক্ষে সেই তহবিল জোগাড় করা সম্ভব হয়নি। করিম নিজে খুব ভালো ব্যাংকার ছিলেন, কিন্তু তারপরও বিষয়টি ছিল অসম্ভব। অন্যদিকে করিমের বিলাসবহুল জীবনযাপন নিয়ে বিভিন্ন পত্রিকায় সমালোচনামূলক প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত দূতাবাস বন্ধ করে দেয়। এই কাজটি যে এরশাদ আবেদিকে খুশি করতে করেছিলেন, সেটা তখন সবাই জানলেও মুখে বলতে সাহস পেতেন না।

এরশাদ পতনের পর এসব ঘটনা জানাজানি হয় এবং বিসিসিআই বাংলাদেশের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধের সময় ব্যাংকে ১৫ হাজার বাংলাদেশের আমানত আটকা পড়ে। এরপর বিভিন্ন তদন্তে এরশাদের সঙ্গে আবেদির বিশেষ সখ্যের বিষয়গুলো জনসমক্ষে প্রকাশিত হয়।

ওই সময় খালেদা জিয়ার সরকার এরশাদের আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা তদন্তে নিউইয়র্কের একটি আর্থিক তদন্তকারী ফার্মকে নিয়োগ দেয়।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব স স আই ব য ব স স আইয় র কর মকর ত র র জন ত ক সরক র র এরশ দ র র কর ম ক জ কর কর ত র পর ম ণ ক র যত ব যবস তদন ত

এছাড়াও পড়ুন:

বিসিসিআইয়ের সঙ্গে মিলে যেভাবে লুণ্ঠন চালিয়েছেন সাবেক স্বৈরশাসক এরশাদ

১৯৮০-এর দশকে ব্যাংক অব ক্রেডিট অ্যান্ড কমার্স ইন্টারন্যাশনাল (বিসিসিআই) ও তার করিতকর্মা চেয়ারম্যান আগা হাসান আবেদির সঙ্গে স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বিশেষ সম্পর্ক ছিল। কিন্তু সম্পর্কটা যে কতটা বিশেষ, তা খুব কম মানুষই জানতেন।

এরশাদের আত্মীয়দের চাকরির প্রয়োজন হলে আবেদি গোপনে তাঁদের উচ্চ বেতনে বিসিসিআইয়ের হংকং, ব্রিটেন ও কানাডা শাখায় নিয়োগ দিতেন। এরশাদও প্রতিদান দিতেন। মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশ ব্রুনেইয়ের লাভজনক ব্যাংকিং খাতে ব্যবসা করতে আবেদির কূটনৈতিক আশ্রয়ের প্রয়োজন হলে এরশাদ সেই দেশে নতুন দূতাবাসই খুলে বসলেন এবং ব্যাংকের একজন ডাকসাইটে কর্মকর্তাকে রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দেন। সে জন্য রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অর্থ ব্যয় হলো। বাস্তবতা হলো, ওই দূতাবাস কার্যত বিসিসিআইয়ের বিক্রয় কার্যালয় হিসেবেই মূলত ব্যবহৃত হয়, ঠিক দূতাবাস হিসেবে নয়।

এরপর ক্ষমতায় শেষ দিকে বিদেশি সহায়তার কমিশন ও কোটি কোটি ডলার অবৈধ অর্থ বিদেশে পাচার করার জন্য এরশাদের সহায়তা প্রয়োজন হলে এগিয়ে আসেন সেই আবেদি।

অর্ধশতাধিক দুর্নীতির মামলায় ক্ষমতাচ্যুত এরশাদের তখন বিচার চলছিল। সরকারের প্রধান কৌঁসুলির তথ্যানুসারে, বিসিসিআই নিজের আন্তর্জাতিক ব্যাংক শাখার নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে ইউরোপ, কানাডা, ক্যারিবীয় অঞ্চল ও দূর প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে এরশাদের ব্যাংক হিসাবে এসব অর্থ পাঠিয়েছে।

সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে অ্যাটর্নি জেনারেল আমিনুল ইসলাম (তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল) দুঃখ করে বলেছেন, ‘এরা দুজনেই দেশকে লুণ্ঠন করেছে।’ ওই সাক্ষাৎকারে তিনি প্রথমবার এরশাদের বিরুদ্ধে টাকা পাচারের অভিযোগের বিষয়ে সবিস্তার বলেছেন, অর্থাৎ কীভাবে বিসিসিআইয়ের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে ১০০ কোটি ডলারের বেশি পরিমাণ অর্থ পাচার করা হয়েছে।

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘এই বিসিসিআই ব্যাংকটি পাচারকারীদের স্বর্গরাজ্য। সব দুর্নীতিবাজ ও পাচারকারীর ব্যাংকিং সেবা দিত বিসিসিআই। আমাদের দেশ ধ্বংসে তারা মদদ দিয়েছে।’

কে এই আবেদি

পাকিস্তানি নাগরিক আগা হাসান আবেদির নিজস্ব একটা স্টাইল ছিল—ভাবখানা এমন ছিল যে তিনি নানা জনদরদি কাজের মাধ্যমে তৃতীয় বিশ্বকে উদ্ধার করছেন। কিন্তু দ্য টাইমসের হাতে আসা বিভিন্ন নথি ও বিসিসিআইয়ের বিভিন্ন কর্মকর্তার সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, এই ব্যাংক তৃতীয় বিশ্বের উপকারের চেয়ে অপকারই বেশি করেছে। লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস আগা হাসান আবেদিকে বিপণনের জাদুকর হিসেবেও আখ্যা দিয়েছে। বিশ্বের ৭০টির বেশি দেশে এই ব্যাংক গরিবের কল্যাণে নিয়োজিত বলে প্রচারণা চালানো হতো।

সংবাদে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মতো গরিব দেশে বিসিসিআই ব্যাংকিং আইনের সর্বোচ্চ সুবিধা নিয়েছে—সরকারকে কর না দেওয়া থেকে শুরু করে দেশ থেকে যত পরিমাণ মুনাফা নিয়ে যাওয়া সম্ভব তা নেওয়া। মুনাফার এই অর্থ ব্যাংকটি তাদের আন্তর্জাতিক বিভিন্ন করপোরেশন ও সাবসিডিয়ারি কোম্পানিতে নিয়ে গেছে। তদন্তে উঠে আসছে, সেই অর্থ ব্যাংকটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও তাঁদের বন্ধুদের ভোগে গেছে।

১৯৯০ সালে গণ–অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এরশাদ সরকারের পতন ও বিশ্বব্যাপী বিসিসিআই ব্যাংক বন্ধ হয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে এখন টের পাওয়া যাচ্ছে, তারা কীভাবে মানুষকে শোষণ করেছে। বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশে তারা এভাবেই কাজ করেছে। ব্যাংকটির সাবেক এক কর্মকর্তার ভাষায়, তারা ছিল ন্যায়ভ্রষ্ট—রবিন হুডের ঠিক উল্টো। রবিন হুড ধনীদের কাছ থেকে অর্থ কেড়ে গরিবদের দিত—তারা গরিবদের অর্থ কেড়ে নিয়ে ধনীদের দিত।

বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশে শাখা খোলার কয়েক বছরের মধ্যে ব্যাংকটি দেশ থেকে ১২ মিলিয়ন বা ১ কোটি ২০ লাখ ডলার মুনাফা নিয়ে যায়।

বিসিসিআইয়ের কুটিল পরিকল্পনা

কিন্তু ১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক পুঁজি পাচার রোধে কঠোর ব্যবস্থা নেয় এবং মন্দ ঋণের বিপরীতে সঞ্চিতি বাড়ানোর চাপ দিলে লন্ডনে ব্যাংকটির শীর্ষ কর্তারা কুটিল এক পরিকল্পনা করেন। কর ফাঁকি দিতে তাঁরা পৃথক একটি ব্যাংক চালু করেন।

প্রথমত, বিসিসি ফাউন্ডেশন গঠন করে বিসিসিআই। গরিব ছাত্রদের বৃত্তি দিতে মূলত এই ফাউন্ডেশন গঠন করা হয়। তার সঙ্গে গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র ও বিদ্যালয়ে পাঠাগার তৈরিতে অনুদান দিত তারা। ব্যাংকটির বাংলাদেশ শাখার পরিচালন মুনাফা থেকে এর অর্থায়ন করা হয়েছে। এর বিপরীতে তাদের কার্যক্রম কার্যত কর মওকুফ করে দেওয়া হয়।

কিন্তু বাস্তবতা হলো, বিসিসিআইয়ের মুনাফার ১০ শতাংশেরও কম জনদরদি কাজে ব্যয় হতো। ঠিক তারা যে কায়দায় পাকিস্তানে কর ফাঁকি দিত, বাংলাদেশেও সেই কায়দা করেছে। বাংলাদেশের বিসিসি ফাউন্ডেশন যে পরিমাণ সুদ আয় করত, তার চেয়ে অনেক কম পরিমাণ অর্থ জনদরদি কাজে ব্যয় করত।

ফাউন্ডেশনর মূল কর্মসূচি ছিল মেধা সহায়ক কর্মসূচি। এর মাধ্যমে দরিদ্র কলেজছাত্রদের সুদবিহীন ঋণ দেওয়া হতো। এই কার্যক্রমের আওতায় ১৯৯০ সালে মাত্র ৪ লাখ টাকা বা তৎকালীন ১০ হাজার ৫০০ ডলার অনুদান দেওয়া হয়েছে। অথচ ফাউন্ডেশন নিজে ১০ মিলিয়ন বা ১ কোটি টাকা সুদ আয় করেছে।

সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, ফাউন্ডেশনের সবচেয়ে বড় অঙ্কের অনুদান জনদরদি কাজে দেওয়া হয়নি, ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে তারা নিজেরাই সেই টাকা নিয়েছে। ব্যাংক অব স্মল ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যান্ড কমার্স বা বেসিক ব্যাংক গঠনে ১ দশমিক ৫ মিলিয়ন বা ১৫ লাখ ডলার বিনিয়োগ করে তারা। সেই ব্যাংকের কর্মকর্তারা ছিলেন প্রায় সবাই বিসিসিআই থেকে আসা। ফাউন্ডেশনের এমন লাভজনক কাজে বিনিয়োগ সরকার কেবল আইনি স্বীকৃতিই দিল না, বরং স্বৈরশাসক এরশাদ ও তাঁর আর্থিক উপদেষ্টা সেই ব্যাংকে বিনিয়োগ করেন। তাঁরা ব্যাংকের এক-তৃতীয়াংশ মালিকানা কিনে নিয়ে তারল্য জোগান দেন।

বিসিসিআইয়ের সাবেক কর্মকর্তারা বলেন, এরশাদ নিজে বেসিক ব্যাংককে লাইসেন্স দিয়েছেন, যেখানে অন্যান্য ব্যাংকের লাইসেন্স আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। ১৯৮৭ সালে বেসিক ব্যাংকের জমকালো উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এরশাদ নিজে উপস্থিত ছিলেন। এই বিনিয়োগের ন্যায্যতা প্রমাণে ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তারা বলেন, নতুন ব্যাংককে অবশ্যই সব মুনাফা ফাউন্ডেশনে ফেরত দিতে হবে। কিন্তু তাঁরা স্বীকার করেছেন, কার্যত ব্যাংকের সব মুনাফা ব্যবসা সম্প্রসারণে ব্যয় হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত ফাউন্ডেশনের পর্ষদ নিয়েছে, যাদের সঙ্গে বিসিসিআই পর্ষদের কার্যত পার্থক্য ছিল না। অর্থাৎ ফাউন্ডেশনের লক্ষ্য ছিল শত শত কোটি টাকার কর ফাঁকি দেওয়া।

সরকার ও বিসিসিআই একাকার

শুধু এরশাদ নয়, বিসিসিআইয়ের কাছ থেকে আরও অনেক রাজনৈতিক নেতাই লাভবান হয়েছেন। ফলে রাজনৈতিক আশীর্বাদ পেতে ব্যাংকটিকে বেগ পেতে হয়নি। এরশাদের জমানায় তাঁর তিনজন জামাতা ব্যাংকে কাজ করেছেন এবং এর মধ্য দিয়ে ব্যাংকটিতে রাজনৈতিক নিয়োগ শুরু হয়। পরবর্তী পর্যায়ে এত বেশিসংখ্যক রাজনৈতিক নিয়োগ হয়েছে যে বিসিসিআই ও সরকারের ভেদরেখা একরকম মুছে যায়।

যে দুই দশক তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয় বিসিসিআই ব্যবসা করেছে, ওই সময় তারা প্রতিটি দেশেই গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীদের দু–একজন বা তাঁদের আত্মীয়দের নিয়োগ দিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে তারা ক্ষমতাসীন দলের আশীর্বাদ নিশ্চিত করেছে। কিন্তু বাংলাদেশে সেই সংখ্যা ১৫-এর কম নয়। প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, পুলিশপ্রধান, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নরদের ছেলেমেয়ে ও আত্মীয়স্বজন এই ব্যাংকে কাজ করেছেন।

এ নিয়োগের মধ্য দিয়ে সরকারের সঙ্গে বিসিসিআইয়ের সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হয়। সরকার ও বিসিসিসিআই যে একাকার হয়ে গিয়েছিল, তার সবচেয়ে নাটকীয় উদাহরণ হচ্ছে ১৯৮৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর জামাতা ইফতেখার করিমকে ব্রুনেইয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দেওয়া।

ইফতেখার করিম তখন ফ্রান্সের প্যারিসে বিসিসিআইয়ের নির্বাহী হিসেবে কাজ করছিলেন। কিন্তু আবেদির ব্যক্তিগত অনুরোধে এরশাদ ইফতেখারকে শুধু বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দিলেন না, তাঁকে ব্রুনেইয়ে বাংলাদেশের দূতাবাসের দায়িত্ব দিয়ে পাঠালেন। বিষয়টি হলো, বিসিসিসিআই তখন ব্রুনেইয়ে শাখা খোলার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছিল। তারা মূলত সুলতানের ২৫ বিলিয়ন ডলার সরকারি তহবিলের ভাগ নিতে মরিয়া।

কিন্তু করিম শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হন। সেখানে চারটি ব্রিটিশ ব্যাংক আগে থেকেই সুলতানের পেছনে লাইন ধরে ছিল। ফলে তাদের ডিঙিয়ে বিসিসিআইয়ের পক্ষে সেই তহবিল জোগাড় করা সম্ভব হয়নি। করিম নিজে খুব ভালো ব্যাংকার ছিলেন, কিন্তু তারপরও বিষয়টি ছিল অসম্ভব। অন্যদিকে করিমের বিলাসবহুল জীবনযাপন নিয়ে বিভিন্ন পত্রিকায় সমালোচনামূলক প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত দূতাবাস বন্ধ করে দেয়। এই কাজটি যে এরশাদ আবেদিকে খুশি করতে করেছিলেন, সেটা তখন সবাই জানলেও মুখে বলতে সাহস পেতেন না।

এরশাদ পতনের পর এসব ঘটনা জানাজানি হয় এবং বিসিসিআই বাংলাদেশের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধের সময় ব্যাংকে ১৫ হাজার বাংলাদেশের আমানত আটকা পড়ে। এরপর বিভিন্ন তদন্তে এরশাদের সঙ্গে আবেদির বিশেষ সখ্যের বিষয়গুলো জনসমক্ষে প্রকাশিত হয়।

ওই সময় খালেদা জিয়ার সরকার এরশাদের আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা তদন্তে নিউইয়র্কের একটি আর্থিক তদন্তকারী ফার্মকে নিয়োগ দেয়।

সম্পর্কিত নিবন্ধ