সম্ভাব্য বিপদের আশঙ্কায় প্রায়ই চিন্তামগ্ন থাকতেন রোমান দোব্রোখোতভ। রাশিয়ার এই সাংবাদিক দেশটির প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের শাসনামল নিয়ে অনুসন্ধানী কাজ চালিয়েছিলেন। তাঁর এমনই একটি অনুসন্ধানে উন্মোচিত হয়েছিল ২০১৮ সালের সলসব্যুরি বিষক্রিয়ার ঘটনার জন্য দায়ী চক্রের মুখোশ। এটি ক্রেমলিনের নিশানা বানিয়েছিল তাঁকে।

অনুসন্ধানী এ সম্পাদক ২০২১ সালের কোনো একদিন জার্মানির বার্লিনগামী একটি বাণিজ্যিক ফ্লাইট ধরতে বুদাপেস্ট বিমানবন্দরের টারমাকে অপেক্ষা করছিলেন। বার্লিনে একটি খুনের বিচারে তথ্যপ্রমাণ হাজির করার কথা ছিল তাঁর। কিন্তু সে সময় তাঁর পেছনেই যে শ্যামবর্ণের এক নারী দাঁড়িয়ে ছিলেন, সেটি দোব্রোখোতভের জানা ছিল না।

পরে উড়োজাহাজে উঠেও দোব্রোখোতভের কাছেই একটি আসনে বসেছিলেন ওই নারী। এটিকে তেমন কিছু মনে করেননি তিনি। দোব্রোখোতভ এ–ও দেখেননি যে তাঁর কাঁধে ক্যামেরা গোঁজা, যা দিয়ে সন্তর্পণে ভিডিও করা হচ্ছে।

অরলিন রুসেভকে গুপ্তচরবৃত্তির প্রতি মোহাবিষ্ট এক ব্যক্তি হিসেবে আখ্যায়িত করেন তাঁর এক সহযোগী। রুসেভের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক ই–মেইল ঠিকানায় বিশ্বের বিখ্যাত কল্পকাহিনির গোয়েন্দা চরিত্র জেমস বন্ডের ‘০০৭’ কোড নম্বরের উল্লেখ রয়েছে।

সেদিন সকালেই ইংল্যান্ডের লুটন থেকে হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্ট উড়ে এসেছিলেন এই নারী। এর আগেই দোব্রোখোতভের ফ্লাইটের তথ্য জোগাড় করেন তিনি।

নির্দিষ্ট গন্তব্যে উড়োজাহাজটির ছুটে চলার পথে ক্যাটরিন ইভানোভা নামের এই বুলগেরীয় নারী টেলিগ্রামে একটি বার্তা পাঠান।

ক্যাটরিন তাঁর সঙ্গী বাইসের ঝামবাজোভের সঙ্গে উত্তর লন্ডনের হ্যারোতে থাকতেন। ক্যাটরিনের জন্য অপেক্ষা করছিলেন তিনি। এরই মধ্যে দোব্রোখোতভকে নিয়ে উড়োজাহাজ বার্লিনে পৌঁছায়।

ক্যাভেটকা নামের আরেকজন নারী ও বিমানবন্দরের কর্মীও এরই মধ্যে একই গন্তব্যে পৌঁছান। বার্লিনে তাঁরও নজর ছিল দোব্রোখোতভের ওপর। কিন্তু তাঁরা দুজনই দোব্রোখোতভকে হারিয়ে ফেলেন।

এভাবেই ক্যাটরিনদের ৬ সদস্যের একটি গুপ্তচর চক্র ইউরোপজুড়ে রাশিয়ার শত্রুদের শনাক্ত করার কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল বছরের পর বছর। চক্রটির নেতারা ক্রেমলিনের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তির বিভিন্ন কৌশল, অপহরণ ও হত্যার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। ষড়যন্ত্রে যুক্ত থাকার অভিযোগে ৭ মার্চ লন্ডনের ওল্ড বেইলি (ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের কেন্দ্রীয় অপরাধ আদালত) চক্রটির তিন সদস্যকে অভিযুক্ত করেন। বাকি তিন সদস্য আগেই আদালতে তাঁদের দোষ স্বীকার করেন।

পরে দোব্রোখোতভ বিবিসিকে বলেন, ‘আমরা এমন এক পরিস্থিতির ভেতর আছি, যেখানে আমাদের মধ্যে অল্প কয়েকজনই বেঁচে যাবেন। হয় তাঁরা হবেন রুশ সাংবাদিক ও মানবাধিকার পর্যবেক্ষকেরা অথবা ভ্লাদিমির পুতিন ও তাঁর সহযোগী খুনিরা।’

বার্লিনের ঘটনাবলি যুক্তরাজ্য থেকে পর্যবেক্ষণ করছিলেন টেলিগ্রাম গ্রুপের সর্বশেষ সদস্য ৪৭ বছর বয়সী অরলিন রুসেভ। তিনিও বুলগেরীয় নাগরিক।

অরলিন রুসেভকে গুপ্তচরবৃত্তির প্রতি মোহাবিষ্ট এক ব্যক্তি হিসেবে আখ্যায়িত করেন তাঁর এক সহযোগী। রুসেভের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক ই–মেইল ঠিকানায় বিশ্বের বিখ্যাত কল্পকাহিনির গোয়েন্দা চরিত্র জেমস বন্ডের ‘০০৭’ কোড নম্বরের উল্লেখ রয়েছে।

রুসেভ ২০০৯ সালে যুক্তরাজ্যে যান ও সাংকেতিক গোয়েন্দা তথ্যের ওপর একটি প্রতিষ্ঠান খোলেন। তাঁর এ সিগন্যাল ইন্টেলিজেন্স দিয়ে পরস্পরের যোগাযোগ কিংবা ইলেকট্রনিক সিগন্যালের ওপর নজরদারি করা যায়।

আমরা এমন এক পরিস্থিতির ভেতর আছি, যেখানে আমাদের মধ্যে অল্প কয়েকজনই বেঁচে যাবেন। হয় তাঁরা হবেন রুশ সাংবাদিক ও মানবাধিকার পর্যবেক্ষকেরা অথবা ভ্লাদিমির পুতিন ও তাঁর সহযোগী খুনিরা। —রোমান দোব্রোখোতভ, রুশ সাংবাদিক

রুসেভ ইংল্যান্ডের গ্রেট ইয়ারমাউথ শহরের একসময়ের যে অতিথিশালায় স্ত্রী ও সৎসন্তানকে নিয়ে থাকতেন, সেখানে তল্লাশি চালিয়েছে মেট্রোপলিটন পুলিশ। সেখানে গোয়েন্দাগিরিতে ব্যবহৃত টেকনিক্যাল সার্ভেইল্যান্সের অনেক যন্ত্রপাতি পাওয়া যায়।

রুশ গোয়েন্দাদের নিশানায় পড়েও বেঁচে যাওয়া নিয়ে সাংবাদিক দোব্রোখোতভ বলছিলেন, ‘আমি ভাগ্যবান যে বেঁচে আছি।’

রুসেভের বসবাস করা ওই অতিথিশালা যেন আলাদিনের গুহা। যোগাযোগের ওপর নজরদারি করার ১ লাখ ৭৫ হাজার পাউন্ড মূল্যের অত্যাধুনিক সব যন্ত্র, রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি জ্যামার, ধোঁয়া শনাক্তকারী যন্ত্রে লুকানো গোপন ক্যামেরা, কলম, সানগ্লাস, টাই, জাল পরিচয়পত্র—কী নেই সেখানে। ছিল একটি হার্ড ড্রাইভ খোলা অবস্থায়। আর সেখানে থাকা ল্যাপটপে রুসেভের টেলিগ্রাম কথোপকথন দৃশ্যমান ছিল।

এত সব যন্ত্র ও উপকরণের মধ্যে পুলিশ একসময়ের ফাইন্যান্স এক্সিকিউটিভ জ্যঁ মার্সালেকের একটি ব্যবসায়িক কার্ডও উদ্ধার করে।

রুসেভ প্রথম ২০১৫ সালে এই নির্বাহীর সঙ্গে পরিচিত হন। বিবিসির দেখা ই–মেইলগুলো অনুযায়ী, মার্সালেক একটি চীনা কোম্পানির কাছ থেকে এক নিরাপদ মোবাইল ফোন পেতে রুসেভের সাহায্য চেয়েছিলেন। ওই সময় মার্সালেক ছিলেন জার্মানির একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা।

এ জুটি একসঙ্গে সাংবাদিক, ভিন্নমতাবলম্বী, রাজনীতিবিদ—এমনকি জার্মানির শহর স্টুটগার্টে একটি মার্কিন সামরিক স্থাপনায় প্রশিক্ষণরত ইউক্রেনীয় সৈন্যদের লক্ষ্য করে অভিযান চালানোর পরিকল্পনা করেছিলেন। তাঁরা ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আটক মার্কিন ড্রোন চীনের কাছে বিক্রি করা নিয়েও আলোচনা করেছিলেন। আর এটি করা হয়েছিল রাশিয়ার স্বার্থে।

গোয়েন্দাদের তথ্য অনুযায়ী, মার্সালেক মস্কোয় আত্মগোপন করে আছেন বলে মনে করা হচ্ছে। তবে যুক্তরাজ্যে তাঁর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই।

রুসেভ যে গুপ্তচর চক্র নিযুক্ত করেছিলেন, তাঁরা সবাই বুলগেরীয়। তাঁরা খুব পরিচিত গুপ্তচর ছিলেন না।

রুসেভের বসবাস করা ওই অতিথিশালা যেন আলাদিনের গুহা। যোগাযোগের ওপর নজরদারি করার ১ লাখ ৭৫ হাজার পাউন্ড মূল্যের অত্যাধুনিক সব যন্ত্র, রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি জ্যামার, ধোঁয়া শনাক্তকারী যন্ত্রে লুকানো গোপন ক্যামেরা, কলম, সানগ্লাস, টাই, জাল পরিচয়পত্র—কী নেই সেখানে। ছিল একটি হার্ড ড্রাইভ খোলা অবস্থায়। আর সেখানে থাকা ল্যাপটপে রুসেভের টেলিগ্রাম কথোপকথন দৃশ্যমান ছিল।

চিকিৎসাপণ্য সরবরাহকারী বাইসের ঝামবাজোভ ও ল্যাবরেটরি সহকারী ক্যাটরিন ইভানোভা ছাড়াও রুসেভ বিউটিশিয়ান ভ্যানিয়া গ্যাবেরোভা, চিত্রকর ও ডেকোরেটর তিহোমির ইভানচেভ এবং এমএমএ যোদ্ধা ইভান স্টয়ানোভকে তাঁর চক্রে নিয়োগ দিয়েছিলেন। স্টয়ানোভ ‘দ্য ডেস্ট্রয়ার’ নামেও পরিচিত।

গুপ্তচর চক্রটির ছয় সদস্যের সবাই আটক হয়েছেন। তাঁদের কেউই যুক্তরাজ্যে থেকে গোপন কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়ার কথা অস্বীকার করেননি। রুসেভ, ঝামবাজোভ ও স্টয়ানোভ আদালতে অপরাধ স্বীকার করেছেন। কিন্তু ইভানোভা, গ্যাবেরোভা ও ইভানচেভ রাশিয়ার পক্ষে নিজেদের কাজ করার বিষয়টি তাঁদের জানা ছিল—এটি মানতে অস্বীকৃতি জানান।

অবশ্য জুরি এ তিনজনের বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন। পরে তাঁদেরও দোষী সাব্যস্ত করেন আদালত। তাঁদের ১৪ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে। আগামী মে মাসে তাঁদের বিরুদ্ধে কারাদণ্ড ঘোষণা করা হবে।

তবে এটিই শেষ নয়। সাংবাদিক দোব্রোখোতভ বিবিসিকে বলছিলেন, ‘(রাশিয়ায়) সরকার বদল না হলে এই চক্রের জায়গায় নতুন লোকেরা সক্রিয় হবেন, যাঁরা আপনাকে হয় মেরে ফেলবেন, নয় অপহরণ করবেন।’

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ষ ট এক ত কর ন র ওপর সদস য র একট সহয গ

এছাড়াও পড়ুন:

হুমকি না থাকলেও বর্ষবরণে সতর্ক আইনশৃঙ্খলা বাহিনী

উৎসবমুখর পরিবেশে সারা দেশে পালিত হচ্ছে বাংলা নববর্ষ। এ উৎসবকে ঘিরে কোনো ধরনের হুমকি না থাকলেও সতর্ক অবস্থানে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। 

সোমবার (১৪ এপ্রিল) ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী রাইজিংবিডিকে এ তথ্য জানান। 

ডিএমপি কমিশনার বলেন, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, রমনা বটমূলসহ পুরো ঢাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। ঢাকার প্রধান সড়ক থেকে অলি গলিতেও গোয়েন্দা নজরদারি করছে। গুরুত্বপূর্ণ স্থানে চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। টহল বৃদ্ধি করা হয়েছে।”

এদিকে, প্রতিবারের মতো এবারও নববর্ষে সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে র‌্যাব দেশব্যাপী গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করেছে। নববর্ষের অনুষ্ঠান শেষ না হওয়া পর্যন্ত নিরাপত্তা জোরদার করতে সারা দেশে র‌্যাবের সব সদস্য নিজ নিজ দায়িত্বপূর্ণ এলাকায় কাজ করছেন। 

সকালে র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিকুর রহমান বলেন, “র‌্যাব সদর দপ্তরে কন্ট্রোল রুমের মাধ্যমে ঢাকাসহ সারা দেশে নিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ ও সমন্বয় করা হচ্ছে।”

তিনি জানান, র‌্যাব সারা দেশে ২২৪টি পিকআপ টহল, ১২২টি মোটরসাইকেল টহলসহ সর্বমোট ৩৪৬টি টহল ও সাদা পোশাকে ৪১৩ জন সহ সর্বমোট ২৪৪৯ জন র‌্যাব সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। বাংলা নববর্ষ উদযাপন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠান দেশীয় ও আন্তর্জাতিক কোন উগ্রবাদী গোষ্ঠী, অন্যান্য নিষিদ্ধ সংগঠন এবং রাষ্ট্র ও সরকারবিরোধী কুচক্রী মহল যাতে কোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে না পারে সে লক্ষ্যে র‌্যাবের গোয়েন্দা নজরদারি জোরদার করা হয়েছে। 

লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিকুর রহমান বলেন, “বাংলা নববর্ষকে কেন্দ্র করে কোনো ধরণের নাশকতার ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। তবুও আমরা আত্মতুষ্টিতে ভুগছি না। গোয়েন্দা নজরদারি ও সাইবার জগতে মনিটরিং বৃদ্ধির মাধ্যমে নাশকতাকারীদের যেকোনো ধরনের নাশকতার পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দিতে প্রস্তুত রয়েছে র‌্যাব।”

ভার্চুয়াল জগতে নববর্ষকে কেন্দ্র করে যেকোনো ধরনের গুজব, উস্কানিমূলক তথ্য, মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে না পারে সে জন্য র‌্যাব সাইবার মনিটরিং টিম নজরদারি অব্যাহত রেখেছে বলেও তিনি জানান।

ঢাকা/এমআর/ইভা 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • হুমকি না থাকলেও বর্ষবরণে সতর্ক আইনশৃঙ্খলা বাহিনী
  • সাহিত্যে রন্ধনশিল্পের প্রভাব
  • পয়লা বৈশাখে থাকছে র‌্যাবের বিশেষ নিরাপত্তা 
  • নববর্ষ উদযাপনে র‌্যাবের বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা, থাকবে মোবাইল কোর্ট