নির্বাচন নিয়ে ধূম্রজাল বাড়াল ‘সংক্ষিপ্ত’ ও ‘বৃহৎ সংস্কার’
Published: 17th, March 2025 GMT
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার সর্বশেষ বক্তব্য ঘিরে রাজনীতিতে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো মনে করছে, নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়ের ব্যাপারে প্রধান উপদেষ্টা এত দিন যে অবস্থান প্রকাশ করেছিলেন, সর্বশেষ বক্তব্যে তাঁর আগের অবস্থান আবার কিছুটা নড়চড় হয়েছে। দলগুলোর নেতারা বলছেন, এতে সরকার সম্পর্কে মানুষের মধ্যে ভুল ধারণা তৈরি করবে এবং নির্বাচন নিয়ে ধূম্রজাল সৃষ্টি করবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস গত শুক্রবার ঢাকায় জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের সঙ্গে বৈঠকে সরকারের বিভিন্ন রকম সংস্কারের উদ্যোগ এবং আগামী জাতীয় নির্বাচনের বিষয়ে কথা বলেন। সেখানে তিনি নির্বাচন প্রসঙ্গে বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো যদি ‘সংক্ষিপ্ত সংস্কার প্যাকেজ’ নিয়ে একমত হয়, তবে নির্বাচন ডিসেম্বরেই হতে পারে। তবে তারা যদি ‘বৃহৎ সংস্কার প্যাকেজ’ গ্রহণ করে তাহলে নির্বাচন আগামী বছরের জুনে অনুষ্ঠিত হবে।
কথা বলে জানা গেছে, প্রধান উপদেষ্টার এ বক্তব্যে রাজনৈতিক দলগুলোকে নতুন করে ভাবনায় ফেলছে। দলগুলো সংশয় পড়েছে, প্রধান উপদেষ্টা ‘সংক্ষিপ্ত সংস্কার’ এবং ‘বৃহৎ সংস্কারের’ আলোচনা তুলে নির্বাচনপ্রক্রিয়া বিলম্বিত করার দিকে যাচ্ছেন কি না।
দলগুলোর নেতারা বলছেন, এতে সরকার সম্পর্কে মানুষের মধ্যে ভুল ধারণা তৈরি করবে এবং নির্বাচন নিয়ে ধূম্রজাল সৃষ্টি করবে।এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমদ গত শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা যেটা বলেছেন, তাতে ওনার আগের কমিটমেন্টের পরিবর্তন মনে হয়। তিনি অল্প সংস্কার আর বৃহৎ সংস্কার বলতে কী বোঝাতে চাইছেন পরিষ্কার নয়। বৃহৎ সংস্কার বলতে হয়তো বোঝাতে চান, সাংবিধানিক সংস্কার। এটা (সংস্কার) পরবর্তী সংসদের ওপর ছাড়তে হবে। আর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তারা হয়তো ঐকমত্যের সনদে পৌঁছাতে চান। এগুলোর জন্য তো বেশি সময় লাগার কথা না।’
রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা বলছেন, এর বাইরে অন্য কোনো বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের যদি বেশি সময় দরকার হয়, তাহলে সেটাও পরিষ্কার করে বলা প্রয়োজন। যাতে রাজনৈতিক দল এবং সাধারণ মানুষ ধোঁয়াশায় না থাকে। সেটি না করে ‘অল্প সংস্কার’, ‘বেশি সংস্কার’, ‘সংক্ষিপ্ত সংস্কার’, ‘বৃহৎ সংস্কার’—এমন বিষয় সামনে আনা হলে সব মহলে বিভ্রান্তি সৃষ্টির অবকাশ থাকে। এতে সরকার সম্পর্কে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ভুল–বোঝাবুঝি বাড়াবে। বিভিন্ন রকম সংশয়-সন্দেহ তৈরি হবে।
প্রধান উপদেষ্টা যেটা বলেছেন, তাতে ওনার আগের কমিটমেন্টের পরিবর্তন মনে হয়। তিনি অল্প সংস্কার আর বৃহৎ সংস্কার বলতে কী বোঝাতে চাইছেন পরিষ্কার নয়। বৃহৎ সংস্কার বলতে হয়তো বোঝাতে চান, সাংবিধানিক সংস্কার। এটা (সংস্কার) পরবর্তী সংসদের ওপর ছাড়তে হবে। আর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তারা হয়তো ঐকমত্যের সনদে পৌঁছাতে চান। এগুলোর জন্য তো বেশি সময় লাগার কথা না।বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমদএ বিষয়ে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মো.
অবশ্য বিএনপি আগামী ডিসেম্বর নাগাদ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে আরও আগে থেকেই সংশয়ে রয়েছে। গত সোমবার দলের স্থায়ী কমিটির সর্বশেষ সভায় নির্বাচন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন করেন নেতারা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর এই সংশয়ের মূলে রয়েছে নির্বাচন নিয়ে সরকারের কোনো কোনো উপদেষ্টার ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য এবং নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতাদের নানা কথাবার্তা। সর্বশেষ এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের দুটি আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থাকে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, এখন দেশে যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, পুলিশ যে রকম নাজুক অবস্থায় আছে; এ রকম অবস্থায় নির্বাচন করাটা অনেক বেশি কঠিন হবে।
সংস্কার কোনটা সংক্ষিপ্ত, কোনটা বিস্তৃত—সেটা ডিসাইড (ঠিক) করবে কে? তাহলে তো এটা ঠিক করার জন্য আরেকটা কমিশন করতে হবে। আমরা মনে করি, একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলো হওয়া দরকার।জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহেরবিএনপির উচ্চপর্যায়ের একাধিক নেতা বলেন, তাঁরা আঁচ করছিলেন যে সরকারের ভেতর থেকেই নির্বাচন বিলম্বিত করার প্রচেষ্টা রয়েছে। এরই মধ্যে ‘বৃহৎ সংস্কার প্যাকেজ’ গ্রহণ করা হলে নির্বাচন আগামী বছরের জুনে হবে বলে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য সামনে এসেছে।
যদিও গত ১৬ ডিসেম্বর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা জাতীয় নির্বাচনের একটি সম্ভাব্য সময়ের কথা বলেছিলেন। তখন তিনি বলেছিলেন, অল্প সংস্কার করে নির্বাচন চাইলে ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে, আর আরেকটু বেশি সংস্কার করে নির্বাচন চাইলে ২০২৬ সালের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে নির্বাচন করা সম্ভব। এরপর একাধিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও ব্যক্তিত্বকে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, আগামী ডিসেম্বর নাগাদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের চেষ্টা করছে তাঁর সরকার। নির্বাচন কমিশনও (ইসি) সেভাবে প্রস্তুতি নেওয়ার কথা বলেছে। এখন ‘সংক্ষিপ্ত সংস্কার’, ‘বৃহৎ সংস্কারের’ প্রশ্ন তুলে আগামী বছরের জুনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা ওঠায় রাজনৈতিক মহলে সংশয় তৈরি হয়েছে।
অবশ্য ‘ছোট সংস্কার’ বা ‘বড় সংস্কার’ কী, সেটা বুঝতে অপারগ বলে মন্তব্য করেছেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সংস্কার তো এখনো শুরু হয়নি। মাত্র থিওরিটিক্যাল কাজ হয়েছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন বলেছে, ১৬৬টি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব এসেছে। তো যেগুলোতে ঐকমত্য হবে, সেগুলো করব। যেগুলোতে ঐকমত্য হবে না, করব না। এখানে ছোট বা বড় বলতে তো কিছু নেই। আমরা চাই প্রয়োজনীয় সংস্কার, অর্থাৎ যে সংস্কারে একটি কোয়ালিটি (মানসম্মত) নির্বাচন হয়, সেটাই করতে হবে।’
এখন ‘সংক্ষিপ্ত সংস্কার’, ‘বৃহৎ সংস্কারের’ প্রশ্ন তুলে আগামী বছরের জুনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা ওঠায় রাজনৈতিক মহলে সংশয় তৈরি হয়েছে।অন্তর্বর্তী সরকার–সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে, অন্তর্বর্তী সরকারের লক্ষ্য দেশের বিভিন্ন খাতে সংস্কার আনা। এ লক্ষ্যে ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন হয়েছে। এর মধ্যে সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশ, বিচার বিভাগ ও দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশন তাদের প্রস্তাব জমা দিয়েছে। পুলিশ ছাড়া বাকি পাঁচটি কমিশনের প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত চেয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এ নিয়ে দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করবে ঐকমত্য কমিশন।
আমরা মনে করি, নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট সংস্কারে এক-দেড় মাসের বেশি লাগার কথা নয়। সে হিসেবে আগামী জুন-জুলাইতে নির্বাচন হতে পারে।বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীতবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপি বড় সংস্কারে যাচ্ছে না। বড় সংস্কার হবে সংসদে। ছোটখাটো নির্বাচনী সংস্কার হতে পারে। যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়, হবে। আর যেগুলোতে ঐকমত্য হবে না, সেগুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের ম্যান্ডেট নিতে নির্বাচনে যাবে। জনগণ যাকে ম্যান্ডেট দেবে, সে সংস্কার করবে। তিনি বলেন, ‘আমরা মনে করি, নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট সংস্কারে এক-দেড় মাসের বেশি লাগার কথা নয়। সে হিসেবে আগামী জুন-জুলাইতে নির্বাচন হতে পারে।’
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব এনপ র স থ য় প রথম আল ক বছর র জ ন উপদ ষ ট র ড স ম বর সরক র র সরক র স ঐকমত য বল ছ ন র জন য র র জন ক র কর অবস থ দরক র
এছাড়াও পড়ুন:
ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচনের বিষয়ে একমত নয় বিএনপি
আগামী ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে প্রধান উপদেষ্টা জাতীয় ঐকমত্য কমিশনকে সংস্কার কার্যক্রম দ্রুত এগিয়ে নেওয়ার যে তাগিদ দিয়েছেন, তার সঙ্গে একমত নয় বিএনপি। তারা ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন চায়। বিএনপি এর বাইরে অন্য কোনো সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিরুদ্ধে বলে জানিয়েছেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমদ।
আজ শনিবার বিকেলে প্রধান উপদেষ্টা ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ ও সদস্য বদিউল আলম মজুমদার বৈঠক করেন। সেখানে প্রধান উপদেষ্টা এ তাগিদ দেন বলে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং গণমাধ্যমকে জানিয়েছে। এরপর রাতে বিএনপির বিভিন্ন সংস্কার প্রস্তাব তৈরির সঙ্গে যুক্ত সালাহ উদ্দিন আহমদ প্রথম আলোকে এ প্রতিক্রিয়া জানান।
এর আগে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে প্রধান উপদেষ্টা জাতীয় ঐকমত্য কমিশনকে সংস্কার কার্যক্রম দ্রুত এগিয়ে নেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছিল প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং। তখন সালাহ উদ্দিন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘যদি তিনি (প্রধান উপদেষ্টা) এ কথা বলে (ডিসেম্বরে নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্য) থাকেন, তাহলে সেটাকে আমরা পজিটিভলি দেখছি।’
তবে সালাহ উদ্দিন আহমদ বলেন, ‘আমরা মনে করি, উনি ডিসেম্বরে নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানাবেন, নির্দেশনা দেবেন এবং যথাযথ প্রক্রিয়ায় জাতির সামনে সে ঘোষণা দেবেন।’
পরে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে বক্তব্য সংশোধন করে জানানো হয়, আগামী ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে তাগিদ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা।
এ বিষয়ে পরে সালাহ উদ্দিন আহমদ বলেন, ‘ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টার তাগিদের বিষয়ে আমরা একমত নই। আমরা এ বছরের ডিসেম্বরের আগে নির্বাচন দাবি করি। আশা করি, তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে এ ব্যাপারে নির্দেশনা দেবেন।’
সালাহ উদ্দিন আহমদ বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা আমাদের কাছে পূর্বে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে ডিসেম্বরে নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে তিনি সব কার্যক্রম চালাচ্ছেন। আমরা সেটা জাতির কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানোর অনুরোধ করেছিলাম, যাতে জাতি আশ্বস্ত হয়, গণতন্ত্রবিরোধী শক্তি যাতে কোনো ষড়যন্ত্রের সুযোগ না পায়। কিন্তু তিনি অন্য একটি ফোরামে গিয়ে নির্বাচন ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে করার কথা বলেন। আমরা এর প্রতিক্রিয়া জানিয়েছি। উনি এখনো সে কথা বললে আমরা তাঁর সঙ্গে একমত নই।’
বিএনপির এই নেতা আরও বলেন, প্রধান উপদেষ্টা যদি ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে থাকেন, তাহলে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসে তাঁদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তাঁরা কোনো কর্মসূচি দেবেন কি না।
সালাহ উদ্দিন আহমদ বলেন, ‘আগামী ১৬ এপ্রিল আমরা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বসব। আমরা জানতে চাইব, আসলে উনি কী চাইছেন।’