জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের সঙ্গে সরকারের প্রতিনিধি, বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের প্রধান ও রাজনৈতিক দলের নেতাদের বৈঠকে সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এ বৈঠকে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ আগস্টের গণ–অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী প্রায় সব দলের নেতারা অংশ নিয়েছেন।
বৈঠকটি এমন সময় হলো, যখন সংস্কার নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনা চলমান। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ইতিমধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে সংস্কারবিষয়ক কিছু প্রশ্ন পাঠিয়েছে, যার উত্তর ১৩ মার্চের মধ্যে দেওয়ার কথা ছিল। কয়েকটি রাজনৈতিক দল উত্তর পাঠালেও অন্যরা সময় নিয়েছে। আবার কেউ কেউ ঐকমত্য কমিশনের প্রশ্নের ধরন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় জাতিসংঘ মহাসচিব বলেছেন, বাংলাদেশের অংশীজনেরাই সংস্কার বাস্তবায়ন করবে। কতটুকু এবং কীভাবে করবে, সে বিষয়ে তাদেরই ঠিক করতে হবে। জাতিসংঘ বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণ ও সংস্কারে সহায়তা দিয়ে যাবে।
বৈঠকে পাঁচটি সংস্কার কমিশনের প্রধানেরা তাঁদের প্রতিবেদনের সংস্কার প্রস্তাবের সারসংক্ষেপ তুলে ধরেছেন। অন্যদিকে রাজনৈতিক দলের নেতারাও মতামত ব্যক্ত করেছেন। কোনো কোনো রাজনৈতিক দল লিখিত বক্তব্য জমা দিয়েছে। এর মাধ্যমে জাতিসংঘ মহাসচিব বাংলাদেশের রাজনীতি ও আর্থসমাজিক বিষয়ে একটা ধারণা পেয়েছেন।
বৈঠকে রাজনৈতিক দলের নেতারা সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেছেন। তবে নির্বাচনের আগে কতটুকু সংস্কার আর কতটুকু পরে হবে, সেসব নিয়ে তাদের মধ্যে মতভেদ আছে। কেউ কেউ গণপরিষদের মাধ্যমে সংস্কার সম্পন্ন করার কথাও বলেছেন।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস আগেই জানিয়ে দিয়েছেন, রাজনৈতিক দলগুলো বেশি সংস্কার চাইলে আগামী বছরের জুনে এবং কম সংস্কার চাইলে চলতি বছরের ডিসেম্বরে নির্বাচন হবে। এর মাধ্যমে তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর কাছেই সিদ্ধান্তের ভার দিয়েছেন।
বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের বক্তৃতা–বিবৃতি দেখে মনে হয়, তাঁরা কোনো বিষয়ে একমত হতে পারবেন কি না, সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। কোনো দল কোনো বিষয়ে মত প্রকাশ করলে অন্যদের দায়িত্ব হয়ে পড়ে তার বিরোধিতা করা। কথাটি যুক্তি দিয়ে বললে সমস্যা হয় না। কিন্তু অনেকেই ‘সালিস মানি কিন্তু তালগাছ’ আমার অবস্থানে চলে যায়। গণ–অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর মধ্যে মত ও পথের ফারাক থাকা অস্বাভাবিক নয়। সংস্কারের মাত্রা ও সময় নিয়েও বিতর্ক থাকতে পারে। কিন্তু কিছু মৌলিক বিষয়ে তাদের তো একটা ঐকমত্যে আসতে হবে। সেটা তখনই সম্ভব, যখন রাজনৈতিক দলগুলো একে অপরকে ছাড় দেওয়ার মানসিকতা তৈরি করতে পারবে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ নির্ধারণ করা হয়েছে ছয় মাস। এত দিন অভিযোগ ছিল জাতীয় ঐকমত্য কমিশন আলোচনা করতে বিলম্ব করছে। আলোচনা শুরুর পর রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্বই বেশি। তারা যত দ্রুত কমিশনের প্রশ্নের উত্তর দেবে, তত দ্রুত আলোচনা শুরু হবে।
জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে রাজনৈতিক দলগুলোকে একটি কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন মনে করি। বাংলাদেশে অতীতে যত অঘটন ঘটেছে, তার দায় আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এড়াতে পারে না। তাদের ব্যর্থতার কারণেই গণ–অভ্যুত্থানের সুফল থেকে বঞ্চিত হয়েছে। আগস্টের গণ–অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রে উত্তরণের যে সুযোগ এসেছে, তা কোনোভাবে হারানো যাবে না।
আশা করি, রাজনৈতিক দলগুলোর বোধোদয় হবে এবং দলগুলো প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার পরিচয় দেবে। নির্বাচন ডিসেম্বরে না জুনে হলো, তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো দলগুলো রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে কতটা পরিবর্তন আনতে পারল।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
টেকসই ভবিষ্যৎ গড়তে জাতিসংঘ বাংলাদেশের পাশে থাকবে: গুতেরেস
বাংলাদেশের শান্তি ও সংলাপ প্রক্রিয়ায় জাতিসংঘ সহায়তা করবে বলে জানিয়েছে সংস্থাটির মহাসচিব অ্যান্টনিও গুতেরেস।
তিনি বলেন, “আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত বাংলাদেশের ন্যায়সঙ্গত, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টাকে সমর্থন করা, কারণ এটি দেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। বাংলাদেশের জনগণের পাশে থেকে একটি টেকসই ও ন্যায়সঙ্গত ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে জাতিসংঘ নির্ভরযোগ্য অংশীদার হিসেবে থাকবে।”
শনিবার (১৫ মার্চ) বিকেলে রাজধানীর এক হোটেলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
আরো পড়ুন:
ঈদের আগেই প্রস্তুত হচ্ছে মিরপুরের ৬০ ফিট রাস্তা: ডিএনসিসি প্রশাসক
ঐকমত্য কমিশন ও রাজনীতিকদের সঙ্গে জাতিসংঘ মহাসচিবের বৈঠক
গুতেরেস বলেন, “বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার ও পরিবর্তনের পথে এগোচ্ছে, আমি আপনাদের আশ্বস্ত করতে চাই যে, জাতিসংঘ শান্তি, জাতীয় সংলাপ, আস্থা ও সংহতি প্রতিষ্ঠায় সর্বদা সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।”
তিনি বলেন, “গুরুত্বপূর্ণ সময়ে বাংলাদেশের পাশে থাকতে পেরে আমি বিশেষভাবে আনন্দিত। প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের নেতৃত্বে দেশটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এবং জনগণ গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও সমৃদ্ধির এক নতুন ভবিষ্যতের আশায় রয়েছে।”
সংবাদ সম্মেলনের আগে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য, রাজনৈতিক দল, তরুণ সমাজ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সংলাপে অংশ নেন এবং জনগণের সংস্কার ও আকাঙ্ক্ষা সম্পর্কে আলোচনা করেন।
জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, “রমজান মাস মানবতার সর্বজনীন মূল্যবোধ-সহমর্মিতা, সহানুভূতি ও উদারতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, আর বাংলাদেশ শান্তি, উন্নয়ন ও মানবিক সহায়তার ক্ষেত্রে এই মূল্যবোধগুলোর প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
এ সময় পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, “জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসের ঢাকা সফর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত অর্থবহ। তিনি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর অধিকার সংরক্ষণের জন্য পূর্ণ সংহতি প্রকাশ করেছেন এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, “আমরা রোহিঙ্গাদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা, অধিকার নিশ্চিত করে ফেরত পাঠাতে চাই। এ ক্ষেত্রে জাতিসংঘের সহায়তা কাম্য।”
ঢাকা/হাসান/সাইফ