রোববার শেষ হওয়া জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের চার দিনের সফর নানা কারণে ঐতিহাসিক হয়ে থাকবে। তাঁর এবারের বাংলাদেশ সফরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের সলিডারিটি ইফতার। কক্সবাজার শিবিরে আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর খাদ্য সহায়তা এপ্রিল থেকে অর্ধেকে নেমে আসার ঘোষণা ইতোমধ্যে দেওয়া হয়েছে। স্বাভাবিক কারণেই চিন্তাগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের জন্য জাতিসংঘ মহাসচিবের সফর আশার আলো হিসেবে হাজির হয়েছে। তবে এক লাখ রোহিঙ্গার সামনে ইউনূসের বক্তব্য ইতিবাচক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। তিনি চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় বক্তব্য দিয়েছেন, সে ভাষা রোহিঙ্গাদের কাছে আপন। ইউনূস রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্বস্ত করে আশা ব্যক্ত করেন, আগামী ঈদ তারা মাতৃভূমিতে করতে পারবে।
রোহিঙ্গাদের জন্য নির্ধারিত বরাদ্দ অর্ধেকে নেমে এলে তা দিয়ে চলা কঠিন হবে। এমতাবস্থায় রোহিঙ্গারা ফিরে যাওয়াকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছে। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনই যে এর সমাধান– তা জাতিসংঘ মহাসচিবও বলেছেন। ইউনূসও তাঁকে সামনে রেখে রোহিঙ্গাদের এক ধরনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, বলা চলে। প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশ কি পারবে? মিয়ানমারের পরিস্থিতির কারণেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন জটিলতায় পড়েছে। কারণ, রোহিঙ্গাদের নিবাস রাখাইন এখন আরাকান আর্মির দখলে।
ডিসেম্বরে আরাকান আর্মি যখন বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী মংডু দখল করে, তখন আমি লিখেছিলাম, ‘আমরা যখন নিরাপদ প্রত্যাবাসনের কথা বলছি; রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বসহ নানাবিধ অধিকারের কথা বলছি; রাখাইন ছাড়া সেটা কোথাও সম্ভব নয়। সেই রাখাইনের নিয়ন্ত্রণ যাদের হাতে থাকবে, বাংলাদেশের উচিত তাদের সঙ্গেই সংলাপ করা।’ (সমকাল, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪)। সরকার এ লক্ষ্যে নিঃসন্দেহে কাজ শুরু করেছে। অস্বাভাবিক নয় যে, সেই কাজের আলোকেই হয়তো প্রধান উপদেষ্টা এ ধরনের অঙ্গীকার করেছেন। যদিও ভেতরের খবর আমরা জানি না। মিয়ানমারের দিক থেকে কিংবা আরাকান আর্মির পক্ষ থেকেও সে ধরনের কোনো ইঙ্গিত দেওয়া হয়নি। তবে প্রধান উপদেষ্টা তাঁর প্রত্যাশার জায়গা থেকেও এ আশাবাদ ব্যক্ত করতে পারেন। বিশেষ করে জাতিসংঘ মহাসচিবকে সামনে রেখেও তিনি এটা বোঝাতে চেয়েছেন– রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন যেমন বাংলাদেশের প্রত্যাশা, তেমনি রোহিঙ্গাদেরও দাবি। সেই প্রত্যাশার বাস্তবায়ন এবং রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বিশ্ববাসীকে এগিয়ে আসতে হবে। এ ক্ষেত্রে জাতিসংঘের জোরালো ভূমিকা পালন করা উচিত।
এ সফরের মধ্যেই রোহিঙ্গাদের জন্য বিশ্বকে এগিয়ে আসার জন্য জাতিসংঘ মহাসচিব তাঁর সামাজিক মাধ্যমে আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁর এক্স হ্যান্ডলে (টুইটার) তিনি রোহিঙ্গাদের নিয়ে একাধিক পোস্ট করেছেন। বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের জন্য তহবিল হ্রাসে বেশি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বস্তুত বর্তমানে এটাই বড় উদ্বেগের বিষয়। কারণ, এটা সবাই জানেন, রাখাইনে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন এতটা সহজ নয়।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের যে ঢল নেমেছিল, সেখানে বিশ্বের আশ্বাস থেকেই মানবিক বিবেচনায় রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয় বাংলাদেশ। প্রত্যাশা ছিল, খুব দ্রুত সময়েই তারা মিয়ানমারে ফিরে যাবে। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত সেই প্রত্যাবাসন হয়নি। বরং মিয়ানমারের রাজনৈতিক অবস্থার কারণে প্রত্যাবাসন পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করে। ২০১৭ সালে মিয়ানমারে ক্ষমতায় ছিল অং সান সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি)। এনএলডির সঙ্গে প্রত্যাবাসন নিয়ে চুক্তিও হয়েছিল। এর পর সেখানে ২০২১ সালে ক্যু করে ক্ষমতায় আসে সেনাবাহিনী। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে বাংলাদেশ আলোচনা করে। কিন্তু সশস্ত্র বিদ্রোহীদের দাপটে মিয়ানমারে দিন দিন সামরিক বাহিনীর অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়ে। বিভিন্ন এলাকায় তারা নিয়ন্ত্রণ হারায়। অনুরূপভাবে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত রাখাইনের অধিকাংশ এলাকাও তাদের নিয়ন্ত্রণ থেকে দখলে নেয় আরাকান আর্মি। আরাকান আর্মি যেহেতু রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান নয়, সে জন্য বাংলাদেশ তাদের সঙ্গে প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা করেছে কিনা, আমরা জানি না। কিন্তু সেনাবাহিনীর পাশাপাশি আরাকান আর্মির সঙ্গেই যে বসতে হবে– সে তাগিদ অনেকেই দিয়েছেন।
তবে পরিস্থিতি যতই জটিল হোক না কেন, ড.
রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা সবচেয়ে জরুরি। জাতিসংঘ মহাসচিবের সফর ও ড. ইউনূসের বক্তব্য নিঃসন্দেহে কূটনৈতিক সফলতা। প্রধান উপদেষ্টা এ মাসের শেষে চীন সফর করবেন। আমরা জানি, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে চীন সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। সে সফরেও তিনি রোহিঙ্গা বিষয়টি জোর দিয়ে তুলে ধরবেন বলে আমাদের বিশ্বাস। পাশাপাশি প্রত্যাবাসন যেহেতু দীর্ঘমেয়াদি বিষয়, এ প্রচেষ্টার পাশাপাশি রোহিঙ্গা শিশুর মৌলিক শিক্ষার বাইরে অন্তত কারিগরি শিক্ষা নিশ্চিতে বাংলাদেশ ভূমিকা রাখতে পারে।
ঈদ আসে আনন্দ নিয়ে। নিপীড়িত জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গারা বঞ্চনার বেদনা নিয়েই ঈদ করে। জাতিসংঘ মহাসচিবের সফর ও মুহাম্মদ ইউনূসের বক্তব্য নিশ্চয় তাদের এবারের ঈদের আনন্দ বাড়িয়ে দেবে। আগামী ঈদ নিয়েও যাতে তারা আশাবাদী হতে পারে, সে জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসতে হবে।
মাহফুজুর রহমান মানিক: জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, সমকাল
mahfuz.manik@gmail.com
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র হ ঙ গ দ র জন য আর ক ন আর ম ইউন স র র খ ইন র সফর
এছাড়াও পড়ুন:
‘ঢাকা সেন্ট্রাল বিশ্ববিদ্যালয়’ কাঠামো প্রত্যাখ্যান তিতুমীর শিক্ষার্থীদের
তিতুমীর কলেজকে ঢাকার সাতটি কলেজের সঙ্গে একীভূত করে ‘ঢাকা সেন্ট্রাল বিশ্ববিদ্যালয়’ নামের প্রশাসনিক কাঠামোর প্রস্তাবনা প্রত্যাখ্যান করেছেন সরকারি তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা। একইসঙ্গে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তিতুমীর কলেজকে কাঠামোর আওতায় আনা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন তারা।
রোববার সন্ধ্যায় কলেজটির শিক্ষার্থীদের সংগঠন তিতুমীর ঐক্যের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে এই প্রতিক্রিয়া জানানো হয়েছে।
সংগঠনটির দপ্তর সম্পাদক মো. বেল্লাল হোসেনের সই করা ওই বিবৃতিতে বলা হয়েছে, যে নতুন কাঠামোর প্রস্তাব করা হয়েছে সেটি প্রত্যাখ্যান করেছে সরকারি তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সভায় আমাদের কলেজের প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানানো হলেও চারজন প্রতিনিধির মধ্যে তিনজনই অকুণ্ঠচিত্তে এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তারা স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেন, শিক্ষার্থীদের ম্যান্ডেট ও সম্মতি ব্যতীত তারা কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে রাজি নয়। একইসঙ্গে এ ধরনে উদ্দেশ্যেপ্রণোদিত স্বার্থান্বেষী অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নের মিটিংকে প্রত্যাখ্যান করেন।
তিনি আরও বলেন, অনুপস্থিত তিনজন শিক্ষার্থীর নাম যথাক্রমে আমিনুল ইসলাম, হাবিবুল্লাহ রনি, মো. মেহেদী হাসান। অন্যদিকে, একজন প্রতিনিধি রেজায়ে রাব্বি জায়েদ, সভায় উপস্থিত হয়ে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে সভাকক্ষ ত্যাগ করেন এবং যেকোনো পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের ন্যায়সঙ্গত দাবির পক্ষে অবিচল থাকার ঘোষণা দেন।
অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার ঘোষণা দিয়ে বিবৃতিতে তিনি আরও বলেন, এ ঘটনার মাধ্যমে আবারও প্রমাণিত হয়েছে সরকারি তিতুমীর কলেজের সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের যৌক্তিক দাবি, ঐতিহ্য, আত্মপরিচয় ও মর্যাদার প্রশ্নে আপসহীন। প্রাতিষ্ঠানিক স্বকীয়তা রক্ষায় তারা সবসময় প্রস্তুত। আমরা যেকোনো অন্যায় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধেও দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে তুলতে অঙ্গীকারবদ্ধ।
এর আগে, গতকাল দুপুরে রাজধানীর সরকারি সাত কলেজ নিয়ে প্রস্তাবিত নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ‘ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি’ নাম চূড়ান্ত করা হয়। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) ভবনে শিক্ষার্থীদের ৩২ সদস্যের প্রতিনিধিদল নিয়ে অনুষ্ঠিত সভা শেষে এমন সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়েছে।
সাতটি সরকারি কলেজ হচ্ছে— ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ, মিরপুর বাংলা কলেজ এবং সরকারি তিতুমীর কলেজ।