সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সর্বসম্মত আঞ্চলিক দৃষ্টিভঙ্গি
Published: 16th, March 2025 GMT
জাফর এক্সপ্রেসে বিএলএর হামলা সংগঠনটির ২৫ বছরের ইতিহাসে সম্ভবত সবচেয়ে বড় হামলা। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হিসেবে সবচেয়ে পরিশীলিত, যা তাদের জ্ঞাত ক্ষমতাও অতিক্রম করেছে। নিঃসন্দেহে এই জঘন্য অভিযানের মধ্য দিয়ে তাদের আন্তর্জাতিক মাত্রা প্রমাণিত। কারণ, সন্ত্রাসীরা আফগানিস্তানে তাদের সহচরদের সঙ্গে ক্রমাগত যোগাযোগ রাখছিল।
আমাদের নিরাপত্তা বাহিনী সুপরিকল্পিত কৌশলের মাধ্যমে সব জিম্মিকে শুধু মুক্তই করেনি, তাদের ৩৩ জনকে হত্যাও করেছে। অভিযান শুরু হওয়ার আগেই সন্ত্রাসীরা ২১ যাত্রীকে হত্যা করেছিল এবং অভিযানের সময় চারজন এফসি (বেলুচিস্তান ও খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে কর্মরত) সৈন্যও শহীদ হয়েছেন বলে জানা গেছে।
পাকিস্তান ও চীনের উদ্দেশে এক ভিডিও বার্তায় বিএলএ জানিয়েছে, তারা সিপিইসি (চীনা প্রকল্প) সম্পন্ন হতে দেবে না এবং ভবিষ্যতেও একই ধরনের হামলা চালাবে। এটি প্রমাণ হিসেবে যথেষ্ট যে, তারা সিপিইসির প্রতিপক্ষ এবং পাকিস্তানের উন্নতি ও অগ্রগতি চায় না– এমন শক্তির পক্ষে কাজ করছে। রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা পাকিস্তানের প্রতি তালেবান সরকারের বৈরিতার জন্য আফগানিস্তানে ভারতের জোরালো প্রভাব এবং র, টিটিপি, আফগান গোয়েন্দা সংস্থা এবং বিএলএর মধ্যে প্রমাণিত যোগসাজশকে দায়ী করেছেন। টিটিপির প্রতিরক্ষা ও অর্থবিষয়ক প্রধান মৌলভি মনসুরের আত্মপ্রকাশ, যিনি গত বছরের জুলাই মাসে বেলুচিস্তানে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, সেই জোটের অস্তিত্বকে সমর্থন করার জন্য যথেষ্ট। তিনি দ্ব্যর্থহীনভাবে আবারও বলেছেন, টিটিপির মাধ্যমে তহবিল দেওয়া হচ্ছিল এবং সিপিইসিকে ধ্বংস করার জন্য বিএলএর সঙ্গে তাদের সহযোগিতাও তাদের নির্দেশে হয়েছিল। ভারতীয় গণমাধ্যমে ঘটনার প্রতিবেদনগুলোও ভারতের জড়িত থাকা প্রমাণ করে।
বান্নু ক্যান্টনমেন্টের পর কয়েক দিনের মধ্যে এটি ছিল দ্বিতীয় বৃহত্তম সন্ত্রাসী হামলা। সেই ঘটনায়ও আমাদের নিরাপত্তা বাহিনী সব আক্রমণকারীকে হত্যা করেছিল। সবচেয়ে দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, কাবুলের তালেবান সরকার সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোকে অন্য কোনো দেশের ওপর হামলার জন্য তাদের মাটি ব্যবহার করতে না দেওয়ার ব্যাপারে বাধ্যবাধকতা মানছে না। বরং তারা তাদের সঙ্গে জোটবদ্ধ এবং পাকিস্তানের অভ্যন্তরে এই জঘন্য কাজগুলো পরিচালনাকে সমর্থন করছে। তারা নিজেদের ভবিষ্যতের পরিণতি সম্পর্কে সচেতন নয়।
একদিন আগে, ১০ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘে আমাদের স্থায়ী প্রতিনিধি মুনির আকরাম ‘সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি’ শিরোনামে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে বিবৃতি দিয়েছেন। এতে তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের অবশ্যই আফগানিস্তান থেকে আসা সন্ত্রাসী হুমকির ব্যাপারে জোরালো মনোযোগ দিতে হবে। আমাদের সীমান্তের মধ্যে আল কায়দা ও অন্যান্য সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে সফলভাবে ধ্বংস করার পর আমাদের সীমান্ত এলাকায় প্রস্তুতি থাকতে হবে। আমি আবারও বলতে চাই, আমাদের সীমান্তের মধ্যে পাকিস্তান নিয়মিত সন্ত্রাসীদের মুখে পড়ছে। টিটিপি, দায়েশ ও মাজিদ ব্রিগেডের মতো সন্ত্রাসী হামলার কথা উল্লেখ করা যায়।’
আমি মনে করি, এই সন্ত্রাসী অস্তিত্বের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী সমর্থন বৃদ্ধি করার পাশাপাশি সন্ত্রাসবাদের ক্রমবর্ধমান হুমকি মোকাবিলায় আঞ্চলিক শক্তিগুলোর সর্বসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা জরুরি। সেই সঙ্গে তালেবান সরকারকে তার মাটিতে সন্ত্রাসীদের আস্তানা নির্মূল করার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেওয়া দরকার, যা শুধু পাকিস্তানের জন্যই নয়, সমগ্র অঞ্চলের জন্য হুমকি। আফগানিস্তানের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থেও এ বিষয়ে চূড়ান্ত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
পাকতিয়ায় টিটিপির আস্তানাগুলোতে হামলাকালে যেমনটি প্রমাণিত হয়েছিল, পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনী এই হুমকি মোকাবিলায় সম্পূর্ণরূপে সক্ষম। পাকিস্তান আফগানিস্তানের সঙ্গে সরাসরি সংঘর্ষ চায় না। এ বিষয়টি এ থেকে স্পষ্ট– তারা সর্বদা কূটনৈতিক চ্যানেল ব্যবহার করে আফগানিস্তানকে এ বিষয়ে তার দায়িত্বের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। তবে জাফর এক্সপ্রেস ঘটনার পর পরিস্থিতি ভিন্নভাবে মোকাবিলা করতে হতে পারে। আইএসপিআর মহাপরিচালক গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার সময় বলেন, যেই করুক না কেন; আমি স্পষ্টভাবে বলতে চাই– তাকে খুঁজে বের করে বিচারের আওতায় আনা হবে। আমি আরও যুক্ত করতে চাই, জাফর এক্সপ্রেসের এই ঘটনা খেলার নিয়ম বদলে দেয়। কারণ এই সন্ত্রাসীদের সঙ্গে পাকিস্তান, ইসলাম এবং বেলুচিস্তানের কোনো সম্পর্ক নেই।’ সন্ত্রাসীরা দেশের বাইরে তাদের সহযোগী এবং পাকিস্তানের অভ্যন্তরে সন্ত্রাসবাদ উস্কে দেওয়ার ক্ষমতা এবং দেশের অভ্যন্তরে তাদের সহানুভূতিশীলদের এই কথাগুলো অবশ্যই তাদের ব্যাপারে মাথায় রাখবে।
মালিক মুহাম্মদ আশরাফ: ফ্রিল্যান্স কলামিস্ট; দ্য নেশন
থেকে সংক্ষিপ্ত ভাষান্তর ইফতেখারুল ইসলাম
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: আফগ ন স ত ন আম দ র স র জন য
এছাড়াও পড়ুন:
বেলুচিস্তানের বিএলএ কারা?
পাকিস্তানের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ বেলুচিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনী জানিয়েছে, তারা মঙ্গলবার পেশোয়ারগামী ট্রেন জাফর এক্সপ্রেস ছিনতাইকারী সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান শেষ করেছে। এরই মাধ্যমে ৩৪৬ জন যাত্রীকে উদ্ধার করা হয়েছে। সামরিক বাহিনী বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মির (বিএলএ) ৩৩ জন হামলাকারীকে হত্যা করেছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিএলএর কার্যক্রমের পরিধি ও দক্ষতা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। কেবল গত বছরে তারা ১৫০টিরও বেশি আক্রমণ চালিয়েছে, যারই ধারাবাহিকতা এই ট্রেন ছিনতাই।
১৯৪৭ সালের আগস্টে ভারত থেকে দেশ ভাগের ছয় মাস পর, ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান বেলুচিস্তানকে নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করে। তখন থেকেই প্রদেশটি বেশ কয়েকটি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের সাক্ষী। ২০২৩ সালের জনশুমারি অনুসারে, পাকিস্তানের আনুমানিক ২৪ কোটি জনসংখ্যার প্রায় ১ কোটি ৫০ লাখের বাসস্থান বেলুচিস্তান। কয়লা, সোনা, তামা ও গ্যাসের মতো প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও এটি দেশের সবচেয়ে দরিদ্র অঞ্চল।
বেলুচিস্তানে সর্বশেষ আন্দোলন শুরু হয় ২০০০ সালের গোড়ায়। প্রাথমিক লক্ষ্য প্রদেশের জনগণের জন্য সম্পদের বৃহত্তর অংশ নিশ্চিত করা হলেও, শিগগিরই তারা পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি তোলে। বিএলএ ১৯৯০-এর দশকের শেষ দিকে এবং ২০০০-এর দশকের গোড়ায় আত্মপ্রকাশ করে। বিএলএর নেতৃত্বে ছিলেন প্রবীণ বালুচ জাতীয়তাবাদী নেতা নবাব খায়ের বখশ মারির ছেলে বালাচ মারি।
২০০৬ সালে সামরিক শাসক পারভেজ মোশাররফের নেতৃত্বে সরকার বিশিষ্ট বালুচ জাতীয়তাবাদী নেতা নবাব আকবর বুগতিকে হত্যা করার পর বিদ্রোহ তীব্রতর হয়। বছরের পর বছর ধরে বিএলএ পাকিস্তান থেকে বেলুচিস্তানের সম্পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ একটি দল হিসেবে নিজেদের আলাদা করে তুলেছে। মধ্যপন্থি বালুচ জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীগুলো প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে কথা বললেও বিএলএ কখনও মধ্যম পন্থা অনুসরণ করেনি।
২০১০ সালে এই গোষ্ঠী তাদের আত্মঘাতী দল মাজিদ ব্রিগেড চালু করে, যা কয়েক বছর ধরে সুপ্ত ছিল। ২০১৮ সালে দলটি জনপ্রিয়তা লাভ করে, যখন আসলাম বালুচ তাঁর নিজের ছেলেকে বেলুচিস্তানের দালবান্দিন শহরে কর্মরত চীনা প্রকৌশলীদের লক্ষ্য করে হামলা চালাতে পাঠিয়েছিল। এতে তিন চীনা নাগরিকসহ পাঁচজন আহত হয়, তবে আসলামের ছেলে ছাড়া আর কোনো প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, বিএলএর সবচেয়ে বড় শক্তি হলো তরুণ ও সুশিক্ষিত সৈন্যদের তালিকাভুক্ত করার ক্ষমতা। বিশেষজ্ঞ আকবরের মতে, ‘তরুণ, শিক্ষিত যোদ্ধাদের নিয়োগ করা এখন আর কোনো চ্যালেঞ্জ নয়। কারণ, এই গোষ্ঠী বালুচ তরুণদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য জনপ্রিয়তা লাভ করেছে, যদিও এর কার্যক্রম বিতর্কিত।’ যদিও বিএলএর তহবিলের উৎসগুলো অস্পষ্ট; বিশ্লেষকরা একাধিক রাজস্ব উৎসের কথা বলেছেন। তার মধ্যে রয়েছে চাঁদাবাজি, চোরাচালান ও মাদক পাচারের মতো অবৈধ কার্যকলাপ।
পাকিস্তান সরকার দাবি করে, ভারত বিএলএকে অর্থায়ন করে। কিন্তু আকবরের মতে, আফগানিস্তানে বছরের পর বছর কাটিয়ে বেশির ভাগ বিএলএ নেতৃত্ব পাকিস্তানে আগমন করেন। তাঁর মতে, সরকারের এসব দাবি হুবহু গ্রহণ করা কঠিন। বিশেষজ্ঞ আকবরের মতে, ‘প্রায় প্রতিটি ইস্যুতে ভারতকে দোষারোপ করার প্রবণতা পাকিস্তানের রয়েছে। এ কারণে দৃঢ় প্রমাণ ছাড়া এ ধরনের দাবি গ্রহণ করা কঠিন।’ ‘যদি সরকার ভারতীয় সমর্থনের সুনির্দিষ্ট প্রমাণ দিতে পারে, তবেই কেবল তাদের অভিযোগের গুরুত্ব রয়েছে। তবে যা স্পষ্ট তা হলো, বিএলএর একটি শক্তিশালী তহবিলদাতা রয়েছে এবং এর যোদ্ধারা বিদ্রোহের জন্য বিশেষভাবে তৈরি উচ্চ পেশাদার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে।’
আকবর বলেন, প্রশাসনের ব্যর্থতা ও প্রাদেশিক সরকারের প্রতি ‘অসন্তোষ’-এ হতাশ জনসাধারণের মধ্যে বিএলএ তার প্রভাব বাড়াতে সাহায্য করে।
পর্যবেক্ষক আকবরের মতে, ‘অনেকে প্রাদেশিক সরকার বিশেষত বেলুচিস্তানের জনগণের চেয়ে ইসলামাবাদের প্রতি বেশি অনুগত বলে মনে করে। কারণ এটি জোরপূর্বক গুমের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে শক্ত অবস্থান নিতে অস্বীকার করে।’
আবিদ হোসেন: পাকিস্তানের ইসলামাবাদে আলজাজিরার ইংরেজি ডিজিটাল সংবাদদাতা; আলজাজিরা থেকে সংক্ষিপ্ত ভাষান্তর ইফতেখারুল ইসলাম