আজ খতমে তারাবিতে পবিত্র কোরআনের সুরা ফুরকানের ২১ থেকে সুরা শুআরা ও সুরা নামলের ১ থেকে ৫৯ নম্বর আয়াত পর্যন্ত তিলাওয়াত করা হবে। ১৯তম পারা পড়া হবে। আজকের তারাবিতে আল্লাহর একাত্ববাদ, কোরআনের নেয়ামত, অবিশ্বাসীদের প্রশ্নের জবাব, আল্লাহর কুদরত, আল্লাহর বিশেষ বান্দাদের গুণ, অপচয়, সোলায়মান (আ.) ও পিঁপড়ার ঘটনা, হুদহুদ পাখির সংবাদ সংগ্রহ, সাবার রানি বিলকিসের আত্মসমর্পণ, পূর্ববর্তী নবী ও তাঁদের জাতি, আল্লাহর নিয়ামত, অহংকার, ব্যবসায় সঠিক ওজন দেওয়া, মানুষের হক নষ্টের পরিণাম, বিভিন্ন জাতির ধ্বংসের বিবরণ, মুমিন জীবনে পরীক্ষা ও মুমিনদের পুরস্কার ইত্যাদি বিষয় আলোচিত হয়েছে।

কোরআন কেন একসঙ্গে নাজিল হয়নি

আল্লাহ নবী-রাসুলদের ওপর বিভিন্ন কিতাব নাজিল করেছেন। এর মধ্যে প্রসিদ্ধ চারটি কিতাব হলো তাওরাত, জাবুর, ইনজিল ও কোরআন। রাসুলুল্লাহ (সা.

)-এর নবুওয়াতের ২৩ বছরের জীবনজুড়ে এ কোরআন নাজিল হয়েছে। ধীরে ধীরে হয়েছে। কখনো এক আয়াত, তিন আয়াত, এক রুকু বা পূর্ণ এক সুরা।

অবিশ্বাসীরা প্রশ্ন করল, তাওরাত ও ইনজিলের মতো কোরআন একবারে নাজিল হলো না কেন?

অবিশ্বাসীদের প্রশ্নের জবাবে আল্লাহ সুরা ফুরকানের ৩২ নম্বর আয়াত নাজিল করেন। আল্লাহ বলেন, ‘অবিশ্বাসীরা বলে, তাঁর কাছে পুরো কোরআন একসঙ্গে অবতীর্ণ করা হলো না কেন? আমি এভাবেই অবতীর্ণ করেছি। তোমার হৃদয়কে তা দ্বারা সুদৃঢ় করার জন্য আমি তোমার কাছে তা ধীরে ধীরে পরিকল্পিত স্তরে ক্রমে ক্রমে আবৃত্তি করেছি।’

ধীরে ধীরে কোরআন নাজিলের মধ্যে বেশ উপকার রয়েছে। কোরআন মুখস্থ করা, অর্থ বোঝা, বিধান জানা এবং তা আমলে বাস্তবায়ন করা সহজ হয়।

আরও পড়ুনমুসা ও খিজির (আ.)-এর চিত্তাকর্ষক গল্প২৩ মার্চ ২০২৪

আল্লাহর বিশেষ বান্দাদের বৈশিষ্ট্য

এ সুরার ৬৩ থেকে ৭৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহর বান্দাদের ১৪টি বৈশিষ্ট্যের আলোচনা এসেছে। বৈশিষ্ট্যগুলো হলো এক. তাঁরা পৃথিবীতে বিনয়ের সঙ্গে চলে। দুই. মূর্খদের থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখে। তিন. রাত জেগে ইবাদত করে। চার. জাহান্নামের আজাবের ভয়ে অন্তর কেঁপে ওঠে। পাঁচ. খরচ করার ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষা করে। ছয়. শুধু আল্লাহর ইবাদত করে। সাত. অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করে না। আট. ব্যভিচার করে না। নয়. তওবা করে। দশ. মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় না। এগারো. গীতবাদ্য ও খারাপ মজলিস থেকে দূরে থাকে। বারো. আল্লাহর কালাম যথাযথভাবে শোনে। তেরো. উত্তম স্ত্রী ও সন্তান লাভে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে। চৌদ্দ. সঠিক পথের দিশা পেতে সাহায্য প্রার্থনা করে।

‘কবি’ শব্দে সুরার নাম

২২৭ আয়াতবিশিষ্ট সুরা শুআরা মক্কায় অবতীর্ণ। এটি কোরআনের ২৬তম সুরা। শুআয়া শব্দটি শায়ির শব্দের বহুবচন। শায়ির অর্থ কবি। সুরার শেষের কবিদের অবস্থা বর্ণনা করায় এর নাম শুআরা রাখা হয়েছে। সুরা শুআরার ১০ থেকে ১৯১ নম্বর আয়াতে মুসা-হারুন (আ.) ও ফেরাউনের কাহিনি, বাবাকে ছেলে ইবরাহিম (আ.)-এর দাওয়াত, নুহ (আ.)-এর জাতির বর্ণনা, হুদ (আ.) ও আদ জাতির কাহিনি, সামুদ জাতির ধ্বংসের ইতিহাস, লুত (আ.)-এর জাতির কাহিনি, শোয়াইব (আ.) ও মাদায়েনবাসীর বিশ্বাস-অবিশ্বাসের বিবরণ রয়েছে।

সুরা নামলে পিঁপড়ার গল্প

কোরআনের ২৭তম সুরা নামল মক্কায় অবতীর্ণ। এর আয়াত সংখ্যা ৯৩। নামল অর্থ পিঁপড়া। এ সুরায় সোলায়মান (আ.)-এর সঙ্গে পিঁপড়ার কথোপকথনের বিবরণ রয়েছে, তাই এটিকে সুরা নামল বলা হয়।

সোলায়মান (আ.) ছিলেন তৎকালীন পৃথিবীর বাদশাহ ও অঢেল ধনসম্পদের অধিকারী। আল্লাহ তাঁকে বিশেষ জ্ঞান দান করেছিলেন। তিনি প্রাণীর ভাষা বুঝতেন।

একদিন তিনি সৈন্যবাহিনী নিয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন। যেতে যেতে পিঁপড়াদের বসতি অতিক্রম করছিলেন। হঠাৎ থেমে গেলেন। শুনলেন, এক পিঁপড়া অন্য পিঁপড়াদের ঘরে প্রবেশের তাড়া দিচ্ছেন। সুলায়মান ও তাঁর বাহিনীর পায়ে পিষ্ট হওয়া থেকে বাঁচার সতর্কবার্তা দিচ্ছে। পিঁপড়ার কথা শুনে সুলায়মান হাসলেন। আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায় করলেন।

সুরা নামলের ১৮ ও ১৯ নম্বর আয়াতে এই ঘটনা বিবৃত হয়েছে এভাবে, ‘যখন সোলায়মান ও তাঁর বাহিনী পিঁপড়ার উপত্যকায় পৌঁছাল, তখন এক নারী পিঁপড়া বলল, হে পিঁপড়ারা, গর্তে প্রবেশ করো। এমন যেন না হয়, সোলায়মান এবং তার সৈন্যরা তোমাদের পিষে ফেলবে, তোমরা তা টেরও পাবে না। সোলায়মান (আ.) পিঁপড়ার কথায় মৃদু হাসলেন।’

আরও পড়ুনজুমার খুতবা শুনে গাছের গুঁড়ি কেঁদেছিল, ১৫ জানুয়ারি ২০২৪

সোলায়মান (আ.) ও হুদহুদ পাখির গল্প

সোলায়মান (আ.)-এর রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যবহৃত হতো হুদহুদ পাখি। হুদহুদ পাখি বার্তাবাহক হিসেবে কাজ করত। পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে কী হচ্ছে, কী চিন্তাভাবনা চলছে, কোথায় কী ঘটছে, কোন রাজা কোথায় সৈন্য পাঠাচ্ছে, কেন পাঠাচ্ছে ইত্যাদি বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়ার জন্য তিনি এই পাখি ব্যবহার করতেন। এ ছাড়া সুলায়মান (আ.) মরুভূমি বা জনমানবহীন প্রান্তরে বের হলে পানি অন্বেষণ করার কাজও সে করত।

নবী একবার পাখিটিকে খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তিনি পাখিটির ওপর বেশ রেগে গেলেন।

কোরআনে ঘটনার বর্ণনা এসেছে এভাবে, ‘একদিন সোলায়মান (আ.) পাখিদের খোঁজখবর নিলেন, এরপর বললেন, কী হলো, হুদহুদকে দেখছি না কেন? নাকি সে অনুপস্থিত? আমি অবশ্যই তাকে কঠোর শাস্তি দেব কিংবা হত্যা করব, যদি না সে অনুপস্থিত থাকার যথাযথ কারণ দেখায়। কিছুক্ষণ পর হুদহুদ এসে বলল, আপনি অবগত নন এমন একটি বিষয়ে আমি অবগত হয়েছি। আমি সাবা থেকে নিশ্চিত সংবাদ নিয়ে আগমন করেছি। আমি এক নারীকে সাবাবাসীর ওপর রাজত্ব করতে দেখেছি। তাকে সবকিছুই দেওয়া হয়েছে এবং তার একটা বিরাট সিংহাসন আছে। আমি তাকে ও তার সম্প্রদায়কে দেখলাম তারা আল্লাহর পরিবর্তে সূর্যকে সিজদা করছে। শয়তান তাদের দৃষ্টিতে তাদের কার্যাবলি সুশোভিত করে দিয়েছে…।’ (সুরা নামল, আয়াত: ২০-২৪)

আরও পড়ুনদোয়া মাসুরা বাংলা উচ্চারণ ও অর্থ, কখন পড়তে হয়০২ জানুয়ারি ২০২৪

সোলায়মান (আ.) আর রানি বিলকিসের কি বিয়ে হয়েছিল

সোলায়মান (আ.) হুদহুদের সংবাদ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে চাইলেন। রানি বিলকিস ও তার লোকদের সূর্যপূজা ছেড়ে এক আল্লাহর ইবাদত করতে বললেন। তিনি হুদহুদ পাখির কাছে একটি চিঠি লিখে পাঠিয়ে দেন।

সব ভেবেচিন্তে তিনি রানি বিলকিস নবীর দরবারে এলেন। রাজপ্রাসাদের স্বচ্ছ কাচের সড়কে ভ্রমে পড়ে গেলেন এবং গোড়ালির কাপড় টেনে ওপরে তুলে ফেললেন। স্বচ্ছ স্ফটিক নির্মিত প্রাসাদ দেখে রানি যারপরনাই বিস্মিত হলেন। এদিকে আবার নিজের সিংহাসন সোলায়মানের কাছে দেখে বিস্ময়ে তাজ্জব বনে গেলেন। পরে তিনি সোলায়মান (আ.)-এর ধর্মে দীক্ষিত হন।

সোলায়মানের সঙ্গে রানির বিয়ে হয়েছিল কি না, এ বিষয়ে কোরআন-হাদিসে স্পষ্ট কোনো বর্ণনা পাওয়া যায় না। ইবনে আসাকির ইকরিমা সূত্রে বলেন, ইমান গ্রহণের পর রানি বিলকিসের সঙ্গে সুলায়মান (আ.)-এর বিয়ে হয়েছিল। তবে কেউ কেউ এ মতের বিরোধিতা করেছেন। সুরা নামলের ২৮ থেকে ৪৪ নম্বর আয়াতে এ ঘটনার বর্ণনা রয়েছে।

রায়হান রাশেদ: লেখক ও আলেম

আরও পড়ুনএক সাহাবিকে নিয়ে ১৬ আয়াত নাজিল হয়২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: অব শ ব স অবত র ণ ক রআন র আল ল হ

এছাড়াও পড়ুন:

ইবলিস কি জিন নাকি ফেরেশতা

মানুষ সৃষ্টির আগে আল্লাহর সৃষ্টিতে ছিল ফেরেশতা ও জিন। ইবলিস আগুনের তৈরি। থাকত ফেরেশতাদের সঙ্গে। একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগি করত। ফলে ইবলিস জিন নাকি ফেরেশতা—এ নিয়ে অনেকেই দ্বিধায় পড়ে যান। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি যখন ফেরেশতাদের বললাম, আদমকে সিজদা করো; তখন ইবলিস ছাড়া সবাই সিজদা করল। সে অমান্য করল ও অহংকার করল । তাই সে অবিশ্বাসীদের অন্তর্ভুক্ত হলো।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ৩৪)

ইবলিসকে কেন সিজদা করতে বলা হলো

ইবলিসকে কেন ফেরেশতাদের সঙ্গে সিজদা করতে আদেশ করা হলো, সে কি ফেরেশতা? আল্লাহতায়ালা আদমকে সৃষ্টির আগেই ফেরেশতাদের আদেশ দিয়ে রেখেছিলেন। আল্লাহ বলেন, ‘সুতরাং আমি যখন আদমের সৃষ্টি সম্পন্ন করব এবং তার মধ্যে রুহ ফুঁকে দেব, তখন তোমরা তার সামনে সিজদায় পড়ে যেও’ (সুরা সাদ, আয়াত: ৭২)।

তখন ইবলিস সেই মজলিশেই উপস্থিত ছিল। তাই ইবলিস ফেরেশতা না হলেও সে ওই আদেশের অন্তর্ভুক্ত হবে।

আরও পড়ুনসুরা আরাফে আছে ইবলিসের কাহিনি ১৮ জুলাই ২০২৪

ইবলিস জিন হওয়ার প্রমাণ

ইমাম রাজি (রহ.) বলেন, ইবলিস জিনদের একজন, তার মৌলিক উপাদান আগুন। এ জন্য তিনি তিনটি দলিল উপস্থাপন করেছেন।

এক. ইবলিসের সৃষ্টি আগুন থেকে। কোরআনে এসেছে, ইবলিস বলেছে, ‘তুমি আমাকে আগুন দিয়ে সৃষ্টি করেছ আর তাকে (আদমকে) সৃষ্টি করেছ কাদা মাটি দিয়ে।’ (সুরা আরাফ, আয়াত: ১২)

দুই. ইবলিসের ছেলেমেয়ে আছে, সে বংশবিস্তার করে। ফেরেশতারা এর থেকে মুক্ত। তাদের স্ত্রী-সন্তান নেই। তাদের মধ্যে নেই নারী-পুরুষের বিভাজনও। অথচ আল্লাহ ইবলিস সম্পর্কে বলেছেন, ‘তবে কি তোমরা আমার পরিবর্তে ওকে ও ওর বংশধরকে অভিভাবকরূপে গ্রহণ করছ?’ (সুরা কাহফ, আয়াত: ৫০)

তিন. ফেরেশতারা আল্লাহর সব আদেশ মেনে চলে। পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘আল্লাহ তাদের (ফেরেশতাদের) যা আদেশ করেন তা অমান্য করে না এবং যা আদেশ করা হয় তা-ই করে।’ (সুরা তাহরিম, আয়াত: ৬)

আল্লাহ কোরআনে অধিকাংশ স্থানে ইবলিসকে ‘শয়তান’ বলে সম্বোধন করেছেন। শয়তান শব্দটি দিয়ে কট্টরভাবে অবাধ্য হওয়াকে বোঝায়। (আত-তাফসিরুল কাবির, ফখরুদ্দিন রাজি, ২/৪২৯-৩০)

তা ছাড়া ‘আল্লাহতায়ালা জিনকে সৃষ্টি করেছেন ধোঁয়াহীন আগুন থেকে’ (সুরা রহমান, আয়াত: ১৫), আর ফেরেশতাদের সৃষ্টি করা হয়েছে নুর বা আলো থেকে (মুসলিম, হাদিস: ২৯৯৬)।

আরও পড়ুনইবলিসের কাহিনি১২ মে ২০২৪

ইবলিস কোন শ্রেণির জিন

ইবনে আবদিল বার (রহ.) বলেছেন, জিনদের বিভিন্ন শ্রেণি রয়েছে, ১. সাধারণ জিনদের বলা হয় জিন্নি। ২. যেসব জিন মানুষের সঙ্গে বাসাবাড়িতে অবস্থান করে, তাদের বলা হয় আমির। ৩. যেসব জিন বাচ্চাদের সামনে আবির্ভূত হয়, তারা আরওয়াহ। এটি রুহ শব্দের বহু বচন। ৪. যেসব জিন খারাপ হয়ে যায় এবং মানুষের ক্ষতি করতে চায়, তারা শয়তান। ৫. যেসব শয়তানের দুষ্কৃতি খুব বেড়ে যায়, তাদের বলে মারিদ। ৬. যারা শক্তিশালী ও দুশ্চরিত্র হয়ে ওঠে, তাদের বলা হয় ইফরিত। (আত-তামহিদ, ইবনে আবদিল বার, ১১/১১৭-১১৮)

আরও পড়ুনএকদল জিন পবিত্র কোরআন শুনে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন২০ নভেম্বর ২০২৩

সম্পর্কিত নিবন্ধ