বিএনপির সামনে সুযোগ অনেক, কিন্তু...
Published: 16th, March 2025 GMT
বিএনপি এখন দেশের সবচেয়ে বড় ও শক্তিশালী রাজনৈতিক দল। অন্য বড় দল আওয়ামী লীগ রাতারাতি উধাও হয়ে যাওয়ার পর বিএনপির সুযোগ বেড়েছে; সঙ্গে তাদের নতুন চ্যালেঞ্জও মোকাবিলা করতে হচ্ছে। বিএনপির বলয়ের বাইরে গণ্য করার মতো এখন রয়েছে আর মাত্র দুটি দল—নবগঠিত এনসিপি ও জামায়াতে ইসলামী। এনসিপি হাঁটিহাঁটি পা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, তাদের দল গোছাতে অনেক কাজ বাকি। জামায়াতে ইসলামী জুলাই বিপ্লবের পর কিছুটা হাঁফ ছাড়লেও, একাত্তরের সত্যগুলো কিছুতেই তাদের পিছু ছাড়ছে না। নির্বাচন যতই কাছে আসবে, এসব দলের অবস্থান নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা হবে। তবে আজকের আলোচনা বিএনপির দলীয় অবস্থান নিয়ে। আমরা কথা বলব বিএনপির শক্তি, দুর্বলতা, কৌশল ও ভবিষ্যৎ নিয়ে।
পরিপক্বতা
বিগত বছরগুলোতে বিএনপিকে অনেক প্রতিকূলতা ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসা সইতে হয়েছে। বিএনপি রাজনীতির একটা দিক প্রশংসা করার মতো, ১৫ বছর অনবরত মার খাওযার পরও তারা মাঠ ও মাটি কামড়ে ছিল এবং দলকে আঁকড়ে ছিল, রাজনীতি ছাড়েনি। এ দেশে অনেক রাজনৈতিক দল রাজনৈতিক প্রতিঘাত সইতে না পেরে বা তাড়াতাড়ি ক্ষমতায় যাওয়ার আশায় নিজেদের রাজনীতি বিসর্জন দেয়। একটা সময়ে জাসদ এই ভুল করেছিল; কিন্তু বিএনপি করেনি। তারা বিভ্রান্ত হয়নি, তারা বাহিনী করেনি। তারা তাদের রাজনীতির শিকড় কামড়ে পড়ে ছিল। এই পরিপক্বতা বিএনপিকে শক্তি জুগিয়েছে ও স্থিতিশীল করেছে।
নেতৃত্ব
বিএনপি খুব সংগঠিত দল। তাদের অভিজ্ঞ নেতার সংখ্যাও কম নয়। দলের একচ্ছত্র নেতা হলেন তারেক রহমান, যিনি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। তারেক জিয়া নামেই সমধিক পরিচিত। তিনি লন্ডনে নির্বাসিত অবস্থান থেকেই দল পরিচালনা করছেন। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম তারেক জিয়ার বৃত্তে থেকেও নিজের জন্য আলাদা পরিচিতি সৃষ্টি করেছেন তাঁর শিষ্টতা ও অসংঘাতপূর্ণ আচরণের জন্য।
বিএনপির সিনিয়র নেতারা যেমন তারেক জিয়ার থেকে একটা দূরত্ব বজায় রাখেন, তরুণ নেতারা তেমনি তাঁকে ঘিরেই রাজনীতি করছেন। এই রসায়ন নির্বাচনী রাজনীতিতে কী ভূমিকা রাখবে বা বাইরের থেকে মনোনয়ন নিয়ে কোনো উত্তেজনা আদৌ বোঝা যাবে কি না, তা দেখার জন্য আরও অপেক্ষা করতে হবে।
বেগম জিয়া ফ্যাক্টর
বেগম খালেদা জিয়া অসুস্থ। তিনি প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে জড়িত নন, তবে নিশ্চয় রাজনীতির খোঁজখবর রাখছেন। বিগত ক্ষমতার দিনগুলোতে তারেক জিয়ার সঙ্গে দলের প্রবীণ নেতাদের একটা অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ছিল। বেগম জিয়া প্রবীণ নেতাদের তখনকার পরিস্থিতিতে দ্ব্যর্থহীনভাবে সমর্থন দিয়েছিলেন এবং বিএনপিতে তাঁদের অবস্থান সুনিশ্চিত করেন। এখনো তাঁকে বিএনপির ঐক্যের প্রতীক হিসেবে মান্য করা হয়। ধারণা করা হচ্ছে, তাঁর শরীর যদি তাঁকে সহায়তা করে, তাহলে বিএনপির যেকোনো নাজুক পরিস্থিতিতে তিনি হস্তক্ষেপ না করলেও, তাঁর মতামত জোরালোভাবে তুলে ধরবেন।
তারেক জিয়া এখনো লন্ডনে কেন
যে প্রশ্নটা প্রায়ই শোনা যায়, তারেক জিয়া এখনো লন্ডন থেকেই দল পরিচালনা করছেন কেন? বিএনপির কাউকে জিজ্ঞেস করলে একটা গৎবাঁধা উত্তর শোনা যায়, তাঁর বিরুদ্ধে মামলাগুলো সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত তিনি দেশে আসতে পারছেন না। হয়তো মামলা আছে, কিন্তু এসব মামলায় তাঁকে জেলে নেওয়া হবে বা জামিন দেওয়া হবে না, এটা কেউ বিশ্বাস করবেন না। অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে বিএনপি সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছে।
তারেক রহমানের এখন পর্যন্ত লন্ডনে থেকে যাওয়ার কারণটা রাজনৈতিক হতে পারে। তিনি লন্ডন থেকে দল চালানোর একটা কার্যকর মডেল খুঁজে পেয়েছেন, অন্য কথায়, ‘কমফোর্ট জোন’ও বলতে পারেন। তিনি ভিডিও মারফত সভা–সমিতি করছেন, তাঁর কাছের লোকদের দ্বারা দেশে দল নিয়ন্ত্রণ করছেন এবং দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে বিরোধ এড়াতে পারছেন। (বিএনপির সিনিয়র নেতাদের মধ্যে বিরোধ নব্বই দশকে খুব বড় আলোচনার বিষয় ছিল।)
তা ছাড়া মির্জা ফখরুল ইসলাম তারেক জিয়ার নেতৃত্বকে মেনে নিয়েও দেশে বিএনপির জন্য একটা সম্মানজনক নেতৃত্ব সৃষ্টি করেছেন, যেটা বিএনপির জন্য খুবই ইতিবাচক। মির্জা ফখরুল ইসলামের ‘লো প্রোফাইল’ বা নিম্নস্বরের উপস্থিতির জন্য তারেক জিয়া কখনো মির্জা ফখরুলকে ‘হুমকিমূলক’ ভাবেননি। যাঁরা এত সব ঘোরপ্যাঁচ শুনতে চান না, তাঁদের জন্য শুধু বলব, যে জিনিসটা ভালো কাজ করছে, সেটাকে বিএনপি নেতা এখনই ভাঙতে চাচ্ছেন না।
তারেকের নতুন উপলব্ধি
দেশে রাজনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নেতাদের উপলব্ধিও বাড়ছে, ব্যক্তিকেন্দ্রিক প্রচারণা জনগণ পছন্দ করেন না। এ বছর তারেক রহমান তাঁর জন্মদিনে কোনো আনুষ্ঠানিকতা পালন না করতে নির্দেশ দিয়েছেন। এর আগে তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন, ‘আজকের পর থেকে দয়া করে আমার নাম যখন কেউ বলবেন, দেশনায়ক, রাষ্ট্রনায়ক—এই কথাগুলো কেউ ব্যবহার করবেন না।’ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের এই উত্তরণ দেশের জনগণ অবশ্যই পছন্দ করবেন। ভবিষ্যতের কাজ দিয়েই তাঁর নেতৃত্ব বিচার করা হবে।
সংস্কার নিয়ে ভিন্নমত
বিএনপি বারবার মত দিয়েছে, নির্বাচিত সরকারই রাষ্ট্রের সংস্কার ভালো করতে পারবে। তারা সংস্কারের প্রয়োজনে নির্বাচন পেছানোর বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ অবস্থান জানিয়েছে। অস্থায়ী সরকারের রাষ্ট্রীয় সংস্কারকে বিএনপি খুব গুরুত্ব দিচ্ছে বলে মনে হয় না। তারেক জিয়া বলেছেন, ‘সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। বিএনপি দায়িত্ব পেলে জনগণের চাহিদা অনুযায়ী তা বাস্তবায়ন করবে।’ তারেক জিয়া ১১ মার্চ এক অনুষ্ঠানে নিজের আট সংস্কার ভাবনা নিয়ে বক্তব্য দেন। তাঁর রাষ্ট্রীয় সংস্কার ভাবনা অন্য রকম—রাষ্ট্রীয় সংস্কারের চেয়ে জনগণের উন্নয়নের জন্য পলিসি উন্নয়নের ওপর তিনি গুরুত্ব দেন; যেমন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি রোধ, চিকিৎসাব্যবস্থা উন্নয়ন, শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন, কীভাবে শিল্প গড়ে তোলা যায় ইত্যাদি।
বিএনপির মাঠ পরিস্থিতি
বিএনপির জন্য একটা বিব্রতকর অবস্থা হলো, মাঠপর্যায়ের কর্মীদের ওপর দলের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। দেশের প্রতিটি আনাচকানাচে আওয়ামী লীগের পরিত্যক্ত দখলদারি, চাঁদাবাজি এর মধ্যেই বিএনপির ক্যাডারদের দখলে চলে গেছে। প্রতিদিনই এ নিয়ে খবরাখবর ছাপা হচ্ছে সংবাদপত্রে। কিছু ঘটনায় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে; কিন্তু এর ব্যাপ্তি এত বেশি যে সেটা থামানো যাচ্ছে না। এস আলমের গাড়ির ঘটনাতেও বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে সমালোচনা হয়। বিএনপি এসব দিক এখন থেকে সামাল না দিলে তারা দ্রুত জনগণের আস্থা হারাবে।
বিভিন্ন স্থানে বিএনপি নেতাদের নিজেদের মধ্যে সংঘাত বিএনপির জন্য সমস্যার সৃষ্টি করছে। এই বিবাদ এখন থেকে মেটাতে না পারলে নির্বাচনী সময়ে প্রার্থিতা ও ঐক্যবদ্ধ নির্বাচন হুমকির মধ্যে ফেলবে।
ভবিষ্যৎ
ভবিষ্যতে তারেক জিয়াকে কিছু প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। যখন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক রাজনীতি তুঙ্গে উঠবে, তাঁর বিরুদ্ধে পুরোনো অভিযোগগুলো আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। হাওয়া ভবন থেকে সমান্তরাল শাসনব্যবস্থা চালানো এর মধ্যে একটি। তিনি যদি সাহস করে তাঁর পুরোনো ভুলগুলো স্বীকার করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারেন, সেটা তাঁর জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক হবে এবং বিএনপির জন্যও সুফল আনবে।
জুলাই বিপ্লবের পর বিভিন্ন শক্তি একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধকে অবমূল্যায়ন করে যখন কথাবার্তা বলতে শুরু করেছিল, বিএনপি দৃঢ়ভাবে তা প্রত্যাখ্যান করেছে। বিএনপির নেতারাও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জোরালো ভাষায় কথা বলেন। এটা বিএনপির ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য খুবই ইতিবাচক।
একক বড় দল হিসেবে বিএনপির সুযোগ রয়েছে পরের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসার। তবে সামনে যারা ক্ষমতায় আসবে, তাদের দায়িত্ব হবে অনেক বেশি এবং কঠিন।
সালেহ উদ্দিন আহমদ শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
[email protected]
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব এনপ র জন য ব এনপ র স র জন ত ক র জন ত র ব যবস থ অবস থ ন করছ ন ইসল ম ক ষমত ফখর ল
এছাড়াও পড়ুন:
ইফতারের রাজনৈতিক অর্থনীতি
রাজনৈতিক দলগুলো ইফতার মাহফিলের নামে মূলত সমাবেশের আয়োজন করছে। এটিকে বলা যায় ইফতার রাজনীতি। আয়োজক দল সাধারণত সমমনাদের দাওয়াত দিয়ে থাকে। তবে সৌজন্যের খাতিরে প্রতিপক্ষকে দাওয়াত দিলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমন্ত্রিতদের হাজির হতে দেখা যায় না। যেমন গত ৪ মার্চ রাজনীতিক ও কূটনীতিকদের সম্মানে জাতীয় পার্টির ইফতার আয়োজনে অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলের নেতারা যাননি।
এ বছর অবশ্য ইফতার ঘিরে রাজনীতি বেশিই জমে উঠেছে। যেমন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী ঘোষণা দিয়েছিলেন– ‘আল্লাহ যদি আমাকে বেহেশতেও নিতে চান, আমি জামায়াতের সঙ্গে বেহেশতে যাব না। কারণ তারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে। যুদ্ধের সময় মা-বোনের ইজ্জত হরণ করতে পাকিস্তানিদের সহযোগিতা করেছে। জামায়াত ছাড়া কারও সঙ্গে আমার কোনো বিরোধ নেই’। ২০২৩ সালের ২৬ জানুয়ারি টাঙ্গাইলের সখীপুর উপজেলার হতেয়া হাজী হাফিজ উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ আয়োজিত জনসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তাঁর এই ঘোষণা সে সময় সংবাদমাধ্যমে যথেষ্ট আলোচিত হয়েছিল। আদতে দেখা গেল, গত ৮ মার্চ (২০২৫) টাঙ্গাইল প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে টাঙ্গাইল জেলা জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ আয়োজিত ইফতার মাহফিলে অংশ নিয়েছেন তিনি।
কাদের সিদ্দিকী জামায়াত প্রসঙ্গে আরও বলেছিলেন, জামায়াত জাতির কাছে মাফ চাক, ভুল স্বীকার করুক, তারপর রাজপথে আসুক। জামায়াতে ইসলামী একাত্তরের ভূমিকার জন্য মাফ চেয়েছে– এমন খবর আমাদের জানা নেই। কাদের সিদ্দিকীর কাছে গোপনে মাফ চেয়েছে বলে কি আমরা ধরে নেব? মাফ না চাইলেও কাদের সিদ্দিকী জামায়াতের ইফতার অনুষ্ঠানে কেন হাজির হলেন?
জামায়াতের ইফতারে কাদের সিদ্দিকীর অংশগ্রহণ যদি নিরেট রাজনৈতিক হয়, নবগঠিত রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি এনসিপির ইফতার ইস্যুটি তাহলে সম্ভবত রাজনৈতিক অর্থনীতি। মঙ্গলবার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ইফতার অনুষ্ঠানের আয়োজন করে এনসিপি। রাজনীতিবিদ, বিশিষ্ট নাগরিক, সাংবাদিক, ছাত্র-শ্রমিক, পেশাজীবী, সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষকে নিয়ে এনসিপি এই ইফতার পার্টির আয়োজন করে। পাঁচতারকা হোটেলে নতুন দল, যেটির এখনও নিবন্ধন হয়নি; এমন রাজনৈতিক দলের পক্ষে জাঁকজমকপূর্ণ ইফতার আয়োজন চমকিত হওয়ার মতোই ঘটনা।
প্রশ্ন জাগে, এ রাজনৈতিক দলের অর্থের উৎস কোথায়? অবশ্য এনসিপি দলীয় তহবিল গঠনের জন্য ‘ক্রাউডফান্ডিং’ করবে বলে জানিয়েছে ইতোমধ্যে। গত ৮ মার্চ দলের এক সংবাদ সম্মেলনে বার্তা সংস্থা রয়টার্সে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, ‘আমরা অনলাইন ও অফলাইনে একটি ক্রাউডফান্ডিংয়ের (গণচাঁদা সংগ্রহ) দিকে যাচ্ছি, যে ক্রাউডফান্ডিংয়ের মাধ্যমে আমরা দলের কার্যালয় স্থাপনসহ নির্বাচনী তহবিল সংগ্রহ করব’ (সমকাল অনলাইন, ৮ মার্চ ২০২৫)।
রাজনীতিতে গণচাঁদা সংগ্রহ অভিনব কিছু নয়। রাজনৈতিক দল ও সংগঠন গণচাঁদা সংগ্রহ করেই চলে। মওলানা ভাসানী মুষ্টি ধান-চাল সংগ্রহ করার বুদ্ধি দিয়েছিলেন তাঁর সমর্থকদের। এখন অবশ্য দিন বদলেছে। কেবল মুষ্টি ধান-চালের জোগান দিয়ে রাজনীতির চাকা ঘোরে না। ঘটনা দেখে মনে হচ্ছে, রাজনৈতিক দলগুলো এখন প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে মুষ্টি ধান-চাল নিচ্ছে না, বরং ধান-চালের একাধিক
কারখানা নিজেদের পকেটে নিয়ে দিব্যি বসে আছে। এইভাবে দলের তহবিলের জন্য ফান্ড নেওয়ায় সমস্যা হয় তখন, যখন রাজনৈতিক দলগুলো বেনিয়া ও স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর কাছ থেকে টাকা নেয় এবং তাদের স্বার্থ রক্ষায় একনিষ্ঠ থাকে। এভাবে চাঁদা নেওয়ার ফলে জনগণের সেবক হওয়ার বদলে রাজনৈতিক দলগুলো বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও মুনাফালোভীর সেবক হিসেবে কাজ করে।
সারাবিশ্বেই রাজনৈতিক দলগুলো তাদের পরিচালন ব্যয় নির্বাহের জন্য গণচাঁদা গ্রহণ করে। তবে আমাদের সঙ্গে তাদের ব্যবধান হচ্ছে– প্রকাশ্য এবং অপ্রকাশ্য। তারা চাঁদা নিয়ে থাকে প্রকাশ্যে, আমরা নিয়ে থাকি অপ্রকাশ্যে। আমাদের কোন রাজনৈতিক দলের তহবিলে কোন শিল্পপ্রতিষ্ঠান কত টাকা চাঁদা দিয়েছে, তার সুলুক সন্ধান করা কঠিন।
আমরা যদি উন্নত গণতন্ত্রের দেশ আমেরিকার দিকে না তাকিয়ে প্রতিবেশী ভারতের দিকেও তাকাই, তাহলেও গণচাঁদার হিসাব পাওয়া যাবে। উদাহরণ হিসেবে দ্য হিন্দুর গত ১২ জানুয়ারি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের তথ্য উল্লেখ করা যায়। ভারতের আম আদমি পার্টির নেত্রী ও দিল্লির সাবেক মুখ্যমন্ত্রী আতিশী মার্লেনা দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে প্রচারণার খরচ মেটাতে একটি গণতহবিলের প্রচারণা চালিয়েছিলেন। নির্বাচনী ব্যয়ের জন্য ৪০ লাখ রুপি দরকার ছিল।
এখন ধরা যাক, আমাদের দেশের একটি নতুন রাজনৈতিক দলের ইফতার পার্টিতে দুই কোটি টাকা দরকার। এ পরিমাণ অর্থ গণচাঁদার মাধ্যমে উত্তোলন করা সম্ভব কিনা? রাজনৈতিক দল এবং দাতা উভয়েই স্বেচ্ছায় এ তথ্য প্রকাশ করবে কিনা? যদি নতুন দিনের রাজনীতির কথা বলা হয়, বিপরীতে সেই পুরোনো পথেই, অর্থাৎ তথ্য গোপন করার পথেই রাজনৈতিক দলগুলো এগিয়ে যায়, তাহলে রাজনৈতিক সংস্কৃতির বদল হবে কী করে?
আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের রাজনীতিতে পবিত্র রমজান মাসের ইফতার ঘিরে যে নির্বাচনী হাওয়া বইছে, তাতে যেন কেবল রাজনৈতিক দলগুলোর ভাগ্যবদল না ঘটে। জনগণের জন্য যে রাজনীতি, জনগণের উদ্দেশে যে ইফতারের আয়োজন করা হয়, সেটির খরচের খাতও জনগণের সামনে পরিষ্কার করা জরুরি। কেননা, সমর্থকদের মধ্যে রাজনৈতিক দলের এজেন্ডার গ্রহণযোগ্যতা মূল্যায়নের জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক দলগুলো সাধারণত সদস্যদের চাঁদা, অনুদান নিয়ে থাকে। এটিই রীতি। আবার শুভাকাঙ্ক্ষীরাও অর্থ দিয়ে থাকেন। তবে কথা হচ্ছে, রাজনৈতিক দলগুলোর অর্থের উৎসের স্বচ্ছতা থাকতে হবে। একইভাবে গণতহবিলের ক্ষেত্রেও একই নীতি থাকা প্রয়োজন। সব তথ্য জনসমক্ষে উপস্থাপন করতে হবে। আবার নির্বাচন কমিশনেও আর্থিক লেনদেন সম্পর্কিত তথ্যে এসবের উল্লেখ থাকতে হবে। কমিশন চাইলেই যেন তা স্বতন্ত্রভাবে নিরীক্ষা করতে পারে।
রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নেতাকর্মীকে আরও চাঙ্গা ও ঐক্যবদ্ধ করতে রমজানে ইফতার মাহফিল আয়োজনে করার উদ্যোগ নিয়েছে। দীর্ঘ দেড় দশক পরে দেশ স্বাভাবিক রাজনীতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এই ইফতার রাজনীতির মাধ্যমে দল বা জোট গোছানো এবং নিজেদের মধ্যে সৃষ্ট ভুল বোঝাবুঝির অবসান হবে বলে মনে করি। ইফতার মাহফিলকে ভোটের প্রস্তুতি হিসেবে দেখতে চাইলে, রাজনৈতিক দলগুলোকে জনগণের মুখোমুখি হবার প্রস্তুতিও নিয়ে রাখতে হবে। নইলে ইফতার মাহফিল আয়োজনের আর্থিক দিক নিয়ে যেমন কথা হবে, তেমনি তা ইফতারের যে পুণ্য সেটিও অধরা থেকে যাবে।
এহ্সান মাহমুদ: সহকারী সম্পাদক,
সমকাল; কথাসাহিত্যিক