হজরত উমর (রা.) কন্যা হাফসা (রা.)–র জীবনী
Published: 16th, March 2025 GMT
একবার খলিফা উমর (রা.) এক নারীর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার কী হয়েছে?’ নারীটি বললেন, ‘কয়েক মাস ধরে আমার স্বামী আমার কাছ থেকে দূরে আছে। তাঁকে আমার কাছে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা তীব্র হয়ে উঠেছে।’
উমর (রা.) তখন তাঁর মেয়ে হাফসা (রা.)–র কাছে গিয়ে বললেন, ‘আমি তোমার কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জানতে চাই। আমাকে সাহায্য করো। স্বামী কত দিন দূরে থাকলে স্বামীকে কাছে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা মেয়েদের মধ্যে তীব্র হয়ে ওঠে?’
হাফসা (রা.
হাফসা (রা.) তখন হাতে ইশারা করে বুঝিয়ে দিলেন তিন বা চার মাস।
উমর (রা.) নির্দেশ দিলেন, কোনো সৈনিককে যেন চার মাসের বেশি সময় আটকে রাখা না হয়।
হাফসা (রা.) ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)–র কন্যা। তাঁর ভাই সাহাবি আবদুল্লাহ ইবন উমর (রা.)। হাফসা (রা.) আবদুল্লাহর চেয়ে ছয় বছরের বড় ছিলেন।
আরও পড়ুনসিজদার যত উপকারিতা১৪ জানুয়ারি ২০২৪বিয়ের বয়স হলে উমর (রা.) বনু সাহম গোত্রের খুনাইস ইবনে হুজাফার সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেন। খুনাইস (রা.) মক্কায় প্রথম পর্বে ইসলাম গ্রহণকারীদের অন্যতম। স্বামীর সঙ্গে হাফসা (রা.) মদিনায় হিজরত করেন। মদিনায় যাওয়ার কিছুদিন পরই খুনাইস (রা.) ইন্তেকাল করেন। হাফসা (রা.) বিধবা হয়ে যান। তাঁর বয়স তখন ২০ বছরেরও কম। উমর (রা.) তাঁর মেয়ের দ্বিতীয় বিয়ের কথা ভাবতে লাগলেন। রাসুল (সা.)–এর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। হাফসাকে ৪০০ দিরহাম মোহরানা দেওয়া হয়।
হাফসা (রা.) ছিলেন তীক্ষ্ণ বুদ্ধির অধিকারী। তাঁর মধ্যে শেখার প্রবল আগ্রহ লক্ষ করে রাসুল (সা.) তাঁকে বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। নারী সাহাবি শিফা বিনতে আবদুল্লাহ (রা.) লিখতে ও পড়তে জানতেন। রাসুলুল্লাহ (সা.)–এর নির্দেশে তিনি হজরত হাফসা (রা.)–কে লেখাপড়া ও রোগ নিরাময়ের উপায় শেখান।
হাফসা (রা.) ৬০টি হাদিস বর্ণনা করেছেন। হাদিসগুলো তিনি রাসুল (সা.) এবং উমর (রা.)–এর কাছে শুনেছিলেন।
আরও পড়ুনহারুত ও মারুত দুই ফেরেশতার নাম০৫ এপ্রিল ২০২৪আয়েশা (রা.) আর হাফসা (রা.)–এর সম্পর্ক ছিল বোনের মতো। তাঁরা একে অপরের সহযোগী ছিলেন। আয়েশা (রা.) তাঁর সম্পর্কে বলেছেন, হাফসার বাবা যেমন প্রতিটি কথা ও কাজে দৃঢ়সংকল্প, হাফসাও তেমন। (আবু দাউদ)
রাসুল (সা.)–এর ইন্তেকালের আগে কোরআন একত্রে সংকলনবদ্ধ হয়নি। কোরআন ছিল সাহাবিদের অন্তরে খোদিত। আবু বকর (রা.)–এর খিলাফতের সময় সাহাবি যায়িদ ইবনে সাবিত (রা.)–কে কোরআন সংকলনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। সংকলিত সেই কোরআন হাফসা (রা.)–র কাছে সংরক্ষিত ছিল। উসমান (রা.) খিলাফতকালে হাফসা (রা.)–র কাছে রক্ষিত কোরআনের কপিকে প্রামাণ্য ধরে আরও কপি তৈরি করা হয়।
হাফসা (রা.) ৪৫ হিজরিতে রোজা রাখা অবস্থায় মদিনায় ইন্তেকাল করেন। জান্নাতুল বাকি কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।
আরও পড়ুন‘রাব্বানা আতিনা ফিদ্দুনিয়া’ কেন পড়ব২৪ মার্চ ২০২৪উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ক রআন
এছাড়াও পড়ুন:
অলৌকিক উট
নবী নুহ (আ.)-এর ছেলে ছিলেন সাম। হজরত সালেহ (আ.) ছিলেন সামের বংশধর। তিনি সামুদ জাতির নবী। হিজাজ ও সিরিয়ার মধ্যস্থলে অবস্থিত ওয়াদিউল কুরা প্রান্তরে ছিল তাঁদের বসতি, বর্তমানে লোকে যাকে চেনে ‘ফাজ্জুহ নাকাহ’ বা ‘মাদায়েনে সালেহ’ নামে। ঐতিহাসিক মাসউদি বলেন, ‘সিরিয়া থেকে হিজাজে যাওয়ার পথে সামুদ সম্প্রদায়ের ধ্বংসপ্রাপ্ত বসতিগুলোর ভগ্নাবশেষ এবং তার প্রাচীন চিহ্নগুলো দেখা যায়।’ (কাসাসুল কোরআন, মুহাম্মদ হিফজুর রহমান, অনুবাদ: আবদুস সাত্তার আইনী, ১/ ১২৮)
বেশ সচ্ছল ও অবস্থাপন্ন ছিল সামুদ জাতি। শক্তিতে বলীয়ান ছিল, সুখ-শান্তির কমতি ছিল না। পাথর খোদাই ও স্থাপত্যবিদ্যায় তাদের ছিল বিশেষ পারদর্শিতা। বড় বড় প্রাসাদ ও পাহাড় কেটে ঘর বানাত তারা। তাদের ছিল সবুজ-শ্যামল উদ্যান। সোনা-রুপার প্রাচুর্যে মোড়ানো জীবন। কিন্তু তারা আল্লাহকে মানত না। আল্লাহর সঙ্গে অংশীদারি করত। সালেহ (আ.) ছিলেন তাদের গোত্রের একজন। তিনি ছিলেন বিচক্ষণ, সুবক্তা ও পণ্ডিত ব্যক্তি।
আরও পড়ুনআল্লাহর কাছে যে দোয়া করেছিলেন নবী সোলায়মান (আ.) ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫একদিন তিনি আল্লাহর নবী হয়ে তাদের কাছে গেলেন। তাদের একাত্মবাদের পথে আহ্বান করলেন। বললেন, ‘আমার সম্প্রদায়, তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো, তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোনো উপাসক নেই, তিনি তোমাদের মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন, আর তাতেই তোমাদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন, কাজেই তাঁর কাছে তোমরা ক্ষমা প্রার্থনা করো, আর তাঁর দিকেই ফিরে এসো, আমার প্রতিপালক তো অতি কাছে, আর তিনি ডাকে সাড়া দানকারী।’ (সুরা হুদ, আয়াত: ৬১)
গুটিকয়েকজন ছাড়া কেউ তাঁর ডাকা সাড়া দিল না। সতর্কবার্তাও এড়িয়ে গেল। তারা প্রাসাদ, অর্থবৈভব ও বিলাসসামগ্রী নিয়ে গর্ব-অহংকার করল। বলল, ‘আমাদের মধ্য থেকে কি তার ওপরই অহি নাজিল হলো?’ (সুরা সাদ, আয়াত: ৮)
তারা সালেহ (আ.)-এর কাছে নবী হওয়ার প্রমাণ চাইল, আপনি যদি আল্লাহর রাসুল হন, তাহলে আমাদের কাতেবা নামের পাথরময় পাহাড়ের ভেতর থেকে একটি ১০ মাসের গর্ভবতী, সবল ও স্বাস্থ্যবতী উট বের করে দেখান। সালেহ (আ.) তাদের থেকে ইমান আনার প্রতিশ্রুতি নিলেন। তিনি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলেন। গর্ভবতী ও দুগ্ধবতী উট বেরিয়ে এলো পাথুরে পাহাড় থেকে। কোরআনে এটিকে ‘আল্লাহর উট’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এ বিস্ময় দেখে কিছু লোক তৎক্ষণাৎ ইমান আনল। অন্যরা ইমান আনতে চাইলে পুরোহিতরা বাধা দিল।
আরও পড়ুনইয়া জাল জালালি ওয়াল ইকরামের ফজিলত১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫সালেহ (আ.) তাদের উটের ব্যাপারে সতর্ক করলেন, ‘আল্লাহর এই উটটি তোমাদের জন্য আল্লাহর নিদর্শন। অতএব তাকে আল্লাহর জমিনে বিচরণ করতে দাও এবং তাকে মন্দভাবে স্পর্শও করো না। নতুবা অতিসত্বর তোমাদের আজাব পাকড়াও করবে।’ (সুরা হুদ, আয়াত: ৬৪)
একই কূপ থেকে উট ও অন্য জন্তুদের পানি পান করাত তারা। উট পানি পান করলে পানি শেষ হয়ে যেত। সালেহ (আ.) উটের জন্য একদিন ও তাদের জন্য একদিন নির্ধারণ করে দিলেন। অনেকেই সালেহ (আ.)-এর কথা মেনে নিল। এভাবে কিছুদিন চলল। তারা উট ও তার বাচ্চাদের থেকে উপকৃত হলো। এর মধ্যে তারা পানি নিয়ে উটের দিনটাকে ঝামেলা মনে করল। একপর্যায়ে সামুদ জাতির ‘মিসদা’ ও ‘কাসার’ নামের দুই যুবক বিভিন্ন প্রলোভনের নেশায় মত্ত হয়ে এই উটকে হত্যা করল। (কাসাসুল কোরআন, মুহাম্মদ হিফজুর রহমান, অনুবাদ: আবদুস সাত্তার আইনী, ১/১৪৪-১৪৫)
আল্লাহ বললেন, ‘তারা উটকে হত্যা করে স্বীয় প্রতিপালকের আদেশ অমান্য করল। তারা বলল, হে সালেহ, নিয়ে এসো যা দিয়ে আমাদের ভয় দেখাতে, তুমি যদি রাসুল হয়ে থাকো।’ (সুরা আরাফ, আয়াত: ৭৭)
সালেহ (আ.) লোকদের কাছে গিয়ে আজাবের দিনক্ষণ জানিয়ে দিলেন, ‘তোমরা নিজেদের ঘরে আরও তিন দিন বাস করে নাও; এটি ওয়াদা, যাতে বিন্দুমাত্র মিথ্যা নেই।’ (সুরা হুদ, আয়াত: ৬৫)
প্রথম দিন তাদের সবার মুখমণ্ডল হলদে ফ্যাকাসে, দ্বিতীয় দিন লাল এবং তৃতীয় দিন ঘোর কালো হয়ে গেল। এক শনিবার ভোরে গগনবিদারী গর্জন, মুহুর্মুহু বিজলির চমক আর ভয়াবহ ভূমিকম্পে তাদের মৃত্যু হলো। তারা নিজ নিজ ঘরে মুখ থুবড়ে পড়ে রইল। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘অতঃপর পাকড়াও করল তাদেরকে ভূমিকম্প। ফলে সকালবেলায় নিজ নিজ ঘরে উপুড় হয়ে পড়ে রইল।’ (সুরা আরাফ, আয়াত: ৭৮)
লেখক: আলেম
আরও পড়ুনরানি বিলকিস ও হজরত সোলায়মানের (আ.) ঘটনা১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫