টিসিবির সাত হাজার স্মার্ট কার্ড বিতরণ হয়নি, পণ্য দেওয়া হচ্ছে ‘নেতাদের স্লিপে’
Published: 16th, March 2025 GMT
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে দুই মাস ধরে আটকে রাখা হয়েছে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) প্রায় সাত হাজার স্মার্ট কার্ড। কার্ড ইস্যু হওয়ার পরও বিতরণ না করায় টিসিবির পণ্য কিনতে পারছেন না এসব ভোক্তা। স্থানীয় বিএনপি ও জামায়াতের সুপারিশের কারণে এসব কার্ড আটকে রাখার অভিযোগ উঠেছে। দল দুটির নেতারা জানিয়েছেন, আগের তালিকায় আওয়ামী লীগের লোকজনের প্রাধান্য থাকায় নতুন তালিকা করার প্রস্তাব দিয়েছেন তাঁরা।
বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা আবুল বশর বলেন, তিনি মক্তবে শিশুদের পড়িয়ে সংসার চালান। গত সোমবার তিনি টিসিবির পণ্য কিনতে গিয়েছিলেন। তবে টিসিবির কার্ড না থাকায় পণ্য পাননি। অথচ বিএনপি-জামায়াত নেতাদের স্লিপ নিয়ে যাঁরা গেছেন, তাঁদের কার্ড না থাকা সত্ত্বেও পণ্য দেওয়া হয়েছে। তিনি শুনেছেন তাঁর নামে স্মার্ট কার্ড ইউনিয়ন পরিষদে (ইউপি) রয়েছে। তবে খোঁজ নিতে গেলে ইউপি কার্যালয় থেকে জানানো হয় তাঁর কার্ড এখনো হয়নি।
এলাকার আরেক বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, তিনি পুরোনো কার্ড নিয়ে পণ্যের জন্য দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়েও পণ্য পাননি। তিনি স্মার্ট কার্ডের জন্য ছবি তুলেছিলেন। কিন্তু তাঁর কার্ড হয়েছে কি না, তিনি জানেন না।
ওই ইউনিয়নে ভারপ্রাপ্ত সচিবের দায়িত্ব পালন করছেন পাশের কুমিরা ইউনিয়ন পরিষদের সচিব শোভন ভৌমিক। জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়নে মোট ১ হাজার ৬৫ জনের স্মার্ট কার্ড এসেছে। এর মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে ৫২৯টি স্মার্ট কার্ড। যাঁরা স্মার্ট কার্ড পেয়েছেন, তাঁদের কাছে পণ্য বিক্রি করার পরও কিছু পণ্য রয়ে যায়। সেগুলো ফেরত না পাঠিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি নিয়ে হতদরিদ্র মানুষের কাছে বিক্রি করা হয়।
উপজেলা প্রশাসন জানায়, স্মার্ট কার্ডধারীরা সচ্ছল কি না, পুনরায় যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। যোগ্য ব্যক্তিদের কার্ড বিতরণ চলমান রয়েছে। গত ২৯ জানুয়ারি উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের সচিবদের কাছে উপকারভোগীদের বিতরণের জন্য ১০ হাজার ৪৭২টি স্মার্ট কার্ড ইস্যু করা হয়। এর মধ্যে দেড় মাসে ৩ হাজার ৫৫০টি কার্ড বিতরণের পর অ্যাকটিভ (চালু) করা হয়েছে। যা মোট উপকারভোগীর ৩৩ দশমিক ৮৯ শতাংশ। বাকি ৬ হাজার ৯৯২টি স্মার্ট কার্ড চালু হয়নি।
ভাটিয়ারী ইউনিয়নে উপকারভোগী রয়েছে ১ হাজার ৬৯১ জন। এর মধ্যে কার্ড এসেছে ১ হাজার ৮২ জনের। তবে ৫২০টি কার্ড বিতরণ করা হয়েছে বলে জানান ইউনিয়ন পরিষদের সচিব আবুল বশর। কুমিরা ইউনিয়ন পরিষদে স্মার্ট কার্ডের আওতায় এসেছে ১ হাজার ৩৭৫ জন। কার্ড বিতরণ হয়েছে ৪৬৫টি। সলিমপুর ইউনিয়ন পরিষদের সচিব আল আমিন বলেন, উপকারভোগী ১ হাজার ৬২৬ জনের মধ্যে কার্ড এসেছে ৯২৫টি। এখন পর্যন্ত বিতরণ করা হয়েছে ৪৫০টি কার্ড। তাঁর এলাকার অনেক উপকারভোগী ভাসমান। অনেকে মুঠোফোন ব্যবহার করেন না। এ ছাড়া জনপ্রতিনিধিরা এলাকায় না থাকায় বাড়ি বাড়ি গিয়েও কার্ডগুলো বিতরণ করা যাচ্ছে না।
তবে একাধিক ইউনিয়ন পরিষদের সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, কার্ডগুলো দুই মাস আগে এলেও বিতরণ কাজ স্থগিত রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কে এম রফিকুল ইসলাম। বর্তমান ইউএনও মো.
জানতে চাইলে উপজেলা জামায়াতের আমির মো. মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, টিসিবির উপকারভোগীদের বিষয়ে তাঁরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে যে পরিমাণ স্মার্ট কার্ড এসেছে, তার ৩০ শতাংশ বিতরণ করা হবে। বাকি ৭০ শতাংশ উপকারভোগীর নতুন তালিকা করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে জমা দেওয়া হবে। এ তালিকা করার জন্য জামায়াতের ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আগের তালিকায় কেবল আওয়ামী লীগের দলীয় নেতা-কর্মীদের প্রাধান্য ছিল। এখন আর তা থাকবে না।
উপজেলা বিএনপির সদস্যসচিব কাজী মোহাম্মদ মহিউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, আগের সরকার গরিবদের কথা চিন্তা করেনি। দলের নেতা-কর্মীদের কার্ড দিয়েছে। এখন যাঁরা হকদার, তাঁরা কার্ড পাবেন। তাই নতুন তালিকা করতে বলা হয়েছে।
জানতে চাইলে ইউএনও মো. ফখরুল ইসলাম বলেন, টিসিবির লোকজন প্রতিটি ইউনিয়নে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ পণ্য বিক্রির জন্য নিয়ে যান। স্মার্ট কার্ডধারীদের কাছে বিক্রি করার পর নিম্ন আয়ের মানুষ যাঁরা তাৎক্ষণিক জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি নিয়ে উপস্থিত হন, তাঁদের কাছে অবশিষ্ট পণ্য বিক্রি করা হয়। এখানে কোনো দলের নেতা-কর্মীদের টোকেন কোনো বিষয় নয়। সম্প্রতি তিনি যোগদানের পর টিসিবির কার্ড বিতরণ করার উদ্যোগ নেন। কিন্তু অভিযোগ আসছে যাঁরা টিসিবির কার্ড পাওয়ার যোগ্য নন, তাঁদেরও কার্ডের আওতায় আনা হয়েছে। পরে তিনি কার্ডগুলো যাচাই-বাছাই করে বিতরণের সিদ্ধান্ত নেন। যোগ্য লোকদের কার্ড বিতরণের কাজ চলমান রয়েছে বলে জানান তিনি।
এক প্রশ্নের জবাবে ইউএনও বলেন, ‘আগের তালিকাটা যাচাই-বাছাই করেছেন আগের ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্যরা। ওই তালিকা ঢাকা পাঠানো হয়েছে বলেই তো স্মার্ট কার্ড ইস্যু হয়েছে। কিন্তু তাঁরা কীভাবে বাছাই করেছিল সেটা আমার জানা নেই।’
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ক র ড ব তরণ র ক র ড এস ছ কর মকর ত ব ছ ই কর ব তরণ ক র জন য উপজ ল ব এনপ
এছাড়াও পড়ুন:
নেত্রকোনায় বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে যুবদলের হামলা, ইউএনও লাঞ্ছিত
নেত্রকোনায় বর্ষবরণ অনুষ্ঠান চলাকালে মঞ্চে হামলার অভিযোগ উঠেছে উপজেলা যুবদলের কয়েকজন পদধারী নেতার বিরুদ্ধে। এসময় ওই নেতারা মঞ্চ থেকে শিল্পীদের নামিয়ে দেওয়াসহ সামনে বসা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও (ইউএনও) অন্যান্য অতিথিদের লাঞ্ছিত করেন। ছিঁড়ে ফেলে দেন অনুষ্ঠানের ব্যানার। পণ্ড হয়ে যায় অনুষ্ঠানটি।
সোমবার দুপুরে আটপাড়া উপজেলা মুক্তমঞ্চে এ ঘটনা ঘটে। অনুষ্ঠানটির আয়োজন করে উপজেলা প্রশাসন।
আটপাড়া উপজেলা প্রশাসন ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, আজ সোমবার সকাল থেকে আটপাড়া উপজেলা পরিষদসংলগ্ন মুক্তমঞ্চে প্রশাসন আয়োজিত বর্ষবরণের অনুষ্ঠান চলছিল। এতে বিভিন্ন সামজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা অংশ নেন। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে দ্বিতীয় অধিবেশন চলাকালীন ‘উপজেলা প্রশাসন বিদ্যানিকেতন’ এর শিক্ষার্থীরা নৃত্য পরিবেশন করছিল।
এসময় উপজেলা যুবদলের সদস্য সচিব নূর ফরিদ খান, যুগ্ম আহ্বায়ক মোদাচ্ছের হোসেন ওরফে কাইয়ুম, কামাল হোসেন তালুকদারসহ স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলের বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত হন। পরে তাঁরা ইউএনওকে অনুষ্ঠান বন্ধ করতে বলেন।
এ সময় ইউএনও কারণ জানতে চাইলে মঞ্চের ব্যানারে স্থান হিসেবে কেন ‘উপজেলা পরিষদ বঙ্গবন্ধু চত্বর’ লেখা হয়েছে, এ কথা বলে যুগ্ম আহ্বায়ক মোদাচ্ছের হোসেনের নেতৃত্বে নেতাকর্মীরা মঞ্চে ওঠে শিক্ষার্থীদের নামিয়ে দিয়ে মঞ্চে থাকা ব্যানার ছিঁড়ে ফেলেন।
প্রত্যক্ষদর্শী একজন বলেন, ইউএনওসহ কর্মকর্তারা তাদের বাধা দিতে চাইলে ওই নেতারা তাদের ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেন। তাঁদের মধ্যে এক নেতা উপস্থাপককে মারধর করে মাইক কেড়ে নিয়ে ইউএনওকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করেন।
প্রত্যক্ষদর্শী এক কর্মকর্তা জানান, তখন ইউএনও বলেন- ব্যানারে তো কোনও ‘বঙ্গবন্ধু চত্বর’ লেখা নেই। তখন সদস্য সচিব নূর ফরিদ আবারও বলেন, না ব্যানারে বঙ্গবন্ধুর নাম আছে। ফেইসবুকেও ব্যানারের ছবি পোস্ট আছে। আমার ফোনেও এ ছবি একজন পাঠিয়েছেন। অনুষ্ঠান এখনই বন্ধ করতে হবে। বিশৃঙ্খলার কারণে একপর্যায়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লে অনুষ্ঠানটি পণ্ড হয়ে যায়। পরে দেখা যায় ফেসবুকে পোস্ট করা ‘বঙ্গবন্ধু চত্বর’র ওই ছবিটি বাংলা সন ১৪৩০ এর।
আটপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রুয়েল সাংমা বলেন, উপজেলা যুবদলের সদস্য সচিব নূর ফরিদের নেতৃত্বে কাইয়ুম, কামালসহ বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী সংঘবদ্ধ হয়ে হঠাৎ অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে মঞ্চের ব্যানার ছিঁড়ে ফেলেন। এ সময় আমি কারণ জানতে চাইলে আমাকেসহ কর্মকর্তাদের লাঞ্ছিত করে অনুষ্ঠানটি বন্ধ করে দেন। উপস্থাপককে মারধর করে মাইক হাতে নিয়ে আমাকে ফ্যাসিবাদের দোসর হিসেবে আখ্যায়িত করেন। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।
আটপাড়া উপজেলা যুবদলের সদস্য সচিব নূর ফরিদ খান বলেন, আমরা একটি স্থানে বসেছিলাম। হঠাৎ একজন আমার ম্যাসেঞ্জারে একটি ব্যানার দেন। ওই ব্যানারে ‘বঙ্গবন্ধু চত্বর’ লেখা ছিল। ফেসবুকেও একজন শেয়ার দিয়েছেন দেখেছি। পরে আমরা মঞ্চে গিয়ে কারণ জানতে চাই। এ সময় আমাদের দলের যুগ্ম আহ্বায়ক মোদাচ্ছের হোসেন, কামাল হোসেন, স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক উজ্জ্বল, সদস্য সচিব রুপণ, ছাত্রদলের টিটুসহ কয়েকজন ব্যানার ছিঁড়ে ফেলেন। পরে প্রশাসনের লোকজন আমাদের নিশ্চিত করেন যে ব্যানারে বঙ্গবন্ধুর নাম নেই। বিষয়টি আমাদের ভুল হয়ে গেছে। এর জন্য আমরা ইউএনও মহোদয়ের কাছে ভুল স্বীকার করেছি। মাফ চেয়েছি। আপনারাও বিষয়টি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। আমরা কাউকে লাঞ্ছিত করিনি। এটা মিথ্যা অপবাদ দেওয়া হচ্ছে।
আটপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান বলেন, যখন এ ঘটনাটি ঘটেছে তখন আমি ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলাম না। অভিযোগ পাওয়া গেলে এ ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
নেত্রকোনা জেলা বিএনপির সদস্য সচিব ও কেন্দ্রীয় বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য ড. রফিকুল ইসলাম হিলালী জানান, যে ঘটনাটি ঘটেছে তা কোনোভাবেই কাম্য নয়। দলীয়ভাবে বিষয়টি তদন্ত করে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
নেত্রকোনার জেলা প্রশাসক বনানী বিশ্বাস জানান, এ ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ইউএনওকে বলা হয়েছে।