অপতথ্য মোকাবিলায় জাতিসংঘ মহাসচিবের সহায়তা চাইলেন প্রধান উপদেষ্টা
Published: 16th, March 2025 GMT
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস অপতথ্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জাতিসংঘের সহায়তা কামনা করেছেন। শনিবার সন্ধ্যায় তিনি রাজধানীর একটি হোটেলে সফররত জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের সম্মানে আয়োজিত ইফতার অনুষ্ঠানে বলেন, ‘আমরা আপনার আশীর্বাদ চাই, বিশেষত একটি বিষয়ে- অপতথ্যের বিরুদ্ধে, যা আমাদেরকে ধ্বংস করছে’।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, মানুষ কঠোর পরিশ্রম করে একটি স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে চায়। কিন্তু কিছু মানুষ তা পছন্দ করে না। তিনি বলেন, ‘অপতথ্য ছড়ানো থেকে আমাদের রক্ষা করুন, বাকিটা আমরা সামলে নিতে পারব।’
জাতীয় ঐক্য প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, শিক্ষার্থীরা যে ঐক্য তৈরি করেছে, তা দেশের সকল পর্যায়ের জনগণের মধ্যে একটি অনন্য সংহতি সৃষ্টি করেছে। তিনি বলেন, দেশের জনগণ অনেক বিষয়ে মতানৈক্য পোষণ করলেও একটি বিষয়ে তারা একমত—‘আমরা একটি নতুন বাংলাদেশ গড়তে চাই। এতে আমাদের মধ্যে কোনো মতপার্থক্য নেই।’
গতবছরের জুলাই-আগস্টে সংগঠিত ছাত্র আন্দোলনকে ঐতিহাসিক আখ্যা দিয়ে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের কাছে অস্ত্র ছিল না, ছিল কেবল তাদের জীবন।’ তিনি বলেন, শিক্ষার্থীরা স্বাধীনতার জন্য, নিজেদের দেশ ফিরে পাওয়ার জন্য এবং নিজেদের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য আন্দোলনে নেমেছিল। তিনি বলেন, ‘এটাই আমাদের নতুন বাংলাদেশ।’
জাতিসংঘ মহাসচিবের বাংলাদেশ সফর প্রসঙ্গে অধ্যাপক ইউনুস বলেন, 'এই সফর বাংলাদেশের মানুষের জন্য আনন্দ বয়ে এনেছে। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা এখনো রমজানের মাঝামাঝি সময়ে, কিন্তু আপনার এই সফর যেন আগেভাগেই আমাদের জন্য ঈদ এনে দিল। আপনার আগমনে আমাদের ঈদ এখনই শুরু হয়ে গেছে।’ অনুষ্ঠানে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসও বক্তব্য রাখেন।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: অপতথ য র জন য আম দ র ইউন স
এছাড়াও পড়ুন:
ইফতারের রাজনৈতিক অর্থনীতি
রাজনৈতিক দলগুলো ইফতার মাহফিলের নামে মূলত সমাবেশের আয়োজন করছে। এটিকে বলা যায় ইফতার রাজনীতি। আয়োজক দল সাধারণত সমমনাদের দাওয়াত দিয়ে থাকে। তবে সৌজন্যের খাতিরে প্রতিপক্ষকে দাওয়াত দিলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমন্ত্রিতদের হাজির হতে দেখা যায় না। যেমন গত ৪ মার্চ রাজনীতিক ও কূটনীতিকদের সম্মানে জাতীয় পার্টির ইফতার আয়োজনে অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলের নেতারা যাননি।
এ বছর অবশ্য ইফতার ঘিরে রাজনীতি বেশিই জমে উঠেছে। যেমন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী ঘোষণা দিয়েছিলেন– ‘আল্লাহ যদি আমাকে বেহেশতেও নিতে চান, আমি জামায়াতের সঙ্গে বেহেশতে যাব না। কারণ তারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে। যুদ্ধের সময় মা-বোনের ইজ্জত হরণ করতে পাকিস্তানিদের সহযোগিতা করেছে। জামায়াত ছাড়া কারও সঙ্গে আমার কোনো বিরোধ নেই’। ২০২৩ সালের ২৬ জানুয়ারি টাঙ্গাইলের সখীপুর উপজেলার হতেয়া হাজী হাফিজ উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ আয়োজিত জনসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তাঁর এই ঘোষণা সে সময় সংবাদমাধ্যমে যথেষ্ট আলোচিত হয়েছিল। আদতে দেখা গেল, গত ৮ মার্চ (২০২৫) টাঙ্গাইল প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে টাঙ্গাইল জেলা জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ আয়োজিত ইফতার মাহফিলে অংশ নিয়েছেন তিনি।
কাদের সিদ্দিকী জামায়াত প্রসঙ্গে আরও বলেছিলেন, জামায়াত জাতির কাছে মাফ চাক, ভুল স্বীকার করুক, তারপর রাজপথে আসুক। জামায়াতে ইসলামী একাত্তরের ভূমিকার জন্য মাফ চেয়েছে– এমন খবর আমাদের জানা নেই। কাদের সিদ্দিকীর কাছে গোপনে মাফ চেয়েছে বলে কি আমরা ধরে নেব? মাফ না চাইলেও কাদের সিদ্দিকী জামায়াতের ইফতার অনুষ্ঠানে কেন হাজির হলেন?
জামায়াতের ইফতারে কাদের সিদ্দিকীর অংশগ্রহণ যদি নিরেট রাজনৈতিক হয়, নবগঠিত রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি এনসিপির ইফতার ইস্যুটি তাহলে সম্ভবত রাজনৈতিক অর্থনীতি। মঙ্গলবার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ইফতার অনুষ্ঠানের আয়োজন করে এনসিপি। রাজনীতিবিদ, বিশিষ্ট নাগরিক, সাংবাদিক, ছাত্র-শ্রমিক, পেশাজীবী, সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষকে নিয়ে এনসিপি এই ইফতার পার্টির আয়োজন করে। পাঁচতারকা হোটেলে নতুন দল, যেটির এখনও নিবন্ধন হয়নি; এমন রাজনৈতিক দলের পক্ষে জাঁকজমকপূর্ণ ইফতার আয়োজন চমকিত হওয়ার মতোই ঘটনা।
প্রশ্ন জাগে, এ রাজনৈতিক দলের অর্থের উৎস কোথায়? অবশ্য এনসিপি দলীয় তহবিল গঠনের জন্য ‘ক্রাউডফান্ডিং’ করবে বলে জানিয়েছে ইতোমধ্যে। গত ৮ মার্চ দলের এক সংবাদ সম্মেলনে বার্তা সংস্থা রয়টার্সে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, ‘আমরা অনলাইন ও অফলাইনে একটি ক্রাউডফান্ডিংয়ের (গণচাঁদা সংগ্রহ) দিকে যাচ্ছি, যে ক্রাউডফান্ডিংয়ের মাধ্যমে আমরা দলের কার্যালয় স্থাপনসহ নির্বাচনী তহবিল সংগ্রহ করব’ (সমকাল অনলাইন, ৮ মার্চ ২০২৫)।
রাজনীতিতে গণচাঁদা সংগ্রহ অভিনব কিছু নয়। রাজনৈতিক দল ও সংগঠন গণচাঁদা সংগ্রহ করেই চলে। মওলানা ভাসানী মুষ্টি ধান-চাল সংগ্রহ করার বুদ্ধি দিয়েছিলেন তাঁর সমর্থকদের। এখন অবশ্য দিন বদলেছে। কেবল মুষ্টি ধান-চালের জোগান দিয়ে রাজনীতির চাকা ঘোরে না। ঘটনা দেখে মনে হচ্ছে, রাজনৈতিক দলগুলো এখন প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে মুষ্টি ধান-চাল নিচ্ছে না, বরং ধান-চালের একাধিক
কারখানা নিজেদের পকেটে নিয়ে দিব্যি বসে আছে। এইভাবে দলের তহবিলের জন্য ফান্ড নেওয়ায় সমস্যা হয় তখন, যখন রাজনৈতিক দলগুলো বেনিয়া ও স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর কাছ থেকে টাকা নেয় এবং তাদের স্বার্থ রক্ষায় একনিষ্ঠ থাকে। এভাবে চাঁদা নেওয়ার ফলে জনগণের সেবক হওয়ার বদলে রাজনৈতিক দলগুলো বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও মুনাফালোভীর সেবক হিসেবে কাজ করে।
সারাবিশ্বেই রাজনৈতিক দলগুলো তাদের পরিচালন ব্যয় নির্বাহের জন্য গণচাঁদা গ্রহণ করে। তবে আমাদের সঙ্গে তাদের ব্যবধান হচ্ছে– প্রকাশ্য এবং অপ্রকাশ্য। তারা চাঁদা নিয়ে থাকে প্রকাশ্যে, আমরা নিয়ে থাকি অপ্রকাশ্যে। আমাদের কোন রাজনৈতিক দলের তহবিলে কোন শিল্পপ্রতিষ্ঠান কত টাকা চাঁদা দিয়েছে, তার সুলুক সন্ধান করা কঠিন।
আমরা যদি উন্নত গণতন্ত্রের দেশ আমেরিকার দিকে না তাকিয়ে প্রতিবেশী ভারতের দিকেও তাকাই, তাহলেও গণচাঁদার হিসাব পাওয়া যাবে। উদাহরণ হিসেবে দ্য হিন্দুর গত ১২ জানুয়ারি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের তথ্য উল্লেখ করা যায়। ভারতের আম আদমি পার্টির নেত্রী ও দিল্লির সাবেক মুখ্যমন্ত্রী আতিশী মার্লেনা দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে প্রচারণার খরচ মেটাতে একটি গণতহবিলের প্রচারণা চালিয়েছিলেন। নির্বাচনী ব্যয়ের জন্য ৪০ লাখ রুপি দরকার ছিল।
এখন ধরা যাক, আমাদের দেশের একটি নতুন রাজনৈতিক দলের ইফতার পার্টিতে দুই কোটি টাকা দরকার। এ পরিমাণ অর্থ গণচাঁদার মাধ্যমে উত্তোলন করা সম্ভব কিনা? রাজনৈতিক দল এবং দাতা উভয়েই স্বেচ্ছায় এ তথ্য প্রকাশ করবে কিনা? যদি নতুন দিনের রাজনীতির কথা বলা হয়, বিপরীতে সেই পুরোনো পথেই, অর্থাৎ তথ্য গোপন করার পথেই রাজনৈতিক দলগুলো এগিয়ে যায়, তাহলে রাজনৈতিক সংস্কৃতির বদল হবে কী করে?
আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের রাজনীতিতে পবিত্র রমজান মাসের ইফতার ঘিরে যে নির্বাচনী হাওয়া বইছে, তাতে যেন কেবল রাজনৈতিক দলগুলোর ভাগ্যবদল না ঘটে। জনগণের জন্য যে রাজনীতি, জনগণের উদ্দেশে যে ইফতারের আয়োজন করা হয়, সেটির খরচের খাতও জনগণের সামনে পরিষ্কার করা জরুরি। কেননা, সমর্থকদের মধ্যে রাজনৈতিক দলের এজেন্ডার গ্রহণযোগ্যতা মূল্যায়নের জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক দলগুলো সাধারণত সদস্যদের চাঁদা, অনুদান নিয়ে থাকে। এটিই রীতি। আবার শুভাকাঙ্ক্ষীরাও অর্থ দিয়ে থাকেন। তবে কথা হচ্ছে, রাজনৈতিক দলগুলোর অর্থের উৎসের স্বচ্ছতা থাকতে হবে। একইভাবে গণতহবিলের ক্ষেত্রেও একই নীতি থাকা প্রয়োজন। সব তথ্য জনসমক্ষে উপস্থাপন করতে হবে। আবার নির্বাচন কমিশনেও আর্থিক লেনদেন সম্পর্কিত তথ্যে এসবের উল্লেখ থাকতে হবে। কমিশন চাইলেই যেন তা স্বতন্ত্রভাবে নিরীক্ষা করতে পারে।
রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নেতাকর্মীকে আরও চাঙ্গা ও ঐক্যবদ্ধ করতে রমজানে ইফতার মাহফিল আয়োজনে করার উদ্যোগ নিয়েছে। দীর্ঘ দেড় দশক পরে দেশ স্বাভাবিক রাজনীতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এই ইফতার রাজনীতির মাধ্যমে দল বা জোট গোছানো এবং নিজেদের মধ্যে সৃষ্ট ভুল বোঝাবুঝির অবসান হবে বলে মনে করি। ইফতার মাহফিলকে ভোটের প্রস্তুতি হিসেবে দেখতে চাইলে, রাজনৈতিক দলগুলোকে জনগণের মুখোমুখি হবার প্রস্তুতিও নিয়ে রাখতে হবে। নইলে ইফতার মাহফিল আয়োজনের আর্থিক দিক নিয়ে যেমন কথা হবে, তেমনি তা ইফতারের যে পুণ্য সেটিও অধরা থেকে যাবে।
এহ্সান মাহমুদ: সহকারী সম্পাদক,
সমকাল; কথাসাহিত্যিক