একের পর এক হুমকি দিয়েই চলেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। বিশেষ মিত্র ইউরোপকেও ছেড়ে কথা বলছেন না। গত শুক্রবার আবারও ইউরোপের ওয়াইন, কনিয়্যাক ব্র্যান্ডি ও অন্যান্য পানীয়ে ২০০ শতাংশ আমদানি শুল্ক আরোপের হুঁশিয়ারি দিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, ট্রাম্প কোথায় গিয়ে থামবেন।

যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যেই বিভিন্ন দেশের ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামে ২৫ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করেছে। বাদ পড়েনি ইউরোপীয় ইউনিয়নও (ইইউ)। ইইউ জানিয়েছে, তারাও পরের মাস থেকে যুক্তরাষ্ট্রের হুইস্কি ও অন্যান্য পণ্যে পাল্টা শুল্ক আরোপ করবে। তার পরিপ্রেক্ষিতেই ট্রাম্পের স্পষ্ট বার্তা, অন্যান্য দেশ যতবার তাঁদের পণ্যে শুল্ক চাপাবে, ততবারই ‘প্রত্যাঘাত’ করবেন তিনি। খবর বিবিসি।

ফলে ইইউ সেই ঘোষণা কার্যকর করলে তাদের মদের ওপরও শুল্ক কার্যকর করা হবে। সংশ্লিষ্ট মহলের ব্যাখ্যা, এই ‘শুল্ক ও পাল্টা শুল্কের’ লড়াই কীভাবে শেষ হবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে এই দোলাচলের মধ্যে বিশ্ব অর্থনীতি শ্লথ হয়ে পড়বে—সেই আশঙ্কা বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম অ্যালুমিনিয়াম সরবরাহকারী কানাডা। তারাও ট্রাম্প–শুল্কের জবাবে পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছে। দ্বারস্থ হয়েছে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও)। এর মধ্যে কানাডার অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যসচিবের বৈঠক হওয়ার কথা। তবে তা কতটা ফলপ্রসূ হবে, তা নিয়ে সন্দেহ ঘনিয়ে উঠছে।

এরই মধ্যে জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ২০২৪ সালে বিশ্ববাণিজ্যের আকার ১ দশমিক ২ লাখ কোটি ডলার বেড়ে ৩৩ লাখ কোটি ডলারে পৌঁছেছে। শেষ ত্রৈমাসিকে উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে ভারত ও চীনের মতো দেশের বাণিজ্য। তবে শুল্ক যুদ্ধের প্রভাব এই বৃদ্ধিতে কতটা প্রভাব ফেলে, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে সংশ্লিষ্ট মহলের।

মেরি টেইলর নামের এক মার্কিন আমদানিকারক বিবিসিকে বলেন, ট্রাম্পের এই শুল্ক আরোপের ঘোষণা তাঁদের জীবিকার জন্য বড় হুমকি। এই শুল্ক কার্যকর করা হলে এই শিল্পের জন্য বিপর্যয়কর হয়—রেস্তোরাঁ, বার ও পরিবেশকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।

টেইলর প্রতিবছর ইউরোপ থেকে ২০ লাখ বোতল পানীয় আমদানি করেন। প্রথম জমানায় ট্রাম্প এসব পণ্যে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছিলেন। সেই ধাক্কা একভাবে সামলেছেন তিনি। কিন্তু ২০০ শতাংশ শুল্ক একেবারে ভিন্ন বিষয় বলে মনে করেন তিনি।

ট্রাম্পের এই ২০০ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণায় সপ্তাহের শেষ দিন গত শুক্রবার ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শেয়ার সূচকের পতন হয়েছে।

ইউরোপ থেকে যুক্তরাষ্ট্র যেসব অ্যালকোহলভিত্তিক পানীয় আমদানি করে, সেগুলো হলো ফ্রেঞ্চ ওয়াইন, ইতালিয়ান ওয়াইন, ফ্রেঞ্চ স্পিরিটস, ডাচ বিয়ার, স্প্যানিশ ওয়াইনস, ডাচ স্পিরিটস, আইরিশ স্পিরিটস, ইতালিয়ান স্পিরিটিস, আইরিশ বিয়ারস ও ইতালিয়ান ভারমৌথস।

এবার ক্ষমতায় আসার পর ইউরোপীয় ইউনিয়ন সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি বলেছেন, ইউরোপ যুক্তরাষ্ট্রের অনেক পুরোনো মিত্র ঠিক, কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়ন গঠনের মূল উদ্দেশ্য ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষতি করা।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: শ ল ক আর প র র ইউর প আমদ ন

এছাড়াও পড়ুন:

নতুন চেতনায় বর্ষবরণের আয়োজন

‘তাপসনিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,/ বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক॥ ... এসো হে বৈশাখ, এসো এসো।’ কালের গর্ভে হারাল পুরোনো বছরের সব পঙ্কিলতা, সব পাপ-তাপ ধুয়ে-মুছে নতুন দিনের উজ্জ্বল আভায় হাসবে স্বদেশভূমি, বর্ণিল সুখচ্ছটায় ভাসবে মানবজীবন– এই প্রত্যাশা নিয়েই শুরু বঙ্গাব্দ ১৪৩২। স্বাগত বাংলা নববর্ষ। 

আজ পহেলা বৈশাখ। বাংলা সংস্কৃতির সবচেয়ে প্রাণবন্ত, হৃদয়ছোঁয়া ও সর্বজনীন উৎসব। বছরের প্রথম সূর্যের আলোয় বাঙালির হৃদয়ে জেগে ওঠে আশার গান। এই দিনে পুরোনো গ্লানি ঝেড়ে শুরু হয় নতুন পথচলা। বাংলা নববর্ষ শুধু একটি দিন নয়; এটি বাঙালির জীবনে ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ঐক্য ও প্রাণের মিলনমেলা।

এবারের পহেলা বৈশাখের আবহ অন্যবারের চেয়ে একটু আলাদা। গেল ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক পালাবদলের পর এটাই প্রথম বাংলা নববর্ষ উদযাপন। নতুন চেতনায় বর্ষবরণ আয়োজনের প্রচেষ্টা চলছে দেশজুড়ে। বাংলা বর্ষবরণের অন্যতম আয়োজন ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামটি বদলে নতুন নাম হয়েছে ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’।   

বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাণী দিয়েছেন। তিনি দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানানোর পাশাপাশি দেশ ও বিশ্বের সব মানুষের উত্তরোত্তর সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করেছেন। দেশবাসীকে বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। 

এদিকে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নাম বদলের বিষয়টি নিয়ে এখনও বিভিন্ন মহলে চলছে আলোচনা-সমালোচনা।   ইউনেস্কোর অপরিমেয় বিশ্ব সংস্কৃতি হিসেবে স্বীকৃতির সনদে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা অন পহেলা বৈশাখ’ নামেই বাংলা বর্ষবরণের আয়োজনটিকে উল্লেখ করা হয়েছে। এখন নাম বদলের ফলে জাতিসংঘের সংস্থার স্বীকৃতিতে প্রভাব পড়বে কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ২০১৬ সালে বাংলা বছরকে বরণ করে নেওয়ার এই উৎসবটি ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পায়। এ ছাড়া আনন্দ শোভাযাত্রায় প্রদর্শনের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে নির্মীয়মাণ ‘ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি’ ও ‘শান্তির পায়রা’ মোটিফ দুটি আগুনে পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায়ও বিতর্ক চলছে। 

এমন আলোচনা-সমালোচনা আর বিতর্কের মধ্যেই গোটা জাতি আজ প্রাণের উচ্ছ্বাসে বাংলা নববর্ষ উদযাপনে মাতবে। বর্ণিল আয়োজনে নতুন বছর উদযাপনের অনুষ্ঠানমালা থাকবে দেশজুড়ে। ঢাকায় ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’ ছাড়াও সারাদেশে থাকবে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার আয়োজন। গ্রাম-শহরে বৈশাখী মেলা, যাত্রাপালা, পুতুলনাচ, নাগরদোলা ছাড়াও থাকবে ঐতিহ্যবাহী খাবার পান্তা-ইলিশ। সেই সঙ্গে থাকবে হালখাতার ঐতিহ্য। ব্যবসায়ীরা লাল খাতা ও নতুন ক্যালেন্ডার বিতরণ করবেন, সঙ্গে থাকবে মিষ্টান্ন বিতরণ।     

মোগল সম্রাট আকবর ১৫৮৪ সালে তাঁর শাসন ব্যবস্থার উন্নয়নে বাংলা সাল প্রবর্তন করেন। সেই সময় রাজস্ব আদায় হতো হিজরি চন্দ্রপঞ্জিকা অনুযায়ী, যা ছিল পুরোপুরি চন্দ্রনির্ভর। কিন্তু কৃষিভিত্তিক সমাজে এটি ছিল অনুপযোগী। কারণ, কৃষির মৌসুম অনুযায়ী রাজস্ব নির্ধারণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। তাই রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন ইত্যাদি কৃষি মৌসুম ও আবহাওয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মিশ্র সৌর ও চন্দ্র পদ্ধতির ভিত্তিতে তৈরি হয় ‘তারিখ-ই-ইলাহি’, যা-ই পরে পরিচিতি পায় বাংলা সাল নামে। এই পঞ্জিকা প্রস্তুত করেন বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ আমির ফতেহউল্লাহ সিরাজী।
যদিও শুরুতে নববর্ষ ছিল প্রশাসনিক কর আদায়ের দিন, ধীরে ধীরে এটি রূপ নেয় একটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উৎসবে। গ্রামবাংলার মানুষ একে একত্রে পালন করতে শুরু করে। রাজস্ব পরিশোধের পর আয়োজিত হতো ‘হালখাতা’, যেখানে ব্যবসায়ীরা পুরোনো হিসাব শেষ করে মিষ্টিমুখ করতেন নতুন খাতা খুলে।

আদিবাসীরা নববর্ষ ঘিরে নিজেদের মতো করে স্বাজাত্যবোধ বজায় রেখে উৎসবের রং ছড়ান। পাবর্ত্য তিন জেলায় আদিবাসীরা উদযাপন করে ঐতিহ্যবাহী উৎসব বৈসাবি। এর নামকরণ হয়েছে বৈসুক, সাংগ্রাই ও বিজু এই শব্দগুলোর আদ্যক্ষর থেকে। এ উৎসবকে চাকমারা বিজু, মারমারা সাংগ্রাই, ত্রিপুরারা বৈসুক বলে অভিহিত করেন। 

দিনভর নানা আয়োজন
উৎসবমুখর পরিবেশে সারাদেশে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। রাজধানীতে আজকের দিনের মূল আকর্ষণ থাকবে ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’। ‘নববর্ষের ঐকতান, ফ্যাসিবাদের অবসান’ প্রতিপাদ্য নিয়ে এই শোভাযাত্রা আজ সোমবার সকাল ৯টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের সামনে থেকে বের হবে। পরে এটি শাহবাগ মোড় ঘুরে টিএসসি মোড়, শহীদ মিনার, শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্র, দোয়েল চত্বর হয়ে বাংলা একাডেমির সামনের রাস্তা দিয়ে ফের চারুকলা অনুষদে গিয়ে শেষ হবে।

রমনা বটমূলে ছায়ানটের আয়োজনে সকাল সোয়া ৬টা থেকে সোয়া ৮টা পর্যন্ত থাকবে বর্ষবরণের বর্ণাঢ্য আয়োজন। সকাল থেকে ধানমন্ডি রবীন্দ্র সরোবরে থাকবে সুরের ধারার বর্ষবরণ অনুষ্ঠানমালা। শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে বিকেল ৩টায় কনসার্ট এবং সন্ধ্যা ৭টায় চীনা দূতাবাসের সহযোগিতায় ড্রোন শো অনুষ্ঠিত হবে। উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী রাজধানীর তোপখানা রোডের সত্যেন সেন চত্বরে সকাল সাড়ে ৮টা থেকে দিনভর লোকসংস্কৃতি উৎসব ও বৈশাখী আড্ডার আয়োজন করেছে। সেখানে থাকবে চারুকারুপণ্যসহ বৈশাখী মেলার আয়োজন। নবপ্রাণ আন্দোলনের আয়োজনে শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণে দিনব্যাপী ‘বৈশাখী উদযাপন আয়োজন’ থাকবে। 

মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটি ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির মেলাঙ্গনে আজ ও আগামীকাল দু’দিনের ধর্মীয় অনুষ্ঠান-পূজা-পার্বণ, মেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। প্রথম দিনে আজ সোমবার সকাল ৮টায় সংগীতানুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে। 
এ ছাড়া বুলবুল ললিতকলা একাডেমি, জাতীয় প্রেস ক্লাব, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিসহ (ডিআরইউ) বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠন বর্ণিল আয়োজনে বাংলা নববর্ষকে বরণ করবে।  

 

সম্পর্কিত নিবন্ধ