প্রচারের নামে ২২ কোটি টাকা তছরুপ, কম্বলের টাকাও হাওয়া
Published: 16th, March 2025 GMT
বেসরকারি খাতের সাউথইস্ট ব্যাংকে কেনাকাটা, সংস্কার ও প্রচারের নামে বড় অঙ্কের অর্থ তছরুপের ঘটনা ঘটেছে। পাশাপাশি ব্যাংকটিতে নিয়োগ, তহবিল ব্যবহার ও ঋণের ক্ষেত্রেও নানা ধরনের অনিয়ম হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ব্যাংকটির অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে এসব অনিয়ম ধরা হয়েছে।
এসব অনিয়মে অভিযুক্ত তিন কর্মকর্তা ইতিমধ্যে ব্যাংক থেকে পদত্যাগ করেছেন। তিন কর্মকর্তা হলেন ওয়ারেস উল মতিন, মোহাম্মদ তানভীর রহমান ও এ কে এম নাজমুল হায়দার। এর মধ্যে ওয়ারেস উল মতিন ব্যাংকটির সাতটি বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন। মোহাম্মদ তানভীর রহমান ছিলেন ব্যাংকটির করপোরেট অ্যাফেয়ার্স ও করপোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি বিভাগের প্রধান। আর এ কে এম নাজমুল হায়দার ছিলেন কোম্পানির সচিব। তাঁরা মিলে ব্যাংকটিতে অনিয়মের চক্র গড়ে তুলেছিলেন বলে নিরীক্ষায় উঠে এসেছে। মূলত তাঁরা তৎকালীন পরিচালনা পর্ষদের হাতিয়ার ছিলেন।
ব্যাংকটিতে যখন উল্লিখিত অনিয়মগুলো সংঘটিত হয়, তখন ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ছিলেন আলমগীর কবির। সিকিউরিটিজ আইন লঙ্ঘনের দায়ে বড় অঙ্কের জরিমানার পরও তিনি ব্যাংকটির চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন। পরে চেয়ারম্যানের পদ ছাড়লেও পরিচালক পদে বহাল রয়েছেন।
সরকার বদলের পর গত সেপ্টেম্বরে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদে বদল আসে। ২০ বছর পর আবারও ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ফেরেন এম এ কাশেম। তিনি ব্যাংকটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন। তার আগে ২০০৪ সাল থেকে টানা ২০ বছর ব্যাংকটির চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন আলমগীর কবির।
প্রচারের নামে ২২ কোটি টাকা তছরুপ
সাউথইস্ট ব্যাংক ২০২৩ সালে ব্যাংকের প্রচারের জন্য বিজ্ঞাপন বাবদ ২২ কোটি টাকা খরচ করে। এ জন্য ওই বছর ব্যাংকটি মেট্রোরেল উদ্বোধন, বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তন দিবস উদ্যাপন ও বিজয় দিবস উপলক্ষে ইনবক্স কমিউনিকেশনের মাধ্যমে ২১ কোটি ৯১ লাখ টাকা খরচ করে। তবে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদে যার কোনো অনুমোদন ছিল না। এমনকি কোনো ধরনের দরপত্র ছাড়াই ইনবক্স কমিউনিকেশনকে এই কাজ দেওয়া হয়। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা করে ২২ কোটি টাকা খরচ করে বিজ্ঞাপন প্রচারের কোনো নথিপত্রেরও হদিস মেলেনি।
ব্যাংকে জমা দেওয়া ট্রেড লাইসেন্স অনুযায়ী ইনবক্স কমিউনিকেশনের ঠিকানা বনানীর ৬২ কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউয়ে। আর ব্যাংক থেকে বিল গ্রহণের জন্য নিকুঞ্জের একটি ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে। তবে দুই ঠিকানায় গিয়ে ইনবক্স কমিউনিকেশন নামের কোনো প্রতিষ্ঠানের সন্ধান পাওয়া যায়নি।
পরিচালনা পর্ষদ ও এমডির নির্দেশে বিল ছাড় করেছি। কাজও দেওয়া হয়েছে তাঁদের নির্দেশে। প্রতিটি বিল দেওয়ার সময় ওপর থেকে নির্দেশনা এসেছে, সেই হিসেবে বিল ছাড় করা হয়েছে। —মোহাম্মদ তানভীর রহমান, সাবেক প্রধান, করপোরেট অ্যাফেয়ার্স বিভাগ, সাউথইস্ট ব্যাংকব্যাংকটির কাছে বিভিন্ন গণমাধ্যমের বিল জমা দিয়ে অর্থ তুলে নেয় ইনবক্স কমিউনিকেশন। পরে ব্যাংকটির পক্ষ থেকে এসব গণমাধ্যমের সঙ্গে যোগাযোগ করেও বিজ্ঞাপন প্রচারের বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। বিজ্ঞাপন প্রচারের তালিকায় ছিল বেসরকারি মাছরাঙা টেলিভিশনের নামও। তবে মাছরাঙার নির্বাহী পরিচালক অজয় কুমার কুণ্ডু এক চিঠিতে ব্যাংকটিকে জানিয়েছেন, ২০২৩ সালে সাউথইস্ট ব্যাংকের কোনো বিজ্ঞাপন মাছরাঙায় প্রচারিত হয়নি। এ–সংক্রান্ত কোনো বিলও তারা পায়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, কোনো ধরনের ক্রয়নীতি না মেনে পর্ষদের অনুমোদন ছাড়াই ইনবক্স কমিউনিকেশনকে প্রচারের এই কাজ দেওয়া হয়েছিল। এ জন্য জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বিজ্ঞাপন প্রচারের কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিল ব্যাংকটির করপোরেট অ্যাফেয়ার্স ও করপোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি বিভাগ। যার দায়িত্বে ছিলেন মোহাম্মদ তানভীর রহমান। গত নভেম্বরে তিনি পদত্যাগ করেন। জানতে চাইলে মোহাম্মদ তানভীর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ইনবক্সকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি না। পরিচালনা পর্ষদ ও এমডির নির্দেশে বিল ছাড় করেছি। কাজও দেওয়া হয়েছে তাঁদের নির্দেশে। প্রতিটি বিল দেওয়ার সময় ওপর থেকে নির্দেশনা এসেছে, সেই হিসেবে বিল ছাড় করা হয়েছে।
কম্বলের টাকাও হাওয়া
ব্যাংকটির নথিপত্র অনুযায়ী, ২০২৩ সালে কম্বল কেনার জন্য ব্যাংকটি ছয় কোটি টাকা খরচ করেছে। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কম্বলের দরপত্রপ্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়া তামান্না বেডিং স্টোর ও মেসার্স জারা ইন্টারন্যাশনালকে বাদ দিয়ে ঘুড়ি কমিউনিকেশনের মাধ্যমে কম্বল কেনা হয়েছে। ঘুড়ি কমিউনিকেশন মূলত অফিস স্টেশনারি ও প্রিন্টিং আইটেম সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। ফলে আদৌ কোনো কম্বল কেনা হয়েছে কি না, তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। ব্যাংকটির একটি সূত্র বলছে, ছয় কোটি টাকার কম্বল কাকে দেওয়া হয়েছে, তার কোনো নথিপত্র ব্যাংকে নেই।
এজেন্ট ব্যাংকিং টাকারও অপব্যবহার
সাউথইস্ট ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকিং বিভাগ তাদের হাতে থাকা অতিরিক্ত অর্থ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে বড় লোকসান করেছে। ব্যাংকটির কর্মকর্তা ওয়ারেস উল মতিনের দায়িত্বে ছিল এজেন্ট ব্যাংকিং বিভাগ। ২০২২ সালে তিনি ব্যাংকের পর্ষদের অনুমোদন ছাড়াই ১৫ কোটি টাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেন। এই বিনিয়োগ ২০২৪ সালে কমে দাঁড়ায় সাড়ে আট কোটি টাকায়। একইভাবে বিভিন্ন শাখার সাইনবোর্ড পরিবর্তন, ব্র্যান্ডিং ও সংস্কারের নামে সাড়ে তিন কোটি টাকা তুলে নেন তিনি। ব্যাংকের বিভিন্ন কর্মকর্তার স্বাক্ষরে ওয়ারেস উল মতিন এই অর্থ উত্তোলন করেন; কিন্তু অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষায় ব্যাংকটির সব শাখা ও উপশাখা জানিয়েছে, ২০২৩ সালে এসব শাখা-উপশাখায় সাইনবোর্ড পরিবর্তন, ব্র্যান্ডিং ও সংস্কারের কাজ হয়নি।
ওয়ারেস উল মতিন গত অক্টোবরে পদত্যাগ করেন। এরপর অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষায় কর্মকর্তারা লিখিতভাবে জানান, তাঁরা কোনো বিলে স্বাক্ষর করেননি, তাঁদের স্বাক্ষর জাল করে টাকা তোলা হয়েছে।
এ বিষয়ে ওয়ারেস উল মতিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি এজেন্ট ব্যাংকিং বিভাগের দায়িত্বে ছিলাম, তবে বিভাগের অতিরিক্ত অর্থ কোথায় বিনিয়োগ হবে, সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা আমার ছিল না। এটা বিনিয়োগ বিভাগ দেখত। গত আগস্টে আমি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করি। ব্যাংক এখনো অব্যাহতি দিচ্ছে না। কেন দিচ্ছে না, তা–ও জানি না।’
বড় জরিমানার পরও বহাল
শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান বে লিজিংয়ের শেয়ার লেনদেনে সিকিউরিটিজ আইন লঙ্ঘনের দায়ে সাউথইস্ট ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আলমগীর কবীরকে গত নভেম্বরে ১২ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়। একই ঘটনায় তাঁর স্ত্রী সুরাইয়া বেগমকে পাঁচ কোটি টাকা ও জামাতা তুষার এল কে মিয়াকে আড়াই কোটি টাকা জরিমানা করা হয়। সব মিলিয়ে এই তিনজনকে সাড়ে ১৯ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়। জরিমানার এই অর্থ তাঁরা পরিশোধ করেছেন বলে জানা গেছে।
বে লিজিংয়ের পরিচালক থাকা অবস্থায় সুরাইয়া বেগম সুবিধাভোগী ব্যবসা নিষিদ্ধকরণ আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে কোম্পানিটির শেয়ার বিক্রি করেন। একই কাজ করেছেন তাঁর স্বামী ও সাউথইস্ট ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আলমগীর কবির এবং জামাতা তুষার এল কে মিয়া। সুবিধাভোগী ব্যবসা নিষিদ্ধকরণ আইন অনুযায়ী, সংশ্লিষ্ট কোম্পানির কোনো পরিচালক নির্ধারিত একটি সময়ে ওই কোম্পানির শেয়ার লেনদেন করতে পারেন না; কিন্তু উল্লিখিত তিন ব্যক্তি সেই আইন লঙ্ঘন করেছেন। এই কাজে নেতৃত্ব দিয়েছেন মূলত সাউথইস্ট ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আলমগীর কবির। তিনি ব্যাংকের চেয়ারম্যান হলেও পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে বে লিজিং পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করতেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বে লিজিংয়ের একজন পরিচালক জুবায়ের কবির। তিনি আলমগীর কবীরের ভাইয়ের ছেলে ও ইরেবাস প্রপার্টিজের কর্ণধার। এই প্রতিষ্ঠানের ঋণ ২০২৪ সালের জুনে খেলাপিযোগ্য হলেও সাউথইস্ট ব্যাংক তা নিয়মিত দেখায়। ফলে তিনি বে লিজিংয়ের পরিচালক পদে বহাল থাকার সুযোগ পান। একই সুবিধা দেওয়া হয়েছে।
এসব অনিয়মের বিষয়ে জানতে ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আলমগীর কবীরের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: স উথইস ট ব য ব ল ছ ড় কর কর মকর ত ২০২৩ স ল করপ র ট ২২ ক ট কর ছ ন র পর চ সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
ফেইথের ‘ফাঁদে’ ফতুর প্রবাসী চান পরিত্রাণ
কাজী তারিকুল ইসলাম। দেশের নামিদামি ব্র্যান্ডের প্রতিষ্ঠানে সফলতার সঙ্গে কর্মজীবন চালানো এই যুবক বছর তিন আগে স্বপ্ন দেখেন পরিবার নিয়ে যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমানোর। মনোগ্রাহী বিজ্ঞাপন দেখে যোগাযোগ করেন, ‘ফেইথ ওভারসিজ লিমিটেড’ নামে এজেন্সির সঙ্গে। বিভিন্ন দেশের ভিসা প্রোসেসিং ও কর্মসংস্থানের মাধ্যমে বিদেশে লোক পাঠানোর কাজ করে থাকে এজেন্সিটি।
জব ভিসায় যুক্তরাজ্যের ইংল্যান্ডে পৌঁছে দেওয়ার নিরাপদ এজেন্সি দাবি করা ফেইথ ওভারসিজকে কয়েক দফায় মোট ২৫ লাখ ৬৫ হাজার টাকা দেন তারিকুল ইসলাম। ফেইথ ওভারসিজ এই অর্থ গ্রহণ করে তিনটি ভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্টে। চুক্তি অনুযায়ী টাকার লেনদেন শেষ হওয়ার পর প্রক্রিয়া অনুসরণ করে পরিবার নিয়ে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমান তারিকুল ইসলাম।
ইংল্যান্ডে পৌঁছে স্বপ্নের সিঁড়ি শুরু হওয়ার কথা ছিল তারিকুলের। তা হয়নি। স্বপ্নভঙ্গ হয় তার। তারিকুলের অভিযোগ, চুক্তিপত্র অনুযায়ী ইংল্যান্ডে পৌঁছানোর পর চাকরিতে যোগ দেওয়ার কথা তার; কারণ জব গ্যারান্টির শর্ত ছিল। কিন্তু ফেইথ ওভারসিজ তাকে চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে ব্যর্থ হয়।
আরো পড়ুন:
ইউএস অ্যাগ্রিমেন্টে ৮৭ লাখ টাকা প্রতারণা
মুক্তিযোদ্ধার নাতি সেজে এক যুগ পুলিশে চাকরি, গ্রেপ্তার
২০২৩ সালে সেদেশে পৌঁছানোর পর চাকরির ব্যবস্থা না করে দুই বছর ধরে ফেইথ ওভারসিজ কথার ফাঁদে ফেলে ঘুরিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তারিকুল। এই মাসে, না- সেই মাসে; এটা করতে হবে, সেটা করতে হবে; ধৈর্য ধরতে হবে; এমন সব কথার জাল বুনে যাচ্ছে তারা।
তারিকুল বলছেন, এই অবস্থায় ইংল্যান্ডে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে চরম হতাশা এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে চোখে অন্ধকার দেখছেন তিনি। এখন স্পন্সরশিপ এবং চাকরি না হলে যেকোনো সময় অবৈধ অভিবাসী হয়ে গ্রেপ্তার অথবা দেশে ফিরে আসতে হতে পারে তাকে।
তারিকুল ছাড়াও যুক্তরাজ্য ও তুরস্কসহ বিভিন্ন দেশে চাকরি এবং স্টুডেন্ট ভিসায় লোক পাঠানোর নামে ফেইথ ওভারসিজের বিরুদ্ধে প্রতারণার আরো কিছু অভিযোগ এসেছে এই প্রতিবেদকের কাছে। অভিযোগকারীদের বক্তব্য, বিদেশ যাওয়ার স্বপ্নকে পুঁজি করে রঙচঙা বিজ্ঞাপন দিয়ে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে ফেইথ ওভারসিজ।
অবশ্য ফেইথ ওভারসিজ কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা প্রতারণা করছে না। তবে নানা কারণে অনেককেই বিদেশে পাঠানো যাচ্ছে না বা বিদেশে পাঠানোর পর সেখানে চাকরির ব্যবস্থা করা সম্ভব হচ্ছে না। এসব সমস্যা সমাধানে তাদের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
যেভাবে স্বপ্নভঙ্গ তারিকুল ইসলামের
কাজী তারিকুল ইসলাম খুলনা মহানগরীর সোনাডাঙ্গা এলাকার বাসিন্দা। জব ভিসা নিয়ে পরিবারসহ যুক্তরাজ্যে যাওয়ার জন্য তিনি যোগাযোগ করেন ফেইথ ওভারসিজের সঙ্গে। তাদের প্রধান কার্যালয় ঢাকার উত্তরায়। সেখান থেকে জানতে পারেন খুলনায় তাদের বাসার পাশে সোনাডাঙ্গার মসজিদ স্মরণীর জাহাঙ্গীর টাওয়ারে ফেইথ ওভারসিজের শাখা অফিস রয়েছে। এই অফিসের ইনচার্জ ও মালিক পরিচালক জর্জ মিথুন রায়।
জর্জ মিথুন রায়ের সঙ্গে তারিকুলের যোগাযোগ হলে তিনি ফেইথের প্রতি আস্থা রাখার কথা বলেন। তারিকুল ইসলামকে তিনি বোঝান, তার নিজ এলাকায় এজেন্সির অফিস, তিনিও (জর্জ মিথুন রায়) খুলনার বাসিন্দা। ফলে অবিশ্বাসের কিছু নেই। ফেইথ ওভারসিজ বিশ্বস্ততার সঙ্গে জব ভিসার গ্যারান্টি দিয়ে যুক্তরাজ্যে লোক পাঠায়।
খুলনা শাখা অফিস ইনচার্জ এবং ফেইথ ওভারসিজ লিমিটেডের পরিচালক (এডমিন) জর্জ মিথুন রায়।
জর্জ মিথুন রায়ের ওপর আস্থা রেখে ফেইথ ওভারসিজকে তিন দফায় ২৫ লাখ ৬৫ হাজার টাকা দেন তারিকুল ইসলাম।
২০২৩ সালের ১৪ আগস্ট তারিকুল পাড়ি জমান যুক্তরাজ্যের ইংল্যান্ডে। এক মাস পর ১৫ সেপ্টেম্বর স্ত্রী ও কন্যাকেও নিজ খরচে সেখানে নিয়ে যান তিনি। তারিকুল বলছেন, তারপর শুরু হয় তাদের বিড়ম্বনা, অনিশ্চয়তা ও হতাশার জীবন।
ফেইথ ওভারসিজ কথা রাখেনি বলে মন্তব্য করে তারিকুল বলেন, সব সঞ্চয় শেষ; ধারদেনায় ডুবে যাচ্ছেন, স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ফিরেও আসতে পারছেন না। এখন কীভাবে সেদেশে থাকবেন। দিশেহারা তরিকুল ফেইথের ‘প্রতারণার ফাঁদ’ থেকে পরিত্রাণ চান; যুক্তরাজ্যে বৈধভাবে বসবাসের নিশ্চয়তা চান।
তারিকুলের জন্য বড় ধাক্কা: চাকরির নামে প্রতারণা
তারিকুল ইসলামকে যুক্তরাজ্যের ওয়েসিস (ওয়াসিস) প্রাইভেট কেয়ার লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানে ‘কেয়ার গিভার’ পদে চাকরি দেওয়ার শর্তে সেদেশে পাঠায় ফেইথ ওভারসিজ। ওয়েসিসের ঠিকানা ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ডশায়ারে।
২০২৩ সালের ১৫ আগস্ট ইংল্যান্ডে পৌঁছানোর পরই সরাসরি তারিকুল তার কর্মস্থল ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড শহরের ওয়েসিস প্রাইভেট কেয়ার লিমিটেডে যান। প্রথম দর্শনেই হতাশ হন তিনি। অল্পসংখ্যক লোকজন নিয়ে পরিচালিত কোম্পানিতে গেলে চাকরিতে যোগদানের বিপরীতে তাকে প্রশিক্ষণের কথা বলা হয়। প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা অনলাইনে।
তারিকুল ইসলাম আশাবাদী হয়ে শুরু করেন প্রশিক্ষণ। প্রথম দফায় এক মাস দশ দিনের প্রশিক্ষণ শেষ করেন তিনি। আবার প্রশিক্ষণের মডিউল ধরিয়ে দেওয়া হয় তাকে। এভাবে একটির পর একটি প্রশিক্ষণের পর কেটে যায় ছয় মাস। কিন্তু চাকরিতে যোগদানের বিষয়ে মেলে না কোনো আশার বার্তা।
আশার প্রহর গুনতে গুনতেই হঠাৎ একটি খবরে চমকে ওঠেন তারিকুল। জানতে পারেন, প্রতারণার দায়ে ওয়েসিস প্রাইভেট কেয়ার লিমিটেডের লাইসেন্স বাতিল করেছে যুক্তরাজ্য সরকার। অথচ এই প্রতিষ্ঠানে তিনি প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, এখানেই তার চাকরি হওয়ার কথা।
যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় (হোম অফিস) থেকে ই-মেইলে তারিকুলকে নোটিশ পাঠিয়ে জানানো হয়, অন্য কোম্পানিতে স্পন্সরশিপ নিয়ে চাকরি করার জন্য। তারিকুলের ভাষ্য- তার তো চাকরিই নাই। এই অবস্থায় দুর্বিপাকে পড়ে যান তিনি।
একদিকে স্ত্রী-সন্তানের ভরণ-পোষণ, নিজের খরচ ও বাসা ভাড়াসহ সেখানে থাকার ব্যয়ভার, অন্যদিকে স্পন্সরশিপ ও চাকরি জোগাড় করা; এসব ভেবে দুশ্চিন্তায় ভেঙে পড়েন তিনি। ফেইথের প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পেরে নতুন করে বেঁচে থাকার লড়াই শুরু করেন তারিকুল ও তার পরিবার।
বর্তমানে কোনো রকমে লুকিয়ে চুরিয়ে ‘ক্যাশ ইন হ্যান্ডে’ কাজ করছেন তারিকুল। স্ত্রীকেও একটি কাজ জোগাড় করে দিয়েছেন। এভাবে কেটে গেছে দুই বছর। প্রতি মাসে ২ হাজার পাউন্ড (তিন লাখ টাকা) খরচ যোগাড় করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে। দেশে স্বজনদের কাছ থেকে ঋণ করে চলতে হচ্ছে তাদের।
পরিত্রাণ চান তারিকুল ইসলাম
কাজী তারিকুল ইসলাম অভিযোগ করেছেন, ফেইথ ওভারসিজ স্পন্সরশিপ এবং শতভাগ জব গ্যারান্টিসহ তাকে যুক্তরাজ্যে পাঠানোর পর তিনি ট্রেনিংসহ তাদের সব নিয়ম মেনে সেখানে অবস্থান করছেন। তবে সেদেশে দুই বছরের মধ্যে তাকে এক ঘণ্টার জন্যও চাকরির ব্যবস্থা করে দেয়নি ফেইথ ওভারসিজ। উপরন্তু, ওয়েসিস প্রাইভেট কেয়ার নামে যে প্রতিষ্ঠানে তাকে চাকরি দেওয়ার কথা, প্রতারণার দায়ে সেটির লাইসেন্স বাতিল হয়েছে।
তরিকুল ইসলাম বলেন, ওয়েসিস প্রাইভেট কেয়ারে যাতায়াত করার সুবাদে তিনি জানতে পেরেছেন, বিভিন্ন দেশ থেকে আট শতাধিক লোক এই প্রতিষ্ঠানে চাকরির জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়ে এসেছেন। অথচ কাজ করছেন মাত্র ৫০-৬০ জন। তাদের লাইসেন্সও বাতিল হয়েছে।
ফলে চাকরি তো দূরে থাক, এখন যুক্তরাজ্যে অবস্থান করাই তারিকুল ও তার পরিবারের জন্য সমূহ বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তরিকুল ইসলামের অভিযোগ, চুক্তি অনুযায়ী ফেইথ ওভারসিজ তার চাকরির ব্যবস্থা করেনি। তার সঙ্গে প্রতারণা করেছে। এমনকি সংশ্লিষ্ট কোম্পানির নিজস্ব আবাসনে থাকার ব্যবস্থার জন্য ফেইথ ওভারসিজ তার কাছ থেকে বাসা ভাড়া বাবদ ৭৫ হাজার টাকা নিয়েছে; যার পুরো লেনদেনই প্রতিষ্ঠানের খুলনা শাখার ইনচার্জ জর্জ মিথুন রায়ের মাধ্যমে হয়েছে।
তারিকুল ইসলাম বলছেন, “ফেইথ ওভারসিজের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী আমি চাই, তারা দ্রুত আমার চাকরির ব্যবস্থা করে দিক। না হলে এই এজেন্সির বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপসহ আমার পক্ষে যা কিছু করা সম্ভব, সবই করব।”
ক্ষোভ প্রকাশ করে তারিকুল বলেন, “ফেইথ ওভারসিজ আমার জীবন থেকে শুধু দুটি বছর নষ্টই করেনি, তারা আমার জীবন-সংসার পাঁচ বছর পিছিয়ে দিয়েছে, ঋণের জালে ডুবিয়ে দিয়েছে। দুই বছরে আর্থিক ও মানসিকভাবে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য আমাকে অন্য একটি স্পন্সরশিপে ট্রান্সফার করে দিক অথবা ক্ষতিপূরণ হিসেবে আমার অর্থ ফেরত দিক। আর বিকল্প কোনো পথ নেই।”
রাজস্ব ফাঁকি দিতে একাধিক ব্যাংকে লেনদেনের অভিযোগ
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ফেইথ ওভারসিজ লিমিটেড তারিকুলের কাছ থেকে গ্রহণকৃত অর্থ প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের নামের বাইরে আরো দুটি ভিন্ন নামের প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক একাউন্টে জমা নেয়। এর মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ আনিসুজ্জামানের সিটি ব্যাংক খুলনা শাখায় ২০২২ সালের ২৬ জুন ২ লাখ ১০ হাজার টাকা, একই একাউন্টে ২০২৩ সালের ১৮ জুন ১১ লাখ ৯৮ হাজার ২৭৫ টাকা এবং একই বছরের ২৬ জুন একই হিসাবে ২ লাখ ১০ হাজার টাকা গ্রহণ করা হয়।
এই তিনটি ব্যাংক হিসাবের বাইরে তারিকুলের কাছ থেকে এজেন্সিটি ‘ভিশন ০৬ এসোসিয়েশন’ নামে ইউনাইটেড কমার্সিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি) ঢাকার গুলশান শাখায় ২০২২ সালের ২৮ ডিসেম্বর ৭০ হাজার টাকা, একই ব্যাংক হিসাবে ২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি ৮৫ হাজার টাকা এবং একই হিসাবে ২০২৩ সালের ১১ জুন ৫ লাখ টাকা গ্রহণ করে।
ফেইথ ওভারসিজ রং তুলি নামে আরো একটি ভিন্ন ব্যাংক হিসাবে ডাচ বাংলা ব্যাংক সাভার বাজার শাখায় ২০২৩ সালের ৪ জুন তারিকুলের কাছ থেকে ৩ লাখ টাকা গ্রহণ করে। প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ব্যাংক হিসাবের বাইরে ভিন্ন ভিন্ন হিসাবে অর্থের লেনদেনে প্রতিষ্ঠানটির স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তারিকুল। কারণ, টাকা গ্রহণের মানি রিসিট দিয়েছে ফেইথ ওভারসিজের নামে। এজেন্সি টাকা নিলেও তাদের নিজস্ব একাউন্টে নেয়নি।
ফেইথ ওভারসিজ যা বলছে
ফেইথ ওভারসিজ লিমিটেডের খুলনা শাখা অফিসে যোগাযোগ করলে সানজিদা নামের একজন নারী অফিসের কর্মকর্তা দাবি করে বলেন, তারা বিভিন্ন দেশে চাকরি এবং স্টুডেন্ট ভিসায় লোক পাঠিয়ে থাকেন। যুক্তরাজ্যে যেতে কেমন খরচ হয়, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ১৮ থেকে ২০-২২ হাজার পাউন্ড পর্যন্ত খরচ হয়। তবে এই বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাইলে তিনি আর কথা বলতে রাজি হননি।
খুলনা শাখা অফিস ইনচার্জ এবং ফেইথ ওভারসিজ লিমিটেডের পরিচালক (এডমিন) জর্জ মিথুন রায় এই প্রতিবেদককে বলেন, “আমরা তারিকুল ইসলামকে ইউকেতে (যুক্তরাজ্যে) পাঠিয়েছি। সেখানে স্পন্সরশিপ এবং জব গ্যারান্টির চুক্তি ছিল। সে অনুযায়ী তিনি ইউকেতেও যান। কিন্তু সেখানকার কোম্পানির নিয়ম-নীতি অনুযায়ী তিনি সব শর্ত পূরণ করতে না পারায় চাকরি হয়নি।”
তারিকুল ইসলাম কী কী নিয়ম-নীতি মানেননি, জানতে চাইলে উদাহরণ হিসেবে জর্জ মিথুন রায় বলেন, তাকে (তরিকুল) কোম্পানি থেকে দূরে অন্য শহরে যোগদানের কথা বলা হয় এবং ড্রাইভিং লাইসেন্স করতে বলা হয়। কিন্তু তিনি তা করেননি।
তারিকুল ইসলাম বলছেন, তাকে ইংল্যান্ডের ভেতরে চাকরি দেওয়ার কথা, ওয়েসিস কোম্পানির অবস্থান অক্সফোর্ডে। ওয়েসিসের লাইসেন্সও বাতিল হয়েছে।
ওয়েসিসের বিষয়ে জর্জ মিথুন রায় বলছেন, যুক্তরাজ্যের ওই প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিল হওয়ার বিষয়ে তার জানা নেই।
তবে ইউকেতে যাওয়ার পর তারিকুল ইসলাম সংশ্লিষ্ট কোম্পানিতে যোগদান করতে না পারার বিষয়টি একাধিকবার তাকে জানিয়েছেন বলে স্বীকার করেন জর্জ মিথুন রায়।
জর্জ মিথুন রায় বলছেন, তারিকুল ইসলামের চাকরির জন্য তার প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বিভিন্ন কোম্পানিতে আবেদন করা হচ্ছে, চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
কোম্পানির নিজস্ব ব্যাংক হিসাবের বাইরে ভিন্ন ভিন্ন একাউন্টে অর্থ গ্রহণের বিষয়টি স্বীকার করে জর্জ মিথুন রায় বলেন, ভিশন এবং রং তুলি- এই দুটি ব্যাংক হিসাবও তাদের গ্রুপের।
ফেইথ ওভারসিজের পরিচালক (মার্কেটিং) পরিচয় দিয়ে কামরুল হাসান নামের আরেকজন বলেন, “তারিকুল ইসলামকে আমরা ইউকেতে পাঠিয়েছেন, এটাই তো বাস্তবতা। তো বাংলাদেশে বসে সেখানে চাকরির নিশ্চয়তা কীভাবে দেওয়া সম্ভব? সব দায়িত্ব আমাদের না, তারও কিছু দায়িত্ব আছে।”
এই কামরুল ইসলামের পাল্টা অভিযোগ, তারিকুল ইসলাম ইউকেতে দুই বছর ধরে অবস্থান করছেন। কিন্তু ৫ আগস্ট দেশের পট পরিবর্তনের পর থেকেই তিনি বিষয়টি নিয়ে সক্রিয় হয়েছেন। তিনি নানাভাবে তাদের হুমকি দিচ্ছেন এবং হয়রানি করছেন। তবে তার চাকরির জন্য চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।”
কামরুল ইসলামের অভিযোগকে ভিত্তিহীন ও মিথ্যা দাবি করে তরিকুল ইসলাম বলেছেন, “আমিই যেখানে বিপদগ্রস্ত ও ভুক্তভোগী, আমি কীভাবে হুমকি দেব? ফেইথ ওভারসিজ আমার সঙ্গে চুক্তি ভঙ্গ করায় আমি মূলত আমার প্রাপ্য বুঝে পাওয়ার চেষ্টা করছি। ৫ আগস্ট দেশের পট পরিবর্তনের সঙ্গে মিশিয়ে তারাই আমার সঙ্গে প্রতারণার বিষয়টিকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছেন।”
পুলিশের ভাষ্য
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের (কেএমপি) উপ-পুলিশ কমিশনার (দক্ষিণ) শেখ মনিরুজ্জামান মিঠু বলেন, কোনো প্রতিষ্ঠান প্রতারণার আশ্রয় নিলে সুনির্দিষ্ট প্রমাণসাপেক্ষে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ফেইথ ওভারসিজের বিরুদ্ধে প্রতারণার প্রমাণ থাকলে তিনি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় নেওয়ার পরামর্শ দেন।
ফেইথের বিরুদ্ধে আরো অভিযোগ
অনুসন্ধানে ফেইথ ওভারসিজ লিমিটেডের বিরুদ্ধে প্রতারণার আরো অভিযোগ এই প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। অভিযোগকারীরা বক্তব্য দিয়েছেন।
ফেইথ ওভারসিজ ২০২৩ সালে আহসান হোসেন নামে এক ব্যক্তিকে যুক্তরাজ্যে পাঠায়। কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী তাকে কোনো চাকরি দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেছেন আহসান।
একইভাবে রুবাইয়া হক, সাদিয়া ইসলাম এবং লিপি বেগম নামে আরো তিনজনকে তারা ইউকেতে ওয়েসিস প্রাইভেট কেয়ার লিমিটেড নামে প্রতিষ্ঠানে চাকরি দেওয়ার চুক্তিতে পাঠায়। কিন্তু ওই কোম্পানিতে তাদেরও যোগদান করানো হয়নি।
আহসান হোসাইন, রুবাইয়া হক, সাদিয়া ইসলাম এবং তারিকুল ইসলাম সংশ্লিষ্ট কোম্পানিতে চাকরি না পেয়ে সম্পূর্ণ অনিশ্চিত জীবন যাপন করছেন। তারা কোনো রকমে ‘ক্যাশ ইন হ্যান্ডে’ বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে (সপ্তাহে ২০ ঘণ্টা) কাজ করে কোনো রকমে টিকে রয়েছেন।
লিপি বেগম ওয়েসিস প্রাইভেট কেয়ার লিমিটেড নামক কোম্পানিতে চাকরি না পেয়ে অপেক্ষমাণ থাকা অবস্থায় প্রতারণার দায়ে কোম্পানিটি বন্ধ হয়ে যায়। তখন তিনি কোনো উপায়ান্তর না পেয়ে ইউকে ছেড়ে আয়ারল্যান্ডে তার ভাইয়ের কাছে চলে যান।
লায়লা বেগমের অভিযোগ, ফেইথ ওভারসিজ লিমিটেডকে মোটা অঙ্কের অর্থ দিলেও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তারা তাকে ইউকেতে পাঠাতে ব্যর্থ হয়। এমনকি তার টাকাও ফেরত দিচ্ছে না।
যুক্তরাজ্যে অবস্থান করা রুবাইয়া হকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, ফেইথ ওভারসিজ লিমিটেড যুক্তরাজ্যের একটি কাগুজে নামসর্বস্ব ভুয়া কোম্পানিতে চাকরি দেওয়ার কথা বলে তাদের পাঠিয়ে দেয়।
তিনি বলেন, সেখানে যাওয়ার পর প্রথম চার মাস ট্রেনিংয়ের নামে তাকে বসিয়ে রাখা হয়। এরপর তিনি যোগদানের জন্য জোর করে ওই কোম্পানিতে গিয়ে বসে থাকতেন। কিন্তু কাজ দেওয়া হতো না। এক পর্যায়ে আট মাস তাকে দিয়ে কাজ করানো হয়। কিন্তু কোনো বেতন দেওয়া হয়নি। এই কারণে তিনি ওই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ইউকে হোম অফিসে লিখিত অভিযোগ জমা দিয়েছেন।
ফেইথ ওভারসিজের প্রতারণার বিষয়ে রুবাইয়া হক বলেন, প্রতি মাসে ১৬ থেকে ১৭ হাজার পাউন্ড বেতনের চাকরির চুক্তিতে প্রায় ৩০ লাখ টাকা নিয়ে তাকে পাঠানো হয়। কিন্তু কোনো চাকরি তো দেয়নি, বরং সেখানে অনিশ্চিত জীবন যাপন করছেন।
চাকরি না হওয়ার বিষয়ে একাধিকবার ফেইথ কর্তৃপক্ষকে জানানো হলেও তারা কোনো সমাধান দিতে পারেনি জানিয়ে রবাইয়া হক বলেছেন, “পাঠিয়ে দিয়েছে; এখন আর তারা দায়িত্ব নিচ্ছেন না। এখন ইউকেতে বসে যেমন তাদের বিরুদ্ধে কিছু করতে পারছি না, তেমনি সেখানে স্বামী-সন্তান থাকায় দেশে ফেরাও সম্ভব হচ্ছে না। এখন তাদের বিচার আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিয়েছি।”
ফেইথ ওভারসিজের ভিন্ন ধরনের প্রতারণার শিকার খুলনায় অবস্থানরত শাখাওয়াত হোসেন রিবু বলেন, প্রতিষ্ঠানটি তাকে কানাডায় পাঠানোর নামে ‘কানাডা এক্সপ্রেস’ এন্ট্রি ভিসার জন্য ৬০ হাজার টাকা নিয়ে ফাইল ওপেন করায়। পরবর্তীতে তাকে ইউরোপের ওয়ার্ক পারমিটের জন্য আবেদন করানো হয়। বলা হয়, তুরস্কে ৬ মাসের ভোকেশনাল ট্রেনিং শেষে ইউরোপের যেকোনো একটি দেশে পাঠানো হবে। এভাবে ছলে-বলে-কৌশলে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে তার কাছ থেকে ৮ লাখ ২০ হাজার টাকা নিয়েছে তারা। দুই বছর পার হয়ে গেলেও তারা তাকে কোনো দেশে পাঠাতে পারেনি।
শাখাওয়াত হোসেন রিবু বলেন, তার আইইএলটিএসের মেয়াদও শেষ হয়ে গেছে। যদিও সম্প্রতি তিনি টাকা ফেরত চেয়ে চাপ দিলে তার টাকা ফেরত দিতে বাধ্য হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
তবে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে ফেইথ ওভারসিজ তার দুটি বছর নষ্ট করেছে বলে অভিযোগ করে ফেইথের কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করেছেন শাখাওয়াত। তিনি বলেছেন, এভাবে তার মতো শতাধিক স্টুডেন্ট ফাইল ওপেন করে অনেক টাকার ক্ষতির শিকার হয়েছেন।
ঢাকা/রাসেল