জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের সঙ্গে বৈঠকে সংস্কার এবং নির্বাচন নিয়ে দলীয় অবস্থান তুলে ধরেছে রাজনৈতিক দলগুলো। সংস্কার দ্রুত সম্পন্ন করে নির্বাচন আয়োজনের পক্ষে মত দিয়েছে বিএনপি। জামায়াতে ইসলামী জানিয়েছে, টেকসই গণতন্ত্র এবং সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। এনসিপির চাওয়া গণপরিষদের সংবিধান সংস্কার। সংস্কার কমিশনগুলো বৈঠকে সংস্কারের সারসংক্ষেপ তুলে ধরে। জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, ‘সংস্কার প্রয়োজনীয়। জাতিসংঘ এতে পাশে থাকবে।
সংস্কার কীভাবে, কতটুকু হবে, তা জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোকে একমত হয়ে করতে হবে।’ পর্তুগালের উদাহরণ দিয়ে তিনি আশাবাদ জানিয়েছেন, জনগণ এবং রাজনৈতিক দলগুলো মিলে এই পথ পাড়ি দিতে পারবে।
গতকাল শনিবার রাজধানীর ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে জাতিসংঘের ঢাকা কার্যালয়ের আয়োজনে বৈশ্বিক সংস্থাটির মহাসচিবের সঙ্গে বৈঠকে সাতটি দল অংশ নেয়। রাজনৈতিক নেতারাও বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সামনে নিজ নিজ দলের অবস্থান তুলে ধরেন।
বৈঠকে ছিলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ; জামায়াতের নায়েবে আমির ডা.
অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল ও তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলমও ছিলেন। বৈঠকে সরকারের সংস্কার পরিকল্পনা এবং চলমান কার্যক্রম জাতিসংঘ মহাসচিবের বৈঠকে তুলে ধরা হয়। ছিলেন সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ, দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশনের প্রধান ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার, পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান সফর রাজ হোসেন ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী। সংস্কারের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য তৈরিতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন কমিশন সমন্বয়কারী তথা সরকারপ্রধানের বিশেষ সহকারী মনির হায়দারও ছিলেন বৈঠকে।
মনির হায়দার সমকালকে জানিয়েছেন, জাতিসংঘ মহাসচিব বলেছেন, ‘গণতান্ত্রিক উত্তরণে ক্ষমতার ভারসাম্য থাকা জরুরি। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে সক্ষম করতে হবে। নির্বাহী এবং বিচার বিভাগের সত্যিকারের পৃথক্করণ জরুরি।’
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসনের পতন ঘটে। এই স্বৈরশাসক ভারতে পালিয়ে গেছেন। ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেওয়া পর গণঅভ্যুত্থানে চালানো হত্যাযজ্ঞ জাতিসংঘকে তদন্তের আহ্বান জানায় ইউনূস সরকার। জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধান অনুযায়ী, অভ্যুত্থান দমনে গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে শেখ হাসিনা সরকার। সহযোগীর ভূমিকায় ছিল আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গসংগঠনগুলো। শেখ হাসিনা মানবতাবিরোধী অপরাধের মূল হোতা।
অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র সংস্কারে ১৫টি কমিশন গঠন করেছে। ছয়টি কমিশনের দেওয়া সংস্কারের সুপারিশ নিয়ে সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনা শুরু করেছে। অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া সব দল সংস্কারকে সমর্থন করলেও পদ্ধতি এবং সময়সীমা নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে।
দ্রুত নির্বাচন চাইল বিএনপি
বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের মির্জা ফখরুল বলেন, ‘জাতিসংঘের উদ্যোগে গোলটেবিল আলোচনা আয়োজন করা হয়েছিল। এতে কমিশনপ্রধানরা ছিলেন। সংস্কারের যেসব বিষয় সম্পর্কে আলোচনা হচ্ছে, তা জাতিসংঘ মহাসচিবকে জানানো হয়েছে।’
বিএনপি কী বলেছে– প্রশ্নে দলটির মহাসচিব বলেছেন, ‘আমরা এতদিন যে কথা বলে আসছি, তাই বলেছি। সংস্কার অবশ্যই করতে হবে। সংস্কারের কথা বিএনপিই আগে বলেছে। নির্বাচনকেন্দ্রিক যেসব বিষয় আছে, সেসব সংস্কার করে দ্রুত নির্বাচন করা এবং সংসদের মাধ্যমে বাকি বিষয়গুলো করতে হবে। আর সংস্কার চলমান প্রক্রিয়া। সেই বিষয়গুলো বলে এসেছি।’
জাতিসংঘের মহাসচিব কিছু বলেছেন কিনা– প্রশ্নে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।’
নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে কথা হয়েছে কিনা– প্রশ্নে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আমরা সংস্কার কমিশনের সঙ্গে কথা বলছি। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে। তারা যা চাচ্ছে, সব তাদের দিয়েছি। এরই মধ্যে একটি বৈঠক হয়েছে। জাতিসংঘের মহাসচিবকে কেন সময়সীমা দিতে যাব?’
বৈঠকে সংস্কার কমিশনগুলোর প্রধানরা নিজ নিজ কমিশনের সংস্কারের সারসংক্ষেপ তুলে ধরেন এবং রাজনৈতিক দলগুলো দলীয় অবস্থান তুলে ধরেছে জানিয়ে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, জাতিসংঘ বলেছে, সংস্কার ও নির্বাচন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। কী সংস্কার হবে, তা বাংলাদেশই ঠিক করবে। জাতিসংঘ মহাসচিব বাংলাদেশে শক্তিশালী গণতান্ত্রিক সরকার আসবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন। তিনি আশা করছেন, বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন পৃথিবীর মধ্যে নজির সৃষ্টি করবে।
সুষ্ঠু নির্বাচন, টেকসই গণতন্ত্র ও জাতীয় ঐক্য চায় জামায়াত
ডা. তাহের বলেন, জামায়াত সংস্কারের কথা বলেছে জাতিসংঘ মহাসচিবকে। একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে বলেছি। টেকসই গণতন্ত্র ও জাতীয় ঐক্যের বিষয়ে কথা বলেছি। জাতিসংঘের মহাসচিব জামায়াতের অধিকাংশ বক্তব্য সমর্থন করেছেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশকে সহযোগিতা করবেন। গুতেরেস সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে আশাবাদ জানিয়েছেন।
গণপরিষদে সংবিধান সংস্কার চায় এনসিপি
নাহিদ ইসলাম বলেন, জুলাই গণহত্যার বিচার এবং রাষ্ট্র সংস্কার অভ্যুত্থানের অঙ্গীকার। অন্তর্বর্তী সরকারেরও এ বিষয়ে জনগণের আছে অঙ্গীকার রয়েছে। মৌলিক সংস্কারের ভিত্তি এই সরকারের সময়ে তৈরি করতে হবে। সব রাজনৈতিক দলকে ঐকমত্য পোষণ করতে হবে, যা হবে জুলাই সনদ। এতে সবাইকে সই করতে হবে।
নাহিদ বলেন, ‘এনসিপির অবস্থান হলো, গণপরিষদের মাধ্যমেই সংবিধান সংস্কার করতে হবে। সংসদের মাধ্যমে হলে সংস্কার টেকসই হবে না। দলীয় অবস্থান থেকে আমাদের কথা বলেছি। জাতিসংঘ মহাসচিব বলেছেন, বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলো যাতে নিজেরাই সমঝোতায়, ঐকমত্যে আসে। গণতন্ত্রের যে মূল ধারণা, তা মাথায় রেখে যাতে একসঙ্গে কাজ করি। তিনি এ প্রত্যাশা করেছেন।’
নির্বাচন সম্পর্কে নাহিদ বলেন, ‘সংস্কারবিহীন নির্বাচন কাজে দেবে না। অন্যান্য রাজনৈতিক দলও এতে একমত। মতপার্থক্যগুলো হচ্ছে, কোন সংস্কার কখন হবে, নির্বাচনের আগে কতটুকু হবে, নির্বাচনের পরে কতটুকু হবে। জুলাই সনদের মাধ্যমে সংস্কার হলে মতপার্থক্য দূর হবে, ঐকমত্যে আসতে পারব।’
জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে জুলাই গণহত্যার বিচার নিশ্চিতে জাতিসংঘের সহায়তা চাওয়া হয়েছে। এ ছাড়া সংস্কার ও নির্বাচনের বিষয়ে ঐকমত্য নিয়ে গণসংহতির অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে।’
এবি পার্টির সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান ফুয়াদ বলেন, ‘গণহত্যা নিয়ে জাতিসংঘের প্রতিবেদন দেওয়া সুপারিশ বাস্তবায়নে সংস্থাটির সাহায্য প্রয়োজন। এখনও জাতিসংঘের তিনটি প্রতিষ্ঠানে শেখ হাসিনার আত্মীয়রা কাজ করছেন। এগুলো জানানো হয়েছে মহাসচিবকে।’
জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক গোয়েন লুইস, ইউএনএইচসিআরের আবাসিক প্রতিনিধি সুম্বুল রিজভী, আইএলওর কান্ট্রি ডিরেক্টর টুমো পুটিআইনেন, ডব্লিউএফপির আবাসিক প্রতিনিধি ডমিনিকো স্কেলপেনি, ইউএনডিপির আবাসিক প্রতিনিধি স্টেফান লিলার, ডব্লিউএইচওর আবাসিক প্রতিনিধি বর্ধন জং রানা, ইউএনওপিএসের আবাসিক প্রতিনিধি সুধীর মুরালিধরন, আইওএমের মিশন প্রধান ল্যানস বনেউ প্রমুখ বৈঠকে ছিলেন।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: অবস থ ন ত ল গণতন ত র সরক র র ঐকমত য দ বল ন বল ছ ন ইসল ম ফখর ল এনস প ব এনপ ট কসই
এছাড়াও পড়ুন:
নির্বাচনের লক্ষ্যে স্থির থাকা জরুরি
জাতীয় নির্বাচনের ‘রোডম্যাপ’ ঘোষণার দাবি জোরালো হওয়ার পর এর দুটি সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিলেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। ‘অল্প সংস্কার’ হলে চলতি বছরের ডিসেম্বর; ‘অধিকতর সংস্কার’ হলে আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন অবশ্যই হবে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নির্বাচনের সময় নিয়ে যাদের সংশয় রয়েছে, তাদের আস্থা জোগাতেই তিনি এটা করেছিলেন। পরে কোনো এক সাক্ষাৎকারে এমনটাও বলেছেন– যত যা-ই ঘটুক, ঘোষিত সময়সীমার বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কেউ যেন ভিন্ন কিছু চিন্তাও না করে।
হালে অবশ্য চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনার কথাটাই তিনি বেশি করে বলছেন। ‘অত্যাবশ্যকীয় সংস্কার’ করে দ্রুত নির্বাচনের দিকে যাওয়ার দাবি সবচেয়ে জোরালোভাবে জানাচ্ছে বিএনপি। তাদের একটি প্রতিনিধি দলকেও তিনি এ ব্যাপারে আশ্বস্ত করেছিলেন। এর পর একাধিক সাক্ষাৎকারেও সেটা উল্লেখ করেছেন। পুনর্গঠিত নির্বাচন কমিশনও (ইসি) ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে প্রস্তুতি নেওয়ার কথা জানিয়েছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজনের দাবি কেউ কেউ তুললেও ইসি জাতীয় নির্বাচনের কথাই বলছে।
নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আবার ‘গণপরিষদ’ গঠনের জন্য নির্বাচন জরুরি বলে মনে করে। এ প্রশ্নে মাঠে থাকা দলগুলোর ঐকমত্য নেই। জাতীয় নির্বাচন যে হতেই হবে– সে ব্যাপারে বরং ঐকমত্য রয়েছে। তবে ডিসেম্বরের মধ্যেই হতে হবে কিনা– এ প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান বিভিন্ন। এনসিপির মুখ্য আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম সম্প্রতি বলেছেন, বিদ্যমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন করা ‘কঠিন’। কিছুদিন আগ পর্যন্ত তিনি নিজেও উপদেষ্টা পরিষদের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নির্বাচনের অনুকূল না হয়ে প্রতিকূল হলে এর দায় তাঁকেও নিতে হবে। এমন মতও রয়েছে, বেড়ে যাওয়া অরাজকতা নিয়ন্ত্রণেও নির্বাচনের রোডম্যাপ সুস্পষ্ট করতে হবে। তাতে স্থবির হয়ে পড়া বেসরকারি খাতও পাবে দিকনির্দেশনা। গণঅভ্যুত্থানের পর সৃষ্ট পরিস্থিতিতে নতুন বিনিয়োগ হচ্ছে না বললেই চলে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধে কর্মহীনতা বাড়ছে বরং; মূল্যস্ফীতিও উচ্চ পর্যায়ে। এখান থেকে উত্তরণেও দ্রুত নির্বাচন এবং নির্বাচিত সরকার অর্জন প্রয়োজন বলে মত এখন জোরালো।
পরপর তিনটি অগ্রহণযোগ্য নির্বাচন করে কার্যত অবৈধভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চেয়েছিল শেখ হাসিনার সরকার। এর অনিবার্য পরিণতিতে নজিরবিহীন গণঅভ্যুত্থানে তাঁর পতন ঘটে গত বছরের ৫ আগস্ট। এতে দেশে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, সে সম্পর্কে অবশ্য কারও স্পষ্ট অনুমান ছিল না। ক্ষমতাচ্যুতদের ওপর প্রতিশোধসহ নানা উপাদান ঘিরে পরিস্থিতি কতটা জটিল হতে পারে, তাও ছিল অনেকটা অজানা।
সত্যি বলতে, ২০১৮ সালের নির্বাচনেই স্থির হয়ে যায়, হাসিনা সরকার কোন দিকে যাচ্ছে! শান্তিপূর্ণ আন্দোলন দমনে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের দায়ও এখন তাদের কাঁধে। জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের প্রতিবেদনেও সেটি স্পষ্ট। শেখ হাসিনাসহ অভিযুক্তদের বিচার নিশ্চিত করার দাবি তাই কম জোরালো নয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা জোরদার করতে রাষ্ট্র সংস্কারের দাবিও জোরালো। এক-এগারো সরকারের সময়ও কিন্তু সংস্কারের ব্যাপারে কম আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়নি। সেদিক থেকে দেখলে সংস্কারের দাবিটি পুরোনো ও অবহেলিত। তা সত্ত্বেও দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি সামনে এসেছে কেন, সেটাও কারও অজানা নয়।
এক-এগারোর সরকার যে দৃঢ়তায় দেশ পরিচালনা করতে পেরেছিল, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দৃশ্যতই তাতে ব্যর্থ। পরিস্থিতি এখন অনেক বেশি জটিল, তাতেও কোনো সন্দেহ নেই। অর্থবিত্ত আর আঞ্চলিক শক্তির সহায়তায় বলবান পরাজিত পক্ষের কর্মকাণ্ডও রয়েছে মাঠে। প্রধান উপদেষ্টা যখন সফররত জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছে ‘অপতথ্য মোকাবিলা’য় সহায়তা চান, তাতেও বোঝা যায় চ্যালেঞ্জটা। তবে পরিস্থিতি জটিল হয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ সংস্কার করে এর দক্ষতা এবং ‘রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা’ বাড়ানো হয়নি বলেও। এতে গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব থেকে আসা তরুণদের অংশগ্রহণ ও ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ক্রমে বেড়েছে। পাশাপাশি মাঠে গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর মতভেদ বেড়েছে ক্রমে। তাদের মধ্যে বাড়তে থাকা ‘কাদা ছোড়াছুড়ি’ নিয়ে এরই মধ্যে গভীর উদ্বেগ জানিয়ে বক্তব্য রেখেছেন সেনাপ্রধান। এর বেশ আগে তিনি ১৮ মাসের মধ্যে সংস্কার শেষ করে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সরকারকে সহায়তা করে যাওয়ার দৃঢ় অঙ্গীকারের কথা জানিয়েছিলেন। এখন ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন করা গেলে সে বক্তব্যের বাস্তবায়ন ঘটে। প্রধান উপদেষ্টার কথাবার্তাও একই ধারায় রয়েছে বলে প্রতীয়মান। সৃষ্ট পরিস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ এ দু’জনের সঙ্গে ভিন্নমত জানিয়ে অন্য কোনো এজেন্ডা সামনে আনা কঠিন।
গণঅভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের পতন ঘটেছিল জনমনে পুঞ্জীভূত ক্রোধের কারণে। রাষ্ট্র সংস্কার কার্যক্রম নয়; বরং বিদ্যমান বিধি-ব্যবস্থা, বিশেষত গণতন্ত্রের ন্যূনতম শর্ত নির্বাচনী প্রক্রিয়াও ধ্বংস করে দেওয়ার কারণে। নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ হস্তান্তর আর ন্যূনতম গণতন্ত্র চর্চা চলতে থাকলেও পরিস্থিতির এতটা অবনতি হতো না। শেখ হাসিনার দীর্ঘ শাসনামলের এক পর্যায়ে বাকস্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক বিলুপ্তি ঘটানোর লক্ষ্যে আইনও পাস করা হয়। সামাজিক মাধ্যমে মতপ্রকাশও ছিল বিপজ্জনক।
এ অবস্থায় স্বৈরাচারী সরকার গেড়ে বসার আগে যেটুকু গণতন্ত্র চর্চা ছিল, তাতে প্রত্যাবর্তন করতে পারাও কম অর্জন বলে বিবেচিত হবে না। এর চাইতে বেশি কিছু অর্জন করা গেলে তাতে কারও আপত্তির সুযোগ অবশ্য নেই। কিন্তু একবারে প্রত্যাশিত সবকিছু অর্জন করতে চাইলে চলমান অরাজকতায় পরিস্থিতি এমন দিকে চলে যেতে পারে, যেখান থেকে ন্যূনতম গণতন্ত্রে ফেরাও কঠিন। তার চাইতে বরং আগামী ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচনের লক্ষ্যে স্থির থেকে এ মুহূর্তের জরুরি সংস্কার সম্পন্ন করা প্রয়োজন বলে মনে হচ্ছে। সে ধারায় ‘রাজনৈতিক সংলাপ’ আয়োজনও জরুরি।
নির্বাচনে কারা জিতবে– সে প্রশ্ন সামনে আনা অপ্রয়োজনীয়। জনগণ তার সার্বভৌম ইচ্ছায় যে দলকে চাইবে, তারাই সরকার গঠন করবে। সেটা মাঠে থাকা কোনো পক্ষের আশা-আকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে গেলেও কিছু করার নেই। গণতন্ত্র এভাবেই কাজ করে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জাতীয় নির্বাচন যেন আন্তর্জাতিকভাবেও গ্রহণযোগ্য হয়, সে চেষ্টা করতে হবে অন্তর্বর্তী সরকারকে। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে অসাফল্যের মধ্যে শুধু নির্বাচনটা সফলভাবে করতে পারলেও তারা কম স্মরণীয় হয়ে থাকবেন না।
রাষ্ট্র সংস্কারের দাবি কিন্তু এর পরও বহাল থাকবে। থাকবে এ-সংক্রান্ত চাপ। নির্বাচিত সরকারকে তো দীর্ঘ অপশাসন আর অরাজকতায় এলোমেলো দেশটাও ঠিকমতো চালাতে হবে। সে চ্যালেঞ্জ থাকছে অনিবার্যভাবেই। তবে বিরাজমান পরিস্থিতিতে ‘বিপথগামী’ হওয়ার ঝুঁকি এড়ানো সামান্য বলে বিবেচিত হবে না। স্বাধীনতার পাঁচ দশক পরও একটা জাতি ঝুঁকিমুক্তভাবে গণতন্ত্র চর্চা করে অভীষ্ট লক্ষ্যে যাওয়ার অধিকার কি রাখে না?
হাসান মামুন: সাংবাদিক, কলাম লেখক